আমি কতবার ভেবেছি, আমার
যদি কবর-টবর হয় তবে সেই
কবরের পাশে একটা সস্তা
কাঁচের ক্ষুদে বাক্স
থাকবে, বাতসঞ্চালনহীন।
সেখানে সেই ফ্যালফেলে
জায়গাটায় আসলে গান ছিল,
মানে আছে। ফেলে যাওয়া
গান। মানে
প্রিয়পুরুষেরা চলে
গেছে, গান গেছে ফেলে।
গান অনুসঙ্গ, গান
অনুঘটক, অবশেষে
গানগুলিই ভাগশেষ, মানুষ
এসেছিল সেই চিহ্ন,
মানুষ চলে গেল তার
চিহ্ন। যখন আমার পৃথিবী
গন্ধ পরিত্যাগ করবে, জল
মধুররস পরিত্যাগ করবে,
জ্যোতি রূপ পরিত্যাগ
করবে, আকাশ শব্দগুণ
পরিত্যাগ করবে... তখনো
আমার সাথে থাকবে কাঁচের
বাক্সে সঞ্চিত গান,
এসেছিলাম তার চিহ্ন,
পেয়েছিলাম তার চিহ্ন।
গান আমার কাছে সময়কালকে
যেমন করে তৈলস্ফটিকে বা
অ্যাম্বারে জমিয়ে রাখে,
যেমন বুক হিম করে দেয়,
তেমন করে শুধু পারে
গন্ধের স্মৃতি। হঠাৎ
হাত ধরে হিড়হিড় করে
টেনে নিয়ে যায় কোনো
দৃশ্যপটে, একটা ছাল
ছাড়িয়ে তোলা শোলমাছের
মতো বের করে আনে
নিরাবরণ বিষাদ। কার কার
নৈঃশব্দ্য আমার কাছে
গানের মতন লাগতো?
একটিমাত্র তারে বাজিয়ে
তোলা একটিমাত্র স্বরের
মতন নৈঃশব্দ্য, সেটা
গান? কার কার
শ্বাসপতনের দ্রুত শব্দ
বুকের কপাটে কান দিয়ে
আমার মনে হতো এটা গান? কে
আমাকে প্রথম চিঠি লিখতে
শেখাচ্ছে খাটে উপুড়
হয়ে, শাড়ি স্খলিত হয়েছে
পায়ের গোছ থেকে,
গ্র্যান্ডফাদার্স
ক্লক মোটা গলায় বাজিয়ে
চলছে ঢং ঢং, আর সে আমাকে
বলছে, “পুতুল চেয়ে লিখো
না। কারো কাছে কিছু
চাইতে নেই!” সেটাও গান।
‘কোন গোপনবাসীর
কান্নাহাসির গোপন কথা
শুনিবারে বারে বারে কান
পেতে রই।’ কতবার
অকল্পনীয় সুরের এই
গানের এতটুকু বাণী
আমাকে কাঁদিয়ে দিয়েছে?
হাত রেখে স্ফীত গর্ভে,
হাতের তলায় এসে ঠোকর
মারছে ভ্রুণ। কতবারই না
কেঁদেছি ‘যারা
স্বর্গগত তারা এখনো
জানে স্বর্গের চেয়ে
প্রিয় জন্মভূমি’ শুনে।
জাতীয় সংগীত গাইতে গিয়ে
বা শুনতে গিয়ে কতবার
গলা বুঁজে এসেছে, এমনকি
অন্যদেশের যত ‘আবার
খাব’/ ‘এবার কালী তোমায়
খাব’ মার্কা জাতীয়তা
ব্যক্ত করা হাউমাউখাঁউ
জাতীয় সংগীত আছে সেইসবও
আমার গলা ব্যথা করে
দিয়েছে কান্না গেলাতে
গেলাতে।
কবি শামসুর রাহমানের মা
গাইতেন না তো কী (‘কখনো
আমার মা’কে’), আমার মা
গাইতেন, একলা দুপুরে,
‘বিধুর বিফল হয়ে
ক্ষ্যাপা পবনে, ফাগুন
করিছে হা-হা ফুলের
বনে’... ‘তুই ফেলে এসেছিস
কারে মন মন রে আমার’।
পিঠে কোঁকড়া চুলের
হালকা মেঘ, গায়ে
কচুবাটা দিয়ে চিংড়ির
ঘন্টের গন্ধ অথবা দিশি
মুরগি কষানোর গন্ধ, দুই
হাতে টানছেন মাড় দেয়া
শাড়ি, জনবিরল ঘরে
ভাসিয়েছেন অচর্চিত
গলায় পাতার তরণী।
শ্রাবণমাসের আকাশের রঙ
আকন্দফুলের মতো
ফ্যাকাশে। কাকে ফেলে
এসেছিলেন আমার মা?
কাদের ফেলে এলে জনম
গেলেও শান্তি পাওয়া যায়
না?
আমার শৈশবে গান শোনানোর
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য
ভূমিকা ‘রেডিও
সীলোন’এর। আব্বা সকালে
ফিটকিরি দেয়া ঝকঝকে
রোদে বারান্দায়
হাত-আয়নাতে দেখতে দেখতে
দাড়ি কামাচ্ছে, সারা
বাড়ি মাথায় তুলে বাজছে
‘দিল দেকে দেখো জী’,
কিংবা ‘আজিব দস্তাঁ
হ্যায় ইয়ে’। শামসাদ
বেগম, সুরাইয়া, মহম্মদ
রফি, মহেন্দ্র কাপুর,
লতা, আশা, সুমন
কল্যাণপুর, গীতা দত্ত,
মান্না দে, তালাত
মাহমুদ... এঁদের
নবরত্নসভার নাম ছিল অল
ইন্ডিয়া রেডিওর
‘বিবিধভারতী’। যেমনি
গায়কির ঝকমারি, তেমনি
গান শুনবামাত্র চোখে
ভেসে আসতো নায়ক বা
নায়িকার চেহারা- এমনি
প্লেব্যাকের জাদু। কে
এল সায়গলের ‘জব দিল হি
টুট গয়া হম জীকে কেয়া
করেঙ্গে’ আব্বা ভাঁজত
মাসের মাঝামাঝি টাকা
ফুরিয়ে গেলেই। সায়গলের
‘বাবুল মোরা নইহার
ছুটহি যায়’ ছাড়াও একটি
বর্ষার গান আমার
ভাললাগতো- একেবারে
ঘনঘোর বর্ষার মেঘে
লুপ্ত বেলায় কালো আকাশে
শাদা গোবক উড়ে যাওয়ার
মতো একখানা গান, আজ আর
সেটা কোথাও খুঁজে পাই
না। আব্বা আমাদের
চিনিয়েছে চিন্ময়, সাগর
সেন, দ্বিজেন আর হেমন্ত,
শ্যামল মিত্রকে
শুনবামাত্র ভালবেসেছি,
সুবিনয় রায়কে আমি
চিনেছি আরেকটু বড় হবার
পর। কণিকা
বন্দ্যোপাধ্যায় এবং
সুচিত্রা মিত্রের
ভেতরে আমার ভাললাগতো
সুচিত্রা মিত্রকে,
বরাবরই। প্রাইমারি
স্কুল শেষ করার আগেই
মুখস্থ করে ফেললাম
রবীন্দ্রনাথের সবক’টি
গীতিনাট্য। ‘সুখভরা এ
ধরায়, মন বাহিরিতে চায়,
কাহারে বসাতে চায়
হৃদয়ে, কাহারে খুঁজিব
দিকদিগন্ত’। সেই
‘ব্যাকরণ-মানিনা’ বয়সে
আমার কিশোরকুমারের
খোলা গলায় ‘একটুকু
ছোঁয়া লাগে একটুকু কথা
শুনি’, ‘আজ খেলা ভাঙার
খেলা খেলবি আয়’ আর
‘পাগলা হাওয়ার
বাদলদিনে’ বেশ ভাল
লাগতো। যদ্দিনে আমি
জানি কিশোরকুমার
শুদ্ধসুরে
রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন
না, ততদিনে এই গানগুলি
আর কারো গলায় আমার এমন
সতেজ লাগতো না। ‘মাঝে
মাঝে তব দেখা পাই’ যেমন
ঋতু গুহ ছাড়া আর কারো
গলায় ভাল লাগে না, ‘কে গো
অন্তরতর হে’ সুবিনয় রায়
ছাড়া চলবেই না, ‘আমার
ভাঙাপথের রাঙা ধুলায়’
লাগবেই হেমন্ত
মুখার্জিকে, ‘অনেক কথা
বলেছিলেম কবে তোমার
কানে কানে’তে সুমিত্রা
সেন।
পাগল হয়ে যাওয়ার আগ
পর্যন্ত আমার ছোটকাকা
খুব গান শুনত, বনিএম-
এ্যাবা- বাকারা-
প্রিসলি-ক্লিফ
রিচার্ড। কে একজন
না-মহিলা না-পুরুষ গলায়
গাইতো ‘জেন্টলম্যান
কলারস নট অ্যালাওড’। ওর
আজন্মলালিত সাধ ছিল,
একদিন পড়শীদের কান
ঝাঁজিয়ে দিয়ে প্রচন্ড
শব্দে গান শুনবে। কোন
গান? ‘ড্রিমগার্ল... কিসি
শায়র কা গজল’, এই যে মুখে
বাক্যি হরে না- সব
সংলাপে একই সুর সেই
হেমা মালিনী সত্যিই ছিল
তার ড্রিমগার্ল। পাগল
হয়ে যাবার পরে আর
কোনোদিন আমি ছোটকাকাকে
গান শুনতে দেখিনি। শুধু
অবিশ্বাস্য সময় ধরে
নামাজ পড়তে দেখেছি।
ছোটকাকাকে নিয়ে হাহা
করে কাঁদতো আমার দাদী,
কেঁদে কেঁদে যা বলতো
সেটা একটা গানের লাইন,
‘তুমি কি দেখেছ কভু
জীবনের পরাজয়, দুখের
দহনে করুণ রোদনে তিলে
তিলে তার ক্ষয়’, কতবার
এই গান শুনেও আমি
দাদীকে কাঁদতে দেখেছি।
একটা মাথা মুড়োনো পাগল
আমাদের কদমতলার
ইঁটবাঁধানো রাস্তায়
হেঁটে যেত গান গাইতে
গাইতে, দুষ্টু
ছেলেমেয়েরা বের করলো,
যে গান সে গায় সেটা
হচ্ছে- ‘হোয়াট ইজ দিস/
কাঁচা-মরিস/ না খাইলে
তোর বউরে দিস’। একটা
অন্ধ ফকির তারস্বরে
আমাদের ইস্কুলের সামনে
‘কলেমা তৈয়ব’ গেয়ে
ভিক্ষা করতো, আমি আমার
জীবনে এমন খোলা গলা
কোথাও শুনিনি, কে যেন
আমাকে বলেছিল অন্ধ
মানুষের গলা জোরালো হয়
খুব- কথাটা সত্যি।
সেকালে আমরা পাড়ার
মিলাদশরীফে পেছনে
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান
করতাম ‘ইয়া নবী ছালার
মইধ্যে কি/ ছালার মধ্যে
গুল গুল বাতাসী’, কারণ
হুজুর আমাদের যত দ্রুত
ফাতেহা আর তিনবার তিন
ক্বুল পড়ে শেষ করতে
বলতেন, সেই সময়ের ভিতরে
আমরা ফাতেহাপাঠই শেষ
করতে পারতাম না,
ফাজলামি করে এই গাইতাম।
আমাদের ঠাট্টাগুলিতে
গান এবং ওয়াজ
উল্লেখযোগ্য স্থান দখল
করে রাখতো, এই যেমন
ফজরের আজান দিতে উঠে
মুয়াজ্জিন মসজিদের
নারকেলগাছে চোর দেখে কি
গেয়ে আজান দেবে?
‘হাইয়াআলাচ্ছালা... ডাব
পাড়ে কোন শালা’।
ইস্কুলে নিয়মিত আমাদের
গাইতে হতো জাতীয় সংগীত,
প্রতিদিন সকালে।
‘হলুদ-পাখি’ মানে
শিশুদের গার্লসগাইড
হবার প্রাথমিক অবস্থায়
আমরা ইস্কুলে কিছু গান
নিয়মিত গাইতাম, এই
যেমন-‘হলদে পাখির দলে
যত রকম পাখি/ মোরা একই
বৃত্তের মাঝে সবাই
থাকি’। একেক জাতের
পাখির আবার আলাদা আলাদা
গান- ‘মোরা টিয়া মস্ত
বীর/ কঠিন কাজেও নই
অধীর’, ‘শালিক কভু নিচু
নয়, বৃষ্টির মধ্যেও
সুখে রয়’ ইত্যাদি। এইসব
গানের মূলসুর ছিল
সহিষ্ণুতা, একতা,
ভ্রার্তৃত্ব। যেসব বড়
বড় ব্যাপার নিয়ে
বাচ্চারা মোটেও
চিন্তিত নয়, সেইসব
তত্ত্বে ঠাসা, অতএব
এইসব আমার মোটেই ভাল
লাগতো না। এর চেয়ে
‘হাইয়ালাচ্ছালা... ডাব
পাড়ে কোন শালা’ কত
আমোদের! মিশনারী স্কুল
হবার সুবাদে আমরা আরো
গান শিখতাম, স্কুল
সারাবছর আমাদের
আশিরপদনখ সাধু বানাবার
জন্য যত প্রয়াস পেত, আর
কিছুতে তা ব্যয় হতো না।
গানগুলির কোনো কোনোটা
পঞ্চকবির কারো, আবার
কোনোটা ইস্কুলের
চিরকুমারী
সন্ন্যাসিনীদের কারো
লেখা। যেমন শিখতাম ‘দাও
শৌর্য দাও ধৈর্য হে
উদার নাথ’, ‘শুভ্র
সমুজ্জ্বল হে চির
নির্মল শান্ত অচঞ্চল
ধ্রুব জ্যোতি’, তেমনি
শিখতাম ‘সাবধান ছোট পা
যেথা চলো/ সাবধান ছোট
মুখ যা বলো’ কিংবা
‘সংসারের মায়া ছেড়ে
আজিকে গেল যে জন’
ইত্যাদি গান যেখানে
‘সদাপ্রভু’ শব্দটা
অবশ্যই থাকতো। শব্দটা
আমার ভাল লাগতো, সদা
থাকো আনন্দের এই সদা
শব্দটা নিয়ে প্রভুর
নাম, দুর্বহ নরকের ভয়
নেই, আলোর মতন নির্ভার
হয়ে জড়িয়ে আছে সদাই...
এমন প্রভুই ভাল।
ইস্কুলে নাচের মেয়েরা
পাহাড়ি সুরের কিছু
বাঁধা গানের সাথে
নাচতো, সেগুলি আমার
ভালই লাগতো, যেমন ‘বনের
হরিণ আয় রে’, ‘কে দিল
খোঁপাতে ধুতুরা ফুল গো’
কিংবা ‘বৈঁচিমালা রইলো
গাঁথা পিয়ালপাতা
ঢাকা’। শৈশবে আমি ‘ছাতা
ধরো গো দেওরা’ শুনিনি।
মিলাদশরীফ আমরা পড়তে
জানতাম বাংলায় (‘তুমি
যে নুরের রবি/নিখিলের
ধ্যানের ছবি/তুমি না
এলে দুনিয়ায়/ আঁধারে
ডুবিত সবি...’), স্কুলেই
সেটা শেখানো হয়েছিল।
এইসময় আমি বেশ কিছু
হামদ ও নাত-নাশিদ
ইত্যাদি শিখি,
‘হিন্দোল’ নামের একটা
গানের স্কুলে ভর্তি করে
দেয়া হয় আমাকে। কবি
গোলাম মোস্তফার
‘নিখিলের চিরসুন্দর
সৃষ্টি আমার মুহম্মদ
রাসুল’, নজরুলের ‘হে
প্রিয় নবী রসুল আমার,
পরেছি আভরণ নামেরই
তোমার’, ‘হেরা হতে
হেলেদুলে নুরানি তনু ও
কে আসে হায়’ ইত্যাদি।
বিভিন্ন নাচের গানও
আমাদের শেখানো হতো,
‘নাচে ইরানী মেয়ে’,
‘নাচে সুনীল দরিয়া আজি
দিলদরিয়া’, ‘চমকে চমকে
ধীর ভীরু পায়
পল্লীবালিকা বনপথে
যায়’, ‘তুমি কি
দখিনাপবন’, ‘বনকুন্তল
এলায়ে বনশবরী ঝুরে’
ইত্যাদি।
আমাদের বাড়িতে কাজ করতো
পারুল বুয়া, সে কীসব গান
গাইত আর কাঁদতো- ‘কালো
মাইয়া আমার ঘরে টিকন
বিষম দায়, ছেলের বাবা কয়
না কথা সাইকল ঘড়ি চায়’
অথচ তার তখনো মেয়ে হয়নি,
মেয়ের জন্ম হয়নি অথচ
মেয়ের বিয়ের যৌতুক নিয়ে
কাঁদছে...এই নিয়ে খুব
হাসতাম আমরা অথচ কে
জানতো এইসব সাংসারিক
বেদনা জাতীয় ঋণের মতন
জন্মের সাথে সাথে
মাথাপিছু ভর করে।
বরগুনার দুরন্ত মেয়ে
মঞ্জুবুয়া গাইত রহিম
বাদশা-রূপবানের গান।
‘শোনো তাজেল গোওওওও না
জেনে প্রেমে মইজো না’।
আয়নাবিবির পালা।
গুনাইবিবি আর
তোতামিয়ার গান। আমাদের
সিমেন্টের মেঝে ভিজে
ত্যানা বুলিয়ে মুছতে
মুছতে অঝোর ধারায় বইয়ে
দিত গান।
আমার জ্ঞাতিদের মধ্যে
সবচেয়ে সুরেলা ছিলেন
আমার নানা, কীসব গান
গাইতেন তিনি, ‘আমি কি
গাইতে জানি গান/ রাস্তা
থেকে ধরে এনে করলে
অপমান’, ‘আমি কারে
দেখিয়া দিব ঘোমটা লো,
নাতিনজামাই আমার নেংটা/
যেন হস্তির গলে বাঁধা
ঘন্টা লো, নাতিনজামাই
আমার নেংটা’,
ছেলেমেয়েদের শেখাতেন
‘চল কোদাল চালাই’,
সকালের জায়নামাজে বসে
গুনগুন করতেন, ‘তোমার
দিল কি দয়া হয় না’।
আমাদের শৈশবের শুরুর
দশটি বছর আরেক
আচ্ছন্নকর সংগীতগুচ্ছ
চালু ছিল, ভিসিআর আর
ভিসিপিতে, তার নাম
‘গীতমালা’। সিনেমার
চয়নকৃত এই গানগুলির
অবদান অস্বীকার করা যায়
না। সাহির লুধিয়ানভির
বাণী। পিতা-পুত্র
দেববর্মণের হীরা চুনি
পান্না। শিব-হরির
জাদুমাখা
টিউলিপবাগানের প্রেম।
নওশাদ। শংকর-জয়কিষেণ। ও
পি নায়ার। মদনমোহন।
কল্যাণজী আনন্দজী।
লক্ষীকান্ত
পেয়ারেলাল। ‘আও মিল
যায়ে হম সুমন অওর
সুগন্ধ কি তারহা’... সুরে
আর কাহিনির ইন্ধনে তো
আমরা ছোটরা পাগল,
নায়িকার শালওয়ারকামিজ
আর শাড়ির ঢং রপ্ত করছেন
খালাফুপুরা, নায়িকার
বুক-টুক নেচে উঠলে
উসখুস করছে
মামা-কাকারা। গীতমালার
এক গরীব বোন ছিল,
‘ছায়াছন্দ’, নানীরা
পানের রসে মুখ লাল করে
ঘরের চারদিক পর্দা টেনে
জেনানামহল বানিয়ে
দেখতে বসতেন আর ঠোঁট
মেলাতেন ‘জীবন আঁধারে
পেয়েছি তোমারে’ কিংবা
‘পিঞ্জর খুলে দিয়েছি’,
কবরী শীৎকারযোগে
‘ইট্টুসখানি’ গাইছেন
অথচ কেউ আমাদের কান ধরে
সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে না,
অচেনা ঢাকার পথে রহমান
আর শবনম ঘড়ির কাঁটার
মতন ছন্দে ঘুরে ঘুরে
গাইছেন ‘কিছু আপনি
শোনান কিছু আমার শুনে
যান’ (প্রেমাস্পদকে
সিনেমার গানে ‘আপনি’
থেকে ‘তুই’ ডাকছি এখন
আমরা, কতকাল পেরিয়ে
এলাম), এই ছিল
বাংলাদেশের এবং
তৎকালীন
পূর্বপাকিস্তানের
সিনেমার গানের
অনুষ্ঠান।
এইসব নানান অভিজ্ঞতার
ভিতর দিয়ে
ক্যালাইডোস্কোপের
নকশার মতন গোত্তা খেয়ে
খেয়ে ভাঙতে ভাঙতে আমার
গান বিষয়ক ধারণা আকার
পেতে থাকলো।খুব আহামরি
ধারণা নয়। তবে সংগোপনে
হৃদয়ের রঙে সংরক্ত,
বর্নাঢ্য।কত ঝগড়া
করেছি গানের
রবীন্দ্রনাথ বড় না
গানের নজরুল বড় এইসব
রাবিশ নিয়ে, গান শুনতে
শুনতে অংক কষার জন্যে
কত বকা খেয়েছি, কত
মনখারাপের উপশম ঘটেছে
গান শুনে শুনে।তবলার
বোল শুনতে শুনতে ভুলে
গেছি কত ভয়, নতুন উদ্যমে
বুক বেঁধেছি। সেইসব
সংগীতের সাথে আমার
নিভৃত বোঝাপড়া, কাউকে
বলে বোঝাবার নয়, কেউ
শিখিয়ে দেবারও নয়।
তবে গানের ব্যাপারে
আমার সবচেয়ে খারাপ
অভিজ্ঞতা হচ্ছে গানের
স্কুল। গানের স্কুলের
মাস্টারমশাইদের ভেতরে
আমি কখনো গান পাইনি,
রবীন্দ্রভাবনা-
নজরুলের
বিদ্রোহ-সাম্য-ঐক্য
ইত্যাদি
মাস্টারমশাইদের গায়ে
তুলে নেয়ার পরিধেয়
বস্তু ছিল, ভেতরের
মানুষের
লোভ-ক্ষুদ্রতা-ঈর্ষা-নি
ষ্ঠাহীনতার সাথে সেই
মহার্ঘ্য আবরণগুলির
মিল ছিল না। ‘বাসন্তী
রঙ শাড়ি পরো, খয়েরি রঙের
টিপ’ গাইতে গেলে কারো
মুখে সন্ধ্যাকাশ ঘনিয়ে
আসতো না। ‘কানন-গিরি ও
সিন্ধুপার’ গানটির
সাথে যে কতকালের
কীর্তিস্তূপে
‘চামচিকা আর বন্য-হয়’
চরে বেড়াবার বেদনা আছে
সেইসব কারো মুখে খেলতো
না তো। ‘তুমি শুধু তার
ভারবাহী হয়ে রবে’, এই
অভিশাপ বোধ করি এই
মাস্টারদের অনেককাল
আগেই কেউ দিয়ে রেখেছে,
বাণীর মর্মস্পর্শিতা
এবং সুরের
মর্মান্তিকতা থেকে
গানকে কতদূর টেনে এনে
ফেলে দেয়া যায় শিষ্যের
ঘাড়ে তার অশেষ নিদর্শন
আমি দেখেছি তো, আশৈশব।
আমাদের শিশুমানসে
সেইসব গড়মিল ধরা পড়ে
যেত ঠিকঠিক এবং বেশ
বেসুরো বাজতো, আমরা
বিশেষ করে আমি খুব
ফাঁকি দিতাম। আমার
জন্যেই কিশোরকুমার
গেয়ে গেছেন ‘গানা না
আয়া, বাজানা না আয়া,
দিলবর কো আপনা বানানা
না আয়া’। এমনিতে যে গান
এত ভালবাসে সে কেন
গানের ইস্কুলে যাবার
কথা ভাবলেই অস্থির হয়ে
উঠবে বিরক্তিতে, এমনিতে
যে ছবি আঁকে সারাদিন, সে
কেন চিত্রাঙ্কণ
প্রতিযোগিতায় গেলে
দিশেহারা হয়ে উঠবে?
বাণী বসুর একটি ছোট
গল্প ছিল, তাতে
ইস্কুলের
দোর্দন্ডপ্রতাপ
মাস্টারের বাড়িতে
অনেককাল আগের ছাত্র এসে
দেখে মাস্টারের বাড়ির
দৈন্যদশা, ধোঁয়ায়
আচ্ছন্ন বাড়িঘর,
কাঁপিয়ে যাওয়া রেলের
হুইসেল, মাস্টারমশাই
স্বীকার করেন ছাত্রের
বোধবুদ্ধির
উৎকর্ষসাধনের জন্যে ঐ
মারপিটগুলি
মাস্টারমশাই করেননি,
করেছিলেন অকথ্য জীবনকে
বয়ে বেড়াবার ক্লান্তি
আর রাগ থেকে। আর্থিক
দৈন্যই সব নয়, গুরু বলে
যাকে পরম আদরে-শ্রদ্ধায়
ডাকা হয়, যাঁর শিষ্যের
থাকে সন্তানের মতো
মুখাগ্নির অধিকার, সেই
গুরু হৃদয়ের দৈন্য-
চিত্তের দৈন্য ছাপিয়ে
উঠতে পারেন না বেশিরভাগ
সময়ই। সৃষ্টিশীল
শিক্ষার ক্ষেত্রে
বারবার এই গুরু-দৈন্য
নিয়ে ধরা পড়েন
মাস্টাররা।
তার প্রায় বছর বিশেক
পরে আমি জেনেছি, গানের
ক্লাসগুলিতে আমাকে
নিয়ে যাওয়ার জন্যে আমার
মা’কে কী সইতে হতো এবং
কতটা। সারাদিনের
রান্না করে কোনোমতে
আমাকে কোলপাঁজা করে মা
দৌড় দিত গানের ইস্কুলে।
অত্যন্ত রক্ষণশীল
দাদা-দাদীর কাছ থেকে
হারমোনিয়াম এবং রেয়াজ
দুইই লুকিয়ে রাখতে হতো।
আমি অনুমোদন আদায়
করেছিলাম আমার দাদীকে
‘আকাশে হেলান দিয়ে
পাহাড় ঘুমায় ঐ’ শুনিয়ে,
আর মা একটি অদৃশ্য
মুচলেকায় সই করে যে
মেয়েশিশুকে কখনো
স্টেজে গান গাইতে দেবে
না। একদিকে বাবা রাতভর
ক্ল্যাসিক্যাল শুনছে
যাই বুঝুক, কাকারা রাত
জেগে দেখছে ‘লাইভ এইড’,
‘সলিড গোল্ড’ বাড়িতে
প্রিয় অনুষ্ঠান,
ছোটকাকার ‘এলভিস
মেডলি’তে কান পাতা দায়,
সকালে দাড়ি কামাতে
গিয়েও বাড়ির লোকে শুনছে
রেডিও সীলোনে সিনেমার
গান ... আরেকদিকে এই
অদৃশ্য সমঝোতায়
স্বাক্ষর। বড় হয়ে মা’কে
জিজ্ঞেস করেছিলাম, “এত
কষ্ট করে কেন নিয়ে যেতে
এই গান শেখাতে?” মা
বলেছিল, গানের সমঝদার
হতে গেলেও তো গানটা
জানা চাই, শুনতে গেলেও
শিখতে হয়, অতটুকুই।”
এইসব তিক্ততার ও
অবিমৃশ্যকারিতার অথচ
ছোট ছোট জয়ের স্মৃতি
থাক, সাতটি দেশ মিলে
দক্ষিণ এশিয়ায় ‘সার্ক’
হবার পরে দুপুরগুলি ছিল
দারুণ উত্তেজনার। আমরা
ভাইবোনেরা ‘দূরদেশ’
সিনেমার ‘যেও না সাথী’
গানটা শিখে গেলাম,
মোহম্মদ আলি-জেবা কিংবা
নাদিম-শাবানা এইসব
দেখলাম আকছার। মালা
সিনহার ডুবু ডুবু চোখে
গাওয়া ‘তুমি বিনা এ
ফাগুন বিফলে যায়’
দেখলাম। সুচিত্রা
সেনের লিপে সন্ধ্যা
মুখার্জির গলা
মিলেমিশে যেতে দেখলাম।
পাগলাগারদের সেই গান
‘এমন বন্ধু আর কে আছে’,
মেডিকেলের
স্টুডেন্টের
‘মেটিরিয়া মেডিকার
কাব্য’ এবং ‘আমরা
মেডিক্যাল কলেজে পড়ি’,
মেসবাড়ির সেই ‘আমার
যৌবন চম্পাচামেলি বনে
অকারণ উচ্ছল হিল্লোল’
শিখেই ফেললাম আমরা। আর
একদিন আমাকে একাঘ্নি
বাণ মারলেন সলিল
চৌধুরী, অকুস্থল সিনেমা
‘পাশের বাড়ি’, গায়ক
ধনঞ্জয়
ভট্টাচার্য্য।“নয়নে
তার ভোমরা কাজল কালো /
দুই কানে তার ঝুমকোলতা
দোলে / কালো কেশে
সর্বনাশের নেশা/ চলন
দেখে পলকে মন ভোলে ভোলে
গো।” আমি অধম মনে করি,
এই গানটির বাণী আর সুর
গীতিকার আর সুরকারদের
অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত।
যাই হোক, আমার মতে কী যায়
আসে।
তিরিশবছর বয়সে পরবাসে
বসে লিখেছিলাম একটি
দিনের কথা- গেন্ডারিয়ার
বাসায় একদিনের
বিকেলবেলা। রোদ হেলে
গেছে। অর্জুনগাছটা ভরে
ঐসব দলামোচড়া দেখতে মতন
ফল এসেছে। জানালার
গরাদে মুখ ঠেকিয়ে
অনন্তকাল তাকিয়ে আছি
দু’বাড়ির মাঝের একফালি
জমিতে। একটা লিকলিকে
নতুন আমের চারা। ভাঙা
লাটাই। আমাদের ছুঁড়ে
ফেলা রাজ্যের
আইসক্রিমের কাঠি।
দইয়ের ভাঁড়। কে যেন গান
বাজাচ্ছিল। হেমন্ত
কুমারের গান– ‘তুম
পুকার লো। তুমহারা
ইন্তেজার হ্যায়’।
খামোশী সিনেমার গান।
ছমছম করা সুর। গান শেষ
হলো। অর্জুনগাছটার
মগডালে মিহিদানা রঙ রোদ
উঠে গেল। সন্ধ্যার
বাতাস অনতিদূরের
বেকারীর খাস্তা
বিস্কুট-দালদার গন্ধে
ভরে উঠতে লাগলো। আমার
অত ভাল লাগছিল কেন? তুম
পুকার লো। কে আমাকে
ডেকে নেবে? (ঠিক তার
ক’দিন আগেই সিনেমার পল
নিউম্যান আমাকে নারীতে
পরিনত করেছে, অযথাই।)
এইবার অযথা ভাললাগার
শুরু, অযথা বেদনার শুরু,
অযথা কুলকুল করে শরীর
ভরে উঠবার শুরু। রোদ
নিভে এলো। আকাশ ফিরোজা
হয়ে এলো। দীননাথ সেন
রোডের কবরখানার
তেঁতুলগাছ-চাঁপাগাছ-গা
আলুর লতা-হরেক আগাছা
থেকে দীর্ঘশ্বাসের
মতোন গরমের দিন-মতোন
একটা গন্ধ ভেপে উঠলো।
আমি জানালায় দাঁড়িয়ে
গুনগুন করতে
লাগলাম-‘তুম পুকার লো’।
কে যেন আমাকে ডেকে নেবে!
মুক্তসর সি বাত হ্যায়
তুমসে পেয়ার হ্যায়...
‘মুক্তসর সি’ অর্থাৎ
মোটকথা, সেই বয়সে আমার
মনে হতো শব্দটা
‘মুক্তো-সরসী’, যে
সরোবরে মুক্তাস্বচ্ছ
জোছনা এসে পড়েছে আর
গোটা জল মুক্তোর
লাবণ্যে ভরে গেছে। এই
যে মুখে পুরে চুষতে
থাকা লটকানের মতন নানান
স্বাদের বিক্ষেপ,গানের
সুর ও বাণীর হাতছানি বড়
সাংঘাতিক। সুর না বাণী?
কিসের মালা দিয়ে ছোঁয়
এরা আমাকে?
গীতবিতান ছিল একমাত্র
বই যা হাতে করে আরেকটি
অচেনা দেশে থাকতে
এসেছিলাম আমি। কত গানই
তো আমি কেবল পড়তাম, সুর
জানতাম না। সুর জানবার
আগ অব্দি ভালবাসতাম।
যেমন-
“ঐ আলোকমাতাল
স্বর্গসভার মহাঙ্গণ
হোথায় ছিল কোন যূগে মোর
নিমন্ত্রণ
আমার লাগলো না মন লাগলো
না
তাই কালের সাগর পাড়ি
দিয়ে এলেম চলে
নিদ্রাবিহীন গগনতলে”
পরবাসে ডেভিড কিটের
একটা গান শুনেছিলাম
বহুবার, ‘টেল মি দেয়ার
উইল বি স্যাটারডেজ।
নাথিং এলস টু ডু’।
গানটার সাথে বিচিত্র সব
আদিম যন্ত্র বাজানো
হতো,একটা টুলশেডকে
বাসাবাড়ি বানিয়ে ফেলে
সেখানে একটা একাকী লোক
থাকতো। তার বাড়িতে আমি
প্রথম শুনেছি সেই গান।
সেই গানের সাথে মিশে
আছে আমার প্রথম
‘রবিবার’এর বোধ, প্রথম
নীল নীল উত্তর আকাশে
ছুটি ছুটি রোদের আভাস।
সেই প্রথম যেন আমার
ছুটি হলো। যেন অনেক
কিছু করবার জন্যে এখুনি
উঠে দাঁড়াতে হবে না,
ছুটে চলতে হবে না আরো
কিছু পাতালের ইঁদুরের
সাথে, আরো অনেকদিন এমন
বেলা করে ঘুম থেকে উঠবো
আমি আর কোনো
প্ররোচনাতেই সকালের
রোদ্দুরকে পরিত্যাগ
করবো না।কাজে যাব না,
হাঁ করে দেখব
পোর্টোবেলো রোডে
মানুষের মিছিল কিংবা
পাড়ার পার্কের
হাঁসপুকুরে ধুপ করে পড়ে
যাওয়া আস্ত আকাশ।এইসব
দিনে আমার মনে হতো
সকালবেলা যে গান আমার
মাথায় গুনগুন করে সেটা
প্রতিদিন লিখে রাখব,
দেখি বাসস্টপে
নাইজেরিয় সহযাত্রিনীর
পাশে দাঁড়িয়ে আমি নিজের
অজান্তেই সুর ভাঁজছি-
‘হাম কালে হ্যায় তো
কেয়া হুয়া দিলওয়ালে
হ্যায়’, কী লজ্জার কথা।
‘ইফ আই কুড সেভ টাইম ইন আ
বটল
দ্য ফার্স্ট থিং দ্যাট
আইউড লাইক টু ডু
ইজ টু সেইভ এভরিডে
টিল ইটারনিটি পাসেস
আওয়ে
জাস্ট টু স্পেন্ড দেম
উইথ ইউ।’
গানটা আমাকে একটা
আধবুড়ো লোক শুনিয়েছিল,
আয়ূক্ষয় যার জীবনে চরম
সত্য। এ গান একটা
বেদনার আকার নিয়ে আমাকে
অধিকার করে নিয়েছিল মনে
আছে, ধ্যাদ্ধেরিয়ে
প্রেমে পড়ে গেছিলাম
তার। কত রাত জেগে
শুনেছি এরপর কিশোরী
আমোনকরের ‘সহেলা রে’-
শুরুতেই একটি স্বরকে
ধরে কিশোরীর নিক্ষিপ্ত
বাণ। শুনেছি
‘গীতগোবিন্দ’র
‘ত্বমসি মম জীবনং
ত্বমসি মম ভূষণং ত্বমসি
মম ভবজলধিরত্নং’ কত
আদরে গায়ক ডাকেন
‘প্রিয়ে, চারুশীলে’!
পৃথিবীর সব ঘুঘু সত্যি
ডেকে ওঠে একত্র। যাই
হোক, পথে পথে দিলাম
ছড়াইয়া রে সেই দুঃখে
চোখের পানি... কলিম
শরাফীই নন শুধু, তাঁর
সাথে আমিও। ঘর নাই, জন
নাই, কূল নাই, কিনার নাই,
বিধিরও খেয়ালের শেষ
নাই।
আমাকে একটা পথের মতন
বিছিয়ে দিলে সে হবে
বিচিত্র এক পথ, আমি
রেডিও শুনেছি এন্তার,
রেডিওতে এলুমিনিয়মের
বাসনের মতো চকচকে
খুরশিদ আলম আর
পুঁটিমাছের ল্যাজের
আছড়ানিতে কাঁপা কাঁপা
পদ্মমৃণালের গলা যার
সেই বশির আহমেদ।
শাদাকালো থেকে রঙিন
টিভির সলিড গোল্ড আর
‘বিচিত্রা’য় অ্যান্ডি
গিবের মৃত্যুসংবাদ ,
ভিসিপি আর ভিসি আরে
গীতমালা, আজম খানের
‘ওরে সালেকা ওরে
মালেকা’ আর পিলু
মমতাজের ‘একদিন তো চলে
যাব পরের ঘরনী হবো’,
লাইভ এইডে কুইনের
দুর্ধর্ষ গান শুনেছি
রাত জেগে, ছাদের
অ্যান্টেনায়
এলুমিনিয়ামের সরা দিয়ে
আমরা মূর্তিপূজকের
চেয়ে গভীর নিষ্ঠায়
দেখেছি ভারতের
সগরভ্রাতাদের
রামায়ণের গান
‘সীতারামচরিত অতি
পাবন’, কবির সুমন
গেয়েছেন ‘প্রথমত আমি
তোমাকে চাই’ আর
‘জীবনমুখী গান’ শব্দটা
শুনে অগ্রজ শিল্পীরা
খিঁচিয়ে উঠে জিজ্ঞেস
করেছেন, “গানের মুখ কবে
জীবনের উল্টোদিকে ছিল
হে?”। একসময় খুলে গেছে
স্বদেশের ঢাকনা, তার
‘হীরার ঝালর সোনার পাত,
শ্বেতপাথরের নিগম ছাদ’-
নাচ এসে হাতসাফাই করে
নিয়ে গেছে গানের যাদু,
গানের সাথে নাচুনেরা
নয়, গায়করাই গাইতে শুরু
করেছে, ইদানিং এক
বন্ধুর ফেসবুকের
দেয়ালে দেখলাম লেখা
‘তোমায় গান ‘দেখাবো’’।
আহা আমার কি ভাল লাগতো
না নেচে নেচে বনিএম এর
সেই লোকটার গান? ভাল
লাগতো না রুনা লায়লার
চিকচিকে লিপস্টিক আর
ববছাঁট চুলে হিলহিলে
নাচ? নাজমা জামানের
‘ফাগুন খুলে দিল
দ্বার’? গান শুধু একদিক
দিয়ে মরমে পশবে কেন?
প্রাণের শ্রবণ শুধু না,
প্রাণেরও চোখ হলো,
একেবারে পুঞ্জাক্ষি।
ইস্কুলে
ভর্তিপরীক্ষায় আমাকে
জিজ্ঞেস করা হয়েছিল,
“পছন্দের একটা গান করতে
পারবে?” আমি মিইয়ে গিয়ে
বলেছিলাম, নেচে নেচে
ছাড়া আমি গান করতে পারি
না... আশির দশকের
ভর্তিপরীক্ষায় একটি
নির্লজ্জ শিশু নেচে
গেয়ে এলো ‘এমন একটা মা
দে না যে মায়ের
সন্তানেরা কান্দে আবার
হাসতে জানে’।
‘ভরা নদীর বাঁকে’তে
কতকাল আগে শুনেছি ‘গহীন
রাইতে বাত্তি
জ্বাইল্লা সিলাই
নকশী-কেথাআআ’, শুনেছি
ছাদপিটানি গান
‘সারাদিন পিটি কার
দালানের ছাদ গো/ পাত ভরে
ভাত পাই না ধরে আসে হাত
গো’। কত কথা সে
গানে-‘তোর ঘরে আজ কী
রান্না হয়েছে/
ছেলেদু’টো ভাত পায়নি পথ
চেয়ে রয়েছে/আমিও ভাত
রাঁধিনি দেখ না লো চুল
বাঁধিনি/ শাশুড়ি
মান্ধাতার বুড়ি মন্দ
কথা কয়েছে’ কিংবা ‘এত
খায় তবু ওদের বউগুলো
শুঁটকো/ ছেলেগুলো
প্যাঁকাটি আর বাবুগুলো
মুটকো’। ভোলা যায় না
গুরু দত্তের মুভিতে
মহম্মদ রফির
তেলমালিশওয়ালার সেই
গান। উত্তমকুমারের
লিপে ‘নিলামওয়ালা
ছ’আনা’ ভোলা যায় না।
ভোলা যায় না
পালকিবেহারার গান
‘পালকি চলে পালকি চলে’
কিংবা ‘কলা বৌ কলা
বৌ/মৌটুসকি ফুলের মৌ/
তুই যে আমি রাণী
লো/জষ্টিমাসের পানি লো/
নোলক দিব দিব মল/ বৌ লো
আমার ঘরে চল’
(‘গৃহদাহ’)। মাথায়
গেঁথে গেছে ‘ও
ভালমানুষের ঝি, তুই
কুমুড়োশাকে বড়ি দিয়া
রাঁধতে জানিস কি?/ ও বৌ
মিহি চালের ভাত দিবি/
উচ্ছে দিয়া ডাল/ ঐ
খলসেমাছের টক দিবি/
চিতলমাছের ঝাল’। মনে হয়
আমাদের গানগুলি ভাতের
আর তরকারির। পেটভরা
ভাতের পরে নিরাক পড়া
বেলায় হাতের গামছা বা
তালপাখা ঘুরাতে ঘুরাতে
যে আনন্দে স্রোতহারা
স্থবির হয়ে পড়ে মন, সেই
আনন্দের। সে অনেককাল
আগের কথা। এখনকার
গীতিকারদের
‘তুমিহীনা’,
‘সুন্দরীতমা’ এইসব ভুল
শব্দে গাঁথা গানের পাশে
আমার হৃদয়ের গানের
বাণীও ‘আহত পাখির মতো
লুটায়ে আছে’। বাঁশি কই
আগের মতো বাজে না, এই
প্রশ্ন বোধ করি প্রজন্ম
থেকে প্রজন্মান্তরেই
বয়ে বেড়াবার। আমাদের
কাল নিয়ে ধূসর বেদনা
বয়ে বেড়ানোই শুধু এই
প্রশ্ন করবার কারণ সেটা
ভাবলে ভুল হবে। নিষ্ঠার
অভাব, বিদ্যার অভাব,
প্যাশনের অভাব এইসব
অনেক ফুটো হয়ে গেছে
ভালবাসার এই জগতে।
অনাদরের মাছটাকে আর
কোনো শাক দিয়েই ঢাকা
যাচ্ছে না। গান শেখাবার
জন্যে বেশ্যাপল্লীতে
যেতে হতো নজরুলকে,
প্রতিভা বসুকে (তখনকার
রাণু সোম) গান শেখাতে
গিয়ে পাড়ার ছেলেদের
হাতে নিগৃহীত হয়েছে
তাঁকে, গান গাইবার
অধিকার নিয়ে বেগম
আখতারের কতবার বুক
চৌচির হয়ে ফেটে গেছে-
সাতবার গর্ভপাতের
বেদনা জুটেছে তাইতে এমন
বেহালার বুকভাঙা আওয়াজ
বেরুতো... কে জমিয়ে
রাখতেন নিঃশেষিত আতরের
শিশি... কে চারবছর ধরে
শুধু ‘সা’তে সুর
লাগানোর চেষ্টা করে
গেছেন অজ্ঞাতবাসে আর
ফিরে এসে বাগসিদ্ধ হয়ে
গেছিলেন, গান শিখবার
এবং গান গাইবার ইতিহাসই
তো রক্তাক্ত, হ্যান্স
ক্রিশ্চিয়ান
অ্যান্ডারসনের
নাইটিঙ্গেল যেমন বুকে
গোলাপকাঁটা বিঁধিয়ে
সারারাতের রক্তপাতে
ফুটিয়েছিল রক্তগোলাপ
তেমন। গানের জন্য এত
কষ্ট কেন? একে তো গান
সাধনার বস্তু,
দ্বিতীয়ত- গান যেভাবে
মামুলি মানুষকে তার
সামান্য জীবনযাপন থেকে
একটা অদৃশ্য আংটায় করে
অনেক উঁচুতে টান দেয়...
মনে করিয়ে দেয় সে
বৃহত্তর বিপুলতর
জীবনযাপনের যোগ্য, সেটা
আর কেউ পারে না। পারে না
বলেই শোষণকামী
স্বামী-শ্বশুরকূল গান
সইতে পারে না (শাশুড়িও,
এই যেমন ‘জীবন থেকে
নেয়া’তে প্রতাপশালী
শাশুড়ির ভয়ে ‘এ খাঁচা
ভাঙব আমি কেমন করে’
গানটা কিছুতেই শেষ করা
যেত না), শোষক রাজা বা
শাসনকর্তারাও গানের
বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যায়।
পৌষের ডাক আর মাঠের
বাঁশি শুনলে তাদের
অচলায়তন ভেঙে পড়বে যে।
বিভূতিভূষণের
‘কিন্নরদল’ পড়ে
অল্পবয়েসে কাঁদেনি এমন
কেউ আছে বলে মনে হয় না,
সঙ্গীতের সবচেয়ে বড়
ক্ষমতা হচ্ছে বাণীর
উর্ধ্বে গিয়ে,
দেশকালজাতপাত
বিদ্যাশিক্ষার
উর্ধ্বে গিয়ে মানুষের
অন্তরকে ছোঁবার
ক্ষমতা। তার ছোঁয়াচে
জীবন বদলে যায়, অনুভব
জন্মায়, প্রেম জাগে,
বিপ্লব সাধিত হয়,
শোষণের শেকল ভাঙে লোকে।
গান তার মুক্তির
আকুলতা, চিরদিনের।