ব্রিটিশ বুদ্ধি কাকে
বলে জানিস? অপু যখন
প্রশ্নটা ছুঁড়ছে, তখন
তমাল বিরক্তি নিয়ে
নাকের মধ্যে একটা কাঠি
ঢুকিয়ে হাঁচি দেয়ার
কসরত করছে । অপুর আর
সহ্য হলো না, সেই তখন
থেকেই ও বলে যাচ্ছে, নাক
সুঁড়সুড়/ সর্দি
গুড়গুড়…। তবে রে,
তমালের মাথায় পড়লো একটা
গাট্টা, অমনিতেই ফ্যাঁচ
করে হাঁচিটা বেরিয়ে
গেলো । তমালের মুখে
হাসি, আলোকিত দাঁত দেখা
যাচ্ছে, কি বলছিলি অপু?
-বলছিলাম তোর পরদাদার
কেচ্ছা । তার যেনো কয়জন
বৌ ছিলো! কয়েক সেকেণ্ড
বিরতি, তারপর হূঙ্কার
এবং ঘুষোঘুষি । কৃত্রিম
যুদ্ধটা আরও কিছুক্ষণ
চলতে পারতো, আধাছেঁড়া
একটা বল এসে ধমাস লাগলো
অপুর মাথায় । কোন
হতচ্ছাড়া রে! একদল
ভূখা-নাঙ্গা গলিমুখের
ক্রিকেটার । ভীত
বালকদের তাঁড়া করতে আসা
দুইবন্ধুকে কিছু সময় পর
দেখা গেলো, গলিমুখে
হতচ্ছাড়া ভূখা-নাঙ্গা
বালকদের সঙ্গে ক্রিকেট
খেলছে!
নাদের মিয়া কে দেখলে
অপু বলে, সরাসরি না,
আকাশের দিকে মুখ তুলে
এবং বিড়বিড় করে, ‘শালা
ব্রিটিশ ।‘ মিয়া নাদের
মামলাবাজিতে ওস্তাদ,
রুলস এণ্ড ডিভাইড পলিসি
কেউ চাইলে তার কাছ থেকে
শিখতে পারে । তার কারণে,
স্কুল জীবন থেকে বন্ধু
রশিদ কাজি আর মোনাম
ভুইয়ার মধ্যে এই শেষ
বয়সে এসে দ্বন্দযুদ্ধ
এবং অতঃপর মুখ দেখাদেখি
বন্ধ । সরটুকু খেয়ে
নাদের সরে পড়ে! এও এক
ভূখণ্ড ভাঙার খেলা;
মানব ভূখণ্ড । অপু
মনখারাপ করে বসে থাকে ।
কয়েকটা চপ্পল শেষ,
চাকরি হচ্ছে না ।বাবাও
নির্জীব আর
হতাশাক্রান্ত ।
কেরাণীর জীবন নিয়ে মাথা
নিচু করে চলতে চলতে এখন
আর ঘাড় উঁচু করে চলতে
পারেন না । অপু দেখেছে,
যদিও তখন সে কিশোর ছিলো,
অবুঝ তো নয়! দাদাজান তার
শেষ ইচ্ছে জানিয়েছিলেন,
‘আমাকে একবার কোলকাতা
নিয়ে যা মুজিব? বাবার
ভিটা দেখতে ইচ্ছে করে
।‘ অপুর বাবা পারেননি,
তার সামর্থ্য ছিলো না ।
অভব্য কাজটি করে অপু,
তিক্ত থুতু ছুঁড়ে মারে
ঘরের কোনায় । শালা
ব্রিটিশ, রসটুকু তো
খেয়েই গেলি, ভাঙলি
কেনো?
মধুপুর মাঠে শুভেচ্ছা
ক্রিকেট ম্যাচ হচ্ছে ।
অপু নীল জার্সি, তমাল
লালের সাপোর্টার । এ আর
নতুন কি? দু’জনের গুপ্ত
পরামর্শেই এসব হয় । নীল
পেটালে অপু নাচবে, লাল
পেটালে তমাল । খেলা জমে
উঠেছে, কোনো একফাঁকে
দর্শকদের মধ্যে
হাতাহাতি হয়ে গেলো । কি
বিস্ময়! ওরা মারামারি
করছে কেনো অপু!! প্রথমেই
অপুর যেটা মনে আসে
সেটাই সে বলে,
ফ্রাসট্রেশান থেকে ।
খোঁজ নিয়ে দ্যাখ, কেউ
তোর আমার মত বেকার, ঘরে
শান্তি নেই, খাবার নেই,
কারো বোন হয়তো অল্পচেনা
ছেলেটার সাথে
পালিয়েছে….. এই পর্যন্ত
এসে অপু থমকে যায়, কি বলে
ফেললো সে! তার একমাত্র
বোনটি এমনই তো করেছিলো;
প্রিয় বড়’দি । যৌতুকের
চাপ, মানসিক নির্যাতন,
একদিন লাশ হয়ে ফিরলো সে
। তমাল মাথা নীচু করে
বসে থাকে । এই অবস্থায়
ঠিক কি বলে প্রসঙ্গ
পাল্টানো যায়? হয়তো
অপুর না জানা খবরটি সে
বলতে পারে, প্রাইমারী
স্কুলের চাকরিটা তার
হয়ে গেছে । নাহ, এখন নয়,
ভস্মে ঘি ঢালা হয়ে যাবে
।
মুজিব আবদুল্লা
রিটায়ার্ড করার আগে
সরকারী বিধি মেনে একটা
কাজ করেছেন। অপুকে তার
চেয়ারের উত্তরাধিকার
বানিয়েছেন । অভাবনীয়!
আর তিনমাস পর অপু
আবদুল্লা তার বাবার
করণিক চেয়ারে বসবে!
সতের ইঞ্চি যে রঙিন
টিভিটা একদিন সে
টিউশনির টাকায়
কিনেছিলো, তার স্ক্রিনে
জমজমাট ক্রিকেট ম্যাচ
চলছে । দুইদলের শিরোপা
জেতার যুদ্ধ । আগামী
দিনের কেরানী অপু
সহজভাবে টিভির সামনে
বসতে পারে না । নচ্ছার
ব্রিটিশ, বাঙালীকে
তোরাই কেরানী
বানিয়েছিস । ভূখণ্ড
ভাঙলি, সব একদিনে অচেনা
হয়ে গেলো, সম্পর্কে
কাঁটাতার । আজ বাংলাদেশ
ভারত খেলছে । এমন যদি
হতো, ভারতীয় উপমহাদেশের
একটাই টিম! বিশ্বকাপ জয়
করে একসাথে ট্রফি ধরে
রেখেছে ধোনি, মাশরাফি,
সৌরভ, তামিম…. হতে পারতো
না? বিষন্ন বারান্দায়
এসে বসে সে, চেনা
সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে
অচেনা এবং অসম স্বপ্নে
হাত বাড়াতেই ডেকে ওঠে
একটা কুকপাখি ।
দাদাজান যখন তার আরাম
কেদারায় বসতেন, এখন
এটায় কেউ বসে না, খসে
গেছে । বাবা এখানেই
রেখেছেন এটা, রোজ সকালে
নিজের হাতে মোছেন । অপু
জানে, অন্ধকারে পর্দা
সরিয়ে দেখে, প্রত্যেক
রাতে বাবা চেয়ারের গায়ে
হাত বুলিয়ে শুতে যান ।
এখানে বসলে দাদা কে
অনেক ভাবুক আর সৌম্য
মনে হতো । অপু কাছাকাছি
এলেই বুঝে ফেলতেন, বলি
পথক্রিকেট খেলে এলি?
হাঁটুতে কাঁদা লেগে আছে
যে! তোর মা দেখলে…. হঠাৎ
কিছু মনে পড়তো তার, কিছু
কি? হায় আমরা ঘটি আর
বাঙালে ভাগ হয়ে গেলাম!
অপূর্ব, আমার বন্ধুর
নামে তোর নাম রেখেছি ।
কাঁটাতার আমাদের আলাদা
করতে পারেনি । এই দ্যাখ
ওর চিঠি! অপু হলুদ হয়ে
আসা চিঠিটা হাতে নেয়,
এটা তো দুইবছর আগের
দাদাজান! দাদা কি
কাঁদছেন? বোঝা যায় না,
গ্লুকোমায় আক্রান্ত
চোখের জল বুকের উপত্যকা
দিয়ে প্রবাহিত হয়?
হতচ্ছাড়া ফাস্ট বোলার,
আমার আগেই চলে গেছে!
কতদুর যাবি? আসছি….
-এত সহজে আপনাকে যেতে
দিলে তো, দাদাজান!
-হুঁ, বাউন্স বল, ক্যাঁচ
উঠেছিলো, আউট হইনি । সব
বলইতো আর ড্রপ করে লাফ
দেয় না । ছক্কা মারতে
গিয়ে বোল্ড আউট হয়ে
যাবো একদিন ।
বলার জন্য বলা, সামান্য
কথা যা অপুকে একধরণের
বায়বীয় গভীরতার মধ্যে
নিয়ে যায় । সে নিজের
সাথে কথা বলে, আয়নার
সাথে, অন্ধকারের সাথে,
নীরবতা কিংবা
বিষন্নতার সঙ্গেও ।
আমার বাবা? নাহ, তার
জীবনে চার-ছক্কা নেই, সে
অনায়াসে এলবিডাব্লিও
হতে পারে? অর্থহীন
উইকেট । তবে আমি কি?
ভবিষ্যত কেরাণী; যে
পোস্টে প্রোমোশন হয় না
। তমাল? নিম্নবিত্তের
ডট বল । আত্মবিশ্বাসের
সঙ্গে যে বোলার বল করে
যাচ্ছে, তাকে দেখলে
হঠাৎ মনে হতে পারে, ইনি
ঈশ্বর! একটা বলও ব্যাটে
লাগছে না । বাউন্স করে
উড়ে যাচ্ছে মাথার ওপর
দিয়ে, নয়তো সাইডে
গোত্তা মেরে
স্ট্যাম্পের দিকে, নচেৎ
ব্যাট ঘোরাতে গিয়ে পিঠ
দিয়ে বল ঠেকানো । কোনো
নো বল কিংবা ওয়াইড
সিগনাল নেই । অপুর
ক্লান্তি আসে, তারপর সে
বিদ্ধস্ত হয়ে বসে পড়ে ।
দৃশ্যটা মিলিয়ে যেতেই
ঘাড় ফেরায় অপু, দাদাজান
ওর দিকে তাকিয়ে হাসছেন!
হ্যালুসিনেশন?
দুইহাজার চৌদ্দ সালে
ঢুকে পড়েছে উনিশশ্
তিরাশি!
তমালের পোস্টিং হয়েছে
দিনাজপুর । ও বিমর্ষ
ছিলো, কেঁদেছিলো হাউমাউ
করে এবং প্রকাশ্যে । কি
করছিস? পুরুষ মানুষ
কাঁদে না! অপু বলছিলো,
যদিও সে জানে, একই ভাবে
সেও কাঁদছে । তমাল
ক্ষেপেছে, স্পষ্টতই
বোঝা যাচ্ছে, ‘কোন বইয়ে
এই তথ্য প্রমাণসহ লেখা
আছে?’ ওরা বলছিলো,
কাঁদছিলো, নদীর পাড়ে
বসে সন্ধ্যাকে অতিক্রম
করেছিলো এবং দুজনের মনে
হচ্ছিলো; একইরকম ভাবনা
এসেছিলো বলা যায়, এও
কোনো নব্য ব্রিটিশ
চালবাজি । এই
সিরাজগঞ্জে কি
প্রাইমারী স্কুলের
অভাব আছে? তাহলে আরেক
মুল্লুকে কেনো! বলগুলি
কি এবার সামায়েলের হাতে
পড়েছে? ঈশ্বর এবং শয়তান
দুজনেই চূড়ান্ত ধূর্ত!
যমুনা ব্রিজের পিলারে
ধাক্কা খেয়ে স্রোতগুলি
বেঁকে যাচ্ছে । যমুনা,
তুমি দ্বিখণ্ডিত হওনি,
তোমাকে অ্যামিউলেট
দেয়া যায়? না। কারণ, তুমি
ভূতগ্রস্ত নও । তুমি
উৎস থেকেই প্রতিবাদী ।
আমার যদি একটা নৌকা
থাকতো, আমি দাদাজান কে
নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম,
যাত্রা শেষ হতো
সাতচল্লিশের আগের বছরে!
অপূর্ব অপু স্বপ্নবাজ,
নিঃসঙ্গ টাইম
ট্রাভেলার । তাকে কঠিন
লাগছিলো, দৃঢ়, ‘আমি
কেরাণী হবো বলে
জন্মাইনি….’
চায়ের দোকানদার মতিন
বিচিত্র কারণে
দুইবন্ধুকে পছন্দ করে।
অপু এবং তমাল কিংবা
তমাল আর অপুকে । পুরো
সন্ধ্যা পার করে দোকান
বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত
বেঞ্চির পূব কোনায় বসে
দুইজনের আড্ডা চলে ।
হাসি আর কান্নার কথা হয়
অনেক কিন্তু তাদের কখনও
কাঁদতে দেখা যায় না ।
ওদের কথা সে কান খাড়া
করে শোনে । যেখানে
কান্নার আবহ মতিনের চোখ
ভিজিয়ে দ্যায়, দেখা যায়
দুইবন্ধু তখনও হাসছে ।
হয়তো সেই হাসিতে
গোঁধূলির সিঁদুর রঙের
ঢলে পড়া বিষন্নতা আছে,
তবুও!
-জানতে চেয়েছিলি না,
আমার দাদার কয়টা বৌ
ছিলো?
-ধ্যাৎ, আমি মশকারী
করছিলাম ।
-তিনটে বৌ আর একজন
রক্ষিতা । অপু হঠাৎ
ভ্যবাচ্যকা খায়, বিষমও
। ওরা বাল্যবন্ধু নয়,
ক্লাস নাইনে পড়ার সময়
তমালদের পরিবার বদলি
হয়ে এসেছিলো এই শহরে ।
তারপর কি হলো শুনবি না?
দাদাজান তো মরে গেলেন,
তিন দাদি, চৌদ্দজন কাকা
ফুপু! সম্পত্তি ভাগ হলো,
অবশ্য সম্পদ বলতে কিই
বা ছিলো আর! কিন্তু সেই
যে রক্ষিতা ছিলো? একটু
সুখের জন্য দাদা যার
কাছে পড়ে থাকতেন, সে
কিছুই পেলো না । ঘর,
সম্মান, সন্তান, সম্পদ,
কিস্যু না! সেদিন আমি
জানলাম, ধর্মপত্নী আর
রক্ষিতা এক নয়!! নিঃস্ব
এক বুড়ি, মফস্বলের
মানুষ যাকে ঘৃণা করে ।
কেউ তাড়িয়ে দ্যায়, কেউ
একটু দয়াপরবশ হয়ে খেতে
দেয় এঁটোকাটা । বুড়ি
মরে গেলো । পাক্কা
দুইদিন কেউ লাশ ছোঁয়নি
। পঁচন শুরু হয়েছে
মাত্র, শেষে ডোম ডেকে
মাটিচাপা দেয়া হলো । না
গোসল, কাফন, জানাজা! অপু,
তুই বুঝতে পারছিস? আমি
লুকিয়ে খাবার নিয়ে
যেতাম বুড়ির জন্য ।
একদিন ধরা পড়ে গেলাম,
বাবা আর কাকারা মিলে কি
মারটাই মারলো আমাকে!
একটামাস জ্বরে বিছানায়
।
ভাইসভার্সা….. এটা এমন
এক মূহুর্ত! অস্বস্তিকর
এবং গুমোট । অপু জানে না
কিভাবে প্রসঙ্গ ঘোরাতে
হবে, একদিন তমালকেও এমন
একটা দিনের মুখোমুখি
হতে হয়েছিলো । মতিন
দুইকাপ আদা চা এগিয়ে
দেয় ওদের দিকে । ঈশ্বর
নাকি? তমাল তখন অন্যরকম
হাসিটা দিয়ে বলে, বুঝলে
মতিনভাই, আমার দাদার
নাম ছিলো হাসিবুল্লাহ
সদাগর । :সদাগরের নাতি
আপনে? বজরা কই? :বজরা
ডোঙ্গা হইয়া ডুইবা গেছে
। তারপর আমার বাপে
হাবিলদার মোছুয়াল হয়ে
আর্মিতে বাবুর্চিগিরি
করছে । অপু এতক্ষণে খেই
পায়, তুই আর্মিতে গেলি
না কেনো?
-এই প্যালারামের
পিলেমার্কা শরীর নিয়ে!
হাসির দমকাটা ঝড় হয়ে
ওঠে । ছক্কা মেরেছিস
প্যালা ছক্কা ।
অপু ইজি চেয়ারের হাতলে
মাথা রাখলো । এভাবে
বাবা অনেকটা রাত এখানে
বসে থাকেন, দাদার
চেয়ারে হাত বোলান।
সপ্তম চাঁদের আলো ভাসছে
। তবে কি বাবা দাদাজানে
স্পর্শ পান? ঘ্রাণ?অপু
তার বাবার মত করে বসে,
ইজি চেয়ারের হাতলে হাত
রাখে। একজন বাউন্সার
বসে আছেন আরাম কেদারায়,
এরকম মনে হয় তার। যেনো
অনুভবে আসে একটা শীর্ণ
হাতের আশির্বাদ। এবার
আমি ছক্কা হাঁকবো, ঠিক,
দেখে নিও। জীবন বেঁচে
থাকার জন্য, মরার আগে
মরে যাবার জন্য নয়। এই
ঘিঞ্জির মধ্যে, একতলা
তিনটে রুমের বাড়িটা
হঠাৎ ইডেনের ক্রিকেট
মাঠ হয়ে যায়। ওপাশে কে?
বিপরীত স্ট্যাম্পের
দিকে! অপূর্ব দাদা? কি
নিখুঁত পুরুষ! মুখ
নাড়ছেন? -প্যালা, ছক্কা
হাঁকিস। বয়স হয়েছে তো,
আগের মত দৌঁড়াতে পারি
না। এপাশে দাদাজান
ব্যাটিংয়ের জন্য
প্রস্তুত।