বয়ঃসন্ধিতেই দীক্ষা
নিয়ে ফেলেছিলাম একদিন
দুম করে। আমার কিছু
করার ছিল না আসলে সেই
সময়ে। সেই বয়সের কাঁচা
আবেগের কাছে হার
মেনেছিলাম, যেমন আর
সবাই মানে আর কি!
সেবারের দর্শন প্রথম
না, আগেও দুএকবার
এসেছিলাম এই গুরুর
কাছে। বয়স কম হওয়ায়
তাঁর মর্ম বুঝিনি। তখন
আমার চোখ খুলেছে,
ভালো-মন্দের তীব্র
বিচারক আমি। ফলে নত হই
যত সহজে, উদ্ধতও তাই।
বিশালতা একটা সম্ভ্রম
জাগায় বটে, কিন্তু তার
কাছে নতি স্বীকার করা
কি অত সহজ! সেই বয়সে সব
কিছুকেই তুচ্ছ করার
একটা প্রবণতা আমারও
ছিল। তাই বিশালতার কাছে
নত হব, তেমনটা হওয়ার কথা
না। তবু ঠিক কী যে
হয়েছিল সেদিন, আমার
কাছেও তা রহস্য।
আঁকাবাঁকা রাস্তা
ধরে, ঘুরে ঘুরে যখন ওপরে
উঠছিলাম, আমি ঠিক বুঝে
উঠতে পারছিলাম না, কতটা
ওপরে উঠছি। রাস্তার
গায়ের ওপরে যে পাথুরে
দেওয়াল খাড়া হয়ে উঠে
যাচ্ছে, সেখানে কখনো
শুধুই পাথর বা সদ্য
হওয়া ঘায়ের মত লাল
মাটির পরত অথবা কিছু
সবুজ, অতিসবুজ মস ফার্ন
জাতীয় গাছ অসহায় ভাবে
ঝুলে আছে। আর এ পাশে এক
বীভৎস খাদ হাঁ মুখ করে
আমায় ডাকছে। আর সেই ডাক
শুনতে দিচ্ছে না কতগুলো
নাম না জানা ঢ্যাঙা
গাছ। গাড়ি চলছে, আমি
ঘুরতে ঘুরতে ক্রমশ
অবসন্ন হয়ে পড়ছি, মনে
হচ্ছে কখন আসবে আমার
স্টপেজ, যেখানে আমি
নেমে একটু হেঁটে চলে
বেড়াবো। এইসব ভাবতে
ভাবতে তন্দ্রা এসে
গেছিল। ধাক্কায় ঘুম
ভাঙল আর ধড়মড় করে নেমে
পড়লাম এক খলবল কথা বলা
ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে।
চারিদিকে লোক গিজগিজ,
সবাই যে যার ব্যাগ
সামলাতে ব্যস্ত। ঘুম
চোখে গিয়ে উঠলাম সাময়িক
আস্তানায়। তখনও তো
দেখিনি তাকে। রাতের আলো
জ্বলে উঠলে বারান্দা
থেকে দেখি, আকাশটা যেন
নীচে নেমে এসেছে। আমার
চোখের সামনে দিয়ে ঝাঁকে
ঝাঁকে তারা মাটিতে নেমে
গেছে আর ক্রমাগত টিমটিম
করে জ্বলছে। ক্লান্তির
ঘুম নেমে আসছিল ক্রমশ
রাত জুড়ে। খুব ভোরে চোখ
খুলে কনকনে ঠান্ডায়
দৌড়ে গেছিলাম
বারান্দায়। দেখি তো,
সেই তারাগুলো এখনও জেগে
আছে কিনা, এই ভেবে।
কিন্তু জানতাম না, এক
অপার বিস্ময় অপেক্ষায়
দাঁড়িয়ে আছে আমার জন্য।
আমার সারাজীবনের
প্রণাম একসাথে পাবে
বলে।
এই তাহলে পাহাড়!
কুয়াশা মাখা, মেঘের
বুকে দাঁড়িয়ে আছে এক
মহাগুরু। কী ভীষণ
উদ্ধত, অথচ শান্ত
নিপাট। ভয়ে নয়, ভক্তিতে
মাথা নুইয়ে আসে। এই
বিশালতার বর্ণনা আমি
দেব! আমার সব এক
মূহুর্তে কেড়ে নিয়েছ যে
তুমি, তার কাছে আমি
চীরভিখিরির মত হাত
পেতে, চোখ পেতে, মাথা
নীচু করে কাটিয়ে দেব
সারা জীবন। তোমাকে
পাওয়ার ঋণ আমার শোধ হবে
না কোনদিন। চোখে জল
মুছে মাথা তুলে দেখার
চেষ্টা করি এই পাহাড়ের
শীর্ষদেশ। কই তোমার সেই
অধরা মস্তক, যেখানে
তুমি পরে থাকো বরফশীতল
মুকুট! দেখতে পাই না।
আমার চোখ আচ্ছন্ন হয়ে
আছে, কুয়াশা আর মেঘ
ছাড়িয়ে আমার দৃষ্টি
পৌঁছয় না অতদূর। আমি
তোমার পায়ের দিকে
তাকাই, সারা শরীরের
দিকে তাকাই। বয়ঃসন্ধির
আবেগে জড়িয়ে ধরতে চাই
তোমায়। একটু বাদেই ভুল
ভাঙে। তুমি যে অধরা, এই
বাস্তব তথ্যটুকু আমার
জানা ছিল না। তোমাকে
ছোঁয়া যায় ঠিকই, কিন্তু
জড়িয়ে ধরে ঘুমনো যায়
না।
আস্তে আস্তে যত বড় হই,
পাহাড় দেখা হয় আরও
অনেকবার। প্রত্যেকবার
সেই একই অনুভূতি,
প্রত্যেকবারই আমার
মেরুদন্ড নুইয়ে আসে
পাহাড় দেখে। আর প্রতি
বারই যখন ফিরে যাই
পাহাড়ের কাছ থেকে, মনে
মনে ওকে বলে যাই, আবার
আসবো, মন খারাপ কোর না।
হায় রে বোকার মরণ, তার মন
খারাপ বলে কোন বস্তু
নেই, সে আমি কী আর বুঝি!
একবার দেখে ফেলেছিলাম-
যখন ছলছল চোখে ফিরে
আসছিলাম ওর কাছ থেকে,
পিছন ফিরে দেখতে গিয়ে
দেখি, ওর মুখে মিটমিট
হাসি। সেদিন বুঝেছিলাম,
ওর মনের মত বিশাল
ক্যানভাসে খারাপ লাগার
আঁচড় পড়ে না। ওই পাহাড়
নিজেই স্বয়ম্ভূ। তার
কাছে আমাদের মত
মানুষদের আনন্দ, দুঃখের
কোন মূল্য নেই। ওর
নিজস্ব আনন্দ বা
বেদনাবোধ নেই, তাই
আমাদের আনন্দ, শোক ওকে
স্পর্শ করে না। পাহাড়
শুধু দাঁড়িয়ে থাকতে
পারে,
মেঘ-বৃষ্টি-রোদ-তুষার
ওকে আদর মাখিয়ে রাখে।
সেই আদরে ওর শিহরণ হয়ত
হয়, আমরা আমাদের মোটা
চোখে তা দেখতে পাই না।
বা হয়ত কোন অনুভূতিই ওর
হয় না, আমরা আবেগ
সর্বস্ব মানুষ এসব ভেবে
রোমাঞ্চিত হই। আর পাহাড়
দাঁড়িয়ে থাকে একই
জায়গায়।
এই যে আমি নত হয়ে আছি
পাহাড়ের কাছে, হয়ত আমার
মত আরও অনেকেই আছে।
কিন্তু আমার এই আনত
মূর্তি কি ও তাকিয়েও
দেখেছে! ওই যে কুয়াশার
আবরণ দিয়ে ঢেকে রেখেছে
ও নিজেকে, দেখে মনে
হচ্ছে যেন ধ্যানী
বুদ্ধ। আসলে কী ও তাই?
নাকি এগুলো স্রেফ ওর
ঔদ্ধত্য? অহংকারে দূরে
সরিয়ে রেখেছে আমাদের।
আমাদের ভালো লাগায়,
মন্দ লাগায় ওর কিচ্ছু
যায় আসে না ওর। ও আছে ওর
নিজের খেয়ালে। যেদিন
প্রথম ট্রেকিং করি,
সেদিনই ভেবেছিলাম, এই
পাহাড়ের পথে পথে ঘুরে
কাটিয়ে দেব সারাজীবন।
কিন্তু হায় রে,
সংসারলোভী মন, জড়িয়ে
পড়লাম। এখন শুধু
ট্রেকিংযের গল্প পড়ি।
বা বাস্তবে যারা পাড়ি
দেয় পাহাড়ের পথে, তাদের
পিছু নিই মনে মনে।
ছন্দা গায়েন হারিয়ে
গেল। পারল না শেষ
পর্যন্ত পাহাড়কে বশ
করতে। এর পিছনে যে কী
চাপ ছিল ওর, তা আজ সকলেই
জানে। কিন্তু যারা
প্রফেশনাল নয়, নিছকই
নেশার টানে পাহাড়ে যায়,
তাদের তো কোন চাপ থাকে
না। কেউ তো ওদের বাধ্য
করে না ছুটে যেতে! তবুও
ওরা যায় সমাজ সংসার
ছেড়ে। এই তো সেদিনের
কথা, নেপালের পাহাড়ে
হারিয়ে গেল আমাদেরই
এলাকার দুই বাসিন্দা।
অনেক খোঁজাখুঁজির পরে
তাদের ‘বডি’ এসে
পৌঁছলো। এদের একজন ছিল
আমার ছোটবেলার বন্ধু।
তার স্ত্রী-কন্যার
মুখের দিকে আমি আজও
তাকাতে পারি নি। কেন
কেড়ে নেয় পাহাড় এদের?
আমাদের ঔদ্ধত্যের জবাব
দেবে বলে! কই এতগুলো
প্রাণ কেড়ে নিয়েও ওর
মুখের রেখার কোন
পরিবর্তন তো হল না!
উদাসীন না নিষ্ঠুর ও? কে
জবাব দেবে!
তবে পাহাড়ের যে কোন
বিরক্তি নেই, এটা
মানতেই হবে! এই যে দলে
দলে লোকে চলেছে পাহাড়ের
পথে, এভারেস্টে
ট্র্যাফিক জ্যাম, এত
মানুষের বর্জ্য ও তো
হজম করছে নির্বিকারে!
শীতল উদাসীনতায় আবার
বরফের চাদরে ঢেকে
দিচ্ছে ওই সব জঞ্জাল।
তবুও ক্ষত হচ্ছে ওর
গায়ে। অনেক বরফ গলে গেল
এই ঘা বেয়ে। বরফ গলে
কান্না হল, আর আমরা জল
বুঝলাম! ওই জলের স্বাদ
নিলে হয়ত নোনা স্বাদ
বুঝতাম! আমাদের অত সময়
নেই আজ। আমরা যারা
ট্রেকার নই, যারা
টুরিস্ট পার্টি, তারা
নিয়ম করে বছরে একবার
ঘুরতে আসি পাহাড়ের
শহরে। ভালো হোটেল,
উপযুক্ত খাদ্যপানীয়
সহকারে। আমাদের হাতে
গোনাগুনতি সময়। ফিরে
যেতে হবে আবার নিজের
বৃত্তে। খুব অল্প সময়ের
এই কাছে আসা, ভালোবাসা ও
মাথা নোওয়ানোর অনুভূতি
আমাদের আবেগকে নাড়া
দেয়। মনে থাকে পাহাড়ের
ওই অবিচলিত মূর্তি, ওই
বিশাল উচ্চতা। কখনও
শ্রদ্ধা আসে, কখনও
প্রশ্ন জাগে ওর অহং
নিয়ে। আসলে আমরা সাধারণ
মানুষ, আমাদের কী আর
পাহাড়ের কাছে আসা সাজে!
না পাহাড় নিয়ে এত কথা
বলা মানায়!
তবু বলি, খুব খুব যেতে
ইচ্ছে হয় আমার পাহাড়ের
কাছে। একা এবং নির্জনে
আমার সেই গুরুদেবের
পায়ের কাছে বসে থাকি
ঘন্টার পর ঘন্টা। দিনের
পর দিন, রাতের পর রাত
শুধু চুপ করে বসে থাকি
ওর পায়ের কাছে। আমার
সবটুকু কান্না দিয়ে
ধুয়ে দিই ওর ধুলোমাখা
পা। আমার সমস্ত
বাচালতা, ছুঁড়ে ফেলে
দিই ওর খাদে। পাকদন্ডী
বেয়ে বেয়ে উঠতে থাকে
আমার সব না-বলা কথারা।
আমার নৈঃশব্দকে ফিরে
পেয়েছি তোমার কাছ থেকে,
আমার ঋণের সীমা পরিসীমা
নেই সেই থেকে। আমার
না-দেখায় তুমি আছ,
না-বলায় তুমি থাকবে,
প্রাপ্তির ঝুলিতে
শূন্যতা ভরা এই পূর্ণতা
তোমারই দান। হে পাহাড়
দেবতা, তোমায় প্রণাম।