গড়িয়াহাট বাণীচক্রে
গান শিখতে গেছি
কুমুদবাবুর কাছে,
কুমুদবাবু আমার নাম
শুনে বললেন, "অ, মিঠুন?
চক্কোত্তি নাকি?" আসল
নাম ঠিকঠাক জানার পরেও
সবার সামনে আমাকে মিঠুন
বলেই ডেকে এসেছেন।
আমৃত্যু। একা থাকলে
অবশ্য মিতুল-ই বলতেন।
ওঁর লায়েলকার বাড়িতে
শিখতে যেতাম যখন,
ফুর্তির আতিশয্য হলেই
জানলা দিয়ে আকাশ দেখিয়ে
বলতেন, "ওইখানে তুলে
দেব।" অর্থাৎ ওঁর কাছে
গান শিখলে
চন্দ্র-সূর্যের পাশে
আমার ঠাঁই হবে। বলেই
ফিরে প্রশ্ন করতেন,
"কোনখানে?" আমি
মিনমিন করতে করতে
জানলার দিকে আঙুল
তুলতাম। একবার
স্বগতোক্তি করেছিলাম,
"যদি পড়ে যাই?" ঠিক
কানে গেছিল বুড়োর। শুনে
সে কী তম্বি আমার ওপর!
ভালোও বাসতেন তেমনি।
জেঠিমা, মানে
কুমুদবাবুর স্ত্রীর
কাছে শুনেছি, একদিন আমি
যেতে না পারলে নাকি
ঘর-বার করতেন।
মাঝেমধ্যে চিঠিও লিখতে
বসে যেতেন আমাকে, "মা
মিতুল, তুমি আসিতে পারো
নাই, আমি অত্যন্ত
উৎকণ্ঠিত।" তারপর
যেদিন যেতাম,
ছেলেমানুষের মতো
খুশিতে লাফালাফি
করতেন। ওইরকম
ফুর্তিবাজ মানুষ আমি
খুব কম দেখেছি। পণ্ডিত
ছিলেন। দর্শনে ডক্টরেট
করেছিলেন। গানবাজনার
থিওরির ওপর বই লিখছিলেন
একটা। শেষ করে যেতে
পারেননি।
কুমুদবাবুর ভালো নাম
ছিল কুমুদরঞ্জন
বন্দ্যোপাধ্যায়।
সরস্বতী পুজোর দিন
জন্মেছিলেন বলে
প্রতিবছর সেই বিশেষ
দিনটিতেই ওঁর জন্মদিন
পালন করা হত। সেদিন
সন্ধেবেলা ওঁর বাড়িতে
গানবাজনার আসর বসত। সেই
আসরে অবিশ্যি ওঁর
ছেলেমেয়ে আর
ছাত্রছাত্রী ছাড়া আর
বিশেষ কেউই থাকত না।
গানবাজনা, খাওয়াদাওয়ার
পর সেদিন আমার আর বাড়ি
ফেরা হত না। টালিগঞ্জে
মেজোমামার বাড়ি থেকে
যেতে হত।
কুমুদবাবুর পৈতৃক বাড়ি
ছিল বসিরহাটে। আমার
বড়মেসোর দাদা ওঁর বন্ধু
ছিলেন। একসঙ্গে ফুটবল
খেলতেন। বড়মেসোর দাদার
ভালো নাম ছিল নির্মল।
আর ডাকনাম ভেজাল। একই
লোকের দুটো নামের এইরকম
বৈপরীত্য আমি জীবনে আর
দ্বিতীয়বার শুনিনি। এই
ভেজালমামা
টাকী-বসিরহাট অঞ্চলে
রীতিমতো বিখ্যাত ছিলেন
তার ডাকসাইটেপনার
জন্য। শোনা যায়, একবার
বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে
ট্রেনে উঠেছেন, কারও
পকেটে টিকিট নেই। ওইসব
লাইনে সচরাচর
টিকিট-কালেক্টর উঠত না,
কিন্তু কী কপাল, সেদিনই
উঠেছে। প্রখমে সাধারণ
কথা-কাটাকাটি, তারপর
ঝগড়া, সেখান থেকে
হাতাহাতি। ট্রেন তখন
নদীর ওপর ব্রিজ পার
হচ্ছে।
টিকিট-কালেক্টরকে
টিকটিকির মতো তুলে
নদীতে ছুঁড়ে ফেলেছিলেন
ভেজালমামা। ভাগ্যিস
নদীতে তেমন জল ছিল না,
হাজামজা ছিল সে নদী।
তাই সে যাত্রায় প্রাণ
নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন
ভদ্রলোক।
কুমুদবাবুর কাছে
বসিরহাটের অনেক গল্পই
শুনেছিলাম। তার
বেশিরভাগই আজ আর মনে
নেই। শুধু মনে আছে ওঁর
মায়ের গলার সাতনরী
হারের কথা। রত্নখচিত
সেই হারের প্রত্যেকটা
রত্নের পেছনে নাকি ছোট
ছোট টুনিবাল্ব লাগানো
ছিল। টুনিগুলো জ্বলে
উঠলে ঝলমল করে উঠত সেই
হার আর সেইসঙ্গে মায়ের
মুখটিও। মায়ের কথা খুব
বলতেন কুমুদবাবু।
অপূর্ব সুন্দরী নাকি
ছিলেন তিনি।
কুমুদবাবুও খুব সুন্দর
ছিলেন বয়েসকালে। আমি
যখন দেখেছি, বয়েস হয়ে
গেছে, তখনও দিব্যি
লাল-টুকটুকে মিষ্টি
একটা বুড়ো। সারাক্ষণ
গান গাইছেন, হাসছেন,
বকবক করছেন, উৎসাহে
ফেটে পড়ছেন, আবার
অভিমানে গাল
ফোলাচ্ছেন। গড়িয়াহাট
বাণীচক্রে গান শিখতে
যেতাম যখন, পৌঁছোতাম
সবার শেষে। আমার শেখা
হয়ে গেলে সবাই মিলে
বেরিয়ে পড়তাম ক্লাস
থেকে। রাস্তায় নেমেই
কুমুদবাবু তারস্বরে
শেষ শেখানো রাগের
বন্দিশ ধরতেন। আমাদেরও
গলা মেলাতে হত ওঁর
সঙ্গে। সে এক দেখা এবং
শোনার মতো ব্যাপার ছিল।
আশেপাশের লোকজন থমকে
দাঁড়িয়ে পড়ত। যাদের
অভ্যেস ছিল, তারা
অবিশ্যি হাসি চেপে পাশ
কাটিয়ে যেত। ওঁকে বাসে
তুলে দিয়ে আমি আর বাবা
উল্টোদিক থেকে হাওড়ার
বাস ধরতাম। তারপর
সেদিনের শেখা রাগটা,
যাতে ভুলে না যাই সেই
জন্য, সারা রাস্তা
গুনগুন করতে করতে বাড়ি
ফিরতাম।
আজও আমি ভাবতে পারি না,
ওইরকম জীবনীশক্তি ছিল
যে মানুষটার, তাঁর
জীবনের শেষ বছরটা কী
ভয়ংকর মৃত্যু-আক্রান্ত
হয়ে কেটেছে। সেরিব্রাল
অ্যাটাক হয়েছিল।
ডানদিকটা পড়ে গিয়েছিল।
মৃত্যুর কিছুদিন আগে
আমি আর মা দেখতে
গিয়েছিলাম ওঁকে, গিয়ে
দেখি চেয়ারে বসে আছেন
ন্যালাখ্যাপার মতো।
লক্ষীদি, ওঁর ছোটমেয়ে,
একটা থালায় ভাত চটকে
গোটা দশ-বারো গোল্লা
পাকিয়ে টেবিলে রেখে
দিয়ে গেছে আর উনি প্রায়
অকেজো ডানহাতটা দিয়ে
অপরিসীম চেষ্টা করছেন
সেই ভাতটা খাওয়ার। কথা
বন্ধ একেবারে, শুকিয়ে
আধখানা হয়ে গেছে শরীর,
মাথাটা অনেকখানি
ঝুঁকিয়ে ডানহাত কব্জি
থেকে উল্টে ভাতের দলা
ধরে মুখে পোরার চেষ্টা
করছেন, নালেঝোলে একসা
হয়ে যাচ্ছে মুখ। মা গেল
রান্নাঘরে জেঠিমার
সঙ্গে গল্প করতে। আমি
একটু একটু করে ভাতটা
খাওয়াতে লাগলাম ওঁকে।
আমার দিকে ফ্যালফ্যাল
করে চেয়ে রইলেন। হঠাৎ
একটু সবল বাঁ-হাতটা
চেপে ধরলেন আমার বুকে।
চোখ বন্ধ করে কী যেন
বিড়বিড় করলেন কয়েক
সেকেণ্ড। আমার সমস্ত
শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে
গেল। মনে হল একটা সুরের
প্রবাহ যেন ঢুকে যাচ্ছে
আমার শরীরে। বুঝলাম,
মৃত্যুর আগে উনি ওঁর
সবকিছু আমাকে দিয়ে
গেলেন। এরপর উনি আর
বেশিদিন বাঁচেননি।
সেদিনের কথা ভাবলে আজও
গায়ে কাঁটা দেয় আমার।
আমি পারিনি ওঁর
আশীর্বাদের যোগ্য হয়ে
উঠতে। ছড়িয়ে গেছি। সুরও
আমাকে ছেড়ে গেছে
ক্রমশঃ। আজ একটু সুরের
জন্য মাথা খুঁড়ে মরি।
ফেরে না সে। কুহকিনীর
মতো তার অদ্ভুত মায়াবী
পালক আমার মুখে বুলিয়ে
কোথায় চলে যায়। পর্দার
ওপার থেকে আমাকে
সারাজীবন আচ্ছন্ন করে
রাখে। আমি সেই পর্দা
সরানোর ব্যর্থ চেষ্টা
করে যাই। পারি না। আমার
আর সুরের মাঝখানে ওড়নার
মতো স্বচ্ছ একটা পর্দা
দুলতে থাকে। দুলতে থাকে
আমাদের ব্যবধান, আমাদের
না-পাওয়া।