আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসলো
রূয়াম| অন্ধকারের মধ্যে
একটা সরু আলোর রেখা তার
চোখদুটোকে ধাঁধিয়ে
দিয়ে গেল| চোখদুটো কচলে
নিল সে| আস্তে আস্তে যেন
সম্বিত ফিরে আসতে লাগলো
তার| ওই সরু আলোটা যেন
চারদিককে আরো ঘন কালো
করে তুলেছে| কোথায় সে?
কোথায় বসে? চারদিক
হাতড়াতে লাগল রূয়াম|
একটা বিছানা| বিছানার
মধ্যে যেন কতকিছু
ছড়ানো-ছিটানো| এইতো,
একটা চশমা| তার চশমা|
চশমাটা নিয়ে চোখে পরল
সে| সরু আলোর নিচে একটা
জানলা| বিছানায় ঘসটে
ঘসটে এগিয়ে গেল|
জানলাটা খুলে দিতেই
আলোয় ভরে গেল ঘরটা|
পাশের জানলাটাও খুলে
দিল| সমস্ত ঘর-ভরা
আলো-বাতাসে এক বুক
নিঃশ্বাস নিল| বিছানার
দিকে চোখ গেল তার| খাটে
ছড়ানো বই, লেখার প্যাড,
পেন, চশমার খাপ,
ব্যাগ—সবকিছু যেন
ক্রমে তাকে প্রকৃতিস্থ
করতে লাগল| কোথায় রূয়াম?
কী করছিল? কী ঘটেছে
এতক্ষণ? আস্তে আস্তে
চোখের সামনে কতকগুলো
দৃশ্য আনাগোনা করতেই
সেই অদ্ভূত অনুভূতিটা
আবার ফিরে এলো ওর মধ্যে|
এই অনুভূতিই ওকে তাড়া
করে ফিরছিল| হ্যাঁ,
রূয়াম পরিষ্কার চিনতে
পারল, এই অনুভব, এই
বোধটাই ওকে টেনে এনেছিল
এই ঘরটাতে| ঘরটাও তার
চেনা লাগলো এবার| রূয়াম
ভালো করে নজর করলো ঘরটা|
এইতো, বড় চৌকিতে পাতা
পরিচ্ছন্ন বিছানাতে সে
বসে| বালিশ-চাদর সব
এলোমেলো| রুয়ামের খোলা
ব্যাগ আর ছড়ানো-ছিটোনো
তার জিনিস| বইয়ের তাক আর
টেবিলে গাদা করে রাখা
বই| বেণুমাসির বাড়ি|
হ্যাঁ এই বেনুমাসির
বাড়িতেই সে এসেছিল|
এখানে সে আসে| কিন্তু
কবে, কেন এসেছিল রূয়াম?
মনে করার চেষ্টা করতেই
সেই অনুভূতিটা, সেই
অসহ্য যন্ত্রনাটা আবার
তার মনকে এফোঁড়-ওফোঁড়
করে বিঁধতে লাগলো| যেন
এক জীবন্মৃতের বোধ|
কী ঘটেছিল? কেন তাকে
আমূল গেঁথে ফেছে এখনো
এই অনুভূতি? ভাবতে গিয়ে
অর মনে পড়তে লাগলো :
অসংযমী, ব্যভিচার,
যৌনজীবন...কতকগুলো
ছেঁড়া ছেঁড়া শব্দবন্ধ|
হ্যাঁ, এবার যেন একটু
একটু মনে আসছে...একটা
ভাবগম্ভীর গলা: কমরেড,
অসংযমী যৌন ব্যভিচারী
জীবনের জন্য তোমাকে
শাস্তি দেওয়া হলো| মনে
পরল এরকমই একটা
শব্দসমন্বয় তার জীবনে
আসবে বলে বেশ কিছুদিন
যাবত সে সময় গুনছিল যেন|
মনে পরল যে সে জানত তার
সামান্য ভুলের জন্য
রক্তিম আর তার স্ত্রী
স্বপ্না নাগাল পেয়ে
গেছিল তার যৌন জীবনের
গোপনীয় কয়াক্তা টুকরোর|
সে জানত যে তার সাথে
রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক
কাজে বারবার পিছিয়ে পড়া
স্বপ্না কোনোভাবেই আর
ছেড়ে দেবে না তাকে|
রুয়ামের জানা ছিল যে
সংগঠনের নেতৃস্থানীয়
কমরেডরা এখনো ফেঁসে আছে
মানুষের যৌনতা ও
যৌনজীবন সংক্রান্ত
নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে
পৌঁছনোর চূড়ান্ত
অসাফল্যে| এখনো তাদের
চিন্তাপথ: “যা কিছু কর,
গোপন রাখো, ঢেকে রাখো
আড়ালে, কথাও প্রকাশ্য
কোনো প্রশ্ন যেন না
ওঠে”| রূয়াম বুঝেছিল যে
সে শেষ| তার এগিয়ে চলার
ওপর কুঠারাঘাত করা যাবে
এবার অনায়াসে|
এই শেষটা রূয়াম মানতে
পারেনি| ওই শব্দগুলোর
তীক্ষ্ণ শ্লেষ, তীব্র
গালিগালাজের সুর
বারবার তাকে খোঁচাতে
থাকে; তার
স্বাধীন,সমর্থ বেঁচে
থাকাতাকে পিটিয়ে
থেঁতলে দিতে থাকে,ক্ষত
হয়, গড়িয়ে পড়ে রক্ত,পুঁজ|
সে যেন বারে বারে মরে
যেতে থাকে, মরে যেতে
থাকে...
অবশেষে আসে সেই
অদ্ভূত অনুভূতিটা| এক
জীবন্মৃতের অনুভূতি|
বেঁচে থাকতে তার আর
ইচ্ছে করে না| অথচ মরে
যাবার অনুমোদনও তাকে
দেয় না তার অতন্দ্র
চেতনা| যে সংগঠন, সংগঠিত
জীবনকে সে নিজের পর
সবচেয়ে গুরুত্বের
জায়গায় দেখে এসেছে,
সেসবকিছুই আজ তাকে
কতকগুলো নির্দিষ্ট
শব্দে সাব্যস্ত করে,
সীমিত করে, বন্দী করে
মৃত্যুর দিকেই যেন ঠেলে
দিচ্ছে| আদর্শ আর
আদর্শচ্যুতি তার কাছে
তো জীবন আর মৃত্যুরই
সামিল| আজ একদল লোকের
সেঁটে দেওয়া তকমায় দেগে
আদর্শ আর অনাদর্শ কেমন
যেন গুলিয়ে যাচ্চে তার|
সে তো কথাও আদর্শচ্যুত
হয়নি, নিজেকে সে জানে|
তবু, তবু, তবুও সংগঠনের
হাত ধরেই তো আদর্শকে
চিনতে শেখা তার| এর
ভিতরকার মানুষগুলোই তো
তার কাছে কখনো আদর্শের
মূর্ত প্রতীক হয়ে
উঠেছিল| আজ সেই
মানুষগুলোর কাছেই চেনা
আদর্শের জগৎ থেকে সে
বিচ্যুত| কখন? কেমন করে?
ভেবে সে কোনো কুল করতে
পারে না| শুধু টের পায় এই
প্রশ্নচিন্হ, এই ব্যাপক
দোলাচলের মাঝে কাঁপতে
থাকা তার ভোঁতা
অস্তিত্বকে| এক
মীমাংসাহীন সংশয়ের
দেওয়ালে মাথা ঠুকে মরে
রূয়াম|
তার মনে পড়ছে
সদ্যমৃত বেণুমাসির
ঘরটার কথা| বেণুমাসি
যতদিন বেঁচে ছিল, যে
কোনো কষ্টের মুহুর্তে
তার কাছে ছুইতে আসত
রূয়াম| বেনুমাসির কোলে
মাথা রাখলে মাসি পরম
মমতায় চুলের মধ্যে
আঙ্গুল বোলাতে বোলাতে
নানা কথা বলত আর খুব সহজ
হয়ে আসত রুয়ামের খারাপ
লাগাগুলো| আস্তে আস্তে
এমন হয় বেনুমাসির ঘরে
এলেই অর্ধেক কষ্ট লাঘব
হয়ে যেত তার| বেনুমাসী
ঘরের একটা চাবি দিয়ে
রেখেছিলেন ওর কাছে|
কখনো বেনুমাসির
অনুপস্থিতিতেও রূয়াম
ওই চৌকির বিছানায় গিয়ে
শুয়ে থাকত, ধীরে ধীরে
ঠান্ডা হয়ে আস্ত ওর
ব্যাথাদগ্ধ মন| এই ঘর
রুয়ামের কাছে এক অদ্ভূত
দেশ, যে দেশ বাস্তব হয়েও
তাকে বাস্তবিক
কষ্ট-দুঃখ-বেদনা-সংশয়-অ
্থিরতার থেকে দূরে
সরিয়ে নিয়ে যেতে পারত|
তাই এই জীবন্মৃত
অস্তিত্বটুকু সম্বল
করে সে সেদিন ছুটে
গিয়েছিল বেনুমাসির
বাড়ি|
ঘুমের-ওষুধ-খাওয়ার
দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তাকে
শিখিয়েছিল কতটা ওষুধে
দীর্ঘস্থায়ী ঘুম আর
কতখানিতে একেবারে
ফিরে-না-আসা| এই অসহনীয়
যন্ত্রণা সহ্য করতে
পারছিল না সে| আবার
সম্পূর্ণ অনুপস্থিতিও
মেনে নিতে চাইছিল না
তার চেতনা| এই সময়টুকু
কোনমতে পেরিয়ে আসতে
পারলে আবার
স্বাভাবিকতার জমি ফিরে
পাবে সে পায়ের
নিচে—এমনটাই মনে
হচ্ছিল তার| ততক্ষনের
জন্য দরকার এক নিরালম্ব
‘শূন্য’ এর অবস্থিতি:
এক অবিচ্ছেদ ঘুম, জীবন ও
মৃত্যুর মাঝখানে এক
অচেতনার দেশ যা তাকে
আদর্শ ও অনাদর্শের এই
তীব্র
সংঘাতকে,দ্বন্দ্বকে
শান্ত করে সমাহিত করে
এক নতুন পারে পৌঁছে
দিতে পারবে| হয়তবা
সেখান থেকেই সে শুরু
করতে পারবে তার নতুন
আদর্শ,নতুনতর জীবনের
দিকে লক্ষ্য রেখে|