আমি,না-১
দেখা আর না-দেখার বাইরে
থাকে সুর। সুর, সেই
শিরাই তো, যা কখনো সখনো
খুব রোদ উঠলে রিয়ার
গালে নীলনদের প্রশাখা
হয়ে যেত।তখন হাত পাকছে
সাইকেলে, দেদার
ঘোরা।সেরকমই ঘুরছি,
গ্রীবা থেকে গ্রীবার
ধ্বনিতে, হাঁসের
অবশ্যই।দিলীপদার
টেপ-রেকর্ডার ছিল।তাতে
রাগ, রাগিনী ঘুরে
বেড়াতো।আমরা ব’লতাম,
রাগদা। একদিন, হঠাৎ
বৃষ্টি এসে যাওয়ায় তখনো
‘ব্যাচেলর’ দিলীপদার
কোয়ার্টারসের গেট খুলে
বারান্দায় এসে
দাঁড়িয়েছি, বৃষ্টি ভার
নামালো জোরেই, ভেতরে
দিলীপদার টেপ বাজছে।
আমি উঁকি মারলাম।
দিলীপদা বলল, বাইরে কেন,
ভেতরে আয়.....আমি তখন ষোলো,
ফলে যে তানালাপ হচ্ছিল
তার কিছুই না বুঝে একটা
হাসি বুলিয়ে দিলাম
ঠোঁটে।
-মেঘে ঢাকা তারা
দেখেছিস, ঋত্বিক
ঘটকের?
-না
-দেখবি, আরেকটু বড় হয়ে
অবশ্যই দেখবি, এই যে
শুনছিস এ.কানন
গাইছেন।রাগ হংসধ্বনি!
এভাবেই হাঁসে পৌঁছে
গেলাম আমি। হাঁসের
গ্রীবায়! অবশ্য চোদ্দ,
পনেরো বছরের মেয়েদের
গ্রীবায় শালিখের
প্রচ্ছায়া থাকলেও,
হাঁসের ফাঁস থাকার
সম্ভাবনাই ছিলনা।
যাইহোক হংসধ্বনি
কিন্তু আমার
শব্দভাণ্ডারে ঢুকে
গেল!
দিলীপদা বলল, সব গানের
ভিত্তি কিন্তু সাতটা
সুর, এর বাইরে কিছু নেই।
দাঁড়া তোকে একটা মজার
জিনিস শোনাই। দ্রুত
ক্যাসেট পাল্টে
দিলীপদা সুইচ অন করে
দিল।গানটা শোনা মনে
হচ্ছে। তবে যে গাইছে
মানে যেভাবে গাইছে আমি
তখন সেরকম সব গানকেই
‘খেয়াল’ ব’লে জানতাম!
-বড়ে গুলাম আলি খাঁ
সাহেব, নাম শুনেছিস?
যা নাম বলল, এত
ভারীভরক্কম, না শোনাটা
অপরাধ ভেবে বললাম,
হ্যাঁ
-কি গাইছে বল?
কান পেতে শুনলাম, কা
করুঁ সজনী আয়ে না
বালম..খুব খেলিয়ে গাইছে,
বললাম, জানি তো, খেয়াল!
দিলীপদা হেসে উঠল।
-এ হল, ঠুমরি...রাগ
সিন্ধু-ভৈরবী, জানিস
সিন্ধু-ভৈরবী কাকে
ব’লে?
বাংলা আমার জোরের
জায়গা। পড়াশোনার এই
একটি ব্যাপারই আমার
পছন্দের ছিল। তো, ব’লে
দিলাম,
সমুদ্র-সন্ন্যাসিনী!
দিলীপদা আবার একচোট
হেসে নিল।
-নারে পাগল। রাগ ভৈরবীর
শাখা এটা, ভোরের দিকে
গাওয়া হয়...ওই যে তোদের
ফিল্মি গান, সে সবও
রাগের স্ট্রাকচার ছাড়া
হয়না...দিলীপদা টেপ বন্ধ
ক’রে বলল, দাঁড়া তোকে চা
খাওয়াই...মানে তুই খেলে
আমিও খাই আরকি!
বাইরে ঘনোরিতালে
বৃষ্টি পড়ছে। নাউ ডোন্ট
আস্ক মি হোয়াট ইজ
ঘনোরিতাল, ওটা আমার
বেতালিক অনাসৃষ্টি!
যাইহোক চা আর নিমকি
নিতে নিতে আমি বেশকিছু
নতুন শব্দের মায়ায়
জড়িয়ে গেলাম!শব্দের
পরতে থাকা রেউর অব্দি
যেতে আমার ভাল লাগে।
কবিতার নামে চুটিয়ে
লিখছি তখন এসবই। দাবড়ে
মেলাচ্ছি, হায়াকে মায়ার
সঙ্গে। আর রিয়াকে
অবহেলার সঙ্গে। যেমন,
রিয়ার অবহেলায় আমি
হতক্লান্ত কবি / রিয়া,
তুমি কি সিন্ধু-ভৈরবী?
দিলীপদার চা আর নিমকির
গুণ আছে ব’লতে হবে।
কেমন এক ঝটকায় চলে এল!
মনে খুব আনন্দ। আর সেই
আনন্দের চাপা আরাম নিতে
নিতে আমি শুনলাম
দিলীপদা গাইছে, চিংগারি
কোই ভড়কে তো শাঁওন উসে
বুঝায়ে....এটা ভৈরবী
বুঝেছিস তো, ভৈরবীতে কি
হয়, জোরটা পঞ্চম,সদাজ আর
কিছুটা কোমল গান্ধারে
থাকে অন্যদিকে সিন্ধু
ভৈরবীতে ওটা শিফ্ট হয়ে
যায় শুদ্ধ মধ্যম, কোমল
ধৈবত আর কিছুটা কোমল
ঋষভে....আড়চোখে দেখলাম,
বাইরে বৃষ্টি থেমেছে,
কোমলাঙ্গী রোদ এসে
পড়েছে মধ্যমে, ধৈবতে,
ঋষভে, রাস্তায়,
হিন্দিস্কুলের ছাতে, আর
ও মাই গড, ওই তো রিয়া
যাচ্ছে..ওর লাল রঙের
লেডিজ সাইকেল....ক্রিং
ক্রিং...সব রাগ থেমে যায়/
রাগিনীর কাছে, ভেবেই
আমি চটজলদি উঠে দাঁড়াই,
বলি, টিউশন আছে, দিলীপদা,
চললাম...ভেজা সাইকেলের
প্যাডেলে চাপ দিতেই গান
ভেসে এল, ইয়ে শাম
মস্তানি...
রণন-১
‘বাজাতে থাকো, থেমোনা’,
ভেজা মুখ, জল গড়িয়ে
নামছে মুখ বেয়ে। দরজা
খুলে মুখ বাড়ানোয়
শাওয়ারের শব্দ ভেসে
আসছে। আমি দেখলাম সেই
মুখে চাপা খুশি, চোখে
জলের আস্কারা। তারপর
দরজা বন্ধ হয়, স্নান
অর্ধেক রেখেই মনে হয়
বেরিয়ে এসে আমি যেটা
বাজাচ্ছিলাম গুনগুন
করতে থাকে। সিল্কের
লুঙ্গি, হাতা গোটানো
শাদা কুর্তা। বলে, যাক
একটা বাধা পেরোলাম। আমি
তো কিছুই বুঝতে
পারছিনা। একটু পরেই কথা
বসিয়ে গাইতে লাগল তবে
অন্তরাটা, মুখড়া নয়।
আমায় সকালে গানের
কথাগুলো দিয়েছিল, তাই
ধরতে পারলাম।ও বয়সে
আমার চেয়ে অনেকটাই ছোট,
কিন্তু আমি জানি ও
সাধারণ নয়। হি ইজ
সামথিং। এন্ড হি ইজ
গোয়িং ফর সামথিং বিগ....
রণন-২
আমি ঘুমোচ্ছিলাম
বাড়িতে। রাত একটা
প্রায়। ঝড়ের গতিতে ও
এল।
-কি করছিস?
মজা ক’রে বললাম,
ঘুমোচ্ছি!
-ও তাহলে তো হয়েই গেল, চল
নিচে চল কথা আছে...
আমি দেখলাম ছটফট করছে
ও। মানে ভেতরে কিছু আছে,
ওগলাতে না পারলে এরকম
করেই যাবে।ভ্রু
নাচাবে। চশমা বারবার
খুলবে। ঘাড়টাকে
ব্যতিব্যস্ত ক’রে
তুলবে। তো, নেমে এলাম।
নিচে রাখা গাড়িতে
উঠলাম। বলল, তুই
চালা...আমি আমার প্রিয়তম
বন্ধুটিকে এতটাই
চিনতাম যে কিছুটা আঁচ
করতে পেরেছি যে ও কি
করতে চলেছে। ও যখন
সেতার হত, আমি বাজাতাম,
আর আমি সেতার হলে ও ঠিক
সেই তালেই বাজিয়ে দিত,
এমনই ছিল তালমেল
আমাদের! আমি গাড়ি
চালাচ্ছি, মুম্বই রাতে
ঘুমোয়না ঠিকই তবে
ট্র্যাফিক কম থাকে। ও
ড্যাশবোর্ড বাজাচ্ছে।
আমি থামছি না। থামলেই
আউট-অফ-রিদম হয়ে যাবে। ও
গানের কথায় সুর
বসাচ্ছে। আমি কিছু
বলছি। ও বলছে, ঠিক হ্যায়
তো এয়সা কর দুঁ...শধু
থামছি না...ভোরের প্রথম
আলো গাড়ির বনেট ছুঁয়ে
দিতেই গানের শরীর আলোয়
ভেসে উঠল। জন্মালো,
প্রসব যন্ত্রণা পার
করে!
আমি,না-২
গানের শিরা হল সুর আর
কবিতার বিষাদ হল রূপো।
এমনকি শর্ট-এক্সট্রা
কভারে দাঁড়িয়ে গরম
ডিউজ বল তালুবন্দী করার
সময় মনে হত, কবিতা এল,
সুর ফুটলো।পরে যখন
ব্লাস্ট-ফার্নেস
টপকানো সন্ধ্যা এসে
পড়তো চায়ের আড্ডায় আর
খুবসে পিঠ চাপড়ানো চলতো
আজকের নেয়া তুখোড়
ক্যাচের, আমি তখন আমার
‘প্রাইজ ক্যাচে’র কথা
ভাবতাম। সে তো ধরাই
দেয়না। সাইকেলের
ব্রেকশ্যু ক্ষয়ে ক্ষয়ে
প্রায় সেই তখনকার
বাঁশপাতা চিণ্ময় রায়,
তবুও অধরা! আমি বাড়ি
ফেরার পথে গাইতে থাকি,
দ্বীপজ্বলা সন্ধ্যায়/
হৃদয়ের জানালায়/
কান্নার খাঁচা শধু
রেখেছি.....ঠিক মোড়েই
ডানদিকে দিলীপদার
কোয়ার্টার...ঢুকে যাই,
অবাক হ’তে থাকা
দিলীপদাকে আরো অবাক
ক’রে জিগগেস করি, আচ্ছা
মনে পড়ে রুবি রায়/
কবিতায় তোমাকে/ একদিন
কত ক’রে এঁকেছি..এই
গানটা, এটা বেসড অন কোন
রাগ?
দিলীপদা চোখ নাচিয়ে
ব’লে, রুবি রায়? হুমম....বড়
হচ্ছিস তাহলে...ব’লতে
ব’লতে গুনগুন করে,
তারপর বলে, রাগ
কিরওয়ানি....
রণন-৩
খুব সাফ সুতরো ছিলাম
ব’লে আমার জন্মদিনে
ফুলের তোড়ার সঙ্গে
প্যাক করা ঝাড়ু দিয়েছিল
ও। আমি রাগতে গিয়েও
রাগিনি। আমার নিজের
হাজার ব্যস্ততা। তবু,
বোধহয় ভালই লাগত ওর
এইসব ছেলেমানুষী! আমায়
রোজ ফুল পাঠাতো কেউ।
রোজ, নিয়ম ক’রে। প্রেম,
ট্রেম জানিয়ে। রোজই
ফেলে দিতাম। একদিন আমি
ও আর কয়েকজন বসে আছি,
আবার ফুল! আমি রেগে গিয়ে
বললাম, কে জানে কোন গাধা
রোজ আমায় ফুল পাঠিয়ে
সময় নষ্ট করে, সরাও তো
এসব, ডাস্টবিনে ফেলো!
হঠাৎ দেখলাম ওর মুখ
কালো হয়ে গেছে।‘ম’
সাহেব ছিলেন আমাদের
মধ্যে, হাসতে হাসতে
বললেন, আরে এই গাধাটাই
তোমায় রোজ ফুল পাঠায়,
নাও এখন গাধাকে ঘোড়া
বানাও!
আমি,না-৩
মান্না দে, মনে আছে
সেক্টর-১৮’র ইস্পাত
বিদ্যালয়ে এসে গেয়ে
উঠলেন, আও টুইস্ট
করে...আমি তখন আরো ছোট।
‘লাগা চুনরি পে দাগে’র
পরে ‘আও টুইস্ট
করে’...এরপরে ‘টুইস্ট’
শব্দটা ভারতের ষাট
দশকের হাঙ্গামায় ঢুকে
পড়ে। রক্ষণশীল
পরিবারের কোন
জ্যাঠামশায় তো এভাবেও
বলতেন, ছেলেটার
ক্যারেক্টার ভাল নয়,
ভাসানে টুইস্ট ফুইস্ট
নাচে...তো, একটা বিগঠন
চলছিল। ‘মাও’-এর
নাকচাপা মুখের ছবির
ওপরে বন্দুকের ঈশারা
দেয়ালে দেয়ালে, সেরকমই
এক দেয়ালের সাম্নে আমি
প্রায় জীবন বাজী রেখে
ব’লতে যাচ্ছিলাম, রিয়া
আমি তোমায়....তার আগে
রিয়া আমায় থামালো, বলল,
কিছু শুনিস নি?
আমার ভাবাবেগে জল, কারণ
রিয়ার চোখে উপছে পড়ছে
জল!
-কি হয়েছে?
-প্রলয় নেই
-নেই, নেই মানে
-কোয়েলে গিয়েছিল পাড়ার
ছেলেদের সঙ্গে, স্নান
করতে না্মে, চোরাবালিতে
টেনে নিয়েছে...আমি বসে
পড়ি। আমার ক্লাসমেট।
প্রলয় নেই! কালই তো কত
আড্ডা মারলাম। রিয়া
নিজের সাইকেল
স্ট্যান্ড করে, আমার
হাত থেকে পড়ে যাওয়া
সাইকেল ওঠাতে ওঠাতে
বলল, যাবিনা?
সেই প্রথম বন্ধুর
মৃত্যু। নিথর দেহ। জলে
অনেকক্ষণ ছিল ব’লে
ফোলা। সেই প্রথম
কথাহারানো আমার
শবযাত্রা বন্ধুর
মৃতদেহ নিয়ে। প্রলয়
আবার কোয়েলেই আসে। পুড়ে
যায়। আমি বাড়ি ফিরে
আসি। অনেক রাত অবধি
ঘুমোতে পারিনা। একটা
গানের সুর ওই অসম্ভব
বিষাদের ভেতরেও কিভাবে
জানিনা ভেসে উঠছিল,
তেরে বিনা জিন্দেগী মে
কোই স্বীকওয়া নহি/
স্বীকওয়া নহি...
রণন-৩
.......................................
আমরা খান্ডালা যাচ্ছি।
বাইরে মেঘ নেমে আসছে
জলের ফোঁটা হয়।
বাঁ-হাতের আঙুলে
সিগারেট লাগিয়ে গাড়ির
ছাদে তুড়ি মারতে মারতে
বানিয়ে ফেলল সেই গানটা।
খুব বিখ্যাত গান। খুব
হিট্ করেছিল। ঋষি
কাপুর আর নীতু সিং।
আমরা যে গেস্ট-হাউসে
ছিলাম সেবার, সারারাত
বৃষ্টি হয়েছিল আর
সারারাত পঞ্চম রেকর্ড
করেছিল ঝিঁ ঝিঁ’ র
একঘেয়ে ডাক। ওর নামটা
ব’লেই দিলাম এবার। আর
গানটা, ‘খুল্লম খুল্লা
প্যার করেঙ্গে হম
দোনো’। ওই গাড়িতেই
গানটা তৈরি করে বলেছিল,
আশা আজকা গিফ্ট ক্যাসা
লগা? আমি অবাক হয়েই মাঝে
মাঝে ওকে দেখতাম। আমার
স্বামী।প্রবল
খাদ্যরসিক। আনমনা।
বেহিসেবী। আর পুরো
দস্তুর পাগল! নইলে
প্রত্যেকদিন নিজের
বৌকে না-জানিয়ে ফুল
পাঠায় কেউ? আর ঝাড়ু
উপহার দেয় বৌ-এর
জন্মদিনে, আর একটা কথা
সেই যে ‘ম’ বাবুর কথা
বলেছিলাম, তিনি আর কেউ
নন, বিখ্যাত গীতিকার
মজরুহ সুলতানপুরী!
আমি,না-৪
গান নিয়ে আমি কথা বলিই
না। শুনি মাঝে মাঝে।
দিলীপদা ডাকে। সুর
চেনায়। আমি চিনতেই
পারিনা। দেরি হয়ে যায়,
গান তখন তাড়ার মুখে,
চলেছি একা থেকে চলা
যাতা হুঁ...গিয়ে দেখি কেউ
নেই। কেউ আসেনি। পায়ে
পায়ে পাহাড়ের মাথায় চলে
আসি। পুরো রাউরকেলা শহর
আমার চোখের নিচে।
সাম্নের দিকে সেক্টরে
ভাগ করা স্টিল টাউনশিপ,
পেছনে পুরনো রাউরকেলা।
এবার উড়লেই হয়। হাতে
এসে লাগুক প্রপেলারের
গুণ। উড়ি একটু?
রাউরকেলা এক বৃষ্টির
বিকেলে বছর দুয়েক আগে
আমায় হংসধ্বনি
দিয়েছিল। আরেকবার
কিরওয়ানি। পাহাড়ের
মাথায় আজ মেঘের বাসা।
আসছে, আমায় মেখে চ’লে
যাচ্ছে। আমি চাইলেই
তারা থেমে থাকবে না।
আমি কে? রিয়া আসেনি। তো?
মাইরি, এই পাহাড়ের
উঁচুতে এসে আমি না-আসা
রিয়াকে দেখলাম
হংসধ্বনি থেকে মেঘরাগ
হয়ে যাচ্ছে। ও, হংসিনী,
মেরে হংসিনি, কহাঁ উড়
চলি.....আজ রিয়া আসেনি।
কাল ভোরেই রাউরকেলা
ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ওর
বাবা কলকাতায়
ট্রান্সফারড...এবার
নেমে আসছি। গুডবাই,
রিয়া। মেরে আরমানোঁকে
পংখ লগাকে ইয়ুঁহি উড়তে
রহেনা...
রণন-২
সুর তৈরি করা আর গান
তৈরি করা এক জিনিস নয়।
খুব কম লোক এটা বোঝে।
গানের কথাগুলো তোমায়
নিজের ক’রে নিতে হয়।
তার শব্দ, ভাব, সবকিছু।
তাকে পোষ মানাতে হয়।
পালতে হয়। কয়েকঘন্টা
মাত্র নয়, বহুদিন ধরে
তাকে গাইতে হয়, তারপর
গানে প্রাণ আসে। আমি ওর
পিছনে যা বলতাম, আজ সবার
সামনে একই কথা বলছি,
আমার প্রিয়তম বন্ধু
পঞ্চম, বাকি দুনিয়া
যাকে রাহুল দেব বর্মণ
হিসেবে জানে শুধু একজন
মহান সুরস্রষ্টাই
ছিলনা, খুব দক্ষ
কারিগরও ছিল!
সারারাত মুম্বইয়ের
রাস্তায় ঘুরে পঞ্চম
ড্যাশ-বোর্ড বাজাতে
বাজাতে তৈরি করেছিল
‘পরিচয়’-এর সেই বিখ্যাত
গান, ‘মুসাফির হুঁ
ইয়ারোঁ/ না ঘর হ্যায়, না
ঠিকানা...’ আর ভানু
গুপ্তা আপনাদের ঠিকই
বলেছে, এই গানটার
অন্তরায় থাকা ‘মুঝে
চলতে যানা হ্যায় হ্যায়/
ব্যস, চলতে যানা’র সুর
ভানুর বাজানো গিটারের
একটা ধুন থেকে ট্রিগার
করেছিল পঞ্চমকে, বাকিটা
ইতিহাস!
রণন-১
আমি ভানু। ভানু গুপ্তা।
পঞ্চমের গিটারিস্ট।
এবার বলি, পঞ্চমের
আবিষ্কৃত
‘প্যাডেল-মটকা’ প্রথম
ব্যবহার করা হয়,
‘জওয়ানি দিওয়ানি’
ছবিতে, ‘ইয়ে জওয়ানি
হ্যায় দিওয়ানি’
গানটায়। আর ‘একোয়া
সোনিক ওয়াটারফোনে’র
ব্যবহার হয় ‘শোলে’র
সাউন্ডট্র্যাকে।
সেইসব ভয়াবহ শব্দ, মনে
পড়ছে? সেই অন্তরাটা ছিল,
হমে চলতে যানা হ্যায়...এই
প্রথম বোধহয় কোন গানে
মুখড়ার আগে অন্তরার সুর
বসে গেল...আমরা শব্দ ধরতে
বেরোতাম। হিসহিস,
টুপটাপ, ক্যাঁকো, সাঁ
সাঁ, সরররর...এরকম নানা
শব্দ ধরা হত। কাচের
গ্লাস, খোলা জানলায়
বৃষ্টির ছাঁট, শাড়ির
ঘষটানোর শব্দ, ঝাড়ুর
শব্দ, ঝিঁ ঝিঁ,
ক্যানেস্তারা পেটানোর
আওয়াজ...ব’লে শেষ করা
যাবেনা। আর কি
অদ্ভুতভাবেই না
ব্যবহার করতো সে সব!
আমায় বলতো, দুনিয়ার কোন
কিছুই ফেলনা নয় দাদা,
কান না থাকলে ফেলনা মনে
হয়...এভাবেই ‘প্যাডেল
মটকা’র আবিষ্কার
হয়েছিল, মনে আছে তো
গানটা? আর ‘একোয়া সোনিক
ওয়াটারফোনে’র ভারতীয়
সংস্করণ, মনে পড়ছে কোন
ফিল্মে ব্যবহার করা
হয়েছিল? এসবই সেই
জিনিয়াসের মাথা থেকে
বেরনো প্রয়োগ, আমি এবং
আমরা শুধু অবাক হয়ে
দেখতাম!
রণন-২
পঞ্চম, মনে পড়ে, খুব
বৃষ্টি ছিল সেদিন। আর
পাহাড়তলির ফাঁকা
নিস্তব্ধতার
কুয়াশা-চেরা রেললাইন
ছিল, যেমন থাকে
সমান্তরাল। আর সেই
কুয়াশার ভেতরে
পাশাপাশি বসা আমাদের
দুটো আবছা গাছই মনে
হচ্ছিল। আমরা সেই
আবৃতকুয়াশার রেললাইনে
বসে সেই অচেনা না-আসা
একজনের কথা ব’লতে থাকি
যার আসার কথা ছিল
কিন্তু আসতে পারেনি,
আমরা কিন্তু অপেক্ষাই
করছি তার, সময় বয়ে
যাচ্ছে...আমরা ভাবছি
এবার হয়ত সেই ট্রেনটা
সেই লোকটাকে নিয়ে
আসবে....ট্রেন আসেনি। সেও
আসেনি। আর তুই পঞ্চম
এভাবেই এই গুলজারকে
ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পা
রাখলি কুয়াশার ভেতর। ঘন
হয়ে উঠল কুয়াশা তোকে
পেয়ে। তুই হারিয়ে গেলি
সেই কুয়াশায়...আর আমি
অন্য আরেক কুয়াশায় একা
হয়ে গেলাম পঞ্চম,
একেবারে একা হয়ে
গেলাম.......
আমি,না-৫
পঞ্চম নেই। রিয়া নেই।
দুনিয়া আছে। রিয়ার
হারিয়ে যাওয়ায় গেঁথে
আছে পঞ্চমের দেয়া সুর,
মেরা কুছ সামান,
তুমহারে পাস পড়া
হ্যায়...আজ সুরের দিকে
তাকালে একটা বাঁক চোখে
পড়ে। সুর মানে সামগ্রীক
সুরের ইতিহাস নয়। আমি
কে সেখানে? পপুলার
মিউজিকের কথা বলছি।
কিভাবে একটা লোকের
বানানো কম্পোজিশন এখনো
প্রভাবিত করে চলেছে
ভারতের এমন বিশাল
জনপ্রিয় গানের
দুনিয়াকে। আজকের
প্রজন্ম যখন ‘রাধা তেরি
চুনরি..’ শোনে, জানতেই
পারেনা এটা ‘জয় জয় শিব
শঙ্কর’ থেকে নেয়া। আমি
উদাহরণ বাড়াবো না। আমি
বৈচিত্রের কথাও সেভাবে
বলবো না। তবে একথা
বলতেই হবে যে, সে
নিজেকেই ভেঙেছে
বারবার। আর তাই
প্রজন্মবাহিত হয়ে
বেঁচে আছে। ‘১৯৪২, আ লাভ
স্টোরি’ কি সত্যিই তার
জবাব ছিল সেই অপোগণ্ড
ইন্ডাস্ট্রির প্রতি
যারা প্লে-ব্যাক
দুনিয়ার এখনো অবধি
শ্রেষ্ঠ সুরকারকে
প্রাপ্য মর্যাদা দিতে
পারেনি? হতে পারে, আবার
নাও হতে পারে। পঞ্চম,
অর্থাৎ রাহুল দেব বর্মণ
থোড়াই এসবের কেয়ার
করতো?
আমরা করি। আমি তো করিই,
বৃষ্টি হলে এখনো গেয়ে
উঠি, রিমঝিম গিরে
শাঁওন...