নিয়তির নাম সিসিফাস

আসমা অধরা




ঘোরের নাম মা, আর নিয়তির নাম সিসিফাস। মায়ের কথা ভাবলেই মুদে আসা চোখে ভেসে ওঠে ছায়াচিত্র, দুটো বাঘ টেনে ছিঁড়ে নিতে চাচ্ছে মা হরিণের দুইপাশ আর সেই মায়ের রেটিনার রিফ্লেকশন ক্যামেরায়- দুটো হরিণ শাবক দৌড়ে পালাচ্ছে দূরে, এর নাম আত্মত্যাগ, স্ববিসর্জন ; সন্তানের জন্য। আমাদের কান্নায় মিশে থাকে মায়ের জন্য হুতাশ। কি করুন মুখে ঘুমোয় মা, বুক ঠেলে ঠেলে জগদ্দল পাথরের মতন উঠে আসে কান্নারা। দিন দিন পাণ্ডুর হচ্ছে আমার মায়ের মুখ। অদ্ভুত সুন্দর গজদাঁত বের করে হাসতো আমার মা, মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম এক সময়ে, দিন দিন হাসি উবে যায়, কপালে আসে ভাঁজের পর ভাঁজ আর ভয়। বুকের ভেতর তার রক্ত দৌড়োয় না, ব্যাথায় নুয়ে থাকে সারাদিন। আর শুয়ে শুয়ে পড়তে থাকে সুরা, আয়াত, কেরাতসম সুরে কান্না গড়ায় চোখ থেকে গালে। আড়াল থেকে দেখি, দূরে সরে গিয়ে কাঁদি বুকভাঙ্গা গানের মতন বিলাপ। এই সমস্ত অমাকালে, তার চশমার আড়ালে নিষ্প্রভ হতে থাকে দৃষ্টি, প্রতিদিন একটু একটু করে নিভে যাচ্ছে, কমে যাচ্ছে আলো। ছানি পড়ছে আরো মোটা হয়ে। মা কিছু পড়তে গিয়ে চোখ আরো বড় বড় করে দেখতে চায়, চশমার কাঁচ মুছতে থাকে এমন ভাবে যেন কাঁচ পরিষ্কার করলেই সব আগের মতন হয়ে যাবে, পোয়াবারো দিনের মতন উজ্জ্বল। আগের মতো মায়ের বুকের ভেতর মুখ গুঁজে দিয়ে ঘুমাতে পারিনা, আমার মায়ের শাড়ী ভরা কেমন শশা শশা গন্ধ, বুকের ভেতর মুখ চেপে ধরলেই ডাব ডাব গন্ধে বুক ভরে যেত। মা বড় বড় গাল করে মুখের ভেতর ভাত ঠেসে দিতো, তা গেলা তো দূর নাড়্রাতেও পারতাম না। কত কত রাগ, অভিমান জমে থাকে বুকে! তবু বেড়ে ওঠার প্রতিদিনেঠমা একটু করে হয়ে গেছেন তার আত্মজার। খন্ডাংশে ভাগ হয়ে গেছেন স্বামী, পুত্র, কন্যায়। মায়ের আর কি আছে নিজের? শরীরের অনু পরমানু থেকে মাংসপিণ্ড অব্দি বিলিয়ে দেয়া ছাড়া। মাটি দেখে দেখে মায়ের কথা মনে পড়ে, প্রিয় স্বদেশ মা হয়ে গেছে কবে! সর্বংসহা জননী। প্রায়দিন বাবা দুপুরে ফেরার সময় জনাকয় নিয়ে ফিরে খেতে বসেছে, ভাবেনি আমার মায়ের জন্য সামান্য কিছু পড়ে রইলো কিনা, ভাই তার বন্ধুবান্ধ ব নিয়ে খেয়ে গেছে, মুখ শুকিয়ে ঘুরেছে কেবল আম্মা। অথচ বড় টুকরো গুলো ভাগ করে দিয়েও নিজের পাতের ছোট খাটো টুকরো থেকেও বাবাকে, ছেলেকে ভাগ করে দিতে দেখে দেখে শিখেছি এটাই নিয়ম। কখনো কেউ হাতে করে আম্মার জন্য কিচ্ছু আনেনি, অথচ বাজারের টাকা বাঁচিয়ে এর জন্য শার্ট, তার জন্য স্যান্ডেল, তার জন্য কাপড় দেয়াই অলিখিত নিয়ম মায়ের। এই মা নামের ঘোর কাটেনা, ঘোরের ভেতর থেকে দেখি দাউদাউ আগুনে জ্বলছে মা, বিকৃত হয়ে যাচ্ছে মুখের রেখা, শব্দ করা বারণ। আপত্তি করা বারণ, আপত্তি তোলা বারণ, একদিন ছুটি বারণ। সেই আগুনে এক আঁজল জল ঢালতে গিয়ে দেখি পুরোই পুড়ে গেছে মা, খসে পড়ছে চামড়া, গলে যাচ্ছে চোখ, চুল। নিয়তি মানাই যদি নিয়ম তবে মা ক্যান চেয়ে থাকে আকাশের দিকে অমন, আকাশ তো নেমে আসেনা কোনোদিন। জীয়ল পাথরের মতন আয়তনে না বেড়ে মা শুকিয়ে যায়, মায়ের চোখ আরো ঝাপসা হয়, মায়ের চামড়া প্রতিদিন কুচকে যায়, মায়ের শিরা সেই শীর্ণ হাত ভেদ করে যেন তার ডালপালা সমেত বটগাছের মতন ছড়াতে চায় শেকড় তার পুরো অস্তিত্ব জুড়েই। জীবন জুড়ে হীরণ্ময় আলোর সে, সে উদাত্ত আহ্বান, সে ধ্যানস্থ পাহাড়, ঝুম বৃষ্টির দিন। আমি সেই আলোর ক্ষুদ্র কণা, উদার আহ্বানের সামান্য ইশারা, ধ্যানমগ্ন পাহাড়ের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়া নুড়িপাথর মাত্র এক, হয়তো ক্ষণিক শিশির, যে পৃথিবীসম এই বিশাল ছায়ার নিচে কম্পিত বিন্দুর ধারনা মাত্র।