লেখাটা শুরু হতে পারে
একদম উলটো দিক থেকে।
শয়ে শয়ে পায়ের একটা
ক্লোজ আপ। ব্যস্ত,
ত্রস্ত, ক্লান্ত,
পরাজিত, অনমনীয় নানা
রকমের হেঁটে চলা। পা-ও
কত রকম। আত্মম্ভরী কালো
জুতো আর দামি প্যান্টের
ঝাঁ চকচকে কম্বিনেশন।
কিংবা পাজামা আর
কোলাপুরি চটির আলুথালু
যুগলবন্দি। নিছক
হাওয়াই চটি পরা
হাক্লান্ত একটা
ম্যাড়মেড়ে শাড়ির জড়িয়ে
মড়িয়ে হাঁটতে থাকা। কত
রকম। নানা শ্রেণি। নানা
যাপন। নানা যুদ্ধ। ঠিক
এই জায়গায় শুরু হোক এই
লেখাটা। ঘামগন্ধ
কর্কশতার পারফিউম
ছড়িয়ে আছে যেখানে।
শুনেছি শিয়ালদা
স্টেশনের কাছে ব্রিজ
থেকে নাকি দিনের
দু’বেলা অফিস টাইমে
এরকম দৃশ্য দেখা যায়।
আমার ধারণা যে কোনও বড়
স্টেশন বা ওই ধরনের
জায়গা থেকেই এমন দৃশ্য
দেখতে পাওয়া যায়। আমিও
দেখেছি। আপনারাও।
ধরে নিন সেরকমই একটা
দৃশ্য। খুব নিচু করে
কেউ বুনে রেখেছে একটা
ক্যামেরা। আর সেই
সিসিটিভি ফুটেজ আপনার
চোখের সামনে একটা
স্ক্রিনের ওপরে ভেসে
যাচ্ছে। পাগুলো আসছে আর
অদৃশ্য হচ্ছে। আবার
নতুন সব পা। নতুন হেঁটে
চলা। এই ভাবে কখনও খুব
ঘন, কখনও পাতলা হয়ে থাকা
সেই ভিড়। পায়ের।
মানুষের। জীবনের।
এইবার বেলা গড়ায়। ক্রমশ
নিভে আসছে শহর। যারা
এসেছিল তারা ফিরে গেছে।
আর যাদের ফেরার কথা ছিল
না তারা ফেরেনি। এখন সব
ফাঁকা। খালি। শূন্য।
চোখের সামনে যেন
অবিশ্বাস্য দৃশ্য। রাত
নেমে এসেছে। আর স্তব্ধ
হয়ে গেছে সেই দৃশ্য।
যেন ফ্রিজ করে রাখা।
কেননা কোনও পায়ের ছবি
আর নেই। কেউ যাচ্ছে না।
কেউ আসছে না। তৈরি
হয়েছে এক অলীক নো
ম্যানস ল্যান্ড! অলীক,
কেননা ভোরের পরেই সেই
জনশূন্য শহরের
আবছায়াকে ভেঙে গুঁড়িয়ে
দিয়ে আবার রাস্তা ভরে
যাবে অগুনতি পায়ের
ছাপে। অবশ্য কোনটা অলীক
সে নিয়ে তর্ক চলতে
পারে। এই নো ম্যানস
ল্যান্ড হয়ে যাওয়া নতুন
দেশই হয়তো একমাত্র
সত্যি। তার শরীরে যে সব
পায়ের ছাপ সেগুলোই হয়তো
নানা রকমের স্বপ্নের
অলীক ইমেজ।
শান্ত, জনহীন রাত। তার
শূন্য ফুটব্রিজ। নিঝুম
রাস্তাঘাট। দরদালানের
ভিড়, পৃথিবীর শেষে পড়ে
আছে। শব্দহীন। ভাঙা।
কেউ নেই এখানে। শহরের
সর্বত্রই কেবল একটা
হাওয়া। বিষণ্ণ, স্মৃতি
জড়ানো, মায়াময়। সেই
হাওয়ায় পাক খাচ্ছে
শূন্য পলিথিন। এলোমেলো
সরে যাচ্ছে আবর্জনা হয়ে
যাওয়া পরিত্যক্ত দিনের
উপকরণ। মাঝে মাঝে
দুঃস্বপ্নের মতো
অ্যাম্বুলেন্স বা বুক
কাঁপানো গম্ভীর শব্দের
লরি ছুটে যাচ্ছে বটে,
কিন্তু তাদের শব্দ তো
আসছে আর মিলিয়ে যাচ্ছে।
একটা ভ্রমের মতো জেগে
উঠেই পর মুহূর্তে ভেঙে
পড়ছে খনখন করে।
স্তব্ধতার কাছে,
জনশূন্যতার কাছে সেই
শব্দ একটা প্যারালাল
ইউনিভার্সের ধারণা
দিয়ে যাচ্ছে মাত্র। এই
চেতনার সমান্তরালে
অবস্থিত একটা অন্য
দুনিয়ায় তাদের কালো
ছায়া কাঁপতে কাঁপতে
মিলিয়ে যাচ্ছে।
হ্যাঁ, রাত। এই নিবিড়,
ফুরফুরে শূন্যতার রাত।
আমাদের নো ম্যানস
ল্যান্ড। ইতিউতি ঘুরে
বেড়ানো দেহোপজীবিনী,
কিয়স্কে বসে থাকা পুলিশ
কিংবা ফ্লাই ওভারের
তলায় ঘুমন্ত ভবঘুরের
দল… ওরা যেন থেকেও নেই।
কতগুলো ইমেজের মতো ফুটে
আছে কেবল। যেন
ম্যানিকুইন। পুতুল।
নিষ্প্রাণ। নিস্পন্দ।
অবশ্য আমরাও কি তাই নই?
আমরাই বা ওই রাতের কাছে
কতটুকু আশ্রয় পেয়েছি?
তার শরীর বয়ে চলে গেছি
অন্যত্র। মুহূর্তে।
বাড়ি ফিরে ঘুমের মধ্যে
দেখেছি এক প্রাণহীন
শহরের আনাচে কানাচে
প্রেতের দল। ফুটপাত হোক
বা পঁয়ত্রিশতলার
অভিজাত বেডরুম।
সর্বত্র মানুষ নয়,
মানুষের ছায়া পড়ে আছে
কেবল। ছায়াগুলি
কাটাকুটি খেলছে
নিজেদের ভেতর। স্পর্শ
করছে না একে অপরকে। ভেদ
করে চলে যাচ্ছে
অন্যত্র। সারাদিনের
হিসেব, শোধবোধ,
ধর্ষকাম---এ সব সঙ্গে
নিয়ে ঘুমের ভেতর এক
অলীক শহরের শান্ত
ফুটব্রিজের ভেতর দিয়ে
কোথায় যেন চলে যাচ্ছে
তারা। তাদের
প্রত্যেকের চারপাশে
জেগে আছে এক অসীম অনন্ত
নো ম্যানস ল্যান্ডের
দুলতে থাকা মানচিত্র।
কুকুর ডাকছে। কিংবা
কাঁদছে। যেন
জ্যোৎস্নার ধুলোর
রাস্তায় গড়াগড়ি খেয়ে
জেগে উঠেছে ভয়ঙ্কর
নেকড়ে। যত দূরে যাই, এক
বৃহৎ অরণ্যের থমথমে
বিশালতা। ইতিউতি গাছের
ফাঁক দিয়ে চাঁদের ম্লান
পায়চারি। জীবনানন্দের
কবিতার লাইনগুলো
ঘোড়াদের
নিওলিথ-স্তব্ধতার
জ্যোৎস্নাকে
ছুঁয়েছিল। মানুষ তো তার
চেয়েও বিপণ্ণ।
প্যারাফিন লণ্ঠন নিভে
গেছে সময়ের অশান্তির
ফুঁয়ে। কিন্তু আমরা
যাইনি মরে আজও। তবু
কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়।
ট্রামলাইন পার হয়ে কবি
হেঁটে যান ছায়াপথ
বরাবর। যেন নিমের শাখার
থেকে একাকীতম এক পাখি
নেমে এসে মিলিয়ে যায়
অনন্তে। নক্ষত্রেরা
অজস্র বুনো হাঁসের মতো
ওড়ে। দক্ষিণ সমুদ্রের
দিকে উড়ে যেতে থাকে।
একটা বিরাট তিমির
মৃতদেহ নিয়ে স্ফীত হয়ে
ওঠা অন্ধকার সমুদ্র।
সেই সমুদ্রের গর্জন
ঢুকে পড়ে আমাদের
অস্তিত্বে। চরাচর জুড়ে
অন্ধকার সমুদ্রের পার।
আমরা নোয়ার নৌকোয় উঠব
বলে এসে দাঁড়াই।
পাশাপাশি অথচ দূরে
দূরে। ঠিক ওই
নক্ষত্রদের মতোই। কেউ
কবে মরে ভূত হয়ে নরম
আলোর বল হয়ে গেছে। কেউ
আবার তরতাজা যুবা।
কিন্তু মাঝে যোজন ফাঁক।
সময়ের। দূরত্বের।
নাকে-মুখে ঢুকে যায়
নোনতা বাতাসের ঝাঁঝ। যে
কোনও রাতের হাওয়ায় আমি
সমুদ্রের ঘ্রাণ পাই।
আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমরা।
দিগন্তের ওপারে লাল
হচ্ছে আকাশ। আমাদের
স্বপ্নগুলো ভেঙে যাছে
আবার। কিংবা আমরা একটা
নো ম্যানস ল্যান্ড থেকে
হেঁটে হেঁটে ঢুকে
যাচ্ছি আর একটা নো
ম্যানস ল্যান্ডের
দিকে। মাঝে কিছু কর্কশ
অলীক ঘামের ইমেজ পেরোতে
হবে মাত্র।
[লেখার মধ্যে মিশে গেল
জীবনানন্দ দাশের
‘ঘোড়া’, ‘গোধূলি সন্ধির
নৃত্য’, ‘শহর’,
‘স্বপ্ন’, ‘আদিম
দেবতারা’ এই সব কবিতার
লাইন।]