“ এমন মানুষ এখানেই আছে
গিরগিটি হিজ নেম’
তাঁরই আছে ভাই অদৃশ্য
লেজ ফোল্ডিং সিস্টেম ...”
হিহি ... হিহি ... হিহি ...
হেসে গড়িয়ে পড়ছে মিঠেল।
লেজ আবার ফোল্ডিং
সিস্টেম ! কি যে লেখে
বাবাটা হি হি হি ...
প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়
বাবাকে -
- মানে কি গো বাবা ? ঐ যে
মেলাতে এখন যেমন লাল
লাল আলো জ্বলে শিঙ
পাওয়া যায় ... ঐ রকম ?
হেয়ার ব্যান্ডের মতো
খোলাপরা করা যায় ?
বাবা তাকিয়ে থাকে
মিঠেলের দিকে। বেচারি
বাবা আটকে আছে
গিরগিটিতে ... কিছুতেই মন
থেকে সরাতে পারছে না রং
বদলের মানুষ আর সময়
বিশেষে দৃশ্যমান তার
লেজের উপস্থিতি ... অথচ
চাইছে ... প্রাণপণ চাইছে
মিঠেলের চোখের দিকে
তাকিয়ে হারিয়ে যেতে ...
ওর সাথে এই খিলখিলে
গড়িয়ে যেতে ... বাবার
লেখা থেকে খুশিতে উপছে
পড়ছে মেয়ে ,বাবা পারছে
না ... কিছুতেই পারছে না ...
বাবা বোবা হয়ে গেছে
কারণ বড় হয়ে গেছে যে ,
শুধু বড় নয় ...বড্ড বড় হয়ে
গেছে বাবা ...
অথচ বাবা হতেই তো
চেয়েছিলো অনি , কেউ মানা
করবে না, ইচ্ছেমতো ঘর
থেকে কাজ আছে বলে
বেরিয়ে যাবে , ইচ্ছে মতো
লজেন্স কিনে খেয়ে নেবে।
কেউ পেটে কৃমির ভয়
দ্যাখাবে না... না তখন
অনি নয় তখন তো পাপান ছিল
সে । দস্যিপনা করলে মা
আদর করে বলতো – “হনুমান
কোথাকার” আর রেগে গেলে
আসে পাশে ছড়ি খুঁজতো আর
বলতো – “দাঁড়া বাঁদরামো
বের করছি” কিন্তু কি
আশ্চর্য, হনুমানই হোক
কিংবা বাঁদর, লেজ নিয়ে
এতটুকু মাথা ব্যথা ছিল
না তখন । তাই কি এতদিন পর
এই লেজের অনুসন্ধান ? এই
বড় হয়ে ? আসলে বোঝেইনি
বড় হওয়া মানে অবাধ পেয়ে
যাওয়া নয়... বড় হওয়া মানে
তার একটা ছোটবেলা থাকে
... যেটা হারিয়ে গেলে বড়
হওয়া যায় বা হারিয়েই
বোঝা যায় শৈশব কথাটার
মানে আর তার অবাধ
বিচরণ।
আর এভাবেই হারিয়ে যাওয়া
বুঝতে বুঝতেই যুঝতে
শেখা। যেভাবে বৃষ্টির
পরে জানলার রডে সারি
বেঁধে ঝুলতে থাকা জলের
ফোঁটা গুলিকে বেশ ফুঁ
দিয়ে ফেলে দেওয়ার পরেই
ঐ কাঁচের মতো চকচকে
ফোঁটাগুলোর জন্য ভীষন
মন খারাপ হতো । উড়তে
থাকা বুদবুদকেও লাফিয়ে
ফাটিয়ে দিয়ে আহা কি বীর
পুঙ্গব। সব কিছুকেই
সঙ্গী বানিয়ে ফ্যালার
অদ্ভুত ম্যাজিক ছিল তখন
সেই বয়েসে। সন্ধ্যার
পরে রাস্তায় বেরোলে মা
হাত ধরে থাকতো এই ল্যাজ
কাটা হনুমানের কারন তার
চোখ থাকতো চাঁদের দিকে
... যেদিকেই যেতো চাঁদটাও
তার সঙ্গে সঙ্গে যেতো ...
মেঘ থাকলে লুকোচুরিটা
আর বেশি জমতো আর
তক্ষুনি মায়ের ঝাঁকুনি
– “আরে অইই উদো রাস্তা
দেখে চল”। রাস্তা দেখে
চল্লেও কি সঠিক পথে
যাওয়া যায় গো মা সব সময় ?
অথবা প্রখর আলোতেও কি
সঠিক রাস্তা বোঝা যায় ?
আলোও তো ঘুরিয়ে দেওয়ার
ক্ষমতা ছিল তখন। একটা
আয়না নিয়ে সটান রোদে আর
তারপর রোদ নেচে বেরাতো
দুষ্টুমির তালে তালে...
কখনো বোনের মুখে কখনো
মায়ের... শুধু আলো নয় সব
বকাবকিগূলো আয়নায়
ধাক্কা খেয়ে চলে যেত
অন্য দিকে... এই আয়না
বস্তুটি একটা আশ্চর্য
ছেলেখালার বস্তু যাতে
কতবার দেখার চেষ্টা
লেগে আছে যে ঘুমোলে
ক্যামন দেখতে লাগে...
কতবার তো জামার একদিকের
হাতায় হাত না গলিয়ে হাত
না থাকার মধ্যেও একটা
মজা খুঁজে পাওয়া যেতো ...
একমাত্র আয়নাই জানে একা
একা কতরকম মুখ
ভ্যাংচানো যায় এবং তার
নিষ্ঠাসহ অনুশীলনগুলি
... আয়নার দৌলতে জেনে
ফেলা জিভের বিশেষ
কার্যকারীতা -
“ওরে খোকা বল দেখি –
জিভে তোর কি কি কাজ
না হলে কপালে তোর খাওয়া
জুটবে না আজ
খোকা বলে – তিন কাজ, একে
করি বকবক
দুয়ে জিভে চেখে দেখি
ঝাল নুন নাকি টক
তিনে করি দুষ্টুমি আমি
যদি রেগে যাই
জিভ ভ্যাংচাতে হলে
জিভটাতো আগে চাই ”
তার উপর ছিল আয়নার ডান
বামের গণ্ডগোল ...এই দিক
পরিবর্তনএ কে যে কখন
কোথায় সেটা বোঝাটা যে
খুব মুস্কিল। ধাপ্পা
খেতে খেতে... দরজার আড়াল
থেকে ধাপ্পা দিয়ে
হনুমান যখন ক্রমশ
শ্রীমান হওয়ার পথে তখন
একটু একটু রাগের সাথে
সখ্যতা হল । একটু একটু
অভিমান ... একেবারে
চুপিচুপি ... বন্ধুরা
পয়সা নিয়ে আসে এটাওটা
কিনে খায় ওকেও দেয় তবু ও
তো কিনে খাওয়াতে পারে
না কাউকে ... বাবা
বিভিন্ন জায়গায় পরিচয়
করিয়ে দেয় –‘এই হল আমার
শ্রীমান...” কিন্তু হাতে
পয়সাই দেয় না ধুর ...
বন্ধুদের ছবি এঁকে দিয়ে
গল্প শুনিয়ে কথায়
কাহাঁতক পটিয়ে রাখা যায়
... এমন কি টিফিন টাইমে
খেলার বলটাও ওর, সবাই
খেলে ... কি আর করবে। তবু
যেদিন হাবু ওকে লুকিয়ে
একা একা আলুকাব্লিটা
খেয়ে নিল উফফফ ভীষণ
প্রেস্টিজে লেগেছিল
ওর। আগে জানলে ওর
সামনেই যেতো না ও ।
বুঝতে পারেনি তাই পিছন
থেকে ডেকে ফেলেছিল। তবে
হাবু ওকে দেখে ঘাবড়ে
গিয়ে দিতে এসেছিলো বটে
কিন্তু ও খায়নি অথচ
হাবুর হাতের কাজটা
পুরোটাই বানিয়ে
দিয়েছিল ও । ওর নিজের
হাতের কাজটা বরং অত
সুন্দর হয়নি আর সেই
হাবু ... ওর প্রিয় বন্ধু
কিনা ... ... এই প্রথম
ক্ষতের পরিচয় । তাই কি
মানুষের রং নিয়ে
ধোঁয়াশা কাটিয়ে উঠতে
পারেনি আজও ... কিন্তু
শ্রীমান গোপনে গোপনে
মূর্তিমান হয়ে উঠলো
নিশ্চুপে ... একটা লুকোনো
খাতা ছিল, তার পাতায়
পাতায় আরও কিছু ভীষণ
লুকোনো কথা ... ঠিক
এইভাবে ...
“বাঃ ... বাঃ ... বেশ একা
খেয়ে নিলি ঝাল ঝাল আলু
কাবলি
তখন কি আর আমার কথাটা
একটুও তুই ভাবলি ?
সত্যি রে ভাই তোর মতো এই
ছেলে পাওয়াটাই রেয়ার
যেই হাতে পেলো একা একা
খেলো আমাকে থোড়াই কেয়ার
!
দাঁড়া না রে দাঁড়া মা-কে
বলে দেব হ্যাংলারে
কোথাকার
তোর সঙ্গেও আজ থেকে আড়ি
বলব না কথা আর ”
এত কষ্টের পরে অগত্যা
মা-র কাছেই আশ্রয়
অভিযোগ ছাড়া আর কোথায়
যাওয়া যায় তাও বুঝতে
পারে নি ও। শুধু বুঝেছে
বন্ধু পাতানো ভাই
পাতানো সই পাতানো এসবের
পিছনে যে কি রহস্য জনক
টান থাকে তার জন্য মন
ছাড়া আর কিছু লাগে না ...
সেদিনো তো কেঁদেই
ফেলেছিল ও... ধনঞ্জয়ের
জন্য ... ধনঞ্জয় বাড়ি চলে
যাচ্ছে। ধনঞ্জয় ঢাঁকির
ছেলে দামিন্যা থেকে
এসেছিল বাবার সাথে
কাঁসি বাজাতে । একটা
ছেঁড়া জামা হাফ
প্যান্ট আর খালি পা তবু
সেবারের দূর্গা পুজোয়
ওদের দুজনকেই একসাথে
দেখেছে সবাই ... ঐ এক
সপ্তাহের পরিচয় অথচ
কতদিনের চেনা । সেবারও
কিন্তু মা ওর কথা ভেবেই
ধনঞ্জয়কে বাড়িতে এনে
ভাত খাইয়েছিল এখনও মনে
পরে কি যে আনন্দ হয়েছিল
ওর ... মা কে সেদিন সত্যিই
দূগগাঠাকুর মনে হয়েছিল
পাপানের ... না হলে ওর
মনের কথা জানতে পারল কি
করে মা ... মা রা বোধহয় সব
জানে ...
এই যে স্কুলের বন্ধু...
পাড়াতুতো বন্ধু ...
ধনঞ্জয়কে কার মধ্যে
রাখবে ও ? না কারোর মধ্যে
রাখতে পারেনি পারবেও না
কোনোদিন।আসলে এই
তুতোগুলি সম্পর্কএর
ছুঁতো ছাড়া কিছু নয় ।
কিছু দুষ্টুমি উঠে আসে
অনির ছড়ার খাতায় -
“ তুইও আমার মাসতুতো
ভাই , খেলব দুজন চল
টুকাই বলে - ভাই
পাতালি ! ফন্দীটা কি বল
?
ফন্দী টন্দি নয়রে
বাবা, ভুল বলিনি মোটে
একটু ভেবে দেখতে
পারিস কেন যে যাস চোটে
নাই বা হলি মাসির ছেলে
তাতে কি যায় আসে ?
দুই জনারই জন্মটা ঠিক
দ্যাখ না একই মাসে
তাই তো আমরা
‘মাস’-তুতো ভাই হিসেবটা
কি ভুল ?
সত্যি ভাই রে পাক্কা
হিসেব দারু্ণ বিউটি
ফুল।”
হা হা হা এসব ভাবলে
হাসিই পায় অনির। আর
সম্পর্কের হিসেব
দ্যাখে না অনি।
ছোটবেলাটা সকলেরই এমন
স্বপ্নের সিন্দুক।
খুল্লেই মার্বেলের
গুলি, ঘুড়িলাটাই,
লাট্টু লেত্তিগুলোর
সাথে বেরিয়ে আসে কিছু
ঝগড়াঝাঁটি, কিছু
খুনসুটি... তার ভিতর
থেকেই খুঁজে নেওয়া যে
যার মত রাস্তা ঘাট ।
সমস্ত ক্লান্তির
গলিঘুঁজি পেরিয়ে অফিস
থেকে অনি ফিরে এলে
মিঠেল বলে –
- তোমরা টেব্ল্ পড়েছো
বাবা ?
- হ্যাঁ তবে আমরা নামতা
বলতাম, ধারাপাত বই থেকে
সকালে উঠে বাসি বিছানায়
জোরে জোরে দুলে দুলে
পড়তে হতো – এক এক্কে এক...
দুই এক্কে দুই ... তিন
এক্কে তিন ...
- ওমা এটা তো বাবা তোমার
ঐ মজার ছড়াটার মতো ... ... ঐ
কি যেন নামতার মত চিমটি
কাটি... দাঁত কপাটি ...
- হা হা হা হা ... অগত্যা ওই
হাবিজাবি ছড়াটা
o – “ চিমড়ে ছড়ায় চিমটি
কাটি
পিঁপড়ে মেরে দাঁত
কপাটি
গা ঠক ঠক গোল্লা চোখ
তেল চকচক তোল্লা হোক
আয়রে তবে
ফুলের টবে
জল ঢেলে যাই
প্রাণ খুলে গাই
খেয়াল খোলা পাগলা ভোলা
কানমলা আর বেনিয়াটোলা
দে উড়িয়ে
সব গুঁড়িয়ে
সব পুড়িয়ে
সুরসুরিয়ে
তাও না পারিস হোঁচোট
খা
মচকিয়ে তোর ভাঙুক পা
ভীষণ জ্বরে পুরুক গা
দিন পনেরো চেঞ্জে যা –
হা হা হা অনি আর মিঠেল
একসাথে হেসে ওঠে । হঠাৎ
মিঠেল এক দৌড়ে চলে যায়
ভিতরে। খানিকক্ষণ পড়ে
ফিরে আসে হাতে একটা রোল
পাকানো কাগজ পিছনে
লুকিয়ে রেখেছে ...– কীরে
ওটা ?
- তোমার জন্য একটা
সারপ্রাইজ আছে বাবা ।
চোখ বন্ধ করো
চোখ বন্ধ করতেই কাগজটা
খুলে অনির হাতে দিল
মিঠেল আর অনি চোখ
খুলেতেই হারিয়ে গেল
একটা রঙের মেহেফিলে ...
হলুদ কমলা মিশিয়ে কি
একটা ইন্দ্রজালের ছবি ...
চমকে উঠল অনি... এটা কি ?
এটা কীসের ছবি এঁকেছিস ?
- আমার ইচ্ছের
- মানে? বাড়ি গাড়ি পাখি
ফুল এগুলোরই তো ছবি হয়...
সবাই আঁকে ...
- না তুমি ইচ্ছে মতো পাখি
ফুল আকাশ নিয়ে ছড়া
কবিতা লিখে দিতে পারো
আর আমি ইচ্ছে মতো রংকে
মিশিয়ে দিতে পারব না?
এটা আমার ইচ্ছের ছবি ...
এটা আমার ইচ্ছের রং ...
অনি থমকে যায় ... একি
শুনছে সে ... একি মিঠেল ... এ
কি ওর মেয়ে ... ওর
উত্তরসূরি ...
অনি হারিয়ে যেতে থাকে...
অনি হালকা হয়ে ভাসতে
থাকে ... মিঠেলের ইচ্ছের
রঙিন পালকে তার
উন্মুক্ত উড়ান ...
মিঠেলের ভিতরে তার
হারিয়ে যাওয়া দিগন্ত
বিস্তৃত রং মহলের
ঠিকানা ... অনি দুলতে
থাকে ... সামনে সাত বছরের
মিঠেল না সাঁইত্রিস
বছরের অনি ... কে প্রকৃত
বড় ...কার ডানায় সীমাহীন
উড়ানের রং... অনি কি
অস্তিত্ব রক্ষায়
বিপন্ন নাকি চূড়ান্ত
সফল অনি বুঝতে পারে না ...
শুধু জানে এভাবেই তার
ছড়ায় ছন্দে রং খুঁজে
পাক মিঠেলরা... শুধু জানে
তার এই –
“ ছড়ার জন্য তন্নতন্ন
স্বর্গ মর্ত্য পাতাল
সকাল সন্ধ্যে ছড়ার
ছন্দে কাহারবা না
ত্রিতাল ।।
অন্তমিলে জড়িয়ে দিলে
রঙিন মজার রাংতা
ঘরোয়া ছড়াও বেপরোয়া
–“ম্যায় সব কুছ জান্তা”
।।
দিতেই পারো একটু আরো
খুশির প্যালেটে রং
কান্নাকাটি দিলেই মাটি
নট গুড ভেরি র ।।
আদর খানিক দাও মিশিয়ে
পাহাড়, নদী, বন
ছড়ায় ছড়িং ইচ্ছে ফড়িং
যখন যা চায় মন
চন্দ্র সূর্যে ভরপুর যে
আকাশ নীলের হাসি
ছড়ার ডানা নেই সীমানা
উড়তে ভালোবাসি
উড়লে হাওয়ায় বন্ধু
পাতায় গাছ, ফুল, মেঘ,
পাখি
ছড়ায় ছড়িয়ে ছোট্টবেলা
সক্কলে পুষে রাখি ।
সত্যিই সক্কলে পুষে
রাখি আমাদের আদরের
সিন্দুকে আমাদের
ছোটবেলা... আমাদের
যক্ষের ধন ... সেখানে অনি
শুধু অনির্বাণ নয় ... অনি
মানে ... অনিরুদ্ধ,
অনিকেত ... অনিমেষ ... অনি
মানে যে কেউ ...
ডানায়