পাহাড় মানে নারী।
‘পালামৌ’-এ
সঞ্জীবচন্দ্র খানিক
আন্দাজ করেছিলেন।
‘আরণ্যক’-এ
বিভূতিভুষণের পরিসর
ছিল বেজায় ছড়ানো। অতএব
সেখানে পাহাড়,
রাজকুমারি ভানুমতি ও
তার রূপের প্রসঙ্গ
থাকলেও তা ততো প্রধান
নয়, বরং পার্শচরিত্র।
কিন্তু
বঙ্কিমচন্দ্রের ভাই,
বিপুল প্রতিভাবান
পাশাপাশি লেখার
ব্যাপারে খানিক
অগোছালো সঞ্জীবচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়ের পাহাড়
সংক্রান্ত সাফল্য
ফ্লুক ছিল না। মাঝে
অনেক রাজনৈতিক, সামাজিক
পরিবর্তন ঘটে যাওয়ার
কয়েক দশক পর তা প্রমাণ
করেছিলেন স্বয়ং
সত্যজিৎ। সত্যজিৎ রায়।
যখন তিনি সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়ের
'অরণ্যের দিন-রাত্রি'কে
ছবি করলেন। যার শুরুর
দৃশ্যেই শহরের চার
সমাজের প্রতিনিধি চার
যুবক পাঠ করলেন বাংলা
সাহিত্যের অন্যতম
শ্রেষ্ঠ সম্পদ।
----‘হাস্য-উপহাস্য শেষ
হইলে নৃত্যের উদযোগ
আরম্ভ হইল। যুবতী সকলে
হাত-ধরাধরি করিয়া
অর্দ্ধচন্দ্রাকৃতি
রেখা বিন্যাস করিয়া
দাঁড়াইল। দেখিতে বড়
চমৎকার হইল। সকলগুলিই
পাথুরে কালো; সকলেরই
অনাবৃত দেহ;...’। (পালামৌ/
সঞ্জীবচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়)
সে ছিল পাহাড়ি নারীর
গল্প। পালামৌ-এর হোক
কিংবা দার্জিলিং,
গ্যাংটক বা কাশ্মীরের।
তাঁদের রূপে মুগ্ধ
হয়েছি আমরা। বার বার।
বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের
অপূর্ব পার্বত্য
সৌন্দর্য্যে বেড়াতে
গিয়ে পাহাড়ি ফুল ও
নারীর প্রেমে পড়েনি এমন
পুরুষ পাওয়া মুস্কিল।
কার প্রেম কী ধারার---সে
আলাদা কথা। কেউ স্বীকার
করবে, কেউ করবে না---সে
বিষয়ও অন্য। আসল কথা
পাহাড় দেখেছি আমরা।
দার্জিলিং, গ্যাংটকে না
গিয়েও দেখছি। নিজেকে
সামান্য প্রেমিক করে
নিলেই দেখেছি। স্বামী
দেখেনি হয়তো,
সোনাগাছিতে যাওয়া শরীর
নাও দেখতে পারে কিন্তু
প্রেমিক দেখেছে
নিশ্চই। দেখতে বাধ্য
সে। এমনকী একটা আস্ত
জীবন সমতলে কাটিয়েও
আমরা যারা বোঝার ঠিক
বুঝেছি পাহাড়ের
ঠার-ঠোর।
পাহাড়, সে চরাচরের
বেডরুমে শায়িত। মৃদু
নাইটবাল্ব তখন রঙিন
জ্যোৎস্নার অল্প চাঁদ।
মহাশূন্যে ঝুলে। পাহাড়,
তার চির অনন্ত
শৃঙ্গজয়ের হাতছানি,
গুহাগাত্রের ডাক
উপেক্ষা করার ক্ষমতা
নেই আমাদের। আমরা
পুরুষ---বস্তুত সমতলের
সাধারণ জীব। আমাদের
বুকের ভিতর সারাক্ষণ
একটা অভুক্ত মা হারা
বাচ্চা কুকুরের ঘ্যান
ঘ্যান করে ডাকে। ডেকেই
চলে!
অতএব নারী-পাহাড়ের
হাতছানি থেকে ইহজীবনে
আমাদের নিস্তার নেই।
কিছুতেই। স্কুলে,
কলেজে, কফিশপে, ট্রেনের
লেডিজ কম্পার্টমেন্টে,
বাসের
‘আস্তে-লেডিজ’-সিটে বসে
আছে পাহাড়। আর আমাকে
দাঁড় করানো হয়েছে ঠিক
তাঁর উলটোতে। দৃশ্যের
মজা দেখছে জীবন। পাহাড়
হেসে-কেঁদে, শাড়ি,
স্কার্ট, সালোয়ারে,
জিন্স-টপে, চুড়ি-টিপ,
নুপুর পড়ে চলেফিরে
বাজিয়ে চলেছে আমার মতো
সমতলকে। আমি পিঠ, বুক
পেতে দিচ্ছি। দিতে
বাধ্য যে। সে তাঁর
মিষ্টি ভার রাখছে আমার
ইহ জীবনের উপর। জীভ
বেরিয়ে যাচ্ছে আমার, দম
আটকে আসছে কিন্তু তবু
তাকে গ্রহণ করাই আনন্দ!
আশ্চর্য আনন্দময়!
বস্তুত পাহাড় জয়ের লোভে
ভুলে গেছি খাদ। ভুলে
গেছি সুন্দরী ওড়নার
আড়ালে আছে শয়তান শীত,
মারীচ তুষার ঝড় কিংবা
হঠাৎ ধস নামার বিপ-বিপ
বিপদ সংকেত।
আমি তো কোন ছার। স্বয়ং
রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত
বয়স সন্ধীক্ষণের সেই
পাহাড়-ভার খানিক নামিয়ে
ছিলেন সেই জীবন
সায়াহ্নে এসে। ছবি
আঁকতে গিয়ে। বস্তুত
তাঁর সারা জীবনের লেখায়
আছে পাহাড় ভ্রমণের
ভয়ঙ্কর-সুন্দর
অভিজ্ঞতা। আসলে তিনি যা
লিখেছেন, এঁকেছেন,
গেয়েছেন তাকে তিন শব্দে
বলা যায় ‘পাহাড়যাত্রীর
ডায়েরি’।
ওই একই রকম। খোঁজ নিয়ে
জেনেছি যে ঠাকুরনগর
একটি পাহাড়ি গ্রাম। আগে
ছিল না। বিনয় মজুমদারের
হাতে তৈরি সে। প্রতিদিন
একটু একটু করে পাহাড়
নামাতেন তিনি। তাঁর
ঋষি-বুক থেকে
মহাপৃথিবীর খাতার
পাতায়। একেকটা লাইন যেন
একেটা ভারি পাথরের চাই।
একেকটা কবিতা যেন
একেকটা পর্বতচূড়ার
ভুগোল-ইতিহাস-বিজ্ঞান-দ
র্শন। নিজের তৈরি
পাহাড়ের নির্জন
গুহাগাত্রে একাই ছিলেন
তিনি আমৃত্যু। আর রোজ
সকালে চরাচরের গায়ত্রী
পাঠ ছিল তাঁর স্বরচিত
অভ্যাস।
পাহাড় মানে আড়াল। যার
উপর হবে ভূবনমোহিনী
সূর্যোদয় এবং কালান্তক
সূর্যাস্তর শুটিং। যে
হঠাৎ বাঁক স্বর্গের মতো
অশেষ, অসীম সেই আবার
ভীষণরকম মৃত্যুপ্রবণ।
তাই রয়েছে
প্রতিমুহূর্তের
সতর্কিকরণ--‘আগে ঘাট
হ্যায়’। কিন্তু আমরা তো
প্রেমিক। তেনজিং-এর মতো
যুদ্ধে জিতে যাব কেউ,
কেউ আবার বরফ-কফিনে পড়ে
থাকব অমর ম্যালোরির দেহ
হয়ে। কিন্তু হাসি মুখে,
কিন্তু ছাড়ব না তাকে।
মরে গিয়েও জোড়িয়ে থাকব
তোমায় --- হে অপেল,
কমলালেবু, রঙবেরঙের
ফুল, ঝর্ণা, কুয়াশায়
সাজানা মায়ার মিছিলের
জীবন। বলব, তুমি আমায়
একটা গুহাগাত্র দাও
প্লিজ। ঠাই দাও এই কূট
শহর ভর্তি এক মাথার
মাথার গোজার ঠাই হও
তুমি। বলব, আদোর আদোরে
ভুলিয়ে দাও --- আমি যে
আসলে পুরুষ, মানে
শিকারী কিংবা অকারণ
যুদ্ধবাজ ঘোড়সওয়ার।
বিনিময়ে তোমার সকল ভাড়
নিতে আমি প্রস্তত। এই
পেতে দিলাম বুক। তোমার
জন্য আমি লিখব ---
‘অবশেষে পাহাড়চূড়া,
প্রেমিকার স্তন
পাহাড় পেরেলে
গ্রাম---তাঁর লাল
গোলাপ কাঠের
বাড়ি’ (অবশেষে/
উট-পালকের ডায়েরি)