নাদু, এক পা এক পা করেই
বেড়ার দিকে এগিয়ে এলো।
রবি কাকা অন্যমনষ্ক হয়ে
বিড়বিড় করতে করতে বেড়ার
ফাটক খুলে চলে গেলেন
দক্ষিণের দিঘীর
রাস্তায়। সারাদিন কি এত
কথা থাকে লোকটার কে
জানে। নিজের মনে কথা
বলারও কি শেষ নেই কোনও?
রবি কাকা চলে গেলেন...
আবছা আলোয় ছায়া বোঝা
যায় না... না হ’লে একটা
লম্বা ছায়া পড়ে লুটোতে
লুটোতে যেতো খোয়া বিছনো
রাস্তায়। ফোনটা আর
বাজছে না... চার্জ শেষ।
বউয়ের চিন্তা... মেয়ের
জ্বর... ওষুধ... সব একসাথে
নিয়ে রবি কাকা চলে
যাচ্ছেন দিঘীর ঘাটে।
নাদু’র কাছে আর ওসব
কিচ্ছু পড়ে রইল না।
আসলে রবিকান্ত রায়ের এই
অদ্ভুতুরে বাড়িটার
ধারেকাছে এলেই নাদুর
এমন হয়... শুধু নাদু একা
পড়ে থাকে মনের মধ্যে।
বউ, মেয়ে, ঘাটের ধারে
শ্যামলী, মাস্টারের
মেয়ে সোমা... সব কেমন এক
একটা মুখোশ মনে হয়।
শালার সংসারটা এক একটা
মুখোশ... সব ঠিকানাগুলো
মুখোশের দোকান। এইখানে
এসে, এমন সন্ধেবেলায়
হঠাৎ নাদু’র মনে হয়...
নাদু ডাকে সাড়া দেওয়াই
সে বন্ধ করবে। তার
মায়ের দেওয়া ভাল নামটা
নদেশ্বর, শ্রাবণ মাসে
শিবের কাছে মানত করে
পাওয়া ছেলে বলে। সেই
মায়ের সাথে নামটাকেও
চিতেয় তুলে দিলো এরা।
নিজেকে এইরকম ভর
সন্ধেবেলা... মাঝে মাঝে
নদেশ্বর বলে ডাকতে
ইচ্ছে করে।
শুধু নিজেকে নিয়েই
আসতে আসতে বেড়ার আরও
কাছাকাছি এগিয়ে গেল
নাদু, ফাটকের হুড়কো
তুলো ঢুকে পড়ল ভেতরে।
রবিকান্ত রায়ের
হোমিওপাতিক ওষুধের
দরকার রবিকান্তর ছায়ার
সঙ্গে পুকুর পারে চলে
গেছে। তাও কেন ভেতর
থেকে টান আসে? নাদু
‘বিশ্ব’ চেনে না... এক
নম্বর, দু নম্বর-রা কে যে
কত নম্বর, তাও জানে না।
বিরিঞ্চি কে দূর থেকে
দেখেছে, ঠিক যেমন
দেখেছে মাস্টারের মেয়ে
সোমা কে। এখন আর কারও
গোঁফ-দাড়ি ছাঁটার সময়
নয়, বাগানের গাছে জল
দেওয়ার দরকার নেই,
বাজার করার তাগাদা নেই,
বাঁশির আওয়াজও শোনা
যাচ্ছে না কোথাও। ওই এক
চিলতে সন্ধে ঢাকা জমিতে
নাদু’র গল্প শোনার
জন্যেও কোনও নম্বর বসে
নেই। শুধু একটা ছায়া
দ্রুত পায় ঘরের ভেতর
একটা জানলা থেকে আর
একটা জানলার দিকে চলে
গেলো। জানলার গরাদ দিয়ে
ধুনোর ধোঁয়া গলে বাইরে
এসে ভেসে যাচ্ছে। সেই
ধোঁয়ার ওপারে ছায়া, তার
মুখ চেনা যায় না। নাদু
জানেও না, ঘরের ভেতর এক
নম্বর। শ্যামলীর মা’কে
সে ধুনো দিতে দেখছে
লক্ষ্মীপুজোর রাতে।
শাঁখ বাজানোর সময়
বিষ্ণুপ্রিয়া হয়ে ওঠে
শ্যামলীর বুক। কাসতে
কাসতে চোখ লাল হয়ে যায়
শ্যামলীর মায়ের। তবু
শঙ্খধ্বনি থামে না।
নাদু চুপচাপ বসে থাকে,
পুজো শেষের শিন্নির
জন্য... বউ-মেয়ের জন্য
নিয়ে যায় শাঁকালু আর
গুড়ের বাতাসা। ধুনো
দেখেই সেই শিন্নি’র কথা
মনে পড়ে গেল। ধোঁয়া
শুধু আবছা ছায়া দেখতে
দেয়... এর বেশি চিনতে দেয়
না। নাদু জানলার গরাদের
দিকে এগিয়ে গেল, আরও ভাল
করে ছায়া চিনবে বলে।
দাড়ি কামানোর ক্ষুর
ধরতে গেলেই হাত কাঁপত
চার নম্বরের। গলার কাছে
এনে, আসতে আসতে কাত করে
ক্ষুর টানার অভ্যেস
রপ্ত করা চাট্টি খানি
কথা নয়। একটু এদিক ওদিক
হ’লে... ভেবেই শিউরে উঠত।
তারপর আসতে আসতে, সব
কিছুর মত... এও রপ্ত হয়ে
গেছে। মাস্টারের দাড়ি
অবশ্য কামাতে হয় না,
শুধু ছেঁটে দেয়।
মাস্টারের গলার কাছে
ক্ষুর ধরলে হয়ত এখনও
হাতটা কাঁপত। ভয়েই হয়ত...
আর কিছু নয়। আজ সন্ধে
থেকেই ফরিং-এর কথাগুলো
ভোঁ ভোঁ করে কানের
মধ্যে ঘুরছে... যদি কান
বলে সত্যিই কিছু থাকে।
কিন্তু ঘুরছে, তা
নিশ্চিৎ। ঘুরতে ঘুরতে
মেরুদণ্ড বেয়ে সারা
শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে
বৈদ্যুতিক তরঙ্গের মত।
সেও অবশ্য, মেরুদণ্ড আর
শরীর বলে সত্যিই কিছু
থাকে। যদিও দাড়ি আর
কাটা হয় না, শুধু ছাঁটা
হয়... ক্ষুরটা আজ বার বার
বাঁ হাতে উঠে আসছে। চার
নম্বর ডান হাত দিয়েই
দাড়ি কামায়। বাঁ হাতে
ক্ষুর তুলতো বহু বছর
আগে, অন্য দরকারে। বাকি
আর সব নম্বরীদের চোখ
এড়িয়ে সেই বিশ্বস্ত বাঁ
হাত, আর বিশ্বস্ত ক্ষুর
নিয়েই রান্না ঘরের
দিকের দরজার সামনে
চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল চার
নম্বর। এখন পাঁচ নম্বর
পাশে থাকলে নির্ঘাত
দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলত
সেই দরজার চৌকাঠে।
রান্না ঘরের জানলার
পাল্লা দিয়েও ধুনোর
ধোঁয়া চুঁইয়ে চুঁইয়ে
বেরোচ্ছে। চার নম্বরের
ডান হাতের আলতো চাপে,
একটা পাল্লা সড়ে গেলো,
একসঙ্গে বেরিয়ে এলো বেশ
খানিকটা ধোঁয়া। জানলার
শিকের ওপারে একটা দরজা...
তারও একটা পাল্লা খোলা...
তার ওপারে মাটিতে
লুটিয়ে থাকা হলুদ রঙের
শাড়ী। চার নম্বর মনে
মনে বলল “পঞ্চান্ন...
ছাপান্ন... সাতান্ন...”।
রান্না ঘরের দরজাটা
ভেতর থেকে বন্ধ থাকার
কথা, তবুও আলতো একটা টান
দিতেই ভেতরে আলগা
ছিটকিনি টা খট করে খুলে
গেল। এক নম্বর কি
এসেছিলো রান্না ঘরে?
চার নম্বর একবার ঘাড়
ঘুরিয়ে চার পাশটা ঠাওর
করে নিলো অন্ধকারে।
রবিকান্ত এখনও ফেরেনি...
কোথাও কারও কোনও সারা
শব্দ নেই। দ্রুত
নিঃশ্বাসের শব্দ এত দূর
থেকে শোনা যায় না।
টুপ করে জলে একটা ঢিল
পড়ল, একটা ছোট
বৃত্তাকার তরঙ্গ...
বাড়তে বাড়তে ছড়িয়ে পড়ল...
মিলিয়ে গেল আবার।
রবিকান্ত ঘাটে বসে
আছেন, সেই নিস্তরঙ্গ
স্থিতিশীলতার দিকে
তাকিয়ে। দু’গালে হাতে
দিয়ে রবিকান্ত। গালে
হাত দিয়ে তাঁর ছায়া।
গালে হাত দিয়ে
বিবেকানন্দ আর আব্দুল...
যারা আসলে রবিকান্তর
বিশ্ব।
- বিরিঞ্চিকে কেন পুষে
রেখেছ এইভাবে?
- আমি পুষিচি?
- নয় তো কি? তোমার মেয়ে
কেন ওকে ডাকে... বোঝো না?
আবার একটা ঢিল পড়ল
পুকুরে। জল শান্ত হওয়ার
আগেই আব্দুল মাথা নেড়ে
বলল – “হক কথা মাষ্টর...
ওই হারামজাদারে বেশি
আশকারা দ্যাও নি। ও
হালা দোযখের সাপ।” একটা
জল ঢোঁড়া ধীরে ধীরে
পুকুরের এক দিক থেক এক
দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।
একটু পরেই পুরো অন্ধকার
হয়ে যাবে... আর কিচ্ছু
দেখা যাবে না। আব্দুল,
বিবেকানন্দ, মাস্টার...
সব অন্ধকারে মিশবে
একসাথে, কিংবা ডুববে।
টর্চটা হাতে নিয়ে
জ্বালালেন রবিকান্ত,
আলোটা এসে পড়ল সোজা
নিজেরই মুখে। আলোর দিকে
তাকিয়ে অস্ফুটে শুধু
বললেন, “কিন্তু, সোমা যে
বলে... ”। “আহ্... এই
ধূপ-ধুনো... কোষাকুষি...
গঙ্গা জল... তারপর সোজা
অন্দরমহল। এরপরেও
ন্যাকা সেজে থাকবে?
তুমি শিক্ষক?!”
বিবেকানন্দ’র গলাটা
বোধহয় একটু বেশিই চড়ে
গেছিল। কাছাকাছি দু’টো
কুকুর ডেকে উঠল সচেতন
হয়। টর্চের আলোটা সেই
দিকে ফেলে রবিকান্ত
বিড়বিড় করে বললেন, “গেল
বছর মেয়েটাকে ফেলে রেখে
গেলো... বাঁজা বলে। কে যে
কাকে পোষে!” ঘাটের
সিঁড়ি থেকে উঠে
দাঁড়ালেন রবিকান্ত,
সন্ধে পেরিয়ে রাত
হচ্ছে। টর্চের আলো খোয়া
পথে ফেলে এগিয়ে গেলেন
কুকুরদের পাশ কাটিয়ে।
বিবেকানন্দ আর আবদুলের
দিকে ফিরেও তাকালেন না।
কোনও পিছুডাক এলো বলেও
মনে হ’ল না তাঁর।
বেড়ার কাছাকাছি এসেই
বুঝতে পারলেন রবিকান্ত,
ফাটক টা খোলা। কোনও
নম্বরী এসে একটু
লাগিয়েও দেয় না। ভর
সন্ধেবেলা আগোল খোলা
বাড়ি... আগোল খুলেই পড়ে
আছি অন্দরমহল। ভেতরে
ঢুকে ফাটকটা বন্ধ করে
বাড়ির দিকে এগোলেন।
ঘরের ভেতর থেকে ফুঁপিয়ে
ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ
আসছে... মাঝে মাঝে হেঁচকি
তোলার মত টেনে টেনে
নিঃশ্বাস, যাকে কাব্যি
করে ঊর্দু তে সিসকিয়াঁ
বলে। এও একরকম নিয়মিত
ব্যাপার। বিরঞ্চি
থাকলে রবিকান্ত মেয়ের
ঘরের দিকে যান না।
নিজের সম্মানের
অস্থিটুকুও তো নিজের
কাছেই! তবু দরজা হাট করে
খোলা... তবু সচেতন
গৃহস্থের মন খোলা দরজা
দেখলে ওই অস্থিটুকু
নিয়েই তদারকি করতে তৎপর
হয়। রবিকান্ত দরজা খোলা
দেখে সন্তর্পনে নিজের
বাড়িতেই চোরের মত
প্রবেশ করলেন। মাটিতে
পড়ে থাকা ছায়াটা
বিবেকানন্দর ধিক্কারে
থেঁতলে গেছে একেবারে।
সোমারই গলার আওয়াজ
বটে, সত্যিই কাঁদছে
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে...
বোধহয় বিরিঞ্চি ফিরে
এসেছিল, মেজাজ দেখিয়ে
বেরিয়ে গেছে কোথাও।
ইতস্ততঃ করেই মেয়ের
ঘরের চৌকাঠে পা রাখলেন
রবিকান্ত। তারপর চমকে
উঠে পা টা পেছনে টেনে
নিলেন। মুখ দিয়ে
অস্ফুটে বেরিয়ে এলো “এ
কি!”
লাল রঙের মেঝেতে গাঢ়
লাল রঙের রক্তের সরু
ধারা... জমে আসতে আসতে
খয়েরী হয়ে যাচ্ছে। ঘরের
একদিক বিরিঞ্চি আধমরা
অবস্থায় পড়ে আছে, বোধহয়
জ্ঞান নেই। সাদা ধুতিটা
রক্তে লাল... তলপেটের
নিচে ধুতিতে লাল
ছোপছোপ... তাজা ক্ষত। আর
সেই ধারা বেয়ে এসেছে
মেঝেতে।
একটু দূরে দেওয়ালে পিঠ
ঠেকিয়ে মেয়ে সোমা বসে
আছে, সামনের দিকে পা
ছড়িয়ে। চোখ দু’টো বন্ধ।
বুকের ওপর থেকে আঁচলটা
সড়ে এসে মাটিতে
লুটচ্ছে। বন্ধ চোখেই
জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছে।
নিঃশ্বাসের ওঠানামার
সাথেই মাঝে মাঝে কেঁপে
উঠছে শরীরটা। হাতের
মুঠোয় ধরা টর্চের ওপর
আরো শক্ত করে চেপে বসল
রবিকান্তের আঙুলগুলো,
বলে উঠলেন “মধুসূদন!”...
এবারে এটু জোর গলাতেই।
বাবার গলার আওয়াজ শুনে
চোখ তুলে তাকালো সোমা,
তারপর অস্ফুটে শুধু
একবার “নাদু” বলে ডুকরে
কেঁদে উঠল।
নম্বরগুলো সব ছড়িয়ে
ছিটিয়ে রয়েছে এদিক
ওদিক। পাঁচ নম্বর মুচকি
মুচকি হাসছে
রবিকান্তের বাড়ির খোলা
দরজা-জানলার দিকে
তাকিয়ে। ধুনোর ধোঁয়া
একেবারেই নেই আর... সব
কিছু স্পষ্ট দেখা
যাচ্ছে। আর, চার
নম্বরের মোনটা ফড়িং-এর
থেকেও বেশি হালকা এখন।
হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে
চার নম্বর। শয়তান
ফড়িংটা ওকে দিয়ে খুন
করিয়ে দিয়েছিল প্রায়...
কিন্তু না! বাঁ হাত তার
এখনও বেশ বাধ্য। দু
নম্বরের কাছ থেকে
খুড়পিটা চেয়ে নিয়ে সব
অশান্তির মূল নিম গাছের
গোড়ায় পুঁতে ফেলেছে চার
নম্বর।