তখন বসে আছি দার্জিলিং
ম্যালে। দুপুরের নরম
রোদ তখনও জড়িয়ে আছে
পশমি চাদরের মত।
আশপাশের মানুষের ঢল
পরিযায়ী পাখির মত বেড়েই
চলেছে। আশপাশ বলতে
ফ্রেমে টাঙানো হলদেটে
কাঞ্চনজঙ্ঘা, চেনা কিছু
রঙ, চেনা কিছু চরিত্রের
ওলট পালট... ব্যস। এ
ছবিতে যথারীতি বাধ্য
ঘোড়ার পিঠে চেপে নাগরিক
ছোট্ট ছেলেটি হয়ে ওঠে
নবাব সিরাজ আর তার পাশে
পাশে এগিয়ে চলে এ শহরের
আধপেটা সহিস। এ কে
ফর্টি সেভেনের ছুঁচলো
নলের মত ক্যামেরা
বাগিয়ে সিরাজের বাবা
যখন সন্তানের বীরত্বের
ঘোড়দৌড় ক্যামেরায়
আঁকতে ব্যস্ত, ততক্ষণে
সন্তানের মা-ও ঝাঁসি
রানী হয়ে চড়ে বসেছে
আরেক চেতকের পুরুষালী
পিঠে। আর রঙ্গমঞ্চের
এসব দৃশ্য দেখে ডানা
ঝাপটাচ্ছে পায়রাদের
কুচকাওয়াজ, আর মিটি
মিটি হাসছে ম্যালে
ছড়িয়ে ছিটিয়ে রোদ
পোয়ানো জীর্ণ বলিরেখায়
আঁকা মুখগুলো, এ শহরের
আদি ইতিহাসের সাক্ষী
যারা।
প্রতি
বছরই কোন এক অদৃশ্য
বাশীওয়ালা জাদুসুরে
ডাকে আমায়। আসতেই হয়
পাহাড়ে। এ যেন খোলস
ছেড়ে বেরিয়ে আসা।
সারাদিন সমতল যাপন যেন
নিজের মনের সাথে
সমান্তরাল দিনলিপি।
ইকড়ি মিকড়ি সেসব চেনা
গলিকে স্পষ্ট করে দেখতে
খানিকটা ওপরে উঠতেই হয়
হয়ত। সমতল পেড়িয়ে যখন
উঠতে থাকি পাহাড়ের
ভাঁজে ভাঁজে, লুকোচুরি
খেলতে থাকে অনেক নীচের
বাক্সবাড়ি, ক্ষুদে
ক্ষুদে গাড়ি, জলরঙে
আঁকা রাস্তা ঘাট , তখন
যেন মনে হয়... নিজেকে,
নিজের মধ্যবিত্ত সমতল
বেঁচে থাকাকে বার বার
আবিষ্কার করতেই যেন
নিজের চেয়ে অনেকখানি
ওপরে ওঠার আয়োজন!
'এ শহরটা মরে যাচ্ছে।
দিনের পর দিন' বৃদ্ধা
বলল। আমার ঠিক পাশে বসা
তিন বৃদ্ধার মাঝের জন।
হাতে উল আর কাঁটার
চমৎকার জুটি নিপুণ
বোঝাপড়ায় খুনসুটিতে
ব্যস্ত। সামনে একটি
লোমশ কুকুর এক হাত জিভ
বের করে ঘাড় নাড়াল।
'কি বলছেন! এত সুন্দর
একটা শহরে জীবন কাটান
আপনারা। আমরা ছুটে
ছুটে আসি' বলে উঠি।
'সেটাই তো...' বলে থেমে যান
উনি। বেরিয়ে আসে খানিক
দীর্ঘশ্বাস। সে উষ্ণ
বাতাসে যে চোখের
লবণাক্ত বাষ্প মিশে আছে
টের পাই। সমতল গ্রাস
করছে এ শহরকে। সে কবে
থেকেই। মানুষের ধর্মই
এ। আশপাশকে নিজের ছাঁচ
দেওয়া। ছেঁড়া কুয়াশা,
হিমেল বাতাস, দেবদারুর
এ শহরে লাফিয়ে লাফিয়ে
বাড়ছে বাড়ি ঘর, শপিং মল,
হোটেল।
পাহাড়ের নির্জন
অলিগলিতে ঢুকে পড়ছে
সমতলের শোরগোল।
চুপ করে থাকি। নাগরিক
প্রতিনিধি আমি।
পাহাড়বাসী বৃদ্ধার না
বলা কথাগুলো ছুঁয়ে
ফেলি। লজ্জ্বিত হই।
হাঁটতে থাকি হাট বাজার
পেড়িয়ে। নিজের
দৈনন্দিনতাকে উপড়ে
ফেলে খানিক জিরিয়ে
নিতে। অনেকখানি পথ
পেড়িয়ে নির্জন রাস্তার
কোনে একাকী একফালি
বেঞ্চিতে নিজেকে বসাই।
আকাশ খানিক ধোঁয়াটে
কালচে এখন। আমার সামনে
বিরাট এক খাদ্ জোড়া
নৈঃশব্দ্য। চেয়ে থাকি
সেদিকে অপলক। খানিক পরে
মনে হয় অতলান্ত গভীর ঐ
নীরবতা যেন আমায় নিজের
অস্তিত্বের গভীর কোন
অন্তঃস্থলে নিয়ে যেতে
চাইছে! চোখের মণিদুটো
ঘুরে যেতে থাকে যেন।
ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ি
নিজের ভেতরে।
অবনী বাড়ি আছ?
টালমাটাল উচ্চারণে
চাবি হাতড়ান কবি। সেই
ছন্দে ধরাস শব্দে দরজা
খুলে যায়। দেখতে পাই
ছেঁড়া ছেঁড়া কতগুলো
কাগজ যেন উড়ে বেড়াচ্ছে
ঘরজুড়ে। হঠাৎ দেখতে পাই
আমার ছোট্ট মেয়েটাকে ।
ওর দু চোখে মোমবাতির
নরম আলো। একটা করে ছবি
আঁকছে আর উড়িয়ে দিচ্ছে
হাসতে হাসতে। আর দেখতে
পাই ছায়ার মত একটা
মানুষ পাগলের মত
ছবিগুলো ধরার চেষ্টা
করছে। লাফিয়ে লাফিয়ে।
পারছেনা। অসহায়তার
গোঙানি সে মানুষের
মুখে। দেখার চেষ্টা
করি ছবিগুলোর রেখা।
চমকে উঠি! এ যে আমারই সব
ছবি। আমার মেয়ে এঁকে
চলেছে নেশার মত। ছবিতে
দেখছি মর্গের মত শীতল
চাউনির বিকিকিনি, হাতে
ধারালো ভোজালি। মুখে
এঁটে আছে শয়তানের নীল
মুখোশ।
সে ছবির ওপর তুলির আঁচড়
যেন ছিঁড়ে ফেলেছে
মুখোশের আড়ালে থাকা
ক্লান্ত চোখদুটো! শিউরে
উঠছি চোখের কালো কোটরে
থক থক করছে কালচে রক্ত।
আমার মেয়ে হাসতে উড়িয়ে
দিচ্ছে সে ছবি। আমি
হাতড়াচ্ছি আরও সব
ছেঁড়াপাতার ছবি
অরণ্যে। দেখতে পাচ্ছি
কাকে যেন যেন পিছমোড়া
করে বেঁধে রাখা হয়েছে
জিলোটিনের কাঠে।
চারিদিকে ঢাক বাজছে।
গিজগিজ করছে মানুষের
মুখ আশপাশে। সবার হাতেই
একটা করে উত্তপ্ত শেকল।
দেখতে পাচ্ছি আমার
প্রিয় মানুষদের, আমার
ছোটবেলার বেড়ে ওঠা
চারপাশ, আমার চিলেকোঠা,
রান্নাঘর, শোবার ঘরের
গোলাপগন্ধ। সবাই একে
একে এসে শিকলে বেঁধে
দিচ্ছে পিছমোড়া হয়ে
থাকা মানুষটার হাত, পা,
মন, চোখ,ঠোঁট, জিভ, ঘিলু,
মেরুদণ্ডও...! মানুষটা
নৈশব্দে ভরে যাচ্ছে।
বোবা এক গোঙানি ভেসে
আসতে চাইছে সবকিছু
ছাপিয়ে। তীব্র আক্রোশ
আর অসহায়তায় কুঁকড়ে
যাচ্ছে মানুষটার মুখ।
হঠাৎ দেখি আমার মেয়ে, ওই
মানুষটার সামনে অবাক
হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে
কাগজ, তুলিতে রঙের
গন্ধ। সে কাগজের বুকে
মানুষটার আদল ফুটে
উঠছে ছায়াছবির মত। চমকে
উঠি; নিজেকে দেখে! হঠাত
দেখি আমার মেয়ে কাঁদতে
কাঁদতে বলে ওঠে এই
দ্যাখো বাবা,আমি তোমায়
মুক্তি দিলাম; বলে
উড়িয়ে দেয় সে কাগজ,
কালচে আকাশে।
সে কাগজের পেছনে আমি
দৌড়তে থাকি। দৌড়তেই
থাকি। হঠাৎ করে হয় আমার
ঘাড়ে উড়ে এসে বসল শীতল
কয়েকটা আঙুল। কে? চমকে
যায়।
'খুঁজে পেলে কিছু?'
প্রশ্নটা ভেসে আসে।
ভাবতে থাকি আমি। ঠিক
কোথায় আমি। কোন
অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ।
সময়ের কোন কাঁটাতার।
কোন কক্ষে। চোখ খুলে
যায়। দেখতে পাই ওনাকে।
মিটি মিটি হাসছেন।
'শুনতে পাচ্ছ?' বলে ওঠেন
উনি। এক মুখ সাদা দাড়ি।
চোখে কালো ফ্রেমের
চশমা। ঘিয়ে রঙা শাল।
চাঁদের আলো এসে পরে
ঝলসে দিচ্ছে
মানুষটাকে। চন্দ্রাহত!
'আপনি?' ভ্রু কোঁচকাই।
'আমি তো রোজ এখানেই আসি।
গত কুড়ি বছর ধরে।
এখানেই খুঁজি নিজেকে।
আজ দেখি আমার আগেই তুমি
এসে
পড়েছ' ।
'কেন আসেন?' অবাক হই আমি।
মানুষটা স্মিত হাসেন।
'ঠিক যে কারণে তুমি
এসেছ। নিজের চেয়ে
অনেকখানি ওপরে উঠতে'
'তার জন্য কুড়ি বছর?' আমি
অবাক হই।
'তার জন্য সারা জীবন
লেগে যায় হে। এই যে এই
শহরের পথে পথে হোঁচট
খাওয়া বাঁকগুলোর ওপারে
অনিশ্চয়তার গল্প, এর
কোন শেষ আছে? সারাজীবন
তো এই সব বিন্দু বিন্দু
অনিশ্চয়তাগুলোকে
কুড়িয়ে বাড়িয়ে আমাদের
যাপন। সেসব থেকে
মুক্তির পথই তো এই
আরোহণ'
'বেশ বললেন...। জানেন আরও
মনে হয় পাহাড় যেন
আমাদের ফোর্থ
ডাইমেনশন। মৃত্যু কত
শিরশিরে হতে পারে টের
পাই পাহাড়ে এলেই। কি
অতলান্ত গভীর পরিণতি এ
জীবনের!'
'তা বটে। আবার ভেবে দেখ
সমুদ্রপিঠের সমতল থেকে
এতখানি ওপরে এসে তুমি
দেখতে পাচ্ছ কত ক্ষুদ্র
তুমি, সামনেই ঐ বিশাল
পর্বত শৃঙ্গদের
সামনে।এই বিশাল
ব্রহ্মাণ্ডের মাঝে
তুচ্ছ তোমার এই
অস্তিত্ব। এ নিয়েই
আমাদের নিত্য দিনের কত
গল্প। কত যাপন। আবার এই
উচ্চতা থেকে যখন দেখছি
ওই ছোট ছোট বয়ে যাওয়া
জীবন, বাড়ি, মানুষ তখন
মনে হচ্ছে এত ঠুনকো
বেঁচে থাকা নিয়ে এত
অমূল্য সময় আমরা ছড়িয়ে
দিই বাদাবনে! কত কিই বা
করা যেতে পারত, নিজের এই
অস্তিত্বটুকু নিয়ে।
আরও কত গভীরেই না খোঁজা
যেন পারত ঝিনুকের
সাম্রাজ্য।'
'আপনার সাথে কথা বলে খুব
আরাম হচ্ছে জানেন।
বুকের মধ্যে আটকে থাকে
কথার নদীরা। শুকিয়ে
যাওয়াটাই ভবিতব্য ভেবে
নেয় যে! হঠাৎ করে জোয়ার
এলে...' বলে উঠি।
স্মিত হাসেন মানুষটা।
'এই... আপনি কে? এখানে একা
একা কি করছেন?' প্রশ্নটা
ধেয়ে আসে
ষ্ট্রীটলাইটের আলো
থেকে। দুজন দাঁড়িয়ে
আছেন। পুলিশ।
বলতে চাই , আমি একা
কোথায়? কিন্তু তার আগেই
ওরা বলে ওঠে, 'উঠে পড়ুন
ঝটপট। এসব জায়গা ভালো
নয়। কিছু একটা হয়ে যাবে
আর খবরের কাগজে আমাদের
খিস্তি করবে'।
আমি পাশের মানুষটার
দিকে তাকাই। তার চোখের
দৃষ্টি আমাকে ছেড়ে
পাড়ি দিয়েছে সুদূর
বরফশৃঙ্গে। চাঁদ-গলা
জ্যোৎস্না আছড়ে পড়েছে
ওই চুড়োয়। আরও অনেক কথা
বাকি ছিল। আরও অনেক কথা
বলার ছিল। বিড়বিড় করতে
করতে উঠে আসি।
'চলে যান প্লিজ' গলায় যেন
আদেশের সুর, পুলিশটির।
আমি অবাক হই পুলিশদুটোর
দৃষ্টি এমন ঘোলাটে বলে।
জলজ্যান্ত মানুষটাকে
দেখতেই পেল না! নাকি
দেখেও দেখল না। কোন এক
অজানা রহস্যের আঁচে
বুকে শিরশির হাওয়া বয়।
পা চলতে থাকে
হুড়মুড়িয়ে। শ্যাওলা
ধরা পাহাড়ি দেওয়াল,
ফার্ণের ঝোপ ঝাড়,
তিরতিরে জলের ধারা
পেড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে
আলোর মাঝে পৌঁছই।
এতক্ষণে ঘড়িতে চোখ পড়ে।
এত রাত হয়ে গেছে! শহর এখন
ঘুমনোর তোড়জোড়ে।
কিন্তু ওই মানুষটা আর
কতক্ষণ ওখানে? থাক। আর
ভাবতে ইচ্ছে করতে মন
চাইছে না।
হোটেলে ফিরে খেতে বসি।
আশপাশে চেনা
নিরাপত্তা। আশ্বস্ত
করি নিজের বেঁচে
থাকাকে। কেবল মনের
মধ্যে উড়ে বেড়াতে থাকে
শিরশিরে কিছু প্রশ্ন।
এসব বেয়ারা প্রশ্নের
ছোঁয়াচ এড়াতে বাঁধা
পড়তে চাই নাগরিক শিকলে।
মোবাইলে হোয়াটস-অ্যাপ
অন করি। একটার পর একটা
ভেসে ওঠে অসম্পূর্ণ সব
সংলাপ। চোখ বোলাতে
থাকি। একটা ছবিতে এসে
মনটা আটকে যায়। আমার
স্ত্রী পাঠিয়েছে ।
মোবাইল স্ক্রিনজুড়ে
ছেঁড়া কাগজ। 'তোমার
মেয়ে আজই এঁকেছে। বলল,
বাবা বুড়ো হলে এমন হবে।
পাঠালাম'।
একটা প্রৌঢ়ের ছবি। হাতে
আঁকা। চোখে কালো ফ্রেম।
একমুখ সাদা দাড়ি। গায়ে
ঘিয়ে শাল। হাতে লাঠি।
ছ্যাঁত করে ওঠে বুকের
ভেতরটা।
-----------