এখানে, এই পাহাড়ের
মাঝপথে এসে দাঁড়ালে,
কেমন যেন জলতেষ্টা পায়।
সমুদ্রের চারদিকে
পাহাড় ঘেরা, ঢেউয়ের মতো
সারিসারি। নীচে গভীর
খাদ। সমুদ্রের নোনা জল
ফণা তুলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে
সেই খাদের তলানিতে।
অস্থির এই জলরাশির দিকে
স্থিরভাবে তাকায় সুমন।
দিন পনেরো আগে এখানে
নতুন এসেছে সে। পাহাড়
বা সমুদ্র দূরে থাক,
নিজের অজ পাড়াগাঁয়ের
মেঠো ও বনজ চৌহদ্দির
বাইরে পা রাখেনি কখনো।
এখানে সে মাঝারি মানের
একটি পর্যটন কম্পানির
হয়ে ঠিকে গাইডের কাজ
করে। কাজটা তার অন্যদের
গাইড করা হলেও সে নিজেই
এ প্রকৃতির দিকে হা-করে
তাকিয়ে থাকে।
পর্যটকদের চেয়ে তার
চোখের কোণেই যেন
বিস্ময়ের ঘোর লেগে থাকে
বেশি।
গভীর খাদের নীচে নোনা
জলের দাপাদাপি। সেদিকে
তাকিয়ে ইলোরা বলল,
‘ভাইয়া, কত গভীরে এই
খাদ?’
সুমন এখন যে তিন সদস্য
পরিবারের গাইডের কাজ
করছে, ইলোরা সেখানে
সবচেয়ে ছটফটে ও
আকর্ষণীয়া। মুগ্ধ হয়ে
সে ইলোরার দিকে তাকায়।
এখানে চারদিকে
বাড়াবাড়ি রকমের
সৌন্দর্যের সঙ্গে ষোলো
সতেরো বছর বয়সী এসব
উচ্ছল মেয়ে যেন
স্বর্গের স্বাদ দেয়।
মেয়েটির মুগ্ধভরা
প্রশ্নের উত্তর জানা
নেই সুমনের। যদিও গত
পনেরো দিন ধরে রাতদিন
এই এলাকার যাবতীয়
বিশিষ্ট তথ্য সে
প্রথবারের স্কুল
ফাইনাল পরীক্ষায় বসার
মতো মুখস্ত করেছে।
কিন্তু কেন যে এত দ্রুত
গুলিয়ে যায় সব!
ইলোরা আবার জানতে চাইল,
‘সুমন ভাই, কত ফুট গভীরে
এই খাদ?’
মেয়েটা কখন যে তার নাম
জেনে নিয়েছে! সুমনের
ভেতরে ভালোলাগা আরো
বেড়ে যায়। কৃত্রিম
বিচক্ষণের সঙ্গে তরল
গলায় বলে, ‘ফুট না,
মিটার। আটশো
অষ্টআশি।’
ইলোরা চিৎকার করে বলে,
‘হোয়াট আ হরিবল
ডিসটেন্স! এ তো এক
কিলোমিটারের
কাছাকাছি!’
মেয়েটার চিৎকার প্রবল
বাতাসের শব্দে চাপা পড়ে
যায়।
নীচে, গভীর খাদের নীচে
পাথুরে ছোট্ট
বেলাভূমিতে জোয়ারের
ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে
ক্রমাগত। ছন্দোবদ্ধ
শব্দের সেই হিন্দোল
মানুষের হাতে তুলে দিয়ে
যায় ঘোরলাগা জগতের কী
এক দুলর্ভ চাবি।
ইলোরা বলল, ‘বর্ষাকালে
তো এই পাহাড় থেকেই মেঘ
ছোঁয়া যায়, তাই না
ভাইয়া?’
সুমন বিহ্বল চোখে
মেয়েটির দিকে তাকায়।
এমন কথা যে জানা নেই
তার।
‘আমরা গত বছর দার্জিলিং
গেছিলাম। বর্ষার শেষে।
একটু দূরের একখানা মেঘ
একটু পরে আমাদের হোটেল
ঘরে ঢুকে পড়ে হঠাৎ। কী
অদ্ভুত, তাই না?’
সুমনের মনে হলো খাদ
থেকে পাহাড়ের উচ্চতা সে
যেন একটু বেশিই বলে
ফেলেছে। দূরত্বটা সে
মুখস্ত করেছিল, সেটা
বোধহয় বাংলা তিনটে চার।
মিটার না হয়ে ফুটও হতে
পারে।
সুমনের বড় কাছ ঘেষে
ঘুরঘুর করছিল ইলোরা। মা
এসে ইলোরাকে একটু দূরে
সরিয়ে নিয়ে বললেন,
‘ছেলেটার সাথে এত
হ্যাংলামি করছিস কেন রে
ইলো? পেটে অতো প্রশ্ন
থাকলে আমাকেও তো
জিজ্ঞেস করতে পারিস।’
‘তুমি জানোটা কী?
প্রশ্নই যদি না করব,
তাহলে শুধু শুধু গাইড
নিতে গেলে কেন? গাইডের
টাকায় আমার ওই বিদেশি
লিপস্টিকটা হয়ে যেত!
তাও তো কিনতে দিলে
না।’
‘সে তুই বুঝবি না। এসব
অচেনা জায়গায় লোকাল কেউ
থাকলে অনেক ঝামেলা থেকে
বাঁচা যায়।’
‘সুমন ভাই মোটেই লোকাল
কেউ না।’
‘কী সর্বনাশ! তলে তলে এত
কথা জেনে নিয়েছিস?’
ইলোরা ভ্রু কুচকে বলল,
‘তুমি মা সত্যিই কুয়োর
ব্যাঙ। সমুদ্র-পাহাড়
দেখতে আসা ঠিক হয়নি
তোমার। এখানে এসে অতো
পিতপিতে হলে চলে?’
রেগে-মেগে ইলোরা সুমনের
কাছে এসেই দাঁড়াল আবার।
মা শাসন করতে এলে তার
মাথায় যেন আগুন ধরে
যায়। এ সময় মা যা বলবে,
তা ভালো-মন্দ বিবেচ্য
নয়, সে ঠিক তার বিপরীত
কাজটাই করবে। কী এক
একরোখা জেদ, গোয়ার্তুমি
চেপে বসে তার মাথায়।
অথচ অন্য সময়ে তার মতো
শান্ত মেয়ে হয় না
দ্বিতীয়টা। আতি-পাতি
জিনিস দেখেও বিস্ময়ে
চোখ ছানাবড়া করবে।
খিলখিল করে হেসে উঠবে
যখন তখন।
আকাশের দিকে ছোট চোখ
করে বলল, ‘গ্রামের
বাড়িতে আপনার কে কে আছে
সুমন ভাই?’
‘মা আছে। আর, আপনার বয়সী
একটা বোন। ইলেভেনে
পড়ে।’
‘বাবা?’
‘ছোটবেলায় মারা গেছে।
আমার তখন সাত বছর বয়স,
বোনের দুই মাস।’...
সুমনের হঠাৎ মন খারাপ
হয়ে গেল। এসব কথা কেন
বলতে যাচ্ছে এমন অচেনা
এক ধনীর দুলালিকে?
মাত্র দু-সপ্তাহ হলো
এখানে সে নোঙ্গর
ফেলেছে। কিন্তু এখনই
বাড়ির জন্য মনটা কেমন
হাফিয়ে উঠেছে। গ্রামের
যে বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়া
মারামারি করত, তাদের
জন্য মনটা পুড়ছে ভীষণ।
আর মায়ের কথা ভাবতেই
তার দু’চোখে জল ভরে
উঠেছে। হঠাৎ একদিন
খেয়াল করল, মা-কে সে শেষ
কবে হাসতে দেখেছে
কিছুতেই সে মনে করতে
পারছে না। মায়ের চোখের
কোণে কোনোদিন কি
আনন্দের চূর্ণ জমতে
দেখেছে? কিছুতেই মনে
পড়ে না সুমনের। পেটের
এক অজানা পিলায়
প্রায়দিনই কেমন ছটফটে
করে মা। মাঝে তিনবার
এমন সঙ্গিন অবস্থা হয়ে
গিয়েছিল যে উপজেলার
স্বাস্থ্যকেন্দ্রে
ভর্তি করতে হয়েছিল।
প্রতিবারই সস্তায়
নামমাত্র কিছু মেডিকেল
টেস্ট করা হতো।
কোনোবারই কিছু ধরা
পড়েনি। অজস্র রোগীর
ঠাসাঠাসি ভীড়ে
ডাক্তাররা বিশেষ
পাত্তাও দেয়নি কখনো।
প্রতিবারই পেইন কিলার
দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে
ব্যথা কমিয়ে দেন শুধু।
পনেরো বছর আগে পদ্মার
উতাল ভাঙনে তাদের ভিটে
মাটি সেই যে তলিয়ে গেল,
তারপর থেকেই মামাবাড়ির
এককোণে তারা তিনজন পড়ে
রয়েছে কোনোভাবে। এর আগে
এক ঝড়ের রাতে তাদের
পদ্মাপাড়ের বাড়িতে
সবচেয়ে বড় ঝড় বয়ে
গিয়েছিল। তার বাবাসহ
আরো পাঁচ জেলের মাছ
ধরার ট্রলার ডুবে
গিয়েছিল ঝড়ে। তাদের
মধ্যে শুধু সুবল কাকা
বেঁচে ফিরেছিল। বাবার
লাশটিও তারা ফিরে পায়নি
কখনো।
অনেকে বলত, বাবার লাশ
নাকি নদীতে ভেসে ভেসে
সমুদ্রে চলে এসেছিল। এই
সমুদ্রে? সুমন একদিন
গভীর শ্বাস ফেলে
সমুদ্রের দিকে তাকায়।
তার শরীর শিরশির করে।
সমুদ্রের জল স্পর্শ
করতে হাত শিরশির করে,
মনে হয় যেন তার বাবার
শরীর মিশে আছে সেই
জলে।
কেন যে হঠাৎ এসব কথা মনে
পড়ল এখন! পদ্মায় সে
বাবার সঙ্গে বেশ ক’বার
সারারাত ধরে মাছ ধরা
দেখেছিল। বিশাল,
কূল-কিনারাশূন্য
অবারিত এক জলধারা! এখন
সে পাহাড় আর সমুদ্র
দেখার পর বুঝতে পারে,
পৃথিবীকে কত
খণ্ডিতভাবে কল্পনা
করেছে। এও বোঝে এখন─যা,
যতটুকু দেখছে, তাও বড্ড
সামান্য। স্কুলের
চৌহদ্দি ডিঙিয়েছে
একমাত্র তার একক
চেষ্টায়। মা নিপাট
ছাপোষা, বকলম তো বটেই।
শুধু বাড়ি বাড়ি ঠিকে
কাজ করে তার জন্যে
প্রাত্যহিক অন্ন জোগাড়
করে দিত। এসবে তার
জীবনে কোনো অসঙ্গতি বা
অস্বাভাবিক কিছু খুঁজে
পায় না সুমন। ক্লাস
সেভেনে ওঠার পর থেকে সে
নিয়মিত একটা দুটো করে
নিচু ক্লাসের ছাত্রদের
প্রাইভেট পড়াতে শুরু
করে। প্রথমে তুলনামূলক
গরিব ছেলেদের পড়ানোর
সুযোগ পেত, তারপর কী করে
যেন তার নামডাক চারদিকে
ছড়াতে থাকল ধীরে ধীরে...।
ইলোরা বলল, ‘আপনার হঠাৎ
কী হলো সুমন ভাই?’
‘সরি। কিছু না। আপনি
কিছু জিজ্ঞেস করছিলেন
মনে হয়।’
‘হ্যাঁ... কথাটা ভুলে
গেছি...। থাক। ... একটা
অদ্ভুত কথা শুনেছি;
সত্যি?’
‘কী?’
‘এই পাহাড়ে নাকি অনেকে
সুইসাইড করতে আসে খাদের
নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ে।’
‘হ্যাঁ। চারদিকটা খুব
সুন্দর, তাই না? যারা
মনের দুঃখ কিংবা বিপদ
কাটানোর পথ খুঁজে পায়
না, বেঁচে থাকার আনন্দ
হারিয়ে ফেলে; তারা মনে
করে─তাদের সে বিপদ বা
দুঃখ কাটানোর খুব ভালো
ওষুধ আছে এই খাদের
নীচে। চারিদিকটা কী
অপরূপ মনোহর সুন্দর।
সুন্দরের মাঝে ডুবে
থেকে জীবন শেষ করে
ফেলা। খারাপ না, তাই
না?’
ইলোরা অবাক হয়ে তাকিয়ে
রইল সুমনের দিকে।
সুমন হেসে বলল, ‘সরকার
অবশ্য মানুষকে এত সুখের
ভেতরে মরতে দিতে চায়
না। এখানে তাই আরো উঁচু
প্রাচীর দিচ্ছে সরকার।
দু-তিন মাসেই কাজ শেষ
হয়ে যাবে।’
ইলোরা প্রসঙ্গ ঘোরাল।
সুমনের জীবনটা তার কেমন
উচ্ছ্বাসে ভরা মনে হলো।
বলল, ‘আপনার এ কাজে অনেক
আনন্দ তাই না?’
সুমন ম্লান হেসে হ্যাঁ
বলল।
তাদের গ্রামের শেষ
প্রান্তে একটি
গণপাঠাগার ছিল।
বেসরকারী ছোট্ট
পাঠাগার। জায়গাটা ছিল
পাশের উপজেলার
প্রান্তসীমায়। সুযোগ
পেলেই সুমন সেখানে গিয়ে
সুন্দর ছবি আঁকা উপকথা
বা ছোটদের
অ্যাডভেঞ্চার বই পড়ে
আসত। নেশাটা এমন জমে
উঠেছিল যে, তার জীবনের
সবচেয়ে বড় স্বপ্ন হয়ে
উঠেছিল─কোনো এক
লাইব্রেরির কর্মচারি
হওয়া। তাহলে রথ দেখার
সঙ্গে কলা বেচার মতো কত
রকম বই পড়তে পারবে সে!
একদিন তার এ প্রিয়
স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত
হয়। উচ্চ মাধ্যমিক
পরীক্ষা শেষে দু’মাসের
জন্য নামমাত্র বেতনে ওই
স্মৃতিকাতর পাঠাগারের
লাইব্রেরিয়ানের
সহকারী হয় সে। মানুষের
কল্পনার সঙ্গে
বাস্তবের যেন বড্ড বেশি
শত্রুতা! সেই দু’মাসে
সে বই পড়াই যেন ভুলতে
বসেছিল। কর্তৃপক্ষের
শ্যেন দৃষ্টির বাইরে
কাজের ফাঁকে বই নিয়ে
বসার কোনো সুযোগ ছিল
না। ‘কাজের শেষে’ বলেও
কোনো শব্দ ছিল না
কর্তৃপক্ষের কাছে।
যতক্ষণ পাঠাগারে থাকবে
ততক্ষণ কিছু না কিছু
কাজের ভেতরে থাকতেই হবে
তাকে। মহান
লাইব্রেরিয়ান বই পড়ার
মতো অকাজ সহ্য করতে
পারতেন না কিছুতেই।
তারপর একদিন তার
চাকুরিদাতা
লাইব্রেরিয়ানের
মানিব্যাগ থেকে তিনশো
টাকা হারিয়ে যায়।
সন্দেহের খড়গ নেমে আসে
ছোটলোক সুমনের ওপর।
সামান্য ক’টা টাকার
জন্য লাইব্রেরিয়ান আরো
দু’জন সাগরেদকে নিয়ে
তাকে ঠিক সাপ-পেটা করে।
তার স্বপ্নের কী করুণ
মৃত্যু!
মায়ের তীব্র অসুখের আগ
পর্যন্ত টাকাকে সে
বয়েসের দোষে তুচ্ছ
জ্ঞানই করত। কোথায় যেন
শুনেছিল, জগতে দুটো
ঈশ্বর আছে। একটা ওপরে
থাকে, হরেক মানুষ তাকে
হরেক নামে ডাকে।
দ্বিতীয় ঈশ্বরের নাম
‘টাকা’। এখন তার মনে হয়,
জগতে ঈশ্বর থেকে থাকলে
একমাত্র টাকার ভেতরেই
আছে।
ইলোরার মা ইলোরাকে তখন
থেকে ডেকেই যাচ্ছেন।
সুমন দীর্ঘশ্বাস ফেলে
বলল, ‘আপনার মা
ডাকছেন।’
ইলোরা ভ্রু-কুচকে বলল,
‘আপনার কী মনে হয় আমি
কানে কালা?’
সুমন অনুনয়ের সুরে বলল,
‘প্লিজ, আপনার মার কাছে
যান। শুনে আসুন কী
বলে।’
‘না।’ ইলোরা সুমনের আরো
খানিকটা কাছে এসে
দাঁড়ায়।
‘আপনার মা আমার
বিরুদ্ধে খারাপ
রিপোর্ট করতে পারে।
সেটা ভালো হবে?’
‘তাতে আমার কী?’
তাই তো! তাতে এ মেয়ের কী
যায় আসে। সুমন অবশ্য
একটুখানি রমনীমোহন।
বিষাদ মনের ছায়া
বেশিরভাগ সময় তার
চেহারার ওপর অন্যরকম এক
প্রতিচ্ছাপ ফেলে রাখে।
গভীর অন্তর্ভেদী
উদাসীন চোখের চাউনি
তাকে হয়তো আরো বেশি
মায়াবি করে তোলে।
চাকুরি হারানোর ভয় খুব
একটা করে না সে। মায়ের
জন্যই এমন বিজনপুরীতে
চাকুরি নিয়েছে।
সামান্য বেতন। ভেবেছিল
মায়ের পেটের পীড়ার
যুৎসই চিকিৎসার জন্য
কিছু টাকা জমাবে।
বোনটার জন্যও টাকা
দরকার। বয়স যেন লাফিয়ে
লাফিয়ে বোনের ঘাড়ে চেপে
বসছে। অথচ এ বেতনে
নিজের চলতেই হাঁপ ধরে
যায়। তাও কি পেত এমন
চাকুরি; তাদের গ্রামের
শান্ত’দা যদি না বলে
দিত? শান্ত দাদা এখানে
লোকমুখের আড়ালে অশান্ত
ভাই। স্থানীয় পৌর
মেয়রের ডান হাত। তাকে
সমীহ করে না, এমন মানুষ
খুঁজে পাওয়া দায়।
ইলোরা বলল, ‘কী অদ্ভুত
কথা সুমন ভাই!
দেখেছেন?’
গভীর খাদের পাশে দুই
সারি কাঁটা তারের বেড়া,
তার গায়ে জড়ানো আর্ট
পেপারে ছাপানো একটি
লিফলেট। গভীর খাদে
ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইলে
লিফলেট লাগানো জায়গাটি
সবচেয়ে উপযুক্ত। নীল
হরফে লেখা একটি
হেঁয়ালিপূর্ণ আহ্বান :
‘নীচে ঝাঁপ দিতে চান?
জীবন মূল্যহীন মনে হয়?
মূল্য পেতে একটিবার ফোন
করুন ..... নম্বরে।’
সুমনের শরীরটা কেমন
শিরশির করে উঠল।
লিফলেটটা একটানে ছিঁড়ে
ফেলল। তারপর কয়েক টুকরো
করে খাদের নীচে ছুঁড়ে
ফেলে দিল। ইলোরা কেমন
অবাক হয়ে সুমনের দিকে
তাকিয়ে রইল। গত
সপ্তাহেও সুমন প্রথম এই
লিফলেটের হুবহু কপি
এখানে দেখতে পায়।
কৌতূহল বশে তার মোবাইল
ফোন থেকে লিফলেটে লেখা
নম্বরে একবার মাত্র
মিস্ড কল দেয় সে। সেটাই
তার কাল হয়ে দাঁড়ায়।
এরপর সেই নম্বর থেকে
বার বার কল আসতে থাকে।
জানতে চায়, কী তার
সমস্যা? বাড়ির আর্থিক
অবস্থা কেমন? কে কে আছে
পরিবারে?
ইলোরা অবাক হয়ে বলল, ‘কি
ওটা সুমন ভাই? ওভাবে
ছিঁড়ে ফেললেন যে!’
‘ওরা ঠগ। জোচ্চড়।’
‘কারা?’
‘ওই লিফলেট যারা
লাগিয়েছে।’
‘কী করে বুঝলেন?’
‘আমি মরতে চাইনি,
খেয়ালের বশে একবার
মাত্র কল করেছি, মিস্ড
কল...’
হঠাৎ সুমনের মনে হলো, এ
কথা কারো কাছে বলার নয়।
বিপজ্জনক ভীষণ।
প্যান্টের ডান পকেটে
রাখা মোবাইল ফোনটা
মোক্ষম সময়ে বাজতে
থাকে। নতুন মোবাইল ফোন,
এখনো সে অভ্যস্ত হয়ে
উঠতে পারেনি ঠিক মতো।
ইলোরা বলল, ‘আপনার ফোন
বাজছে। ধরুন
তাড়াতাড়ি।’
সুমন কাঁপা হাতে মোবাইল
স্ক্রিনে নম্বর দেখে,
আশ্বস্ত হয়। তার
গ্রামের বাড়ির কাছের
মুদি দোকানের ফোন।
মায়ের বা বোনের কোনো
প্রয়োজন হলে এ দোকান
থেকেই ফোন করে তাকে। কল
রিসিভ করতেই ছোট বোন
সোমার আতঙ্কিত গলা শোনা
যায়। সুমন অবাক হয় না।
এমন ফোন গত পনেরো দিনে
সে কম করে চার-পাঁচ বার
পেয়েছে। প্রথমবার খুব
ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে।
সোমা কাঁদতে কাঁদতে
বলে, ‘দাদা, তুই আয়
একবার। মা কেমন করছে
রে!’
সুমন স্বাভাবিক গলায়
বলে, ‘সদর হাসপাতালে
নিতে পারবি কাউকে দিয়ে?
আমি কিছু কাজ শেষ করে
দু’দিন পর আসব।’
সোমা আর কিছু বলার আগেই
সুমন কল কেটে দেয়।
পাশ থেকে সুমনের কথা
শুনে ইলোরা সাধারণ
কৌতূহলে বলে, ‘কেউ
অসুস্থ হয়ে পড়েছে সুমন
ভাই?’
এমন প্রশ্নের কোনো
উত্তর দিতে ইচ্ছে করে
না সুমনের। যদিও এদের
গাইড হিসেবে যে কোনো
প্রশ্নের যথার্থ উত্তর
দেওয়াটা তার দায়িত্বের
ভেতরই পড়ে।
ফাল্গুন মাসেও আকাশের
নৈঋত কোণে শরতের মতো
কেমন পেঁজা-তুলা মেঘ
জমে ওঠে। সেদিকে সুমন
বিমর্ষ চোখে তাকিয়ে
থাকে। তারপর কী ভেবে
হঠাৎ ইলোরাকে বলে,
‘আপনি কোনো গ্রামে রাত
কাটিয়েছেন কখনো?’
‘গ্রাম!’ ছোট বেলায় দূর
থেকে একটা ঘিঞ্জি গ্রাম
দেখেছিল ইলোরা।
গ্রামের কথা ভাবলেই তার
মনে সেই গা ঘিনঘিন করা
গ্রামের ছবি ভেসে ওঠে
মনে। বলে, ‘সেভাবে আমি
কাছ থেকে গ্রাম দেখিনি
কখনো, মফস্বলের একটি
সরকারি হসপিটাল
দেখেছি। দেখে খুব ভয়
পেয়েছি।’
‘অমন হাসপাতালে তো
আপনার যাবার কথা নয়।’
‘ওটা ছিল ছোটমামার
ডাক্তারি পড়ার
হসপিটাল। মেডিকেল
ইন্টার্নির ডিউটি ছিল
মামার, আমাকে নিয়ে
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে
দেখাচ্ছিল সব। যা
দেখলাম তাতে বাড়িতে এসে
ক’দিন ঘুমোতে পারিনি
ঠিকমতো। মনে হয়েছে, নরক
বলে কিছু থাকলে তার
চেহারা এমনই হবে হয়তো।
মানুষের জীবন কত ভয়ঙ্কর
হয়, কত যন্ত্রণার─সেই
হসপিটালটা না দেখলে আমি
কল্পনাই করতে পারতাম
না। বিভিন্ন ওয়ার্ডে কত
রকম রোগের
যন্ত্রণাকাতর শতশত
রোগী। উপরে নীচে ফ্লোরে
তিন চার গুণ করে কিলবিল
করছে রোগী─যাদের দিন
আনি দিন খাই অবস্থা।’
সুমন অবাক হয়ে গেল
ইলোরার কথা শুনে। এটুকু
মেয়ে, গণ্ডীবদ্ধ জীবন;
এক নজর দেখেই তার
অভিজ্ঞতা কেমন সুন্দর
করে বলে দিল!
সুমন ম্লান হেসে বলল,
‘অমন একটি সদর হাসপাতলে
মাকে চিকিৎসার জন্য
নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা
চলছে। ফ্লোরে জায়গা
পেলেও তা হবে অনেক বড়
ভাগ্য।’
‘কী হয়েছে আপনার
মায়ের?’
‘জানি না।’ সুমন চুপ
করে গেল।
গ্রামের জন্য, মায়ের
জন্য তার মনটা উতলা হয়ে
ওঠে। এত সুন্দর পাহাড়
ঘেরা সমুদ্র, তাও যেন
তার গ্রামের মেঠো পথের
দু’ধারে বর্ষার বিল
কিংবা হেমন্তের সবুজ
থেকে হলুদ হয়ে ওঠা
ধানখেতের তুলনায়
বৈচিত্র্যহীন অনেক।
ম্রিয়মান, সবকিছু কেমন
একপেশে দূর-পরবাস
বান্ধবহীন লাগে তার
কাছে।
‘নীচে ঝাঁপ দিতে চান?
জীবন মূল্যহীন মনে
হয়?’─ কথাটা হঠাৎ
বারবার তার মাথায়
ঝিঁঝিঁ পোকার মতো
অণুরণিত হতে থাকল। জীবন
তার মূল্যহীন নরক
গুলজারই মনে হয়। কী
মানে আছে এমন জীবনের?
কীসের টানে টেনে লম্বা
করা জীবনের নষ্টভ্রষ্ট
যন্ত্রণাদগ্ধ সময়? যদিও
সে কারণে খাদের নীচে
ঝাঁপ দেওয়ার ইচ্ছে নেই
তার। তবে ‘মূল্য পেতে
একটিবার ফোন করুন...’
কথাটা তাকে কৌতূহলি
করে। কী মূল্য দিতে চায়
তারা?...
ভালো বা আকর্ষণীয়
পর্যটক পেলে দিনটা
সেদিন খুব দ্রুত পার
হয়ে যায়। ইলোরাদের
সঙ্গে তার বিদায়ের পর
অফিসে রিপোর্ট করে সুমন
সেই পাহাড়ের ধারে এসে
চুপচাপ অনেকক্ষণ
দাঁড়িয়ে রইল একাকী।
তার ফোন নম্বর নিয়ে
গেছে ইলোরা। নিজের
নম্বর সুমনকে দিতে
চাইলে সুমন হঠাৎ জেদের
বশে সে নম্বর নেয়নি।
ইলোরা হেসে বলেছিল,
‘আমি এখন একটা মিস কল
দিলেই তো আপনার কাছে
আমার নাম্বার পৌঁছে
যাবে!’
বিব্রত সুমন হেসে বলে,
‘আমাদের অনেক
সীমাবদ্ধতা আছে। কিছু
মনে করবেন না। এটা
স্রেফ চাকুরি আমার।’
ইলোরা বলল, ‘বুঝলাম না
ঠিক।’
সুমন হাসল শুধু।
ইলোরার বাবা সুমনের
অফিসে সুমন সম্পর্কে
ছোট্ট একটি মন্তব্য
লিখেছিলেন, ‘ফাঁকিবাজ
ছেলে। তিন ভাগের একভাগ
দায়িত্ব পালন করেছে।
সতর্ক হবেন।’
... পেঁজা-তুলা মেঘের
ফাঁকে আধ খাওয়া একখানা
চাঁদ উঠেছে। বড় রহস্যময়
এ চাঁদের আলো, এখানকার
চারপাশটা কেমন মিহি
কুয়াশাার চাদরে
অপার্থিব করে তুলছে।
জীবনানন্দের পঞ্চমীর
চাঁদের কথা মনে পড়ে গেল
সুমনের।
‘যখন গিয়েছে ডুবে
পঞ্চমীর চাঁদ...’─ সেই
চাঁদ কখন ডুবেছিল? কোন
পক্ষের চাঁদ ছিল ওটা?
চাঁদের কলার হিসেবটা
যথেষ্ট ভালো জানে সে।
একসময় নিজের কৌতূহল
মেটাতে জেনে নিয়েছে
সেসব।
সমুদ্র থেকে আর্দ্রতার
আজল-ভরা বাতাসের ঝাপটা
ফাল্গুনের শীতটাকে
নির্বাসনে পাঠিয়ে
দিয়েছে যেন। কী অপার,
অপূর্ব এ জগৎ! তাঁর মাকে
একটিবার যদি দেখাতে
পারত এ প্রকৃতির এক তিল!
জীবনভর শুধু একপেশে
বঞ্চনাই পেয়ে গেল। এখন
বুঝতে পারে, জগৎ-জুড়ে
তার মায়ের মতো কোটি
কোটি মা রয়েছেন। মাথাটা
কেমন বিবশ হয়ে আসে
সুমনের। তার মনে হলো,
এসব আত্মযন্ত্রণা থেকে
মনটাকে অন্য দিকে সরাতে
জীবনানন্দের চাঁদের
হিসেবটা করা যেতে পারে।
খুব সহজ হিসেব, সব
মিলিয়ে দুটো পঞ্চমীর
চাঁদ। একটা
কৃষ্ণপক্ষের,
মধ্যদিনের কিছু আগে
চুপিসারে অস্ত যায়।
অন্যটি শুক্লপক্ষের,
ডুব দেয় মাঝ-রাতের কয়েক
ঘণ্টা আগে।
জীবনানন্দের পঞ্চমীর
চাঁদটা নিশ্চয়ই রাতেই
ডুবেছিল।
সুমন পাহাড়ের খাদের
নীচে তাকাল। সমুদ্রের
ফণা-তোলা জল ঝাঁপিয়ে
পড়ছে সে খাদের তলানিতে।
রাত যত বাড়ে চারদিকের
নিস্তব্ধতা তত বেশি
জাঁকিয়ে বসে।
আজ বোধহয় শুক্ল-অষ্টমীর
চাঁদ, পশ্চিমে ডুব দেবে
মধ্যরাতের পরপরই।
গ্রামের বাড়ির
মুদি-দোকানে একটিবার
ফোন করে জানা দরকার ছিল
মায়ের দুর্ভোগের
সর্বশেষ খবর। মোবাইল
ফোনে যা টাকা অবশিষ্ট
আছে তাতে মাত্র এক
মিনিট কথা বলা যাবে।
মাসের মাঝামাঝি, হাতে
টাকা নেই, মোবাইলে
মিস্ড কল দেওয়ার টাকা
রাখতে হবে। ‘মূল্য পেতে
একটিবার ফোন করুন...’─ কী
ভেবে সে লিফলেটের সেই
নম্বরে মিস্ড কল দেয়
একবার।
সাত-আট মিনিট পর ফোন
আসে।
সুমন কল রিসিভ করে বলে,
‘আপনারা কী মূল্য দিতে
চান?’
ফোনের অপর-প্রান্ত থেকে
বলে, ‘আপনার সাথে আগেও
তো কথা হয়েছে।’
‘হ্যাঁ।’
‘পরিস্কার করে আমাদের
কয়েকটি প্রশ্নের জবাব
দিন। আপনি কি সত্যিই
সুইসাইড করতে চান?’
‘হ্যাঁ।’
‘কেন?’
‘সেটা কি এক কথায় বলা
যায়?’
‘অনেক টাকা হলে আপনার
সমস্যার কি বড় কোনো
সুরাহা হয়?’
‘আপনারা কি সেই টাকা
দেবেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘কেন?’
‘তার বিনিময়ে আপনাকে
চাই। ধরে নিন আপনি
সুইসাইড করেছেন। আপনি
মৃত। কিন্তু তার
বিনিময়ে আপনাকে আমরা
অনেক টাকা দেব।’
‘কত টাকা?’
‘আপনার যা সম্পত্তি আছে
তার দশ গুণ।’
সুমন সংক্ষেপে মনে মনে
হিসেব করে বলল, ‘এক
লাখের মতো?’
‘না। আরো বেশি। রাজি?’
‘আমাকে নিয়ে আপনারা কি
করবেন?’
‘সেটা আমাদের ব্যাপার।
এত প্রশ্ন করা যাবে না।
রাজি থাকলে চব্বিশ
ঘণ্টার ভেতরে জানান। আর
হ্যাঁ, এসব কথা কাউকে
বলবেন না। তাতে জীবন
যাবে আপনার, কিন্তু
আপনার পরিবার এক টাকাও
পাবে না।’
ফোন কেটে যায়।
সুমন কেমন ঘোরের ভেতরে
চলে যায়।
ছোট্ট স্যাঁতসেতে
মেসের কুঠুরিতে যেতে
ইচ্ছে করছে না আজ রাতে।
নামতে ইচ্ছে করছে না
নীচের জন-অরণ্যে।
মধ্যরাতের পর চাঁদ
না-ডোবা অব্দি এই
বিজনপুরীর
মৃত্যু-খাদের কাছে বসে
থাকেবে সে। একটা ফোন বা
অন্য কিছুর অপেক্ষায়।