এ পাগল অন্ধরেখায় কেউ
নেই,তুমি একাই। তোমার
আশপাশ জুড়ে পড়ে রয়েছে
কিছু শুকনো পাতা,কিছু
না মানুষী স্তব্ধতা,আর
অপরিসীম এক শূন্যতা।
একে তুমি আদর করে
ব্ল্যাকহোল বলেই ডেকো।
ক্যাপ্টেন নিমো এবার
উঠলেন,চেয়ার থেকে।
জানলার ধারে গিয়ে
দাঁড়ালেন। জানলা মানে
একটা জানলার একটা
ফ্রেমই শুধু দাঁড়িয়ে
আছে,তাকে আঁকড়ে থাকার
মত দেওয়াল নেই,মাথায়
ছাদ নেই,কেবল ওই যা
ভূমিটুকুই। তবু ফ্রেম
আউট হলেই বহুদূর অবধি
কিছুই নেই। কিছু ঝাপসা
অক্ষরের মতই
সীমান্তরেখা। আছে
গোলাগুলির শব্দ। যা এ
সীমান্তরেখায় খুব
পরিচিত। কিন্তু এখন
কোনো শব্দও নেই। তিনি
মাথার পেছনে হাত রেখে
চোখ ছোট করে আনলেন,কেমন
যেন এ দৃশ্যমানতায়
কিঞ্চিৎ
নড়াচড়া,উদগ্রীব
হলেন,ছোট্ট তিন্নি দৌড়ে
আসছে হাত বাড়িয়ে...নিমোর
মুখে ফুটে উঠলো হাসি।
কিন্তু কারা যেন ওকে
ধরে নিলো,আর তিনি হাত
জোড় করে অনুরোধ করবার
চেষ্টা করলেন,গলা দিয়ে
স্বর বেরিয়ে এলো না।
ভোর হচ্ছে,আলো,পালাতে
হবে,এক্ষুনি। কেউ যদি
দেখে ফেলে ভুল করে।
তিনি ট্রেঞ্চে প্রবেশ
করলেন। মাথার ওপর দিয়ে
উড়ে যাচ্ছে বোমারু
বিমান। নড়লে চড়লেও শব্দ
হবে। তাই স্থির।
দশ...নয়..আট
বেনিয়াটোলা লেন এর
বাড়িতে বাবা যখন ফিরতেন
বাজার করে,মা এগিয়ে এসে
ব্যাগটা ধরে নিতেন।
কষ্ট হয়তো। মা বাবার
বন্ধু ছিলো
নিশ্চিত,পূর্ব জন্মেও।
একথা বলতেই মা খুব
হেসেছিলো। দিদিও।
প্রাচুর্য ছিলো না
কখনোই। ডাল ভাত দু এক
টুকরো মাছ। বেঁচে থাকতে
আর কত কি লাগে! দিদি গানে
বসলে নয়ন বসতো তবলায়।
নয়ন মানে নয়ন
মুখার্জী,সংক্ষেপে
নিমো। মা দিদির সাথেই
গলা মেলাতেন। পোষা
বেড়ালের সোহাগী ঘরঘরে
আওয়াজের মতই সুখ ছিলো এ
বাড়িতে। বাবা চলে
গেছিলো এক শীতের রাতে।
দিদির বিয়ে,মার
ক্যানসার। নিমো চাকরি
পেলো…
সকালটা দুপুরের দিকে
এগোচ্ছে। জল তেষ্টা
লাগে খুব। কিন্তু আনতে
যাবে কি করে,যদি কেউ
দেখে ফেলে। শত্রুপক্ষ
খুব শক্তিশালী। তাই
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে
থাকলো। কিছু অবিন্যস্ত
এলোপাথাড়িই আজ নিমো।
জানলার ফুটো গুলো ভরাট
করতে গিয়েই জানলো
দেওয়ালই নেই। নেই মানে
ছিলোই না। অথচ সে
লিখেছিল দেওয়ালে পিঠ
ঠেকে গেলে ঝাঁপিয়ে
পড়তেই হয়! আচমকা কিসের
শব্দ,ছায়া সরে গেল মনে
হল। ওরা কি টের পেয়েছে
তবে? তার উপস্থিতি? নিমো
খেয়াল করেনি,এ আসলে
তারই পায়ের শব্দ। তারই
ছায়াকে শত্রুপক্ষের
ভেবেই সে লুকিয়ে
পড়েছিলো। এ বিস্তীর্ণ
নো ম্যানস ল্যান্ডে
এটাই দস্তুর। নিজেকেও
বিশ্বাস করা নিষেধ।
দুপুর খুব আলসেমি নিয়ে
হেঁটে যাচ্ছে বিকেলের
দিকে।
ঝুল ধরেছিলো ঘরগুলোতে।
কে আর পরিস্কার করে।
বিশাল অশ্বত্থ ফাটিয়ে
দিচ্ছে দেওয়াল,লোপাকে
বিয়ে করে এনেছিলো নিমো।
মানে লোপাই র্যাদার
আগ্রহ নিয়ে এসে
পৌঁছেছিলো নিমোদের
বাড়ি। ক্লাসমেট বিয়ে
করার কিছু সুবিধে থাকে।
সে সব বোঝার কথা,কত
দিনের বন্ধুতা। মা
বহুবার বলতো,বিয়েটা
অন্তত দেখে যেতে দে
নিমো। সে না করেনি। যা
করতে হয়,তা করে ফেলাই
শ্রেয়।ঝুল বারান্দাটা
আরও পুরনো হয়েছে।
রেলিঙে মরচে। সম্পর্ক
তো সময় গেলে মজবুত
হয়,তাই ই জানতো নিমো।
দেখেছে আঠা কমে আসে।
পাশাপাশি শোওয়া দুটি
মানুষের মাঝেও কি
দুর্ভেদ্য দেওয়াল উঠে
যায় কখন অজান্তেই।
বিকেলগুলো জুড়েই চলে
সামরিক কুচকাওয়াজ।
পর্যটকরা ভীড় করে
কুচকাওয়াজ দেখতে। দুই
যুযুধানপক্ষের এই
গ্যালারি শো বেশ মজার!
হাতে হাত মেলানো,এক
সাথে পতাকা নামানো,যেন
সন্ধির মেজাজ,বন্ধুতা।
আদতে সন্ধ্যে পেরোলেই
কিন্তু শুরু গোলাগুলি
আবার। বিকেলের ওই
সময়টাতে নিমো অস্তগামী
সূর্যকে সাক্ষী
রেখে,ফিরিয়ে আনতে
চেষ্টা করে হারানো
দেওয়াল,কিছু পর যা হয়ে
উঠবে বাঙ্কার। বাঁচতে
হবেতো প্রাণে। এ ছাড়া
উপায় কি আর। এই সেই
একমাত্র সময় যখন সে
বাইরে এসে দাঁড়ায়। কতটা
জল আর কতটা দুধ মাপতে
গিয়ে ঠিক ঠাহর করতে
পারেনা। এই একমাত্র সময়
যখন কুচকাওয়াজে চাপা
পড়ে যায় শব্দ। মুখ থেকে
ও বার করে আনে শব্দ। তা
অর্থবোধক হয়ত হয়ে ওঠে
না। নিজের শরীরকে ছুঁয়ে
ছুঁয়ে দেখে। সেওতো
ভালোবাসা। যুদ্ধ চললে
বুঝি নিজেকে ভালোবাসাও
যায়না? পড়ে থাকা
পাতা,ভাঙা দেওয়ালের
টুকরো ইতিউতি ছড়িয়ে
থাকা
বিচ্ছিন্নতাগুলোকে
কুড়িয়ে আনার ফাঁকেই
সন্ধ্যে নামে। এবার
আবার লড়াই শুরু।
: বাপি বলে বুকে এসে মাথা
রাখলে জুড়িয়ে যেত মন।
কেমন একটা প্রশান্তি
ছড়িয়ে পড়ত সারা শরীর
জুড়ে। কিন্তু সে
প্রশান্তি
দীর্ঘস্থায়ী হবার আগেই
ডাক পড়ত মিমোর। মিমো
নয়নের পুত্র। একটু একটু
করে তার বড় হয়ে ওঠাগুলো
ও যে এক শিল্পের
নির্মাণ। কিন্তু লোপার
তা যে পছন্দ না। কবে যে
তাকে ঠিক ঘৃণা করতে
শুরু করেছিলো লোপা তা
কিন্তু নয়ন ওরফে নিমো
জানেই না। জানে হাঁড়ি
কুড়ি এক জায়গায় থাকলে
ঠোকা ঠুকি হয়। আবার তা
নিজের নিয়মেই থেমেও
যায়। জোর করে তা থামাতে
হয় না। কিন্তু যদি তেমন
দীর্ঘসময় ধরে ভূমিকম্প
হয়,তখন? মা চলে গেল তেমনই
এক ভূমিকম্পের দিনে।
বাতাসে তখন জলের গুঁড়ো
উড়ে উড়ে নেমে আসছে।
আকাশ অন্ধকার। দমকা
বাতাস বইছে। ভেঙে
পড়ছিলো দেওয়াল।
দরজা...একটাই জানলা কি
করে যেন রয়ে গেল মাটি
আঁকড়ে। আর নিমো সে
জানলার ফ্রেমেই
দেখছিলো লোপা আর মিমোর
চলে যাওয়া,তখন রাত
নামছে।
সন্ধ্যের পর এই না
মানুষী ভূখন্ডে কেমন
যেন এক শূন্যতা এসে ভর
করে। কোনো শব্দ নেই।
কোথাও আলো নেই,অথবা আছে
চোখে আসছে না,ভূমির
বন্ধুরতায়,বাঙ্কারের
পাঁচিল পেরিয়ে। তবু
পৃথিবীরও আছে নিজস্ব
আলো। সে ক্ষীণ আলোয়
দেখে নেওয়া যায় শত্রুর
অবস্থান। জানলার
ফ্রেমের বাইরে শরীর
ঝুঁকিয়ে বাইরের মাটি
স্পর্শ করতে গিয়েই
চ্যাটচ্যাটে কি একটা
তরল যেন স্পর্শ করল
নিমো,হাত চোখের কাছে
নিয়ে এসে দেখলেও
ঠিকঠাহর করতে পারলোনা।
দুটো দেশলাই কাঠি আছে।
একটা রাতের জন্য। একটা
এখব ব্যবহার করা যেতে
পারে। কিন্তু
সতর্কতায়। কারণ আগুণ
টের পেলেই শত্রুপক্ষ
মুহুর্তে ঝাঁঝরা করে
দেবে গুলিতে,আর বারুদ
যতই থাকুক না কেন,তারও
তো ক্লান্তি আছে,যখন
আগুণ বাড়ন্ত। নিজের
সমস্ত শরীর দিয়ে আড়াল
করে,আগুণ জ্বালতেই চমকে
উঠলো নিমো। রক্ত! আর তা
নি:সৃত হচ্ছিলো তারই
শরীর থেকে,কই সে বোঝেনি
তো কিছুই। রাত গভীর
হচ্ছে।
লোপা তার বন্ধু ছিলো!
মিমো তার সন্তান,যেমন
বেনিয়াটোলার এই
ভাঙাচোরা বাড়িটাই তার
আশ্রয়! তেমন ভূমিকম্পে
আসলে কিছুই আস্ত
থাকেনা। একটু পর হয়ত
চিল শকুনের আশ্রয় হবে
এই বাড়ি। যে কোনো ধ্বংস
স্তুপেই এরাই
মুখ্য,মিমোর দোলনাটা
কেমন তালগোল পাকিয়ে
গেছে। বিছানা যে
বিছানায় ভরা গ্রীস্মেও
ভেসে আসতো বানভাসির
শব্দ আড়াআড়ি ভেঙেছে।
ছাদ নেই। জানলার রেলিং
গুলোও কারা চুরি করে
নিয়ে গেছে।
ধ্বংশস্তুপের নীচে
চাপা পড়েছে বাবা ও মার
ছবি। এখানে যে জীবন
কখনো ছিলো কে বলবে! একটু
দূরে বসে একটা মিনি
বেড়াল কেবল কাঁদছে। ওর
ও কিছু চাপা পড়েছে।
প্রাণ বলতে এই দুই।
নিমো আর মিনি বেড়াল।
বুকে ব্যথা হচ্ছে খুব।
একটু জল পেলে ভালো হয়।
উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পড়ে
গেল নিমো। লোপা ভালো
থাকুক তার নতুন সাথীর
সাথে। হাত দুটো কপালে
তুললো নিমো। এটা কি
প্রার্থনা না’কি
স্যালুট টু দা
আর্থ,যেখানে কাটলো এই
স্বল্পদিনের পর্যটন
ঠিক বোঝা গেল না।
ফণিমণসার গাছটা কিন্তু
অক্ষত আছে।
কাঁটাতারের এত কাছে
থাকলে বোঝা যায় জলপাই
বীভৎসতা। মিলিটারি
বুটের শব্দ এগিয়ে
আসছে,তীব্রতর হচ্ছে
আওয়াজ। তবে কি ওরা টের
পেয়েছে,নিমোর
অস্তিত্ব। বুকে খুব
ব্যথা। উঠতেও পারছেনা।
তবু,সেই দেওয়ালহীন
জানলার দিকে নিজেকে
টেনে নিয়ে গেল,বাইরে
তাকাতেই চোখে পড়ল কে
যেন হাতছানি দিয়ে
ডাকছে। ওহ! মিমো। কোথা
থেকে এলো। বুটের আওয়াজ
আরও তীব্র। মিমোর
বাড়ানো হাত ধরলো বাবা।
কোনোরকমে নিজেকে বার
করে আনলো ঘষটে ঘষটে।
স্টপ। ডোন্ট মুভ। এ
যুদ্ধক্ষেত্রে এখন আর
কোনো প্রাণের শব্দ নেই।
জোরালো টর্চের আলো পড়লে
দেখা গেল,ঘষটে জানলা
পেরনোর দাগ। আসলে
এখানেই হয়ত বাঁচার
চেষ্টা করছিলো কেউ।
কাঁটাতারের কাছে দূরে
আর কোনো শব্দ নেই। পিস
এন্ড পিস রিস্টোরড
এগেইন।