নতুন ফ্ল্যাটে এসে দাদু
ঝিমলিকে বলেছিল, ‘জানিস
ঝিমলি এই ফ্ল্যাটটা এখন
যেখানে আছে, আগে এখানে
এমন জঙ্গল ছিল যে দিনের
বেলায় শিয়াল ডাকতো’।
ঝিমলির বিশ্বাস হয় নি,
‘যাঃ এমনটা হয় নাকি?’
দাদু সত্যির উপর জোর
খাটিয়ে বলেছিল, ‘সত্যি
– সত্যি – সত্যি’। দাদু
আরও বলেছিল,
‘চন্দ্রবোড়া, কেউটে
কতরকম সাপ ছিল। এখন
যেখানে তোদের সুইমিং
পুল হয়েছে ওটা তো ছিল
নেকড়েটার বাসা। ডালে
ডালে হনুমান, হুফ হুফ
করে বেড়াতো। গাছের
কোটরে কোটরে কাঠবিড়ালি
থাকতো। সে এক সাংঘাতিক
ব্যাপার’।
ঝিমলি জানলা দিয়ে একবার
বাইরে তাকায়। কোথায়
জঙ্গল, গাছ, চারিদিকে
মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে
আছে তাদের উত্তরা
আবাসন। ঝিমলি ঠোঁট
উল্টে দিয়ে বলে, ‘ধ্যাৎ
তুমি বানিয়ে বানিয়ে
বলছ। তুমি নিজে চোখে
দেখেছো?’
দাদু এবার একটু ঘাড়
নেড়ে বলে, ‘না, আমি সবটা
দেখি নি। তবে আমার দাদু
দেখেছে এবং শুনেছে এই
জায়গায় শিয়াল ডাকছে’।
দাদুর কথাটা ঝিমলি
পুরোটা বিশ্বাসও করে
নি। আবার উড়িয়ে দিতেও
পারে নি। তাই রাত্রে
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে
তাদের খাঁচায় রাখা
টিয়াটার দিকে তাকিয়ে
ভাবছিল – ইস্ত্রিওয়ালা
দর্জি কি বলতে পারবে
একথা সত্যি কিনা। দর্জি
ভুটিয়ার দেশ পাহাড়ে। সে
কি এক কারণে সমতলে
নেমেছিল আর ফিরে যাওয়া
হয় নি। দর্জি অনেক খবর
রাখে। পাহাড়ের খাঁজে
খাঁজে হরেক মজা – হরেক
বিপদের কথা। ঝিমলির মনে
আবার সংশয় দোলা দেয় – সে
তো সব পাহাড়ের কথা,
সমতলের খবর দর্জি কি
জানি জানবে কিনা।
রাত্রে বিছানায় শুয়েও
তার মাথা থেকে ভাবনাটা
যায় না। দাদু যা বলল তা
যদি সত্যি হয়ে যায় কেমন
হবে ব্যাপারটা। উঃ
ভাবতেই অন্ধকারে
ঝিমলির গায়ে কাঁটা দিয়ে
ওঠে। নিজেকে কেমন জঙ্গল
বুকের মুঙলির মতো মনে
হয়। এইসব ভাবতে ভাবতেই
ঘুমের দেশের ঘুম পরীরা
তাকে যে কখন ডেকে নিয়ে
যায় সে আর টের পায় না।
ঘুমের মধ্যেই সে একটা
স্বপ্ন দেখে – স্বপ্নের
মধ্যে হুফ হুফ করে
ছাদের উপর শব্দ শুনতে
পায়। ঘুমের দেশেই ঝিমলি
স্বপ্নের মধ্যে যেন
আস্তে আস্তে পায়ে পায়ে
হেঁটে ছাদে আসে।
চারিদিকে তাকিয়ে সে
অবাক হয়ে যায় –
বিস্ময়ের সীমা থাকে না।
চারিদিকে আকাশছোঁয়া
উঁচু উঁচু বাড়িগুলো
কোথায় গেল – এ তো শুধু
জঙ্গল আর জঙ্গল। বট,
অশ্বত্থ, শিমূল, পলাশের
সঙ্গে কত ছোটো গাছ যে
তার ঠিক নেই। চোখ বড়ো
বড়ো করে দেখে ঝিমলি
ছাদের কার্নিশে বসে
কুঁদো হনুটা লেজ
দোলাচ্ছে। আর মাঝে মাঝে
হুফ হুফ করে শব্দ করছে।
ডানদিকে তাকাতেই ঝিমলি
এবার সত্যি সত্যি ভয়
পেয়ে যায় – চন্দ্রবোড়া
তার সুন্দরী, সর্পিল
দেহটাকে নিয়ে হিস হিস
করছে। তার পাশে ধূর্ত
মুখের শিয়ালটাও আছে।
জলের ট্যাঙ্কির মাথায়
নাম না জানা তিন চারটে
পাখিও কিচিরমিচির
করছে। ঝিমলির কৌতূহলের
বাঁধ ভেঙে যায় – সে
জিজ্ঞাসা করে, ‘তোমরা
সব কোথা থেকে এলে গো?’
পালের গোদা হনুটাই
এক্কেবারে ঝিমলির
পায়ের কাছে হুম করে লাফ
দিয়ে এসে বসে। হনুর
দেখাদেখি শিয়াল,
চন্দ্রবোড়া, পাখিগুলো
আর যাকে এতক্ষণ ঝিমলি
খেয়ালই করে নি – সেই
পুঁচকে কাঠবিড়ালি সেও
তুরতুর করে এসে ঝিমলির
কোলের কাছটিতে বসে।
ঝিমলি আবার জিজ্ঞাসা
করে, ‘তোমরা কোত্থেকে
এলে ভাই? দাদু যে বলেছিল
তোমাদের মধ্যে নেকড়েও
ছিল’।
হনু একটু ঘাড় দুলিয়ে
বলে, ‘আমরা তো এখানেই
ছিলাম। আর নেকড়ে? তার
কথা জিজ্ঞাসা করো না।
তার কথা মনে পড়লেই চোখে
জল চলে আসে’।
যেই না হনু এই কথা বলল,
অমনি চন্দ্রবোড়া, পাখি,
কাঠবিড়ালি, শিয়াল
সক্কলে মিলে ফ্যাচ
ফ্যাচ করে চোখ মুছতে
থাকে। ঝিমলি ব্যস্ত হয়ে
তাদের থামায়, ‘থাক থাক
নেকড়ের কথা তোমাদের
বলতে হবে না’।
শিয়াল এবার হুক্কা হুয়া
ডাক ছেড়ে গলাটা
পরিষ্কার করে নিয়ে বলে,
‘কিন্তু ঝিমলি সোনা,
আমরা যে এতদিন আমাদের
কথা কাউকে বলতে পারি
নি। তুমি না শুনলে হবে
কেমন করে’।
ঝিমলি এবার বলে, ‘বেশ
তাহলে বল শুনছি’।
হনু বলতে শুরু করে,
‘অনেক অনেকদিন আগে
এখানে জঙ্গলে ভরে ছিল
জায়গাটা। আমরা সকলে খুব
মিলেমিশে না হলেও
থাকতাম একরকম। একদিন
নেকড়েটা কোথা থেকে এসে
হাজির হল। সে যে জঙ্গলে
থাকতো সেই জঙ্গল নাকি
মানুষ কেটে কেটে সাফ
করে ফেলেছে। ব্যাস
নেকড়ে রোজই আমাদের
মধ্যে থেকে কাউকে না
কাউকে খেতে লাগলো। চিতল
হরিণের বংশ তো নেকড়ে
একাই নির্বংশ করে
দিল’।
ঝিমলি এবার হনুকে
থামিয়ে দেয়, ‘তাহলে
তোমরা নেকড়ের জন্য কষ্ট
পাচ্ছ কেন?’
কাঠবিড়ালি এবার তার
মিহিন গলায় বলে, ‘আহা
এখনও তো ভোর হতে দেরী
আছে। বাকিটা শোনই না
ঝিমলি রানী’।
ঝিমলি আবার স্থির হয়ে
বসে, ‘ঠিক আছে বল’।
হনু আবার শুরু করে,
‘নেকড়ের জ্বালায়
অতিষ্ঠ হয়ে একদিন যখন
দিনের বেলা নেকড়ে পিপুল
গাছটার নীচে মহাসুখে
দিবানিদ্রা দিচ্ছিল,
তখন আর সব পশুরা মিলে
মিটিং করলাম। মিটিং-এ
সিদ্ধান্ত হল গ্রামের
মানুষকে নেকড়ের
বিরুদ্ধে জানানো হবে’।
একটানা অনেকক্ষণ বলে
হনু হাফিয়ে ওঠে।
শিয়ালকে উদ্দেশ্য করে
বলে, ‘এবার তুই বল না
ভাই’।
শিয়াল ফ্যাসফ্যাসে
গলায় বলে ওঠে, ‘জানো
ঝিমলি রানী তারপর কি হল,
সেই মানুষগুলো আরও অনেক
মানুষের সঙ্গে কি সব
পরামর্শ করলো। তারপর
দলে দলে মানুষ এসে
গাছগুলোকে কি
নির্মমভাবে কেটে নিয়ে
যেতে লাগলো। কেউ কেউ
আমাদের মধ্যে পালাতে
পারলো, কেউ কেউ খাবারের
অভাবে শুকিয়ে শুকিয়ে
প্রাণত্যাগ করলো।
টিয়াগুলোকে জাল দিয়ে
মানুষগুলো ধরে নিয়ে
গিয়ে খাঁচায় ভরে রাখল
আর নেকড়ে যাকে কেন্দ্র
করে এত কাণ্ড তাকে
মানুষরা ঘুমপাড়ানি
বন্দুক দিয়ে গুলি করে
ঘুম পাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে
চিড়িয়াখানার খাঁচায়
রেখে দিল। সেই অহংকারী
দাপুটে তেজস্বী নেকড়ে
খাঁচার ভিতর কেঁচো হয়ে
পড়ে থাকে। মরা-পচা মাংস
খেতে দেয়। খিদের জ্বালা
যখন আর সহ্য করতে পারে
না তখন বাধ্য হয়ে একটু
একটু খায় আর ঝিম মেরে
পড়ে থাকে’।
হনু একটা দীর্ঘশ্বাস
ফেলে বলে, ‘জানো ঝিমলি
ভাই, নেকড়ে দেখে
মানুষেরা মজা পায়, মুখ
ভ্যাংচায়। আমরা
ভেবেছিলাম মানুষ
বুদ্ধিমান প্রাণী সে
একটা সঠিক ব্যবস্থা
করবে’।
পাখিগুলো ডানা ঝাপটিয়ে
তড়বড় করে ওঠে, ‘হনু হনু
ভোর হয়ে আসছে, ঝিমলিকে
আসল কথাটা বল’।
হনু তখন এক লাফ দিয়ে
কার্নিশে উঠে বসে,
‘তুমি আমাদের একটা কাজ
করে দেবে?’
ঝিমলির খুব মন খারাপ
হয়ে যায়। সে বলে, ‘এখনই
চলে যাবে তোমরা? বল কি
কাজ’।
‘বিধানসভায় আমাদের হয়ে
চিঠি লিখে দেবে? কোথাও
জলা-জঙ্গল নষ্ট করে
মানুষ যেন ইমারত না
বানায়’, আনন্দে হুফ হুফ
করে লাফ দেয় হনু।
শিয়াল গলার শির ফুলিয়ে
ডেকে ওঠে। কাঠবিড়ালি
কিচকিচ করে কত কি যে বলে
যায়। চন্দ্রবোড়া ফণা
নামিয়ে কৃতজ্ঞতা
জানায়। আর সব কিছুকে
ছাপিয়ে ঝিমলি শুনতে
পায়, মা চীৎকার করছে,
‘ঝিমলি কটা বাজে? তুই
পড়তে বসবি কখন? ঘুম আর
ভাঙছে না। কুম্ভকর্ণ
হয়ে গেলি নাকি?’
ধরমর করে উঠে বসে
ঝিমলি। চোখ কচলে অবাক
হয়ে যায়। আপন মনে
বিড়বিড় করে, ‘আরে ওরা সব
গেল কোথায়?’
সকালবেলা দাদুর কাছে
পড়তে বসে ফিসফিস করে
বলে, ‘দাদু, বিধানসভায়
চিঠি পাঠাতে গেলে কি
করতে হয় গো?’
দাদু ঝিমলির কথায় হো হো
করে হেসে ওঠে।
রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে
বলে, ‘বৌমা ঝিমলি কি
বলছে শোনো। বিধানসভায়
চিঠি পাঠানো যায় কি
করে!’
ঝিমলির বাবা সেভ
করছিলেন। মুখ ভর্তী
ফেনা। সেই অবস্থায় উনি
বলেন, ‘ওকে বলো দু’কান
ধরে নীলডাউন হয়ে থাকলে
বিধানসভায় চিঠি চলে
যায়’।
দাদু, বাবা, মা তিনজনের
হাসির শব্দে ব্যালকনির
খাঁচায় রাখা টিয়াটা
ডানা ঝাপটিয়ে ডেকে ওঠে।
অজানা এক কষ্টে ঝিমলির
দু’চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে।
মনে মনে সে প্রতিজ্ঞা
করে - বিধানসভায় এখনই
চিঠি না পাঠাতে পারলেও
টিয়াটার খাঁচার দরজা
খুলে একদিন জঙ্গলের পথে
উড়িয়ে দেবেই দেবে।