“আবু লাল লুবো”
প্যাঁচা খাওয়া গলিটা
পেরিয়ে দুচার খুপরি ঘর
গায় গায় । গলি রাস্তার
কোনে কোনে মুরগীর পালক
ছড়িয়ে । হাল্কা পচা
গন্ধের সঙ্গে রসুন-
পেঁয়াজ মিঠা- আতর আর
তারই সঙ্গে কুতুব চাচার
আতরের দোকানের খুশবু
মিলে বেজায় চিৎ খাওয়া
গন্ধ তৈরী হয়েছে – এটা
বিশ বছর পর ঝিংরি
মহল্লায় ঢুকে হামিদ টের
পায় । ডানের কসাইখানার
সামনের ড্রেনটা একটু
বদলেছে ,সিমেন্ট দিয়ে
বাঁধানো হয়েছে । সেখানে
এখনও জমে আছে লালাচে জল
,যতটা এসে জমছে ,বয়ে
যাচ্ছে তার থেকে অনেক
কম ,একটা ছেঁড়া চটি আটকে
আছে কালভাটের নিচেটায় ।
এই ড্রেনটাই চলে গেছে
হামিদদের গলি অবধি ,
ছোটোবেলায় এই
ড্রেনটাতেই ওড়া তিন
ভাইবোন সকালের
প্রাকৃতিক কাজ সারতো
লাইন দিয়ে বসে । ও ,
ফারুক আর নাজমাও ।
নাজমা তখন সাড়ে তিন ।
নাঃ হামিদের তখনকার
স্মৃতিতে কোনো
দুর্গন্ধ নেই ...
ঈদের সময়ে আব্বার সঙ্গে
বসাকের দোকানে জামা
কাপড় কিনতে যেত ওরা
দুইভাই মহল্লার উল্টো
দিকেই রাস্তার ওপাড়ে ।
আব্বার খাতা ছিলো ।
আম্মি আর নাজমা যেত আর
একদিন । আব্বা ছিলেন
আসানসোলের ,আর মা ছিলেন
ভাগলপুরের । রঙ নিয়ে
সেই থেকেই হামিদের বড্ড
গোঁড়ামি । যতই ওর আব্বা
ওকে বোঝায় ,ওরে ছেলেরা
এমন ক্যাট ক্যাটে লাল
জামা পরেনা ,ও ততোই গোঁ
ধরে“ না আ আ আ ... আবু আমি
লাল লুবো ” তখন বাজারের
লটারির দোকানে বেজে
চলেছে পূরানো রাজ
কাপূর- ...সার পে লাল টোপি
রুশি ...ফির ভি দিল হ্যায়
হিন্দুস্থানী ...” এ গান
চারুবাবু ,প্রমোদ
বাবু,সুরজিত-জ্যোতি,
নাম্বুদিরিপাদেরা কি
শুনেছিলেন ! নাঃ একথা
হামিদের জানার কথা নয়
।
লালে দূর্বলতার কথা
হামিদ নিজেও জানে ।
রাস্তার ধারে শয়ে শয়ে
দোকানের বোর্ডে
যেগুলোতে লাল রঙ
সেগুলোর দিকেই ও তাকাতো
। হিঁদু পাড়ার কোনো
বাড়িতে বিয়ে লাগলে বা
নতুন বউ এলে বেশ বোঝা
যায় , ছাদে রোদে মেলা
থাকে লাল শাড়ি , লাল শায়া
, লাল ব্লাউজ... আরও লাল
কতো কি ! এমনকি সিঁড়ির
ধারে রাখা নতুন লেডিজ
চটিটাও লাল ...! লাল
দেখলেই হামিদের মেজাজ
বেশ শরিফ হয়ে যায় সে
অনেক দিন থেকেই ।
এরপর স্কুল , এরপর
স্টুডেন্টস ফেডারেশন ,
যুব মিছিল , ৯৬ এ বাড়ি
বাড়ি দল বেঁধে গিয়ে
সবাইকে শান্ত থাকতে
বোঝানো । ঝিংরি মহল্লা
তখন উত্তেজনায় কাঁপছে ,
বাইরের কিছু অচেনা লোক
মাঝে সাঝে আসছে
মহল্লায়, গোপন সভা করছে
আনসার চাচার উঠোনে । যা
হোক কেটে গেলো সময়টা
তেমন কিছু না ঘটেই ।
এরপর কলকাতা ।
মিটিয়াবুরুজ । দোতলা
বাস তখনও সব ঊঠে যায়নি
বোধহয় । হামিদ কারনে
অকারনে উঠে পড়তো দোতলা
বাসে , ওর যে খুব পছন্দের
! এই লাল বাস গুলো ...
দেখতে দেখতে লাল বাস
ঊঠে গেলো । রেল
স্টেশনগুলোর রঙ মেটে
লাল থেকে বদলে যেতে
লাগলো আরও কিছু বছর পর ।
প্লাস্টিক চেয়ার
বানানোর কম্পানিরা
বাজার বুঝে এখন সবুজ
চেয়ার বানায় । দোকানে
দোকানে লাল আবিরকে ঠেলে
সরিয়ে এখন সবুজ আবিরের
দেদার বিক্রিবাটা ।
এদিকে জুটমিল গুলো এক
এক করে সেই কবে থেকেই
লাল বাতি জ্বলছে ।
হামিদের প্রিয় লাল
পতাকাকে জনগন বেশ কবার
হলুদ কার্ড দেখিয়ে
এবারে ফাইনালি লাল
কার্ড দেখিয়ে মাঠের
বাইরে করেছে । এত ফাউল
করলে যা হবার তাই হয়েছে
আরকি । পেটের ধান্দায়
হামিদ এখন রেডিমেড
জামাকাপড়ের পাইকার ।
কাঁধে ব্যাগ বইতে বইতে
রাস্তায় মাঝে সাঝে
মিছিল দেখে চমকে দাঁড়ায়
,অবাক হয়ে শোনে স্লোগান
দেওয়ার স্বর কেমন
অদ্ভুতভাবে এক! হঠাৎ
করে শুনলে তফাত বোঝার
উপায় নেই । অনেকদিনই
এসব ঝক্কি থেকে নিজেকে
সরিয়ে রেখেছে হামিদ ।
কলকাতায় এসে থেকে সংসার
ছেলে মেয়ে বউ নিয়ে
নিজের গণ্ডি বেঁধে
নিয়েছে । সেই সেবার
থেকেই আর কোনো সংস্রব
রাখেনা যেবার এলাকার
কনভেনরের সঙ্গে আপোস
করতে নাপারায় ওকে পুলিশ
তুলে নিয়ে গেলো ,সারা
রাত থানায় বসিয়ে রাখলো
। সেদিন থেকেই নিজেকে
লালকার্ড দেখালেও
কোথায় যেন লালিমাটা রয়ে
গেছে মনে মনে ...
এবারে আবার সারুক খান
জিতেছে । মহা উৎসব হবে
ইডেনে । এলাকার রুলিং
পার্টির মাতব্বর
শাকিলভাইকে বলে একটা
ফ্রি পাস জোগার করেছে
হামিদ , শর্ত অন্তত
একদিন মিছিলে যেতে হবে
। যদিও একদম ফ্রি নয়
থানায় ১০০টাকা দিতে
হয়েছে নজরানা । তবু
এতগুলো স্টারকে দেখার
জন্য এ আর এমন কি !
ছেলে ইমরানকে নিয়ে সেই
সকাল থেকেই লাইনে ।
বড্ড চাপাচাপি । রোদে
লাল হয়ে গেছে ছেলেটার
মুখ ,বার বার বলছে
“আব্বু পানি”...
অনেক বেলা গড়িয়ে গেছে
,ভিড় নড়ছেনা বরং ছড়িয়ে
পড়ছে । সারুক খান নাকি
এখনো এসে পৌছয় নি ! প্রায়
চারটে বাজছে ! রোদে গরমে
এতক্ষন দাঁড়িয়ে এবার
ভিড়টা ফুঁসতে শুরু
করেছে । হঠাৎ সামনের
দিক থেকে সবাই ছুটতে
লাগলো যে যেদিকে পারলো
। কয়েকজন পড়ে গেল ...
“আব্বু ঘোড়া !” ইমরানের
আঙ্গুল অনুসরন করে
হামিদ দেখে ঘোড়া পুলিশ
ধেয়ে আসছে লাঠি উঁচিয়ে
...শক্ত করে ইমরানকে বুকে
চেপে হামিদ দৌড় লাগায়
পিছনের ময়দানের দিকে
...সেই যেখানে এক শহীদ
মিলিটারির বিরাট
মূর্তিটা মাথা নিচু করে
আছে ।
হামিদ দৌড়াচ্ছে ... পিছনে
এক বুড়ো ঘোড়াপুলিশের
ঘোড়ার ক্ষুরের আঘাতে
মাটিতে পড়ে গেলো , একটা
বাচ্চা মেয়ের মাথা
ফেটেছে ...রক্ত “
আব্বু...লাল...” ইমরানের
ককিয়ে ওঠা স্বর শুনতে
পায় হামিদ...পরিত্রাহী
ছুটতে থাকে ,হামিদ ওর
অভিজ্ঞতা থেকেই জানে
শাসকের রক্তচক্ষু কি
ভিষন বস্তু। ইমরানেরও
কি লালে আসক্তি রয়েছে ?
কে জানে ! এইভাবে বুঝি
থেকে গেছে রঙের
বংশানুক্রম...
উৎসবের সবুজ ইডেন সেদিন
হামিদ আর ওর ছেলে
ইমরানকে প্রত্যাখানের
লাল কার্ড দেখায় ...বিনা
ফাউলেই ।