পরিমল দত্ত-কে এখানে
‘দত্ত বাবু’ বলেই সকলে
চেনে। নির্বিবাদি
সদালাপী পরিমল দত্ত
এখানে কারো কাকা, কারো
দাদা, কারো বা দাদু।
তাছাড়া দত্ত বাবু আছেনও
সব কাজে। প্রাইমারি
স্কুলের শিক্ষকতায়
অবসর গ্রহণের পর তার
এখন অখন্ড অবসর। মেয়ের
বিয়ে হয়েছে শিলিগুড়ী;
ছেলে কম্পানীর বড়
চাকুরী নিয়ে কোলকাতায়-
আর কল্যাণীতে পরিমল
বাবুর বুড়ো-বুড়ীর সংসার
বেশ নির্বিগ্ন ছিমছাম।
রিটায়ার্মেন্টের পর যে
টাকা পেয়েছেন তা এখন
ব্যাংকে গচ্ছিত; গিন্নী
আছেন ঘরে লক্ষ্মী পুজো
আর তের পার্বন নিয়ে
অন্য দিকে পরিমল বাবু
আছেন সমাজ সংসার নিয়ে।
দূর্গা পুজো, সরস্বতী
পুজো, নাম সংকীর্তন,
বিয়ে, পৈতে সৎকার সব
কাজেই দত্ত বাবু আছেন
অবিচ্ছেদ্য।
দীর্ঘদিনের বাস তার এই
কল্যাণী-র বিদ্যাসাগর
কলোনীতে। সেই ছেষট্টি
সালে বাংলাদেশের খুলনা
থেকে বাবার হাত ধরে
এখানে আসা। বাবা হরিপদ
দত্ত আসতে রাজি হননি
কিছুতেই। কিন্তু কোন এক
অমাবশ্যায় তার বৃদ্ধ
দাদু আর কাকাদের লাঠি
পেটা করে চোখের সামনে
হালের গরু দু’টো কে
খুলে নিয়ে গেল পাশের
পাড়ার বশির, ওমর আলী আর
আমীররা- তখন আহত বুড়ো
বাবা, হরিপদের হাত ধরে
অশ্রু সজল হয়ে বলেছিল,
“বাবা আমার বংশের
প্রদীপ তোর হাতে তুলে
দিলাম; তুই পালা! তুই
বাঁচ আর আমার বংশ রক্ষা
কর।” হরিপদ দত্তের
তক্ষুনি মনে হয়েছিল,
সবকিছু ফেলে পালিয়ে
গিয়ে কি কেউ বাঁচে?
কিন্তু সে অবস্থায়
কিছুই বলতে পারেননি
তিনি- শুধু অসহায় চোখে
দেখেছেন আক্রান্ত
নিরীহ মানুষের আতঙ্ক।
তারপর চোখের জল আর
বানের জলে ভাসতে ভাসতে
সীমান্ত পাড় হয়ে এই
দেশে। নামহীন গোত্রহীন
হয়ে ভেসে বেড়ানো আর
বাঁচার সংগ্রাম। কখনো
দূর আত্মীয়ের বাড়ি
ক’দিন, কখনো রাস্তায়
কখনো বা গাছতলায়। তখন
পরিমলের বয়স কম। দাদুর
পাঠানো সামান্য টাকায়
চলল তাদের উদ্বাস্তু
জীবন। বাঁচার তাগিদে আর
সময়ের প্রয়োজনে এক সময়
তারা কিছুটা সামলে নেয়।
‘উদ্বাস্তু’ থেকে তারা
পরিণত হয় ‘রিফিয়্যুজি
পরিবারে’। পরিমল যখন
বিদ্যাসাগর স্কুলে
ভর্তি হয়, তখন ভাল বন্ধু
হয়নি তার কেউ। সবাই
পরিমলের নামে না ডেকে
ডাকত ‘রিফিয়্যুজি’
বলে। সৌমেন ঘোষ নামে
একজন ছিল তার ক্লাসে; সে
সব সময়ই বলত, “এ্যই তোর
গায়ে কেমন জানি ‘নেড়ে’
‘নেড়ে’ গন্ধ। হাসত
সবাই। খেলত না ওর সাথে।
সে এক বিচিত্র সংগ্রাম।
নিজেকে মানুষ প্রমাণ
করার প্রানন্ত
সংগ্রাম।
তারপর একদিন স্কুল
কলেজ শেষ হয়। সংসার আর
চাকুরী স্থায়ী হয়। অন্য
দিকে খুলনায় উজার হয়
ফেলে আসা ঘর-দোর; দাদু,
দিদিমা, কাকা-রা। কেউ
মরে কেউ বাঁচে। আবার
কেউ থেকেও যায় পোড়া
মাটি কামড়ে। এখানে বাবা
গত হন। গত হন মা- পরিমল
গলা ছেড়ে কাঁদতে পারেনি
কখনো। কাউকে জড়িয়ে ধরতে
পারেনি অসহায় লতাপাতার
মত। একমনে সে শুধু তার
গায়ের গন্ধ তাড়াতে
চেষ্টা করে গেছেন। আজ
দত্ত বাবু লুঙ্গি ছেড়ে
ধূতি; রূপসা নদী ছেড়ে
গঙ্গায় তার স্বপ্নের
নৌকা দুধ সাদা পাল তুলে
তরতর বেয়ে চলে। মহরমের
ঢোলের তাল, চৈত্র
সংক্রান্তির গাজনের
ডাকের ছন্দের কাছে
পরাজিত হয়েছে বেশ
কিছুকাল আগেই। তাই দত্ত
বাবু শের-ই বাংলা,
মওলানা ভাসানী ত্যাগ
করে সি.পি.এম কংগ্রেস
আই-এর রাজনৈতিক
মতাদর্শে মাথা মুড়িয়ে
একবারে পুরো দস্তুর
কল্যাণী বাসী। এখানকার
“জাগরণী” ক্লাবে আর
পাঁচু গোপালের চায়ের
স্টলে তার নিত্য
আনাগোনা। আজো এই রুটিন
ওয়ার্কের ব্যতিক্রম
হয়নি। চায়ের দোকানের
নিশ্চল কুমীরের পিঠের
মত চিত হয়ে পড়ে থাকা
কালো বেঞ্চে বসে দত্ত
বাবু উঁচু গলায় বলে উঠে,
“এ্যাই, পাঁচু এক প্লেট
ঘুগনি আর চিনি বেশি
দিয়ে একটা চা দাও।”
নেশা বলতে দত্ত বাবুর
এই একটা। চা। সকালে
বিকেলে চা তার চাই-ই
চাই। দ্রুত হাতে টেবিল
পরিস্কার করতে করতে
পাঁচু গোপাল গলা চড়িয়ে
বলে, “কাকা শুনেছ তো,
ওদেশের অবস্থা তো ভাল
না।” হঠাৎ এই প্রশ্নে
দত্ত বাবু একটু ঘাবড়ে
যান; দ্রুত ভাবতে থাকে
“ওদেশ” নামে কোন দেশ!
ইউরোপের কিছু দেশ সহ
আমিরিকা রাশিয়ায় কিছু
উত্তেজনা চলছে বটে,
কিন্তু সেই উত্তেজনা কি
কল্যাণীর স্টেশন রোডের
গোলপেতা ঘেরা চায়ের
দোকানের পাঁচু গোপাল
রায়কে ভাবিত করবে? দত্ত
বাবু ভারতে থাকেন।
তারপর বলে,
কোন দেশ?
কেন, বাংলাদেশ; তোমাদের
বাংলাদেশ, ওখানে না কি
রাজা ভোট নিয়ে তুমুল
চলছে।
মূহুর্তে শব্দটা পরিমল
দত্ত বাবু-র মগজের
কোথাও আটকে গিয়ে তীব্র
প্রতিধ্বনি তুলতে থাকে
“বাংলাদেশ”,
“বাংলাদেশ...” পাঁচু’র
কথাটা শোনার সাথে সাথে
দত্ত বাবুর পায়ের তলার
মাটি কাঁপতে থাকে- যেন
ভূমিকম্পন। ঘোর লাগা
চোখে দত্ত বাবু দ্যাখেন
কুয়াশা ঢাকা সকালের
রূপসা, লঞ্চের ভেঁপু;
মাঠ ভর্তি সরষে ফুল,
নিকানো তুলশী তলা
মহরমের লাঠি খেলার
ঢোলের বাদ্য- অমাবশ্যার
রাত, রক্তাক্ত দাদু...
দত্ত বাবুর মনে হয় গায়ে
তার সেই গন্ধটা আছে
এখনো, যেটা ছেলে বেলায়
সৌমেন পেয়েছিল, আর সে
কারণে তাকে এক বেঞ্চে
বসতে নিতে চায়নি সে
কোনদিন।
এক চামচ ছোলার ঘুগনি
মুখে তুলে স্বাদ পান না
দত্ত বাবু। কিছু না
দেখার দৃষ্টি নিয়ে অপলক
তাকিয়ে থাকে ব্যস্ত
ষ্টেশনে স্থির দাঁড়িয়ে
থাকা মালগাড়ির দিকে। এর
মাঝেই কখন যে পোষ্ট
অফিসের কেরানী তারাপদ
বিশ্বাস এসে দাঁড়িয়েছে
খেয়ালই করেননি দত্ত
বাবু। তারাপদ বিশ্বাস
আন্তরিক গলায় বলেন, “এই
যে, দত্ত দা, আপনাকেই
খুঁজছি সেই সকাল থেকে;
আপনার একটি চিঠি আছে।”
আজ কাল চিঠির প্রচলন
নেই বললেই চলে। তবুও
কর্মকর্তা আর
কর্মচারীরা অফিস আগলে
পড়ে থাকে। পরিচিত লোকের
চিঠি পেলে নিজেরাই পৌছে
দেয়। পোস্টম্যানের
তোয়াক্কা করে না।
উৎসুক গলায় পরিমল দত্ত
বলে,
তাই না কি?
হ্যাঁ, ওদেশ মানে,
আপনাদের বাংলাদেশ- থেকে
কোন ‘এক মুসলমান
লিখেছে’;
আপনি কি লেখা দেখেই
লেখকের ধর্ম বলতে পারেন
দাদা? তাছাড়া ওখানে
হিন্দুরাও তো আছেন।
না না খামের গায়ে
প্রেরকের নাম লেখা
রয়েছে তো। এর মাঝেই
পাঁচু আরো এক প্লেট
ঘুগনী আর এক কাপ চা দিয়ে
যায়। তারাপদ দাদা শব্দ
করে চা চুমুক দেন।
পরিমল দত্তের উদাসীনতা
কাটে না। দোয়েল পাখির
ছবি অঙ্কিত হলুদ খামটা
হাতে নিতে নিতে পরিমল
দত্ত, তারাপদ বিশ্বাস
কে দুম করে একটা প্রশ্ন
করে বসে; ক্লান্ত স্থির
মালগাড়ির দিকে চেয়ে, সে
বলে, আচ্ছা দাদা, একটা
কথা জিজ্ঞাসা করি;
হ্যাঁ হ্যাঁ এর জন্য
অনুমতির প্রয়োজন আছে
কি?
না, মানে বলছিলাম যে, এই
ধরুন ইতালী থেকে কোন
চিঠি বা পার্সেল আসলে,
সোনিয়া গান্ধীকে কি কেউ
বলেন যে, সোনিয়া জি,
আপনার দেশ ইতালী থেকে,
এক খ্রীস্টান একটা চিঠি
বা পার্সেল পাঠিয়েছেন?
... তারাপদ বিশ্বাস কে
কোন রকম সুযোগ না দিয়ে,
দত্ত বাবু উঠে পড়েন; পা
বাড়ান সামনের দিকে।
না না চিন্তা মূহুর্তে
তার মাথায় এসে ভীড় করে।
সন্ধ্যার আলো আঁধারে
তার চোখে আবার আবছা হয়ে
ভেসে ওঠে, রূপসা নদী
নৌকা বাইছ, মহরমের মেলা,
যাত্রাগানের কর্ণেটের
শিহরণ জাগানো সুর,
নবান্নের পায়েস... ঠিক
তখন বিকট চিৎকার করে
কল্যাণী ষ্টেশনে 60up
লোকাল ট্রেনটি প্রবেশ
করে। ট্রেনের বিকট
হুইসেলে দত্ত বাবুর
মাথাটা শূন্য হয়ে যায়।
তিনি সন্ধ্যায় আলো
আঁধারে সুতো কাটা ঘুড়ি
মত এলপাথারি উড়তে থাকে;
উড়তে থাকে তারপর
গোৎত্তা খেয়ে মুখ
ডুবিয়ে পড়ে যায় শান্ত
রূপসার বুকে।
দুই
পরিমল বাবু শিয়ালদা
স্টেশনের চার নম্বর
গেটে যখন দাঁড়ান তখন
সন্ধ্যা নামতে শুরু
করেছে। অপেক্ষা
বিরক্তিকর।
উদ্দেশ্যহীন ভাবে তিনি
চারপাশটা দেখতে থাকেন।
সারি সারি
এ্যম্বাসেডার, ফলের
দোকান, ফুলের দোকান,
বখাটে, রিক্সাওয়ালা,
যাত্রী-অযাত্রী গিজগিজ
করছে চারপাশে। ট্রেনের
ঘোষণা হয়েছে। এখুনি
ষ্টেশনে ঢুকবে ভাগিরথী
এক্সপেস, যা দুপুরের পর
কোলকাতা থেকে ছেড়েছে।
আলফাজ মিঞার এই ট্রেনেই
আসার কথা। চিঠি পাওয়ার
পর দত্ত বাবুর দু’রাত
ঘুম হয়নি। আলফাজের
চেহারাটা মনে করতে দত্ত
বাবুকে মোটেও কষ্ট করতে
হয়নি। আলফাজ পাশের
পাড়াতেই থাকত। ভীষন
ডানপিঠে ছিল সে। লটকন,
আমড়া, কামরাঙ্গা গাছে
আলফাজই উঠত। বর্ষার
মৌসুমে রূপসা পাড় দিতে
চাইতো সাঁতরে।
সেই আলফাজ আসছে এত কাল
পর। এক সপ্তাহ থাকবে
এদেশে। কোলকাতা হয়ে
দেশে ফেরের মুখে
কল্যাণী এসে পরিমলের
সাথে দেখা করতে চেয়ে
চিঠি দিয়েছে। আনন্দ আর
উত্তেজনায় দু’রাত
ঘুমাতে পারেনি দত্ত
বাবু। হঠাৎ দত্ত বাবুর
মনে হয়, তার ছেলে বেলার
বন্ধু, রূপসা নদী পাড়ের
বারোহাটি গ্রামের
আলফাজ কোন দিন পরিমলের
গায়ে ‘হিন্দু’
‘হিন্দু’ গন্ধ পায়নি...
অকারণেই দত্ত বাবু উদাস
হয়ে যায়। ষ্টেশনে
সন্ধ্যার আলো জ্বলে
ওঠে। ছিন্নমূল কিছু
বেশ্যা শেয়ালের চকচকে
দৃষ্টি দিয়ে দত্ত
বাবুকে লক্ষ্য করে
কিন্তু পাত্তা দেয় না।
দত্ত বাবুও ওদের দিকে
তাকিয়ে থাকে
উদ্দেশ্যহীন। এরমধ্যে
সময় চলে যায় খানিকটা;
হঠাৎ একটা আওয়াজ তার
কানে ধাক্কা দেয়,
“আচ্ছা ভাই, বিদ্যাসাগর
কলোনীটা কোন দিকে হবে?”
হাজারো শব্দের মধ্যে
“ভাই” শব্দটি দত্ত
বাবুকে হঠাৎ নড়িয়ে দেয়।
কণ্ঠস্বরটি আবার ডেকে
ওঠে, “ও ভাই ... ...? কোন
উত্তর আসে না। উত্তর
আসবেও না। এখানে “ভাই”
শুনলে সবাই অবাক চোখে
তাকিয়ে থাকে- যেন
‘এলিয়ান” দেখছে। দত্ত
বাবু মূহুর্তে ঘুড়ে
দাঁড়ায়। তার চোখ আটকে
যায়, মাঝারি সাইজের
দাড়িওয়ালা পাঞ্জাবী
পরিহিত শক্ত সমত্ত একটা
লোক, আলফাজ হোসেন। “এই
যে এইদিকে”, বলে পরিমল
সামান্য এগুতেই, লোকটি
হাতের ব্যাগটি মাটিতে
ফেলে দৌড়ে এসে দত্ত
বাবুকে জড়িয়ে ধরে।
চিৎকার করে ওঠে, “এই
পরিমল, হালারপো, তুই কন
তে কনে আইসি বদলাইছিস!”
পরিমল বাবুর মনে হয়, এমন
উষ্ণ আলিঙ্গন বহু বছর
পর পেলেন। আলফাজের গা
থেকে আতরের গন্ধ ছাপিয়ে
দত্ত বাবু পাচ্ছেন,
লটকন, কামরাঙ্গা আর
আমড়ার টক টক গন্ধ; এই
আলিঙ্গনের মধ্যে দত্ত
বাবু দ্রুত ভাবতে থাকে,
আলফাজ কি তার গা থেকে
কোন বেধর্মীর গন্ধ
পাচ্ছে? যেটা সৌমেন ঘোষ
পেয়েছিল, আজ থেকে অনেক
বছর আগে...
এরপর ওরা রিক্সায় চড়ে
কল্যাণী শহর দেখে
বিস্মিত হয়ে হাসতে
হাসতে আলফাজ এসে
পৌঁছাল বিদ্যাসাগর
কলোনীর পরিমল দত্তের
বাড়িতে। আলফাজ বলল,
“এগের দ্যাশে উন্নতি
কত; আর আমাগেরে! আসলে
দ্যাশ প্রেমটাই আসল...
দত্ত বাবু জিজ্ঞেস করে;
“আচ্ছা, আমাদের রূপসায়
এখনো নৌকা বাইছ হয়? মনে
আছে কি ধুমধাম করে বাইছ
হত?
তা মনে নেই; ওতা কি ভুলা
যায়- তয় এখন আর হয় না।”
কেন?
আরে রাজনীতি বুজলি
রাজনীতিতে সব কিছু
খাইয়া নিছে...
দত্ত বাবুর মনে হয়,
রাজনীতিই সব কিছু গড়ে
আবার রাজনীতিই সব কিছু
নিঃশেষ করে দেয়। নিঃশেষ
করে সম্প্রীতি,
সৌহার্দ্য, হালের গরু;
অমাবশ্যায় নিরীহ
মানুষকে জীবন নিয়ে হতে
হয় উদ্বাস্তু। দত্ত
বাবু মুখ ফসকে বলে,
আচ্ছা বাজারপাড়ার বশীর,
ওমর, আমীর-রা এখন কোথাও?”
উৎসুক হয়ে, আলফাজ
জিজ্ঞাসা করে, ‘কি’?
তারপরই বলে, ‘শোন আমি
ফুচকা খাইছি; আর কফি
হাউজও দেখছি- আহা, “কফি
হাউজের সেই আড্ডাটা আজ
আর নেই... আলফাজের হেঁড়ে
গলার বেসুর গানের মাঝে
পরিমলের গুরুত্বপূর্ণ
প্রশ্নটির উত্তর
হারিয়ে যায়; যা এতদিন
দত্ত বাবুর মনের গহীনে
আটকে ছিল। আর সেও পড়ে
থাকে অন্ধকারের রহস্যে
ঘেরা অজানা তিমিরে।
এবার আলফাজ প্রশ্ন করে,
“হ্যা রে তোগে দ্যাশে
লোডশেডিং কিরাম?
আলফাজের মুখে “তোগো
দ্যাশ” শব্দটি আবার
দত্ত বাবুর মাথায় কোথাও
আটকে গিয়ে প্রতিধ্বনি
তুলতে থাকে। দত্ত বাবু
অবাক চোখে তার পাশে বসা
বন্ধুটি মুখের দিকে
তাকিয়ে থাকে অপলক।
কিন্তু আলো আঁধারের এই
ক্ষনে তার মুখটা বড়
আবছা দেখায়।
তারপরের সময় গুলো কেটে
যায় দ্রুত। আলফাজ খুব
সহজেই দত্ত বাবু স্ত্রী
সাবিত্রী বালা কে ভাবী
বলে সম্মোধন করে, ব্যাগ
থেকে লাল পেড়ে বাহারে
এক ঢাকাইয়া তাঁতের
শাড়ির উপহার দিয়ে
স্বাভাবিক গলায় বলে,
“ভাবি পানি দ্যান, অজু
করা লাগবি, নামাজের
ওয়াক্ত হল।”
আলফাজ নামাজ পড়ে
সাবিত্রীর পুজো ঘরের
পাশে। রাতে মুসুর ডাল,
মাছের ঝোল, ভাত খেতে
খেতে আলফাজ উদার কণ্ঠে
হাসে। পরে বলে, “আমার
ছোট মিয়াডা ভারি
সোন্দোর রবীন্দ্র
সংগীত গাতি পারে- আমার
ইচ্ছে ও শান্তি নিকেতনে
পড়ুক।” আলফাজ তার বাড়ির
কথা, পরিবারের কথা
দেশের কথা বলে ওদের
দু’জনকে মুগ্ধ করে
রাখে। দ্রুত সময় গড়িয়ে
রাত হয়। আজ রাত গভীরও হয়
যেন একটু দ্রুত।
সকালে লুচি তরকারী
খেয়ে বাজারের ঝোলা নিয়ে
দু’বন্ধু বেড়িয়ে পড়ে।
কল্যাণীতে তেমন কিছু
সেই অর্থে দেখার স্থান
বা জিনিস নেই; তাই ওরা
দু’জনে বাজারে যাওয়ার
জন্য মনস্থ করে। পথে
অনেকেই বিস্মিত হয় এই
দাড়িওয়ালা মানুষটিকে
দেখে; যদিও এখানে মাঝে
মাঝেই পাঞ্জাবী ও শিখ
দেখতে পাওয়া যায়।
তাছাড়া এখানে
দাড়িওয়ালা মানুষ যে
একেবারেই নেই তা কিন্তু
নয়; তবুও অতিউৎসাহী কেউ
কেউ বলেই বসে, “কি দাদা,
এটা কি আপনার দেশের
লোক?” “মুসলমান”? দত্ত
বাবুর অস্বস্তি বাড়ে,
কিন্তু আলফাজ
নির্বিকার। সে মন্দির
দেখে; পুজোর থালা
বহনকারী হিন্দু বৌ গুলো
কে দেখে অকারণেই মুগ্ধ
হয়। বাজারে মাছ
বিক্রেতা উঁচু গলায়
তাকে ডাকে, “বাবু আসেন, এ
আপনাদের দেশের চিংড়ি।”
একজন বলে, “আজকে মাছ-ই
নেন, “গোসত” তো ও দেশে
রোজ খান... পাঁচু গোপালের
দোকানে একজন বলে, “দাদা
ওদেশে কি জঙ্গীরা খুব
শক্তিশালী”। আলফাজ
সকলের সাথে হেসেই কথা
বলে। তার গলায় অভিমানের
লেশ থাকে না
বিন্দুমাত্র।
দত্ত বাবু বুঝতে পারেন,
আলফাজ চলে যাওয়ার পর
তাকে নানা প্রশ্নের
সম্মুখীন হতে হবে; এমন
কি এবার দূর্গা পুজোর
কমিটির সহ-সভাপতির
পদটিও হুমকির মুখে পড়তে
হতে পারে। এক পর্যায়ে
তিনি লজ্জিত স্বরে
বলেন, “তুমি বন্ধু কিছু
মনে করো না প্লিজ”।
আরে না না, এ দ্যাশের
লোকের পিরান শক্তি দেখে
আমি অবাক হচ্ছি রে।
আমাগের দ্যাশের মানুষ
গুলান কিমুন ধারা বদলাই
যাচ্ছে দিন দিন... দত্ত
বাবু কথা গুলো শুনে যায়
ঠিকই কিন্তু এদেশের
মানুষ গুলোকেও খুব
আন্তরিক ও মানবিক বলে
ভাবতে কষ্ট হয়।
তার মনে পড়ে সেই দিনের
সেই বাঁচার সংগ্রামে,
রেশন কার্ড, জাতীয়
পরিচয়পত্র যোগাড় করা
অথবা চাকুরী পাওয়ার
ক্ষেত্রে এই হিন্দু
দরদী মানুষ গুলো কোন
রূপ সাহায্য করেনি। ঘুষ
নিয়েছে নির্লজ্জের মত।
তারপরও একটা ভেসে আসা
উদ্বাস্তু থেকে
রিফিউজিতে পরিণত হওয়া
পরিবারের মুখ বুজে মেনে
নিতেই হয় সবকিছু, শুধু
এক খন্ড মাটির জন্য,
একটুকু পরিচিতির
জন্য-একটা দেশ পাওয়ার
আশায়।
গল্পের এক পর্যায়ে
আলফাজ বলেন, “মহান
আল্লাহ পাকের দুনিয়ায়
কেউই অসহায় না; আল্লাহ-র
এই দুনিয়ায় এই দ্যাশটা
না থাকলি, আমাগো
বারোহাটি, বটতলা,
বারুরী গিরামের জানের
ভয় পলাইয়া যাওয়া হিন্দু
গুলান, কনে গিয়া বাঁচত!”
মূহুর্তে পরিমল দত্তের
চোখের সামনে ঝিলিক দিয়ে
যায় জোসনা প্লাবিত
রহস্যময় রূপসা, দিগন্ত
জোড়া সরষে ক্ষেত,
অমবশ্যার রাত, রশির,
ওমরদের রক্ত চোখ,
রক্তের গন্ধ, বাবা
হরিপদ দত্তের বিপন্ন
দৃষ্টি... বাঁচার জন্য
একখন্ড মাটির
আকাক্সক্ষায়- যাকে তারা
দেশ বলবে। এভাবেই কেটে
যায়, আলফাজ মিঞার বাকী
দিন গুলো। আনন্দ আর
ছেলে মানুষীতে দুই মধ্য
বয়স্ক মানুষ বার বার
ফিরে যায় তাদের কৈশোরে।
যেখানে কোন বিধিবদ্ধ
সীমানা থাকে না; যেখানে
সবাই রাজা। ধর্ম অথবা
রাজনীতির নিয়ম,
হিন্দু-মুসলমানের
বিভেদ টানতে ব্যর্থ হয়।
আলফাজের চলে যাওয়ার
আগের দিনে বহরমপুর,
মুর্শীদাবাদ বেড়িয়ে
আসে তারা। ফেরার পথে
মুর্শীদাবাদের এক
গ্রামের মসজিদে নামাজ
আদায়ও করেন আলফাজ মিঞা।
অজু সারতে সারতে আলফাজ
বলে, “বন্ধু তুমি তো
দেখি এখনো হরিনাম ধর
নাই; ঘটনা কি? তো তুমি
ইখানে বস, আমি নামাজটা
সারি ফ্যালাই- হাতের
কাছে মজিদ পালাম তো...
অবশ্য সফরের সময় অনেক
কিছু মাফ আছে...” পরিমল
দত্ত বসে থাকে। আলফাজের
নামাজ শেষ হয়। এক সময়
ওদের ভ্রমণও শেষ হয়।
বাড়ি ফিরে আসে দু’জন।
রাতে দত্ত বাবুর স্ত্রী
আলফাজ মিঞার ব্যাগ
গুছাতে সাহায্য করেন
হাসি মুখে। পরদিন সকালে
প্রয়োজনীয় কাজ ফেলে
পরিমলও তার সাথে বেড়িয়ে
যায় বন্ধুকে এগিয়ে
দেওয়ার জন্য। বাড়ি থেকে
কল্যাণী ষ্টেশন।
ট্রেনে তুলে দিয়ে বাইরে
নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে
দত্ত বাবু। এক সময়
গাড়ির দরজার ভীড় ঠেলে
সে গাড়িতে উঠেও পড়ে।
আলফাজের কাছে এসে
হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
“উঠেই পড়লাম; তোকে
বর্ডার পর্যন্ত এগিয়ে
দিয়ে আসি।”
“আলহামদুইল্লা”, বলে
আলফাজ আবার হা হা করে
হসে ওঠে। তার এই
দিলখোলা হাসিতে
যাত্রীরা কিছুটা
বিরক্ত হয়। বর্ডারে
পৌঁছুতে খুব বেশী সময়
লাগে না ওদের।
ইমিগ্রেশনের কাজ মিটে
যায় দ্রুত। তারপর চেকিং
শেষে ওরা এসে দাঁড়ায়
একবারে সীমানায়। এখান
থেকে বেশ কিছুটা পথ
হেঁটে যেতে হয়। তারপর
বাংলাদেশি বি.জি.বি-এর
চেকিং। সব কাজ শেষ করে
আলফাজ পা বাড়ায়। মৌখিক
অনুমতি নিয়ে পরিমলও তার
সঙ্গী হয়।
আলফাজ বলে,
কনে যাচ্ছিস?
যাই তোর সাথে কিছুটা
পথ।
বেশ কিছুটা পথ তারা
হেঁটে চলে নির্বাক।
তারপর আলফাজ মিঞা হঠাৎ
থমকে দাঁড়িয়ে বলে,
“আমি আবার আসবানে,
আল্লাহ যদি বাঁচায়। এ
দ্যাশের মানুষ গুলাই
বড়ই ভালা-এরা আমার
বন্ধুরে থাকতি দেছে।
একডা পরিচয় দেছে- একডা
দ্যাশ দেছে- আমি কি
এগেরে না ভালবাসি থাকতি
পারি- আমি আবার আসবানে।
অহন তুই যা পরিমল; আর আসা
লাগবিনে- আল্লাহ
হাফেজ...
আলফাজ মিঞা লম্বা পা
পেলে এগিয়ে যায়
বাংলাদেশের দিকে।
পরিমলের মনে হয় বুকের
মাঝটা অতি দ্রুত ফাঁকা
হয়ে যাচ্ছে তার মনে হয়
সেই সে দিনের মত রূপসা
নদীটা আবার দূরে সরে
যাচ্ছে। পরিমলের চোখটা
হঠাৎ জ্বালা করে ওঠে।
চওড়া ফ্রেমের চশমা
সরিয়ে রুমাল দিয়ে পরিমল
দত্ত তার ভেজা চোখ
মোছে। মুছতেই থাকে। তার
‘মুসলমান বন্ধু’ আলফাজ
ক্রমেই হারিয়ে যেতে
থাকে দৃষ্টির বাইরে।
একজন স্থানীয়
ভ্যানওয়ালা হঠাৎই
চিৎকার করে বলে, “দাদা
ওদিকে গেলে, পাসপোর্ট
দেখিয়ে যাও- না গেলে
ফিরে যাও; তুমি যেখানে
দাঁড়িয়ে আছ ওটা নো
ম্যানস্ ল্যান্ড।”