বাসস্ট্যান্ডে তখন
অনেক লোক । বেশিরভাগ ১৪
থেকে ২১, আর কিছু বয়স্ক ।
প্রথম দল হাঁটবে আর
পরের দল হাঁটাবে ! এমনটা
ধরে নিয়েই বাস চলতে
থাকে । বাইরে পতপত করে
ওড়ে নাম লেখা পতাকা,
সঙ্গে লোগো... আর গন্তব্য
। এবারের ট্রেকিং
সিকিমে । প্রতি ছ’মাস
অন্তর নাম পাল্টায় ।
আসলে পাহাড়ে যায় সবাই ।
পাহাড়ে যাওয়াটাই সব ।
রাতের খাওয়া বহরমপুরে ।
ধাবার আবছা আলো আর
বাড়তি আচার চাইবার
ফাঁকে খুচরো আলাপ ।
বেশিরভাগের একই শহর,
স্কুলে স্কুলে
রেষারেষি । ফার্স্ট বয়
আর মধ্যমেধা কিশোরী
কোনাকুনি টেবিলে পোকা
তাড়াচ্ছে । কয়েকজন
ছোট্টবেলা থেকেই এই
দলের সঙ্গে পাহাড় চড়ে
দড় । তারা চিনিয়ে দেয়
কোন কাকু ভীষণ কড়া আর
কোন দাদা দারুণ মাছ
ধরেন । কোলকাতা থেকে
আসা মেয়েটির মা এসেছেন
সঙ্গে । তাঁর
আদিখ্যেতায় ভুরু
কুঁচকে খুচরো পয়সা
গোনেন টিম লিডার ।
অভ্যস্ত হাতে আলাদা হয়ে
যায় নোট আর কয়েন,
অভিভাবক ও ছেলেমেয়ে,
নতুন ট্রেকার আর পুরনো
গাইড । মনে মনে কষা অঙ্ক
মেনেই পরবর্তী কাজ হবে
। উনি দক্ষ পর্বতারোহী
। দু’মাস আগে কামেট
থেকে নেমেছেন । উত্তরের
সব বাস গভীর রাত্রে
ফারাক্কা পেরোয় ।
রাতচরা মেয়েটি চোখ আবছা
খুলে দেখে সবার ঘুমন্ত
মুখে হলুদ আলো । বয়কাট
চুল গঙ্গার হাওয়ায় উড়ছে
। সে গুনতে থাকে
থামগুলো... এক...সাত...তের...
গোনা ফুরয় না ।
সক্কালবেলা বাস থামার
ঝাঁকুনিতে উঠে দেখে
মালদহের আশ্চর্য সকাল ।
ফার্স্ট বয় টুথপেস্ট
প্যাক করে ফেলেছে
রুকস্যাকে । থাম গোনার
বিস্ময় চোখ থেকে ধুয়ে
ফেলে নিজেরটা এগিয়ে দেয়
মেয়ে । তাকে দেখে মুগ্ধ
হবার কোনও কারণ নেই ।
শ্যামলা, দোহারা,
ছেলেদের মত হাবভাব ।
গম্ভীর ছেলে
নির্বিকারে উপকার
গ্রহণ করে মুরগিছানার
হাঁটাহাঁটি দেখে ।
মেয়েটিকে এর পর থেকে
শিলালিপি বলে ডাকা চলে
।
শিলিগুড়ি পেরতেই
উত্তেজনার চিৎকার । চা
বাগান । পাকদণ্ডি বেয়ে
বেয়ে ওপরে, আরও ওপরে ওঠা
। রূপোলী সুতোর মত
তিস্তা । ততক্ষণে বাস
বদল হয়ে ছোটো মিনিবাসে
ভাগ হয়ে গেছে দল । ওপরে
ওঠার চাপে কারও মাথা
ঘুরছে, কেউ হাতব্যাগ
থেকে বের করেছে সোনালী
স্কার্ফ । বরফের রং
মুখ্যত সাদা । তার অনেক
শেড হয় । পাহাড়ের রং বলা
মুশকিল । আসন্ন বর্ষায়
সে সবুজ । তার পাথরে
খেলছে
সাদা-লাল-খয়রি-কালোর
মিনে । তার শিরায় ঠাসা
অভ্র তাকে সুন্দরী
করেছে । যেখানে থামা হল
সেখানে বাহারি নিশান
উড়ছে । কুয়াশায় আশপাশের
সব রেখা উধাও ।
ধোত্রে... সে এক পাহাড়ের
মাথা । অখণ্ড সাদার
মধ্যে ছবির মত কাঠের
বাড়িতে গনগনে লাল ডিমের
ঝোল । হাসির রং পাথরের
মতই... লালের প্রাবল্যের
মধ্যে ঝলমলে মাইকা ।
টিম লিডারের শীতের
পোশাক আগের গাড়িতে চলে
গেছে । ফ্রস্ট বাইটের
অভ্যেস থাকলেও, শীত
সবসময়েই কষ্টের ।
শিলালিপি নিজের
জ্যাকেট এগিয়ে দিয়েছে ।
সে বেশ মোটাসোটা... সহজে
শীত ধরে না । তাছাড়া
সোয়েটার আছে । কখনও না
হাসা টিম লিডার হাত
বাড়ালেন । জ্যাকেটে ওম
লেগে আছে । পাহাড়ের
বুকে উষ্ণতা ফেরাতে হয়
না । আবার গাড়ি চলে ।
থামে যেখানে তিরতিরিয়ে
বয়ে গেছে ঋষিখোলা । তার
ওপরে সাত আটটা সাঁকো ।
সাঁকো তো নয়, একফালি
বাঁশ পাতা । ধরার জন্য
আরেকটা । তিন চারবার
জলে পড়ে যাবার পর
বিরক্ত কয়েকজন নদী
পেরিয়েই চলেছে । বেস
ক্যাম্প । চারপাশে
প্রহরীর মত পাহাড় ।
সবুজ, সবুজতর, সবুজতম ।
ফাঁক দিয়ে ঈষৎ দেখা
যাচ্ছে বরফের আবছা রেখা
। হিমালয় । দেখতে পেলে
হাত জোড় হয়ে আসে
শ্রদ্ধায় । মনে হয়, এই যে
এত অহঙ্কার... নিজের
নিজের ভাল-মন্দ নিয়ে
তুলকালাম... কত তুচ্ছ ! ওই
যে দূরের হিমমগ্ন সাধক,
এমনকি এই কাছের রূপবান
অরণ্যসঙ্কুল অতিকায়...
আমাকেও নিয়ে যাক,
ঊর্ধ্বে । এসব
প্রার্থনার মধ্যেই
গভীর রাত্রে বৃষ্টি
নামে । তাঁবুর গা বেয়ে
বেয়ে নামে জলকণা ।
রাত্রিবেলা যে যার
সম্বল ত্রিপলে মুড়ে
নিজেরা ছাতা খুলে বসে
থাকা ।
এবং... হাঁটা । অনেক অনেক
হাঁটা । আঁকাবাঁকা
পিচের পাকদণ্ডিতে সে
হাঁটা একরকম । একপাশে
পাহাড়ের গায়ে মস,
লাইকেন, ফার্ন, চোখ
ঝলসানো ফুলের গায়ে পড়া
আহ্লাদ । অন্য পাশে
নেমে গেছে খাড়া খাদ ।
কুয়াশায় বোঝাই । ভুলিয়ে
দেয় যে ঘরবাড়ি কোন
সমতলে, কোন অনায়াস
ভূমিতে । পরিষ্কার
আবহাওয়া থাকলে আবার এই
খাদই দূরদর্শী করে তোলে
। নামা মানেই সবসময়
চ্যুতি নয়... অবতরণও বটে
। নীচের ধাপচষা মাঠ,
মরকতসবুজ উপত্যকা,
পাথুরে বিন্যাস রোদে
ঝকঝক করে । কোথায় পা
ফেলা যায় আর কোথায় নয়,
বুঝিয়ে দেয় । জীবনের
একপাশেও তো এমনই আর্দ্র
গন্ধের চিরহরিৎ গাছ ।
অন্য পাশে শূন্যতা... পা
হড়কে পড়া যায় বা ওড়া যায়
। মাঝখান দিয়ে রাস্তা
চলে । এ পাহাড় থেকে ও
পাহাড় ছুঁয়ে সে পাহাড়ে
। আরেকরকম হাঁটা হয় ।
পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠা
পথের মেখলার ওপর নয়...
বুকের ভেতর দিয়ে যাওয়া
শিরাধমনী বেয়ে । শক্ত
পাথরে বিঁধে পা কেটে
যায় । জুতো খোলার পরেও
সঙ্গ ছাড়ে না জোঁক ।
জঙ্গলের ভেতর কাদায় পা
পিছলে পড়তে হয় বহুবার ।
অক্সিজেনের কষ্টে
পিঠের ভারি বোঝা আরও
দুঃসহ হয়ে ওঠে । জলের
পরিমিত ব্যয় নিয়ম,
কাজেই জিভ গলায় নেমে
আসতে চাইলে লোকাল
হাইটাই গাম চিবোনো ।
যাত্রা শেষ হলে বাকি
থাকে নতুন তাঁবু
খাটানো, রান্নার জোগাড়
। ফার্স্ট বয়রা কাঠকুটো
জুটিয়ে আনে । বড়োরা
মাথাপিছু চালের হিসেব
করেন । শিলালিপি তাঁবুর
দড়ি বাঁধা শেষ করে
পাথরে বসে হাপরের মত
শ্বাস টানতে থাকে ।
মাঝে মাঝে খাতা বের করে
দু’কলম লিখে নেয় ।
এর মাঝে মাঝে অনেককিছু
শেখা চলে । কম্পাস দিয়ে
দিক চেনা, সঙ্কেত
পাঠানো, ট্র্যাক সাইন
দেওয়া, তারা চেনা , পাখি
চেনা, হঠাৎ বিপন্ন হলে
বা হারিয়ে গেলে
আত্মরক্ষার উপায় ।
সঙ্গে সঙ্গেই চেনা যেতে
থাকে টুকরো টুকরো
সম্পর্ক । কারোর কম্পাস
দলশুদ্ধ সকলের পথ
ভুলিয়ে দেয় । তখনই
আচমকা কারও মধ্যে জন্ম
নেয় নেতা । ফেলে আসা
চিহ্ন দেখে দেখে ঘরে
ফিরিয়ে আনে সবাইকে ।
আগে বেরিয়ে যাওয়া দলের
কেউ পরের দলের কারোর
জন্য উদ্বেগে, উৎকণ্ঠায়
এক জঙ্গল ট্র্যাক সাইন
বিছিয়ে রাখে । ভেঙে
যাওয়া সাঁকো পেরতে
অযাচিত এগিয়ে আসে
প্রতিদ্বন্দী হাত ।
অচেনা পাখির ডাকে আনমনা
হতেই বিজ্ঞানসম্মত নাম
শুনিয়ে দেন কোনও এক
বয়স্ক । হয়ত পরের লাইফ
সায়েন্স পরীক্ষায়
সেটাই লিখে শ্রোতাটি
তাক লাগিয়ে দেবে ।
শিলালিপি তারা দেখতে
ভালবাসে । এক রাত্রে
সবাই ঘুমিয়ে গেলে কিসের
টানে যেন বেরিয়ে এল ।
মাথা উঁচু করে দেখল...
তারা নেই । মেঘ নিচু হয়ে
এসেছে । লেমনগ্রাসের
ঝোপ থেকে বুক চেপে ধরা
উগ্র মিষ্টি গন্ধ আসছে
। এক দু’কুচি বৃষ্টি ।
পাহাড়ে বর্ষা প্রেয়সীর
মত আসে । সে দেখল
চারপাশের জমাট অন্ধকার
। জুতো খুলে পায়ের আঙুল
ডোবাল ঘাসে... আঙুল রাখল
হাওয়ায় । শুনতে পেল কত
হাজার বছরের অশরীরী
দীর্ঘশ্বাস । যাদের
বুকের ওঠানামা এইসব
শীতল বাঁকে নিথর হয়ে
গেছে – তাদেরই শুষে
নিতে না পারা হাওয়ারা
পাক খাচ্ছে ।
ওরা ফিরে আসে । সাতদিন
পর । রোগা হয়ে, কঠিন হয়ে,
দ্রব হয়ে । কেউ ফেরার
পথে বমি করেছে । কারোর
চশমা পড়ে আছে চড়াইয়ে ।
পাহাড়ে নোংরা না ফেলার
অভ্যাস কেউ ফিরে এসেও
মেনে চলেছে । সাতদিন
ভদ্রস্থ শৌচাগার না
পাওয়ায় কারোর রোজ
বাথরুমে এক ঘণ্টা কাটছে
! কলকাতার মেয়েটি আজকাল
মাকে ছাড়াই লোকাল
ট্রেনে চাপে । ফার্স্ট
বয় তার অ্যালবামে হাত
বোলায় আর স্পোর্টস
শ্যু-র ক্যাটালগ দেখে ।
টিম লিডার বলেছেন পরের
বার সান্দাকফু ।
ক্যাম্প ফায়ারের গনগনে
আঁচে যার গলায় গান
শুনেছিল... সে কি আবার
যাবে ? চিন্তায় চিন্তায়
এক্সের পাওয়ার ভুল বসে
যায় । কিছু প্রেমের
অর্কিড সমতলের মাটিতে
জল পেয়ে বাড়ে । কিছু
নিঃশব্দ সম্পর্কের ঘাস
পাহাড়ের বুকেই বুনে আসা
হয়... তার গন্ধ সমতলে
বাঁচে না । কিছু অচেনা
মুখ আত্মীয় হয়ে ওঠে...
ফিরতি বাস স্টপে বাবাকে
বলে ওঠেন - ‘দাদা, পরের
বার আবার পাঠাবেন
কিন্তু... না হলে ভালো
লাগবে না’! কিছু
বন্ধুত্ব চিঠি
চালাচালি করে আমৃত্যু ।
কিছু সম্ভাবনা অদেখাও
থেকে যায়... হয়ত পরের
কোনও যাত্রায় তার সামিট
অপেক্ষা করে । যাত্রাই
তো । একটুকরো জীবন ।
মাটি থেকে শীর্ষে উঠে
আবার নেমে আসা । তার
মধ্যেই পাওয়া, হারানো,
লুকনো, খোঁজা... কত কি !
শুধু শিলালিপিরা
ডায়রিতে লিখে রাখে –
“যখন বুঝতে পারব মরে
যাচ্ছি... ওই মাঠটায় চলে
যাব । আবার যেদিন
আমাদের মত এক দল আসবে...
কেউ মাঝরাতে বৃষ্টির
গন্ধ পেয়ে দাঁড়াবে...
আমার শেষ নিঃশ্বাস
পাহাড় থেকে পাহাড়ে পাক
খাচ্ছে, শুনতে পাবে”...।
এপিটাফ কি শিলালিপি নয় ?