ফুর্র্র্র্র্ ...
বাঁশি বেজে উঠেছে ।
ব্রাসিলের মাঠে
মিডলাইন বরাবর দাঁড়িয়ে
আছে দুই দল । মুদ্রা
লাফিয়ে উঠছে শূন্যে ।
ফোকাসে দুই অধিনায়কের
উদ্বিগ্ন মুখ । ভাগ্য
নির্ধারিত লাথিতে খেলা
শুরু ।
এখনও -- দায়, সংসার,
ব্যস্ত জীবনে বিরামহীন
দৌড়ের মাঝে কোনো এক
অপার্থিব বিকেলে
ফ্লাশব্যাকে ফিরে আসে
শৈশব; ভেসে ওঠে বাতাস
কাটার আওয়াজ,মুদ্রার
মাটিতে আছড়ে পড়ার ধাতব
শব্দ -- ঠং ন্ ন্ ন্ ।
মনে পড়ে, কারো পকেটে
একটা সিকি থাকলেই
বাজিতে মেতে ওঠা জীবন
জুয়ার সেই সূত্রপাত;
বল্ তো - হেড না টেল ?
আমরা সব্বাই প্রায় একটি
সিনেমা অবশ্যই দেখেছি -
শোলে । সেখানে টসের
গুরুত্ব ঠাকুর সাব, জয়,
বীরু, বাসন্তি বা
ধান্নু'র থেকে
কিছুমাত্র কম বলে মনে
হয়নি আমার । দুর্দান্ত
চতুর, মিতবাক জয় বারবার
টস করে আর জিতে যায় ।
ক্লাইম্যাক্সে টস্
নির্ধারণ করে জীবন -
মৃত্যুর, বুদ্ধিমান জয়
বন্ধুত্ব নামক এক সোনার
পাথরবাটির জন্য মরণকে
টেনে নেয় বুকে । জানা
যায় মুদ্রার দুদিক ! এ
মৃত্যু, আত্মহত্যার এক
অবিশ্বাস্য দলিল; অন্তত
একে আত্মহত্যা ছাড়া
কিছুই ভাবা যায় না ।
সমগ্র অস্তিত্ব জুড়েই
বেজে চলে এক মায়াবী
মাউথঅর্গ্যান ।
শৈশব থেকে মৃত্যু
পর্যন্ত আমাদের জীবন
জুড়ে লাফিয়ে চলে টস্ ।
যেন একটা ব্যাঙ !
অবিশ্যি সে ব্যাঙ
শীতকালের অপেক্ষা রাখে
না । সদ্য কৈশোরে পাড়ার
গলিতে পয়সার অভাবে ভাঙা
চারি, কিংবা মুঠোয়
পাতার খণ্ড রেখে হার
জিতের যে পদ্ধতি
মফঃস্বলের কিশোররা
ব্যবহার করে সেটাও তো
টস । ক্রিকেটে টস নিয়ে
কত ধুন্ধুমার কাণ্ড,
এখন সেসব স্মৃতির কোলাজ
। ভাগ্যে চিরকাল
অবিশ্বাসী মানুষও
বারবার টস হেরে একসময়
ভাবে - দৈব প্রবল না
থাকলে হেরে যেতে হয়; তবু
সে চেষ্টা চালায়
পুরুষাকার দিয়ে ।
চর্মগোলকে প্রথম
লাথিটিও দৈবের অধীনস্ত
আবার ক্রিকেটে সুপার
ওভারে মীমাংসা না হলে
টস নির্ধারণ করে
হারজিতের । হেরে যায়
লড়াই জিতে যায় ভাগ্য ।
আমাদের বৃহত্তম
গণতন্ত্রেও টস তার
জায়গা ধরে রেখেছে ।
কোয়ালিশন সরকার যেন সেই
টসেরই রকমফের । আবার
ভোটে যেখানে দুই
যুযুধান পক্ষের 'টাই'
সেখানেও টস্ ! তার ফলে
মাঝে মাঝেই জগঝম্প
ব্যাপারস্যাপার,
'হারিজিতি নাহি লাজ' এ
কথা দুর্ভাগার
সান্ত্বনা ছাড়া আর যে
কিছুই নয় সেটাও সুধীজন
মনে মনে জানেন এবং
ছাগলের তৃতীয় বাচ্চার
মত টসের তোষামোদি করতে
বাধ্যও হন । ভেবে দেখুন
এই টস্ আসলে কী
নির্বাচকমণ্ডলীকেই
চূড়ান্ত অপমান করা নয় ?
অভিধান জানাচ্ছে - টস
নানাবিধ অর্থে
লাফালাফি করে ! 'হাত দিয়ে
ওপরে ছোড়া', 'আন্দোলিত
করা' ইত্যাদি ইত্যাদি ।
আন্দোলিত যে হচ্ছি
সেকথা বলাই বাহুল্য আর
সে যে মাঝে মাঝেই খাবি
খাওয়া সেটাও টের পাচ্ছি
।
অপ্রচলিত একটি
শব্দবন্ধ এই প্রসঙ্গে
মনে পড়ছে - 'ব্রেস্ট
টসিং' । রসিকজনেরা
জানেন পেন্ডুলামের
দ্বিত্ব চলনে কিঞ্চিৎ
আমিষ গন্ধ থাকলেও সে বড়
মোহময় । টসের এই টস্কে
দেওয়াটা ভারি উপভোগ্য
ব্যাপার ।
এবার ভাবুন দেখি, টস যদি
সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করত
কেমন হত !
স্বয়ংবর সভায় সুন্দরী
কন্যেটি একটি মুদ্রা
নিয়ে দুই এর সরল
গুণিতকে ভাগ করে
নিচ্ছেন পতিপ্রবর আর
সেই সভায় আমন্ত্রিত
আমজনতাও । শেষে এসে
দেখলেন - রূপে লক্ষ্মী,
গুণে সরস্বতী যে
কন্যাটিকে সমাজের জন্য
পাবেন না কোনোদিন
ভেবেছিলেন, টসে সেই
আপনিই ফাইনালিস্ট এবং
শেষাবধি এক কুবের
পুত্রকে হারিয়ে লাভ
করলেন কন্যারত্ন ।
মৃত্যুর সময় ড্যাঙস
হাতে চার বিদঘুটে যমদূত
আপনাকে নিতে এসেছে ,
আপনার পরিবার বললেন -
লেটস্ টস্ । আর আপনি
আবার জিতে এই বিকট গরম,
ঘাম প্যাচপেচে জায়গায়
থাকার মেয়াদ বাড়ালেন ।
ব্যাজার মুখে যমদূতেরা
ফেরত গেল আর যম ক্ষেপে
গিয়ে তাঁদের শাস্তি
দিলেন টস্ করে -- নেশা
তিনমাস বন্ধ । বাজারে
দেখলেন ইলিশের বেজায়
দাম, পকেট থেকে কয়েন বের
করে বললেন - আজ টস্ হোক
। যদি জিতি ইলিশ আমার,
হারলে সব টাকা মেছুরের
। অথবা উজ্জ্বল মঞ্চে
বিখ্যাত সাহিত্য
পুরষ্কার দেওয়া হচ্ছে
টস করে । কি সাংঘাতিক
ব্যাপার হত সেসব হলে !
জীবন আমাদের জন্য
সাজিয়ে রাখে ঘুঁটি,
নিরন্তর দাবা খেলে চলে
ভাগ্য । শৈশব থেকেই
শুধু টস করে চলছি আমরা ।
মুহূর্তের ভুল আমাদের
জন্য প্রস্তুত রাখছে
কঠিন থেকে কঠিনতর
ময়দান, কেউ কেউ জিতছে আর
কেউ কেউ হেরে যাচ্ছে
অবিরাম । গীতা থেকে
মহাভারত - সবই দৈব নামক
টস - উপাখ্যান ! মহাভারতে
ইচ্ছামৃত্যু'র অধিকারী
পিতামহ শায়কশয্যায়
প্রশ্ন শুনছেন পার্থের
- ' কেন ইচ্ছামৃত্যু'র
অধিকারী,
সর্ববিদ্যাবিশারদ
আপনার এই অবস্থা ? '
ভীষ্ম উত্তর দিচ্ছেন - '
পার্থসারথি জানেন,
পুরুষাকার থাকলেও হেরে
যেতে হয় । দৈবই আমাদের
নিয়ন্ত্রক ।' এখানেও
সেই টস, ভাগ্যের সাথে
পুরুষাকারের । যোগ্যতা,
প্রতিভা, সততাই শেষ কথা
নয় । শেষ কথা বলেন নিয়তি,
যার নিয়তি শোলের সেই
কয়েনের মত, দু'পিঠেই
শেষাবধি হেরে যাওয়া
লিখে রাখে - তাকে, আঙুরফল
টক্ ভেবেই মেনে নিতে
হয় পরাজয়ের আড়াল । ' হেড
ফর আই উইন, টেল ফর ইউ লস' -
এসব বাক্য হয়েই থেকে
যায় ।
মুখে বলি -' লড়াই, লড়াই,
লড়াই চাই / লড়াই করে
বাঁচতে চাই' । কিন্তু
শেষে গিয়ে জেতে সেই
ভাগ্য । জীবনের মাঠে
আমরা গড়াচ্ছি ফুটবলের
মত । কেউ হ্যান্ডবল
করেও গোল দিচ্ছে রেফারী
নামক ঈশ্বরের
বদান্যতায় আবার কেউ যে
মুহূর্তে পৌঁছে যাচ্ছে
লক্ষ্যের দোরগোড়ায় -
ওমনি বেজে উঠছে খেলা
শেষের লম্বা বাঁশি ----
ফুর্-র্-র্-র্-র্
-র্-র্-র্-র্-র্
............