কতগুলো বছর এই রোদ এই
ঝোড়ো হাওয়ায় , টুপটাপ
ঝিরঝির বৃষ্টি পায়ে
পায়ে ঋতু পেরোতে থাকে
কেউ । পায়ের মধ্যেই
লুকনো স্পিড ব্রেকার ,
মাইলেজ , দেশ-বিদেশ
জানতে পারিনা
ঘুণাক্ষরেও । ঐ যে
নাগকেশরের ফুলগুলো,
প্রতিবছরই তো কেমন
বিষণ্ণ নারীর মতো ফোটে
গাছটাকে জড়িয়ে। সবাই
ভাবে বুঝি উড়ে এসে
জুড়ে বসা অর্কিড। তা
তো নয়।ফুলগুলোতে
বিষণ্ণতাই জৌলুস। কেউ
জানতো না । ফুলগুলো
জানে কেবল। হলুদ জবার
সঙ্গে লাল জবার কলম
কেটে জুড়ে ফুল ফোটালেও
নতুন ফোটা ফুলে আধেক
লাল আধেক হলুদের জন্য
জায়গা রেখে দেয়।
দুইয়ে মিলে প্যালেটের
রঙের মতো কমলা হয় না।
এর গোপন তত্ত্ব ওরা
জানে , ভোরে চুপিচুপি
কমপ্লেক্সের গাছে ফুল
নিতে আসা বিনীতা মাসিমা
জানে না ।
রুমকিও জানতো না কাকু
কেন এত রেগে যায়
আদিত্যর আশেপাশে থাকলে
। ওর সাথে হেসে গল্প
করলে। কো- এডুকেশন
স্কুলে পড়ে দুজনেই ।
কাকু তো জানেন এখনকার
ছেলেমেয়েরা খুব ফ্রি।
তাহলে কেন এমন করেন ।
একই রক্ত সম্পর্কে
আত্মীয় হলেও ডাইরেক্ট
নিজের ভাইঝি নয় বলে ?
রুমকিকে আদর দেন না এমন
নয় । গতবার এসে দারুণ
টেস্টি অনেক ম্যাপল
কুকিজ এনে প্রথমে
রুমকির হাতেই
দিয়েছেন। ভালোবাসেন
তো খুবই। তাহলে রুমকি
আর আদিত্যর বেলায় এত
বাঁধাবাঁধি কেন? ওরা
দুজনেই ভেবে কোনো
কূলকিনারা পায় না। এমন
তো নয় যে ঢাকুরিয়া -
সল্টলেক এরকম দূরত্বে
ওরা থাকে । আদিত্যরা
উৎসব অনুষ্ঠান উপলক্ষে
আত্মীয়সজনদের সঙ্গে
দেখা হবে বলে আসে সেই
কানাডা থেকে । ওখানে
পাঁচ বছর ধরে রয়েছে
ওরা । আদিত্য এলে রুমকি
ওর কাছ থেকে নড়তে পারে
না। আদিত্যই ওকে চোখের
আড়াল করতে চায় না। তিন
চারটে দিন তারপর আবার
কলকাতা কানাডা যথারীতি
ম্যাপে তাদের যথাযথ
অবস্থানে ফিরে যায় ।
হায়ার সেকেন্ডারি
পরীক্ষার পর এবছর
পিসতুতো বোন সায়নীর
বিয়েতে আদিত্যরা আসার
পরে বিকেলবেলায় ছাদে
গল্প করতে করতে একটা
গিফ্ট বক্স রুমকির হাতে
দিয়ে বললো ও চলে
যাওয়ার পর খুলে দেখতে।
কিন্তু রুমকির তো আর তর
সইছে না। এই প্রথম কোনও
গিফ্ট আদিত্য ওকে
দিয়েছে। রাতে খুলেই
ফেললো বক্সের ভেতরে কী
আছে দেখার জন্য । দেখলো
পিলার শেপের একটা একটু
মোটা সাদা ক্যান্ডেল।
জ্বালতে গিয়েও রেখে
দিলো। মনে পড়লো আদিত্য
ওকে রিকোয়েস্ট
করেছিলো এখন খুলতে না।
থাক, পরেই সই , মোমবাতিই
তো। বিয়ে বউ ভাত বেশ
হইচই আনন্দ করে মিটে
যাওয়ার পর ওরা কানাডা
চলে গেল । ভীষণ মন কেমন
করছে রুমকির। বারবার
গিফ্ট বক্স হাতে নিয়ে
দেখছে আবার রেখে দিচ্ছে
শেল্ফের উপর । ইচ্ছে
করছে কাঁদতে । কিন্তু
যদি কেউ দেখে ফেলে ছলছল
চোখ, উস্কো খুস্কো মুখ ।
এই সময়টা পাক্কা
অভিনেত্রীর মতো অভিনয়
করে চলতে হয় ভালো
থাকার । অশ্রুগ্রন্থির
নোনা ঢেউ যেন চোখে উপচে
না আসে । প্রতি বারই
আদিত্য যখন যায় কেন
এমন হয়? এতটা দমবন্ধ
করা চাপা কষ্ট। কেন ? ঠিক
আছে সরাসরি নয় জ্ঞাতি
ভাইবোন , বন্ধুর মতো । আর
কিছু তো নয়। অন্যান্য
বন্ধুদের লাভ
অ্যাফেয়ার শুনেছে।
তাদের এরকম হয় দুজনে
দুজনকে ছেড়ে থাকার
সময় । রুমকির এরকম
হচ্ছে কেন ? আদিত্যর ও কী
এরকম হয় ? এইসব যখন
একমনে ভাবছে রুমকির
বাবা ঘরে ঢুকলেন
সায়নীর বিয়ের ফটো
এলবাম নিয়ে । কোন কোন
ছবিগুলির কপি নেওয়া
হবে সিলেক্ট করতে বলে
চলে গেলেন।উল্টে
পাল্টে ছবিগুলো দেখতে
দেখতে শুভদৃষ্টির
কয়েকটা ছবির মধ্যে
দেখলো ওরা দুজনেই আছে ।
পাশে মিষ্টি দিদি আছে
ওর বাচ্চাকে কোলে নিয়ে
। বাচ্চাটা হার্টের
ভাল্ভে ফুটো নিয়ে
জন্মেছে । ছেলেটা রুগ্ণ
থাকে সারা বছর ।দেখলে
কষ্ট লাগে ওর জন্য।
রুমকি সায়নীর মালা
বদলের সময় হেল্প করে
দিচ্ছিলো। আর হাঁদা
ছেলেটা সেসব না দেখে
রুমকিকেই দেখছিলো ! ইস
এমন করে দেখতে হয় !
রুমকি ছবিটা দেখে এখন
জানতে পারলো। কী সব
হচ্ছে শরীরের মধ্যে ।
তিরতিরে একটা কাঁপন। এ
কী অস্থিরতা ! মুখটা কখন
থেকে হাসি হাসি হয়ে
আছে টেরই পায়নি। বাবা
এসে ধমক দিলেন একলা
অকারণে হাসার জন্য ।
এলবাম নিয়ে ঘর থেকে
বেরিয়ে যেতেই রুমকি
একটা সুন্দর চিনামাটির
বাতিদানে মোম রেখে
সলতেয় আগুন ছোঁয়ালো।
ছোট একটা শিখা তৈরি করে
জ্বলছে মোমবাতি । ঘরের
লাইট নিভিয়ে দিয়ে
বক্সটা নিয়ে বিছানায়
লাফ দিয়ে উপুড় হয়ে
শুয়ে আবার আদিত্যর
ভাবনায় ডুব দিলো। কী
এমন বিশেষত্ব আছে
মোমটার যে কানাডা থেকে
উড়িয়ে নিয়ে আসতে হল !
মেয়েবন্ধুকে কোনো
ছেলে মোমবাতি গিফ্ট
দিয়েছে বোধহয়
আদিত্যই এমন প্রথম
ছেলে। মুখ নামিয়ে
হাসছে রুমকি । অনেকগুলো
ছবির মধ্যে থেকে ওদের
যে ছবি সরিয়ে রেখেছিলো
সেই ছবিটার সঙ্গে মৃদু
কথা বলে যাচ্ছে অনর্গল
। দ্রুত গলে যাচ্ছে
মোমবাতিটাও। কিছু একটা
উঁকি দিচ্ছে ভেতর থেকে।
হঠাৎ সুরেলা টুং টাং
পাশে রাখা মোবাইলে।
আদিত্যর কল। রিসিভ করে
খুশিতে উচ্ছলতায়
রুমকি কথা বলে ওঠার
আগেই আদিত্য অনেক কথা
দ্রুত বলে যাওয়ার পরে,
শেষে রুমকির মুখ থেকে
একটাই শব্দ শোনা গেল - '
না ' ।
আদিত্যর সঙ্গে
স্কাইপে কিংবা চ্যাটে
কথা যেখানে ফুরোতে
চাইতো না , আজ কথা শেষ
হয়ে গেল মাত্র সাত
মিনিটে। কথার শেষে
জিজ্ঞেস করেছিলো মোমটা
জ্বালিয়েছে কিনা
রুমকি। উত্তরে না বললেও
মোম তো জ্বলছে। ভেতরে
উঁকি দেওয়া জিনিসটা
এখন স্পষ্ট বোঝা
যাচ্ছে। কাস্টিং
আয়রনের একটা
মানবমানবী মিথুন
মূর্তি। রুমকি আর
আদিত্যর মতো। ফোনটা
আসার আগেও সুখের
কল্পনায় জীবন্ত ছিল।
ওরা জেনে গেছে একই
রক্তের আত্মীয়দের
মধ্যে বিয়ে হলে তাদের
সন্তানের নিউরো
জেনেটিক
অস্বাভাবিকতার হার
সাধারণ শিশুদের
তুলনায় অনেক বেশি হয়।
এর ফলে জন্ম নিতে পারে
হৃদপিণ্ডে ছিদ্র কিংবা
ত্রুটিযুক্ত
মস্তিষ্কের গঠন নিয়ে
অপরিণত শিশু ।
মিষ্টিদিদির ছেলে
এরকমই এক ভিক্টিম।
জ্বলা শেষ হয়ে গেলে
নিভে গেলো মোম। প্লেটের
মধ্যে পড়ে রইল প্রেত
মিথুনমূর্তি ।