এটা বোধহয় তোমাকে লেখা
আমার প্রথম চিঠি। আসলে
চিঠির যুগ তো
লুপ্তপ্রায় অঙ্গের মত
খুঁজে দেখতে হয় এখন, অথচ
একসময় চিঠি লেখার কি
ধুমটাই না ছিল। আচ্ছা
আমি না হয় এই প্রথম
তোমায় চিঠি লিখছি, তুমি
কি আমাকে কোনো চিঠি
কখনও লিখেছিলে? এর আগে
অথবা পরে! না তেমনটা তো
কিছু মনে পরে না। আসলে
সেদিন অফিসে শ্রাবণী,
তাজমিরারা ওদের শৈশবের
গল্প করছিল। শিশুবেলার
কথা কারও কি ছাই মনে
থাকে নাকি। সবাই সবার
মায়ের মুখেই শোনে। মা,
ওদের মতোই আমার কোনো
শৈশব ছিল? সেই প্রথম যখন
তুমি তোমার শরীরে আমার
অস্তিত্বের কথা টের
পেয়েছিলে! লজ্জা, আনন্দ,
অদ্ভুত এক ভয়ভয় ভাব, আর
তার সাথে প্রথম মা
হওয়ার অহংকার তোমাকে
ওদের মায়েদের মতই আবেশে
ঘিরে ধরেছিল? নতুন এক
প্রাণ আনতে চলেছো তুমি
পৃথিবীর বুকে, তাই
তুমিও নিশ্চয়ই নতুন হয়ে
উঠেছিলে? হুঁ আমি বেশ
দেখতে পাচ্ছি তুমি তখন
চোখে কাজল দিতে, লাল
হলুদে মেশানো শাড়ী
পড়তে, আর সে সময় তোমার
পিঠ পর্যন্ত যে কোঁকড়া
চুলগুলো ছিল তুমি
সেগুলো একসাথে করে একটা
বেণী বেঁধে রাখতে।
তোমার ছোটো কপালকে ঘিরে
কুচোকুচো অলক ছড়িয়ে
থাকতো। আর দুই ভ্রূর
মাঝখানে
সূর্যিঠাকুরের পাটে
বসার সময়কার রঙ নিয়ে
আলো করে থাকতো সিঁদুরের
টিপ। আচ্ছা এমনভাবে যদি
ভাবি তুমিও আমার মতো
পায়ে নূপুর পরতে
ভালোবাসতে। তুমি যখন
আমাকে গর্ভে নিয়ে হেঁটে
বেড়াতে আওয়াজ হতো, ‘ছুন
ছুন...’। আমি নিশ্চয়ই কান
পেতে সেই শব্দ শুনতাম
বলো? আচ্ছা মা, সে সময়
বাবা আর তুমি তো
একসাথেই থাকতে। তাহলে
কি আমার আগমন বার্তা
তুমি কি প্রথম বাবাকেই
দিয়েছিলে? বলো না, বলো না
প্লীজ.........। শ্রাবণী আর
তাজমিরার মা নাকি
কিছুতেই প্রথমে এই শুভ
সংবাদ তাদের স্বামীকে
দিতে পারে নি। কিন্তু
তুমি পারবে না কেন, তুমি
সে সময়ই গ্রাজুয়েট
ছিলে। ভারতনট্টমেও
ডিগ্রী ছিল তোমার।
তোমাকে কি মানায় এ
খুশির লজ্জা! তুমি আমার
আগমন সংবাদে সত্যি
সত্যি খুশি হয়েছিলে তো?
সেই কোন কাল থেকে একজন
নারীর পূর্ণতা তার
মাতৃত্বে হয় বলেই শুনে
আসছি। তবে মাতৃত্ব মানে
‘বাহির থেকে অন্তরের
বাঁধন বড়ো কষে বাঁধে’।
সেই শক্ত বাঁধনে
হাঁসফাঁস করে আমার
প্রাণের উপস্থিতি
তোমাকে চরম বিড়ম্বনার
মধ্যে ফেলেনি তো? তাই কি
তুমি আমায় প্রথম
থেকেই.........। না না আমি আজ
সে সব কিছু ভাবতে চাই
না। আজ কোনো হলাহল নয়।
আজ তোমার আমার মধ্যে
উপচে পড়ুক শুধু অপত্য
ভালোবাসা, যে
ভালোবাসাকে আগুনে
পোড়ানো যায় না, জলে
ভেজানো যায় না, উষ্ণ
খরবায়ু যাকে শুষ্ক করে
ফেলতে পারে না, সেই
ভালোবাসা। আজ আমার
প্রতি তোমার কোনো
ঘেন্যা রেখো না মা। আজ
তুমি শ্রাবণী,
তাজমিরাদের মায়েদের
মতোই শুধু মা হয়ে যাও।
ওদের মায়েদের মতোই বলো,
‘কুসন্তান যদি বা হয়,
কুমাতা কভু নয়’। আমি
তোমার কুসন্তান হতে
পারি মা, সত্যি তো তা বলে
তুমি কুমাতা কেন হবে।
এবার আমায় তুমি বলো,
আমায় গর্ভে নিয়ে প্রথম
কয়েক মাস তুমি কি খুব
কষ্ট পেয়েছিলে? খেতে
পারতে না। বমি হতো
তোমার? তবু নিশ্চয়ই সে
সময় তোমার ভেতর লুকিয়ে
থাকা ছোট্টো আমিকে
যত্নে রাখতে। খেতে
ইচ্ছা না করলেও নিশ্চয়ই
জোর করে খেতে। কারণ সে
সময় তোমার মাথায় একটা
চিন্তাই ঘুরতো আমাকে
সুন্দর করে পৃথিবীর আলো
দেখানো। তাই তো আমি
জানি সে সময় তোমার খেতে
ইচ্ছা না করলেও তুমি
জোর করে খেতে। বলো না মা
একটা বার মিথ্যে হলেও
আজ একটা বার সত্যির মতো
করে বলো, তোমার গর্ভে
আমার একটু একটু করে
বেড়ে ওঠার স্বপ্নের
কথা। তোমার তলপেট যখন
ঈষৎ স্ফীত হয়ে উঠলো,
অদ্ভুত রূপলাবণ্যে
বিকশিত হয়ে উঠেছিলে
তুমি। জুঁই ফুলের সুবাস
তোমাকে ঘিরে থাকতো সব
সময়। আশপাশের সকলে যখন
তোমার ভেতরের গুটিসুটি
হয়ে ঘুমিয়ে থাকা আমিকে
নিয়ে কথা বলতো, তুমি
সকলের কথা মন দিয়ে
শুনতে। তারপর রাতের
বেলা সবাই ঘুমিয়ে পড়লে
জ্যোৎস্নার নৌকোয় পাল
তুলে তুমি আমায় নিয়ে
ভেসে যেতে। তুমি আমায়
জিজ্ঞাসা করতে, ‘সোনা
আমার ভেতরে থাকতে তোর
কোনো কষ্ট হচ্ছে না
তো?’
আমি বলতাম , ‘না মা’।
তুমি বলতে , তুই এখন কি
করছিস রে পাজি?’
আমি তোমার গর্ভের জলে
সাঁতার কাটতে কাটতে
বলতাম, ‘আমি তো সাঁতার
কাটছি’। কারণ আমি
জানতাম জলে ভালোবাসা
মগ্ন থাকে।
তাই তো তুমি বলতে,
‘ত’বেরে দুষ্টু.........’।
আমি ভেসে বেড়াতে বেড়াতে
বলতাম, ‘আমায় ধরতে পারে
না। আমায় ধরতে পারে
না’।
মাগো আমি যে পৃথিবীর
আলো দেখার পর থেকে
সবসময় তোমাকে ধরা দিতে
চেয়েছি, কিন্তু তুমি
আমায় ছুঁইয়েও দেখোনা।
কেন মা? কেন? দেখছো কি
পাপী মন আমার, সেই
বারুদের গন্ধে দাবার
দান দিতে চলেছি। অচেনা
সরীসৃপের মত জেগে উঠছে
খরিশের কুলকুন্ডলিনী।
এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যাচ্ছে
আমার মন নামে মস্তিষ্ক।
আমার আজকাল খুব ভয় করে
মা। আমাকে ফের তোমার
গর্ভের নিরাপত্তা দাও।
এক ভুবন অন্ধকার দাও,
ঠিক তোমার গর্ভেরই মত।
এবার চুপি চুপি আমায়
একটা কথা বলো তো, তুমি কি
ওদের মায়েদের মত টক
খেতে ভালোবাসতে? দিদা
তোমাকে কুল, তেঁতুলের
আচার বানিয়ে দিত, তাই না
? তুমি সেই সব খাট্টি,
মিট্টি কোনো লুকোনো
জায়গায় বসে টাগরায় শব্দ
তুলে তুলে খেতে। সাত
মাসে দিদা তোমায় সাধ
দিয়েছিল যখন তখন
গর্ভভারে টইটুম্বুর
অবস্থা। জলচৌকির উপর
থালা দিয়ে দিয়েছিল দিদা
যাতে তোমার নিচু হয়ে
খেতে কষ্ট না হয়।
দু’পায়ে আলতা, সিঁথিতে
চওড়া করে সিঁদুর, লাল
টিপ, আর আমি জানি বাবা
তোমাকে চুপি চুপি চোখে
কাজল দিতে বলেছিল। কি
সুন্দর তোমাকে লাগছিল!
যত দিন এগিয়ে যাচ্ছে তত
আমার দুষ্টুমি তোমার
গর্ভে বেড়েই চলেছিল।
তুমি টের পেতে বলো? আর সে
সময় তোমার কেমন অনুভূতি
হত? বকুনি দিতে?
ডাক্তারবাবু টেবিলে
শুইয়ে প্রথম যেদিন কি
এক রিমোটের মত যন্ত্র
পেটে চেপে ধরে আমার
হৃৎপিন্ডের ধুকপুকুনি
শুনিয়েছিল, তুমি আনন্দে
কেঁদে ফেলেছিলে বলো।
ডাক্তারবাবুর হাত চেপে
ধরে বলেছিলে, ‘আর একবার
ওর প্রাণের স্পন্দন
আমাকে শুনতে দিন’।
বাবাকেও ডেকে এনেছিলেন
ডাক্তারবাবু, তোমরা
নির্নিমেষ তাকিয়েছিলে
একে অপরের দিকে। আকণ্ঠ
শুষে নিচ্ছিল অপার্থিব
প্রেম। তোমাদের ছোট্টো
সোনা হয়ে আমিও কিন্তু
তখন একটু একটু অহং বোধ
করিনি তা কিন্তু ভেব
না।
মাগো, চারদিকে ধরিত্রী
জুড়ে এক আদিম অন্ধকার।
কত মানুষ কত শত বার
আমাকে আস্ত একটা মা
দেবে বলে সর্বস্বান্ত
করেছে। আর আমি একই
জন্মে বার বার
জন্মান্তরিত হয়ে
চলেছি। আমাকে আমার
বিশ্বাস থেকে দোহাই
তোমার সরে আসতে বলো না।
আমাকে বিশ্বাস করতে বলো
না যে আমাকে গর্ভ ধারণ
তোমার অনভিপ্রেত,
কলুষিত। পায়ে পড়ি
তোমার, তুমি বলো না দশ
মাস দশ দিন তুমি জঞ্জাল
বয়ে বেড়িয়েছো।
আমার আজকাল খুব ক্লান্ত
লাগে, খুব একা, ভয়ও করে
খুব। আমাকে আর একবার
তোমার জঠরে নেবে মা? আর
একবার প্রথম থেকে শুরু
করে জন্ম দেবে? দেখো
আমার সমস্ত শরীর জুড়ে
জন্মদাগের কালশিটে
দাগ। তোমার অপাপবিদ্ধ
গর্ভের জলে আর একটা বার
ধুইয়ে দেবে? যে মনোবিদ
আমাকে এখন দেখে, সে
আমাকে বলে তোমাকে
বিশ্বাস করতে হবে,
‘তোমার কোনোদিন কোনো মা
ছিল না’। ধুস তাই কখনও
হয় নাকি! তুমিই তো আমার
মা। এই ক’দিন হল মাত্র
তুমি প্রেগ
কালারটেস্টে নিজেই
নিশ্চিত হয়ে গেছো আমি
তোমার গর্ভে। তবে আমি
কিন্তু আর জন্ম নেব না।
তাহলে কিছুতেই তুমি আর
আমাকে অস্বীকার করতে
পারবে না। কি মজাটাই না
হবে তখন। মা,
ওমা..........................................।
ইতি