এ মেসি, রোনাল্ডো,
নেইমারদের মতো ফুটবল
নক্ষত্রদের বিশ্বকাপ
খেলা নয়; তবে এ ও এক
অনন্য ফুটবল খেলা; এক
দুঃসহ, বুকচাপা মহা
বিশ্বকাপ! এখানে কোচের
ভূমিকা নিতান্তই নগণ্য,
তাৎপর্য্যহীন অথচ এতই
জটিল ও সতত পরিবর্তনশীল
যে কোচিং করানোর জন্য
আমাকেও কোচিং নিতে হয়,
নিতে হয় তাদেরই কাছ
থেকে যাদের আমি শেখাতে
চাই; তারা এ খেলার
স্বরূপ সম্যক উপলব্ধি
না করে খেলে গেলেও তারা
এ খেলায় আমার চাইতেও
পারঙ্গম; আর আমি সব জেনে
বুঝেও এ খেলা যথাযথভাবে
খেলতে পারি বলে তো মনে
হয়না। স্বীকার করতে
দ্বিধা নেই যে কোচ
হিসেবে আমি একজন কাগুজে
বাঘ। তাই কাগজ, তাই এই
নোটশীট-
মনে রাখা দরকার
প্রথমেই, যে এ ফুটবল
নক্ষত্রদের নয় ,
জোনাকিদের; বিশ্বকাপের
মতো এ ফুটবল-কার্ণিভাল
নয়; এ কর্কশ
জীবনযুদ্ধের
ফুটবল,ফুটবল এখানে
নিরাকার। সাবজেকটিভ নয়,
এখানে খেলতে হয়
অবজেকটিভ ফুটবল।এখানে
খেলোয়াড়ের সংখ্যা
অনির্দিষ্ট। এই খেলায়
প্রতিপক্ষ মানুষ ছাড়াও
প্রকৃতি,
আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক
অবস্থা,ব্যবস্থা,
বিধিনিষেধ, প্রতিবেশ,
পরিবেশ, পরিস্থিতি
সবকিছুই হতে পারে।এই
খেলায় কোনো বাঁধাধরা
নিয়ম-নীতি বা ৪-২-৪ অথবা
৪-৩-৩ এর মতো কোনো
গেম-প্ল্যান বা ফর্মূলা
নেই। নেই কোনো বাঁধাধরা
সময়সীমা বা পরিসর,
ক্ষেত্র বিশেষে এই
খেলার ধরণ পালটে পালটে
যায়। এখানে খেলোয়াড়দের
স্বাধীনতা স্বীকৃত এবং
ইনোভেটিভ খেলা বেশী
কার্য্যকরী ও ফলপ্রসূ
বলে গণ্য হয়।অবস্থার
দাস হওয়া নয়, অবস্থাকে
বদলে দেওয়া ও
প্রতিকূলতাকে অনুকূল
করে নেওয়ার মানসিক গঠন
ও সামর্থ্যই এই খেলায়
জয়ী হওয়ার অন্যতম
নির্ণায়ক শক্তি।আপাতত
এটুকুই আমার টিপস্।এর
সাথে আমার জোনাকি
ফুটবলারদের
অনুপ্রাণিত তথা
ওয়ার্ম-আপ করতে নিম্নে
তাদেরই কয়েকটি ভিডিয়ো
ক্লিপিংস প্রদর্শনের
আয়োজন।
ক্লিপিংস-১
(ফালাকাটা,জলপাইগুড়ির
মৌসুমি বর্মণ)
মৌসুমির বাবা রিক্সা
চালায় আর মা লোকের
বাড়িতে কাজ করে, কাজ করে
স্থানীয় পসার সম্পন্ন,
ধনী, প্রতিষ্ঠিত এক
ডাক্তারের
বাড়িতেও।ডাক্তারের
ছেলের মত মৌসুমি ও
এবারে উচ্চমাধ্যমিক
পরীক্ষা দেয়।প্রতিটা
বিষয়ের জন্য ডাক্তারের
ছেলের যেখানে প্রাইভেট
টিউটর, সেখানে মৌসুমির
জন্য প্রাইভেট টিউটর তো
দূরস্থান,প্রয়োজনীয়
বই-পত্রও ঠিকঠাক
নেই।দিন আনি দিন খাই
পরিবারের মেয়ে মৌসুমি
৮১% নম্বর পেয়ে পাশ করে
ডাক্তারের ছেলেকে অনেক
অনেক পিছনে ফেলে। এতো
নিছক পরীক্ষা পাশ নয়, এ
এক অনবদ্য গোল মৌসুমির,
যা সে করে এক শ্রেণীর
মানুষের বিলাস, ব্যসন,
প্রাচুর্য্য, অহঙ্কার ও
সামাজিক অব্যবস্থার
বিরুদ্ধে।
ক্লিপিংস-২
(পাটনার পারো দেবী)
২০০৯ সালে পাটনার কাগজ
বিক্রেতা অলখ
নিরঞ্জনের সাথে বিয়ে হয়
পারো দেবীর।অলখের
বাড়িতে শৌচাগার না
থাকায় প্রকৃতির ডাকে
সবাইকে ছুটতে হতো মাঠে
ঘাটে আর সেই কাজের জন্য
পারোকে থাকতে হতো সন্ধে
নামার অপেক্ষায়,লজ্জার
হাত থেকে বাঁচতে। এই
নিয়ে আশান্তি। অভাবের
সংসার- শৌচাগার তৈরীর
টাকা জোগাড় করতে পারেনা
অলখ । ফলে রেগে মেগে দুই
বছরের ছেলেকে নিয়ে,
স্বামীকে, হয় শৌচাগার
তৈরী করো, নয়তো ভুলে যাও
আমাকে, বলে বাপের বাড়ি
চলে যায় পারো।এরপর দুই
বছর অতিক্রান্ত হয়,
অলখের সাড়া না পেয়ে
বিবাহ-বিচ্ছেদের
সিদ্ধান্ত নেয় পারো
দেবী, সাহায্য চেয়ে
মহিলা হেল্প-লাইনে ফোন
করে, খুলে বলে সবকথা। সব
শুনে তারা হাঁ, শুধু
একটা শৌচাগারের জন্য
বিবাহ ভাঙতে চলেছে ! খবর
পেয়ে এগিয়ে আসে সুলভ
শৌচালয়
কর্তৃপক্ষ।তারা
একলক্ষ টাকা দিয়ে
শৌচাগার তো তৈরী করে
দেয়ই, এমনকি ‘ঘর ঘর
শৌচালয়’ আন্দোলনে তার
এই ভূমিকা
গুরুত্বপূর্ণ মনে করে
তাকে দেড় লক্ষ টাকা
পুরস্কার সহ তাদের
বাড়ির আরো অনেক
অসম্পূর্ণ কাজ সেরে
ফেলার জন্য আরো তিনলক্ষ
টাকা প্রদান করে।
এভাবে প্রতিকূল
পরিস্থিতিকে অনুকূল
করে নিতে,দুর্ভেদ্য
রক্ষণ-ব্যুহ ভেদ করে
গোলে বল ঠেলে দিতে যে
অদম্য স্পিরিট ও
ক্রীড়াশৈলী পারোদেবী
প্রদর্শন করে তা তার
জীবনের ফুটবল খেলাকে
প্রদান করে এক
পাহাড়-প্রমাণ উচ্চতা!
ক্লিপিংস-৩
(ঝাড়্গ্রামের পূর্ব
সিংভূমের সাত বছরের
মেয়ে অপর্ণা)
অভাব ও সাংসারিক
অশান্তির জেরে ৭ বছরের
মেয়ে অপর্ণা ও ২ বছরের
ছেলে মৃত্যুঞ্জয় কে
নিয়ে ঘর ছাড়েন তা্দের
মা; বাপের বাড়ি যাওয়ার
জন্য বাসে উঠেও মাঝপথে
একটা লেভেল ক্রসিং এ
বাস থামলে, সেখানে নেমে
ছেলে কোলে মেয়ের হাত
ধরে রেললাইন বরাবর
ছুটতে থাকেন। বিচলিত
বোধ করে অপর্ণা নিরন্তর
প্রশ্ন করতে থাকে
‘কোথায় চলেছো মা ?’ কোনো
উত্তর পায়না সে।সামনে
তখন এগিয়ে আসছে ট্রেন,
অচিরেই সে বুঝতে পারে
কি ঘটতে চলেছে; সে মায়ের
হাত ধরে টানে পারেনা
আটকাতে, না পারলেও সে
দুর্দান্ত ট্যাক্ল করে
মায়ের কোল থেকে তার
ভাইকে টেনে নিতে সক্ষম
হয়।মা কাটা পড়ে
ট্রেনে।এরপর পুলিশ
তাদের পুরুলিয়া শহরের
উপকণ্ঠে আনন্দমঠ হোমে
রাখে।হোমের কর্মীদের
কাছ থেকে জানা যায়
ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ
পর সোমবার রাতে মায়ের
জন্য ডুকরে ওঠা ভাইকে
কোলে নিয়ে, গাছের
পাতা,আকাশের তারা
দেখিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে
ছোটো অপর্ণাই। এভাবে
মৃত্যুর বিরুদ্ধে
ফুটবল খেলায়, তার মায়ের
আত্মঘাতী গোল সত্ত্বেও,
সে তার ও তার ভাইয়ের
মৃত্যু রুখে দিয়ে ২-১
গোলে বিজয়ী হয়।
এখন বলার কথা এটাই উপরে
প্রদর্শিত ভিডিয়ো
ক্লিপিংস গুলিতে বিধৃত
জীবন আলেখ্যগুলির
মধ্যে জীবনযুদ্ধের
অন্তর্নিহিত যে
প্রাণবন্ত ফুটবল
প্রবাহ তার স্বরূপ
আমাদের জোনাকি ফুটবল
খেলোয়াড়রা অনুধাবন
করুক এবং একে
হেল্থ-ড্রিংকসের মত পান
করে বলীয়ান ও উদ্দীপ্ত
হয়ে সেই খেলাকে আরো
বিকশিত ও প্রসারিত
করুক, এটাই বিশ্বকাপ
ফুটবল কার্ণিভাল
চলাকালীন এ আমার
প্রত্যাশা।