বাওরাল। নামটা শুনলেই
কেমন বাওয়াল বাওয়াল মনে
হয়। বাঙালীর মনে হয় বলা
উচিত। এক ভাষা থেকে
অন্য ভাষায় শব্দের এই
ভেঙে যাওয়া, ঠুকরে
যাওয়া, ঠিকরে গিয়ে ভেসে
ওঠা, মনোরঞ্জক এক
পর্যবেক্ষণের জন্ম
দেয়। নিখিলের
ক্ষেত্রেও এর
ব্যতিক্রম হয়নি।
বাওরাল অস্ট্রেলিয়া
মহাদেশের নিউ সাউথ
ওয়েল্স এলাকার একটি
শান্ত ছোটখাটো
টাউনশিপ। সিডনী থেকে
একবার ট্রেন বদল করে
ঘন্টা দুয়েকের জার্নি।
নিখিল একটা রোববার দেখে
রওনা দিল। এই শহরেই
কেটেছিল স্যার ডন
ব্র্যাডম্যানের
ছোটবেলা। নিখিল একে
ভারতীয়, তায় হুজুগে
বাঙালী। ক্রিকেট তো
ওপিয়াম, ভারতে, বাংলায়।
লোকে কি বলবে এমন
ঐতিহাসিক জায়গায় না
গেলে? স্যার ডনের নামে
ওভাল এবং মিউজিয়াম
রয়েছে বাওরালে। তারাই
আপাতত গন্তব্য।
জায়গাটা অবশ্য শীতে
টিউলিপ ফেস্টিভালের
জন্যও বেশ বিখ্যাত।
করবেট গার্ডেনে টিউলিপ
ফুলের ভিড় দেখতে
মানুষের ঢল নামে,
শুনেছে সে। এখন
ফেব্রুয়ারীর কাঠ-ফাটা
গরমে সে গুড়ে বালি।
হাঁটতে হাঁটতে করবেট
গার্ডেনকে বেশ ছোট মনে
হল নিখিলের। হয়ত নামের
মধ্যে যে রোমাঞ্চকর জিম
করবেটীয় ইঙ্গিত ছিল,
উসপে খরা নহি উতরা।
আবার নাম! নামকরণের
সার্থকতা! গুগল ম্যাপ
দেখতে দেখতে গার্ডেন
ক্রস করে নিখিল
ব্র্যাডম্যান
ওভাল-মিউজিয়ামের পথ
ধরলো।
সদ্য শেষ হওয়া টি২০
এশিয়া কাপের ফাইনালে
বাংলাদেশকে হারালো
ভারত। সেই ম্যাচ নিয়ে
সোশ্যাল মিডিয়ায় দুই
দলের সমর্থকদের তর্জা
দেখতে দেখতে মন খারাপ
হয়ে যাচ্ছিল নিখিলের।
স্কুলজীবনে ক্রিকেট
নিয়ে উন্মাদনা তো তারও
ছিল। ভারত জিতলে আনন্দ
হত, হারলে দুঃখ কিম্বা
রাগ। কিন্তু তা বোধ হয়
তখনও এত ভায়োলেন্ট হয়ে
ওঠেনি। এখন ম্যাচের আগে
বাংলাদেশী বোলারের
হাতে ভারত অধিনায়কের
কাটা মুন্ডুর মর্ফড ছবি
ট্রেন্ড করে আর ম্যাচের
শেষে ভারতীয় সমর্থকেরা
জবাব দ্যায়
কাউন্টার-মর্ফিং করে।
স্থান পরিবর্তন হলেও
হিংসাটা হিংসাই থেকে
যায়। ক্রিকেটকে
ব্যবহার করে দুই দেশের
মধ্যে রেসিস্ট
ন্যাশানালিজমের যুদ্ধ
চলে। সরকারের সমালোচনা
করলে রাষ্ট্রদ্রোহের
অভিযোগে ছাত্রদের
অ্যারেস্টেড হতে হয়।
ওদিকে ক্রিকেটের নামে
কুরুক্ষেত্র চলতে
থাকে। যেসব দেশেদের
আলাদা হওয়ার কথাই ছিল
না তারা একে অপরকে জবাই
করে। একই ভাষায় হয়ে চলে
ভারত বাংলাদেশের
কটূক্তি। পাকিস্তানের
ক্রিকেটার ভারতের
প্রশংসা করলে তার
বিরুদ্ধে মামলা দায়ের
হয়। যেমন
প্রতিস্পরদ্ধী
ছাত্ররা সিডিশানের
উপহার পায়
অভিভাবকতাহীন শাসকের
থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে
কামান বসানোর কথা হয়।
'ভারত মাতা কি জয়' না
বললে হত্যা করা হবে।
নিখিল ভাবে বোলারের
হাতে প্রতিপক্ষের ওই
কাটা মুন্ডু, সে
ভারতেরই হোক আর
বাংলাদেশের, কত সহজে
ক্রিকেটকে চাপাতির
দিকে নিয়ে যায়। অভিজিত
রায়রা খুন হন আর
ক্রিকেট মাঠে
লগ্নী-পুঁজির লড়াই
জান-লেওয়া হয়ে ওঠে।
সময়...সময়টাকে যেন দানোয়
পেয়েছে। নিখিল গুন গুন
করে গেয়ে ওঠে:
এত মানুষ রয়েছে
পৃথিবীর
তবু দানবকে কেন ভয়?
এত মানুষ রয়েছে
পৃথিবীর
তবু দানবের কেন জয়?
সময়...সময়...
ব্র্যাডম্যান
মিউজিয়াম যা ভেবেছিল
তার থেকে বড় দেখা গেল।
একটা বইয়ের
ফ্যাক্সিমিলি বিশেষ
করে নজর কাড়লো ওর।
বইটির নাম 'টম উইলিস
অ্যান্ড দ্য
অ্যাবোরিজিনাল
ক্রিকেটার্স'। উনিশ
শতকে তিনি
অস্ট্রেলিয়ার আদিম
অধিবাসীদের নিয়ে একটা
ক্রিকেট টিম
বানিয়েছিলেন।
শ্বেতাঙ্গ টম বড়
হয়েছিলেন
অ্যাবোরিজিনাল
মানুষদের চারপাশে।
তিনি তাদের জীবনযাপন
সাংস্কৃতিক অভ্যাস এসব
ভালোই বুঝতেন। বইটায়
লেখা ছিল কিভাবে
স্থানীয় মানুষদের খেলা
শেখানোর সময় তিনি এই
ব্যপারগুলোকে কাজে
লাগিয়েছিলেন। পড়তে
পড়তে একেবারে অন্য এক
সময়ের ইতিহাস ভেসে উঠলো
নিখিলের চোখের সামনে।
টাইম ইন অ্যান্ড আউট।
১৮৬১ সালে উইলিসের
বাবা-সহ আরো ১৮ জন সাদা
মানুষকে
অ্যাবোরিজিনালরা
হত্যা করে। টম তখন
যুবক। তারপরে তৈরী হয়
তার ক্রিকেট টিম। ১৮৬৮
সালে অ্যাবোরিজিনাল
অস্ট্রেলিয়ান টিম
প্রথম ইংল্যান্ড সফর
করে। দেশের বাইরে
ক্রিকেটের
মক্কায়।তখনও
অ্যাবোরিজিনালরা
দেশের সংবিধানে ফ্লোরা
ও ফনা! আরো ১০০ বছর পর
১৯৬৮ সালে যখন প্যারিস
উত্তাল ছাত্রবিপ্লবে,
সেই একই বছরে
অ্যাবোরিজিনালরা
মানুষ হবার স্বীকৃতি
পায় সাদা অস্ট্রেলিয়ার
কাছে। এ এক আশ্চর্য
ইতিহাস, মনে মনে ভাবল
নিখিল।
অ্যাবোরিজিনালদের
হাতে সাদা মানুষদের
বৃহত্তম ম্যাসাকারের
পরে টম তাদের সাথেই
গড়ছেন ক্রিকেট দল। যেন
যাবৎ হিংসাকে অতিক্রম
করে যাচ্ছেন। তারপর
বইয়ের আরেক পাতায় আরো
একটা শক। ১৮৮০ সালে
ডিলিরিয়ামের বশে টম
একজোড়া কাঁচি দিয়ে
নিজেকে স্ট্যাব করেন
এবং তা থেকেই তার
মৃত্যু হয়। এ যেন
হিংসার আত্মঘাতী
প্রত্যাবর্তন। মাঠের
বাইরে। টাইম আউট
অ্যান্ড টাইম ইন। মদের
নেশা আর তার থেকে মারক
কনফিউশন।
অ্যাবোরিজিনালদের
সাথে টমের ছবি দেখতে
দেখতে এসব আকাশপাতাল
ভেবে যাচ্ছিল নিখিল।
বাইরে তখন মধ্যগগনের
দামাল সূর্য। ওভালে
জমিয়ে খেলা হচ্ছে। কোনো
অ্যাবোরিজিনাল
প্লেয়ার নেই সেখানে।
নিখিল ভাবছিল তার নিজের
দেশের ক্রিকেট টিমের
কথা। কখনো কি কোন
আদিবাসী মানুষ খেলেছেন
ভারতীয় দলে? তার দেশেও
কি খুঁজলে একটা টম
উইলিস মিলবে না? টমের মা
ছিলেন ঘোর আস্তিক।
যেহেতু তার মৃত্যু ছিল
আত্মহত্যা, তার মা এরপর
তার অস্তিত্ব অস্বীকার
করেন। একটি
ইন্টারভিউয়ে এলিজাবেথ
উইলিস বলেন ঐ নামে তার
কোন সন্তান নেই, ছিল না
কোনদিন। তবে কি অন্য
নামে ছিল? অন্য সময়ে?
অন্য আরেক ইতিহাসে? টম
যেখানে টাইমড আউট হননি,
হবেন না। এসব চিন্তা
করতে করতে নিখিলের মনে
পড়ল ক্রিকেট মাঠে বিরল
'টাইম আউট' এর নিয়ম। একজন
ব্যাটসম্যান আউট হয়ে
পাভেলিয়নে ফেরার পর
একটা নির্দিষ্ট সময়ের
(৩ মিনিট) মধ্যে পরের
ব্যাটসম্যান না নামলে
তিনি টাইমড আউট হতে
পারেন। বলাই বাহুল্য
এভাবে খুব কম লোকই আউট
হয়েছেন। গুগল বলছে
ফার্স্ট ক্লাস
ক্রিকেটে হলেও এমন ঘটনা
আন্তর্জাতিক ম্যাচে
এখনো অব্দি হয়নি। নিখিল
মোবাইলে ইন্টারনেট অফ
করতে করতে সময়ের কথা
ভাবতে লাগলো। সময়ের
ভেতর-বাইরের কথা,
ঢোকা-বেরোনোর কথা।
মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে
কিছু খেয়েদেয়ে স্টেশনে
ফেরার পথে, বিকেলের
আকাশে যখন সন্ধ্যের
মেঘ, তখন ঘনিয়ে আসা
অন্ধকারের ভেতর থেকে কে
যেন নিখিলকে বলে উঠলো:
টাইম আউট। কে আউট? সে না
সময়? সময়ের নিরঙ্কুশ
স্বভাবের ভেতর থেকে
উঁকি দিল বেলাশেষের এক
আনতচিত্র, নিখিলের খোলা
চোখের পাতার পেছনের
অন্ধকার থেকে।
একটা থুতনি। ঠিক
মধ্যিখানে দুটো দাড়ি।
আশেপাশে আর কোনো চুল
নেই। দাড়িদুটো প্রথমে
পাকানো ছিল। তারপর
দৃশ্যান্তরে তারা ছোট,
খোঁচা-খোঁচা এবং রুক্ষ
হয়ে উঠলো। লাল আলোর
দিগন্ত থেকে একটা ধাতব
কাঁচি দেখা দিল। থুতনি
বরাবর এসে দাড়িজোড়াকে
কাটতে লাগলো।
দৃশ্যান্তরে পাজি
সময়ের মতই তারা আবার
গজিয়ে উঠলো। আবার কাঁচি
ধরা একটা হাত দেখা দিল।
এইভাবে চলতে থাকল।
আজ দুবছর হল নিখিলের মা
নেই। কেন জানি না
বাওরাল স্টেশনের দিকে
ফিরতে ফিরতে তার মনে
পড়লো মায়ের ঐ দুফালি
দাড়ির কথা। যেটা সে
নিয়ম করে কেটে দিত, যত
নিখুতভাবে সম্ভব। মা
নিজের হাত দিয়ে জায়গাটা
ঠিক ঠাহর করতে পারত না।
তাই নিখিলকে বলত। আর
নিখিলও গোড়া থেকে কেটে
দিত। কাটতে গিয়ে একবার
দুবার একটু কেটেও গেছিল
মায়ের। তা সেই স্বমূলে
উত্পাটিত দাড়িযুগল
অনতিবিলম্বে আবার দেখা
দিত মায়ের থুতনিতে আর
নিখিলের ডাক পড়ত। আজ
মায়ের থেকেও বেশি যেন
ওই দুফালি দাড়ির জন্য
মায়া হল ওর। সময়ের থেকে
দূরে পাঠানোর নাম করে
সময়ের কত কাছে চলে
এসেছিল ওরা। যত বেশি
কাটা হত ততই তাড়াতাড়ি
গজাত ঐ সময়। আর আজ
চাইলেও ফেরা যাবে না
চিবুকের স্পর্শে।
মগজের সান্ধ্য
চলচ্চিত্রে কেন জেগে
উঠলো এই নিভু নিভু ছবি,
অসম্ভবের দোসর হয়ে, তা
জানা নেই নিখিলের।
ইতিপূর্বের অন্যান্য
চিন্তামালার সাথে
বাহ্যত কোনো সম্পর্ক
নেই এই দৃশ্যের। ভেতর
থেকে কখন কি যে বাইরে
বেরিয়ে আসে কে জানে! সে
কি আর
সম্পর্ক-অসম্পর্কের
ধার ধারে! দৃশ্যটা
টাইমড আউট হয়ে
পশ্চিমাকাশে মিলিয়ে
যাবার পর নিখিল গুনগুন
করে গেয়ে উঠলো:
যত ভাবো ভুলে যাবে, যা
ছিল বেদনা
যতই ভোলো না, যতই বোঝো না
দেখো, হঠাত ফেরারী কোন
স্মৃতিই কাঁদাবে
যত দূরে, দূরে দূরে দূরে
যাবে বন্ধু।