সেদিন পেনাল্টি মিস করে
বাড়ি ফেরার সন্ধ্যে ।
কলেজের মেধা তালিকায়
সারা বছরের কর্মফল ঝলমল
করছে । ভালো এবং
সাধারণের নির্ণায়ক
একটি পার্সেণ্ট
প্রতিপক্ষের ল্যাং হয়ে
মাটিতে ফেলে দিয়েছে ।
রেফারিকে তো আর হলুদ
কার্ড দেখানো যায় না,
তাই ভাগ্যকে গালাগাল
দেওয়াটাও অব্যক্ত ।
নিজস্ব মাঠ কোন অদৃশ্য
কারুকাজে অচিনপুর হয়ে
উঠেছে । ভুঁইফোড়
সহমর্মিতা...অযাচিত
উপদেশ...সহসা অবজ্ঞা
পায়ে ক্লান্তির মত
জড়িয়ে যাচ্ছে । কোথায়
যাওয়া যায় ? বাড়ি ?
গঙ্গার ঘাট ? কোথায়
ফিরবে ? কার কাছে ?
ফোন । “কি রে, বাড়ি আয় !
রেজাল্টটা জেরক্স
করাতে ভুলিস না কিন্তু
!” মা । দারুণ ডিফেন্ডার
।
আরেকদিন । সেমসাইড হয়ে
গেছে ।
“তুই আমায় লাইক করছিস
কী করে বুঝব ? ভেবেছিলাম
তুই জানিস আমি আর
শৌভিক...ও তো তোর বেস্ট
ফ্রেন্ড, তুই তার
সিক্রেটগুলো জানবি
না...?” এবং অবশ্যম্ভাবী
– “আমার পক্ষে তোর
সঙ্গে যোগাযোগ রাখা
সম্ভব নয় । আমরা আর
বন্ধু থাকতে পারব না ।”
কলেজ স্ট্রিটে
বিকেলগুলো মনখারাপের
রং মাখা । দোকানে যত আলো
জ্বলে, কলুটোলার
ফুটপাতে পড়ে থাকা পুরনো
বইয়ের স্তূপ তত মলিন হয়
। দে’জ-এ ‘উনিশ কুড়ির
প্রেমের গল্প’ রঙিন
প্লাস্টিকে শরীর মুড়ে
চলে যায় ‘ভালোটি
বাসিব’-র সঙ্গে । আর
পাতা ছেঁড়া, কোণা
দুমড়ানো রুমির বয়েত
একলা শুয়ে থাকে
ইউনিভার্সিটির দেয়াল
ঘেঁসে । কানে ভেসে আসে
মাঠজোড়া দুয়ো, কাছের
মানুষের চোখে
বিশ্বাসভঙ্গের জল । সে
কী কঠিন সময় ! বিছানায়
মুখ গুঁজেও লুকোনোর মত
অন্ধকার পাওয়া যায় না
।
কপালে হাত । “ওরকম হয় ।
শিক্ষা নাও, আর যাতে ভুল
না হয় । ভুলই তো... হয়ে যায়
। ‘ডেসপারাডো’ দিয়েছে,
দেখবি চল ।” বাবা ।
কিভাবে যেন ‘তুমি’ বলতে
বলতে ‘তুই’ ডেকে ফেলেন
। কোচ ।
বোন । গম্ভীর মুখ করে
বয়ঃসন্ধির সমস্যা বলতে
আসে । যেন সে-ই প্রথম
যুবতী হচ্ছে... কী মধুর
সেই প্রথমের বিষণ্ণতা !
নিজেকে পরিনত লাগে তার
কাছে গেলে । ভাই ।
লুকিয়ে সিগারেট খাওয়ার
প্রথম পাপ । দাদা-দিদি ।
এবং একটি বন্ধু । যে
কিনা বান্ধব না বান্ধবী
ঠাহর হয় নি কোনোদিন ।
একটি শত্রু । যাকে মেরে
ফেললে আমৃত্যু আর
কিস্যু করার থাকবে না ।
একজন স্যার । একজন
ম্যাডাম । একটি ছাত্র
যে অঙ্ক বই এনে দিয়ে বলে
“ওই গানটা আরেকবার...” ।
কিছু বই । একটা তানপুরা
। একটা ক্যামেরা আর
ক্রিকেট ব্যাট ।
এখানে সারি সারি বসে
থাকে আমার ইমারতের
ইটগুলো । মুখেচোখে
তাঁদের অসম্ভব টেনশন...
“পারবে তো ? পারছে তো ?”
যাতে চোট-আঘাত না লাগে
সে জন্য হাত জোড় করে
প্রার্থনা । অথচ যখন
আমি গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে
মাঠের বাইরে, হাতে মুখ
ঢেকেছি অপারগতায়... তখন
কি আশ্চর্য ! এঁদেরই
কারও মাঠে নেমে সে কী
দাপট! প্রথম গার্জেন
কল-এ মা সেজে গেছিল
পাড়াতুতো মিলি দি ।
প্রমাণ করে দিয়েছিল,
দ্বিঘাত সমীকরণটাই ভুল
শেখান হয়েছে ক্লাসে,
আমার কোনও দোষ নেই!
চন্দ্রিমা যখন হাতের
শিরায় ব্লেড টানছে,
সামনে প্রেগা নিউজের
স্ট্রিপ দুটো গোলাপি
দাঁত মেলে সুখবর দিয়ে
হেসে খুন... তখন পাপিয়া
এগিয়ে এসেছিল । যার
বাড়ি ‘কাঁঠালে’ শুনে
কোচিং ক্লাসে অসম্ভব
হাসাহাসি । রায়
ত্রিবেদী চিনতে কিন্তু
তার অসুবিধা হয় নি মোটে
। কষ্ট হয় নি দাদারও,
অনিকেতের গালে চড় মেরে
আসতে । এরা থাকে বলেই
মাঠে নির্ভার দৌড় ।
একটি সোনালি বলকে তাড়া
করে নিজের লক্ষ্যে
পৌঁছনর জেদে টিকে থাকা
যায় । যা যা পারি, সব
হাজার হাজার চোখের
সামনে দেখাবার সাহস করা
যায় । মার খেয়ে পড়েও
যাওয়া যায় । পায়ে
প্লাস্টার বেঁধে দেখা
যায় ওই আমার চেনা লোকটা
আমার রঙের জার্সি পরে
আমার খেলা খেলে চলেছে ।
শেষের শোরগোলটা জিতের
হোক বা হারের, আমার হয়ে
লড়ার জন্য একজন এগিয়ে
তো এসেছে !
কিন্তু শুধু একজনের
এগোনোয় থেমে থাকে না
খেলার গল্প । দৌড় একার
হতে পারে, চোট একার হতে
পারে... গোল কিকের
পশ্চাদপটের পা-ও একার
হতে পারে । কিন্তু খেলা
কী কারও একার হয়েছে
কোনোদিন ? দর্শকের
সমবেত রূদ্ধশ্বাস
ব্যতেরেকে কবে জ্বলে
উঠেছে স্কোরবোর্ড ?
মাঠের সীমানার বাইরে
বসে থাকা মানুষগুলোও
তাই একা নয় । ওরা সবাই
মিলেই না আমায় আরও, আরও
এগিয়ে যাবার ভরসা দেয় !
যার দলে ওই বেঞ্চগুলোয়
অভিজ্ঞ মুখ, চোট-সারানো
পা আর ধারালো চোখেরা
বসে আছে... তারা সোনালি
সূর্যের মত ওই অধরার
দিকে স্পর্ধা নিয়ে হাত
বাড়াতে পারে, যাকে আমরা
‘জয়’ বলি ।
পৃথিবী,ফুটবল আর
বিশ্বকাপ - তিনেরই
বর্তুল শরীর থেকে চুইয়ে
পড়ে রোদ । পৃথিবীর রোদ
গায়ে মাখতে বলেন ওরা ।
দেখিয়ে দেন, কত জোরে পা
ছুঁড়লে চামড়া থেকে
রোদের ধুলোপরাগ সরিয়ে
উড়ে যাবে বল... জালে মোড়া
আকাশের বুকে কিম্বা
অন্য প্রতীক্ষিত পায়ে ।
ওদেরই গলা ফাটানো
সমর্থন, ভেসে আসা
মন্তব্য আর আগলে রাখার
প্রতিশ্রুতি বেয়ে বেয়ে
পৌঁছে যাওয়া বিশ্বজয়ীর
তকমায় – যেখানে সোনার
গালে ঠোঁট রেখে দাঁড়িয়ে
থাকার নিথর মুহূর্ত ।
এদের জন্যই রাস্তায়
রাস্তায় মুখের ঢল নামে
। একেকদিন গ্রাম-শহর
তোলপাড় হয়ে ওঠে ।
অদৃশ্য ম্যাচ চলে
প্রতিপক্ষের সঙ্গে ।
স্ট্রাইকাররা সামনের
সারিতে ব্যানার ধরে,
শ্লোগান শোনায় ।
ডিফেন্ডাররা
ব্যারিকেডে আগলে রাখে
নতুন মুখেদের । মাঝমাঠ
সামলায় কাঁচাপাকা দাড়ি,
চওড়া সিঁথি । এক শহর
স্টেডিয়াম, বাড়ির
জানালায় জানালায়
গ্যালারি । লাইভ দেখায়
মিডিয়া... যারা
আন্দোলনের স্বত্ব কিনে
নেয় । তখনও, বাড়িতে বসে
খবরের কাগজের
খসখসানিতে...
রান্নাঘরের নার্ভাস
খুন্তির শব্দে...কিংবা
ক্যামেরার সামনে
প্যানেলে বসে কারা যেন
বলিষ্ঠ পিঠ চাপড়ে চলে ।
বিধাতার কমেন্ট্রি
ছাপিয়ে তাদের গলাই তো
ভেসে ওঠে ... “গো-ও-ও ! গো
গেট দেম !” কয়েকজন মাঠে
নামে, কয়েকজনকে নিরাপদে
বাড়ি পাঠাবে বলে ।
এগারোজনের স্বপ্ন তখন
সমষ্টির হয়ে ওঠে । বসে
থাকা কয়েকজন তখন...
নেতৃত্ব । বিশ্বজয়েরই
অন্য নাম হয়ত সব হারানো
মানুষের একনায়কত্ব ।
যেভাবে কফি আর ফুটবল
নিয়ে বেঁচে থাকা একটা
দেশ নিজে রক্তাক্ত হয়েও
মাঠ খুলে দেয় লড়াইয়ের
জন্যে ... যেভাবে ছোট ছোট
কিছু নাম বড় বড় তারাদের
উল্কা হয়ে পুড়ে যেতে
বাধ্য করে... ভরসা হয়,
ওদের জন্য নিশ্চয়ই কেউ
আছে । মার খেয়ে কখনও
শুয়ে পড়বে না ওরা । আমরা
কেউ-ই কোনোদিন একা বাড়ি
ফিরব না ।
আমার জন্য কিছু মানুষ...
কিছু মানুষের জন্য আমি...
একদিন এভাবেই হয়ত ঠিক
সেই সকালটা এনেই ফেলব –
যেদিন “viva” শব্দটায় আর
শুধু হেলথ ড্রিঙ্কের
নাম বোঝাবে না !