"the hills are alive with the sound of music...with the
songs they have sung for thousand years, the hills fill my
heart with the sound of music..." অথবা " i
go to hills when my heart is lonely"
...পাহাড়ের গম্ভীরতায়
সেই অমোঘ হাতছানি আছে।
আর তাই বুঝি সেই কালের
যাত্রা ধ্বনি শুনতে
রবিঠাকুর থেকে সকলেই
পাহাড়ের কাছে ঋণি।
পাহাড়ের গাম্ভীর্যে
আছে লুকনো সেই
ব্যক্তিত্ত্ব যা তার
ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া
ঘটনার স্রোতকে শুধু ধরে
রাখেনি, সে যেন সংসারের
বয়োজ্যেষ্ঠ মধ্যমণির
ভূমিকা নিয়ে আগলে
রেখেছে আশপাশ...তার
গাছপালা, ফুল-পাখি
সবকিছু।
জীবনে অনেক পাহাড় দেখা
হল । পাহাড় অনেক জীবনকে
দেখাল। আর আজ তাই পাহাড়
নিয়ে লিখতে বসে মনে পড়ে
যাচ্ছে সেই সব পাহাড়ী
স্মৃতি। কানে বাজছে
পাহাড়িয়া ধুন।
গত গ্রীষ্মে কবিপক্ষে
নর্থ-ইষ্টে গেলাম
পাহাড়ের সাথে এক
আড্ডাচক্রে।
রবিঠাকুরের শিলং
স্মৃতির ফরাসে পা রাখতে
রাখতে উদ্বেলিত হল মন।
রডোডেনড্রণ উঁকি দিল
পাশ থেকে। আর হাতছানি
দিল ল্যান্ড অফ দ্যা
রাইসিং সান বা অরুণ
পাহাড়ের দেশ।
আড্ডার শুরুতেই পাহাড়
বলে উঠল, বিশ্ব
উষ্ণায়নকে আপাতত
বুড়ো আঙুল দেখিয়ে
বলতে পারি, আমাদের
রাজ্যকে কংক্রীটের
জঙ্গল বানানো সহজ নয়
হে ! এখানে প্রায়
ছাব্বিশটি উপজাতির
শান্তিপূর্ণ
সহাবস্থান। জমি এখানে
সুলভ নয় অতএব চাহিলে
যারে পাওয়া যায়না
তেমনি এই অরুণাচল।
প্রাকৃতিক সম্পদে
ভরপুর। রামধনুর সব কটি
রং যেন চুরি করে রেখেছে
এই রাজ্য। এই রাজ্যে
সূর্য ওঠে সেই কোন
কাকভোরে। হিমজোছনায়
তখনো আকাশটা ভেজা থাকে।
আর সূর্যাস্ত হয়
বিকেলেই, প্রকৃতির সব
রংগুলো কুড়িয়ে
নিয়ে। আপাতনি, মিশমি,
ন্যিশি, ট্যুটসা, আদি,
টাংসা, আকা, মিজি, মংপা,
শেরদুকপেন, বগুন
প্রভৃতি উপজাতির
হোমটাউনে যতটা আছে
প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা
ঠিক ততটাই আছে সীমানার
টানাপোড়েন। তবুও
শিল্প, সংস্কৃতি, উত্সব,
তিব্বতী পতাকা উত্তোলন,
বৌদ্ধধর্মের লিপি পাঠ
আমাদের ভরিয়ে রাখে
সারাটা বছর।
আমি বললাম্, বাপ্রে!
তোমার তো খুব অহঙ্কার!
আমি জিগেস করার
আগেভাগেই গলগল করে সব
বলে দিচ্ছ, দারুণ মুডে
আছো মনে হচ্ছে।
পাহাড় বলল,
ট্রাইবাল কিংবদন্তীতে
পৃথিবীর প্রেমিক হল
আকাশ আর ঈশ্বর নিজে
রামধনুর সিঁড়ি দিয়ে
তাঁর প্রিয়তমা পত্নী
চাঁদের সাথে দেখা করতে
যান। সাক্ষী পাহাড়।
পাহাড়ী বারোমাসের
তেরোপার্বণ। নতুন বছর
পালনের সাথে সাথে কৃষি
উত্সব, চাঁদ ও সূর্য
পুজোর পাশাপাশি
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের
জন্য পুজোয় মেতে ওঠে
আনন্দে। পাহাড় খুশিতে
থাকে তখন।
কুয়াশাছন্ন ভ্যালি আর
পাহাড়ের গা থেকে
ঝুলন্ত মেঘ।
ক্যামেরায় ক্লিক
ক্লিক.. আবারো চলা। পথে
পথে বন্দুকধারী
স্থলসেনার ছাউনি। সেসা
ওয়াটার ফলস আর
রহস্যময় মেঘমিনারে
চোখ রেখে পৌঁছলাম টেংগা
ভ্যালি। কুয়াশাছন্ন
পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে
চলা। কখনো মেঘ, কখনো
রোদের সাথে লুকোচুরি
খেলছি। পাহাড়ী পিটস্টপ
প্রথমে রাতে ভালুকপং
তারপর দিরাং। সেখান
থেকে আরো
গুরুগম্ভীরতায়
আচ্ছন্ন পাহাড়ী শহর
তাওয়াং এ। অতএব আপাততঃ
ডেষ্টিনেশন চীনের
সীমান্তে তাওয়াং।
পাহাড় সেখানে একই
হিমালয়, একটু খোঁচালেই
আগ্নেয়গিরির লাভার মত
বেরিয়ে আসবে কিন্তু
সময়ের দলিলে এই
হিমালয়ের অনেক গল্প
শোনাল সে। পাহাড়ের
গায়ে ধাক্কা খেয়ে মরেছে
কত প্রেম। পাহাড়ের
আপাত সবুজ গায়ে কত
সৈনিকের বলিদান হচ্ছে ।
আমরা তো পাহাড় দেখে,
বেড়িয়েই খালাস কিন্তু
পাহাড়ের এই নির্জনতা
যেন বারেবারে আছড়ে পড়ে
উল্টোদিকের পাহাড়ের
গায়ে। লাগামছাড়া
কান্নার চোরাস্রোত বয়ে
যায় পাহাড়ের বুকের ওপর
দিয়ে।
মেঘের দেশ তাওয়াং।
সেখানে খুব কম মানুষের
বাস। পুরোটাই যেন
ভারতীয় স্থলসেনাদের
কবজায়। আর আছে নিরীহ
কিছু উপজাতিদের
ঘরবাড়ি। মেঘের মিনারে
ঢুকতে ঢুকতে যেন শুনতে
পেলাম সেনাদের
কুচকাওয়াজ। অবচেতনে
কানে এল দু-চারটে
গোলাগুলির শব্দ।
পাহাড়কে শুধাই তারপর?
সে শোনায় আমার জন্মেরো
আগে ঘটে যাওয়া চাইনিস
এগ্রেশনের কথা। ১৯৬২
সালের ভারত-চীন ভয়ানক
সেই যুদ্ধের কথা। এই
তাওয়াংয়ের আগে একটি
জায়গা নুরানাংয়ে
গাড়োয়াল
রেজিমেন্টের বীর
যোদ্ধা যশোবন্ত সিংহ
রাওতের প্রাণ বলিদান
চাইনিজ সোলজারের হাতে ।
যশোবন্ত সিংহ বাঁচাতে
চেয়েছিল দেশকে।
চাইনিজ সোলজারদের
অনুপ্রবেশ রুখেছিল
নিজের জীবন দিয়ে। তার
মাথাটা কেটে নিয়ে
গেছিল চীনেরা। তারপর
তার একটা মূর্তি
বানিয়ে ফেরত দিয়েছিল
ভারত সরকারকে।
আমি বলি, তারপর?
পাহাড় বলে, তার আর পর নেই
।
লড়াকু যুবক যশোবন্তের
দুই প্রেমিকা ছিল। মংপা
উপজাতির দুইবোন, সেলা ও
নুরা। পাশের এক গ্রামেই
থাকত তারা। অবসরে এই
দুইবোনের সাথে
যশোবন্তের
ফূর্তিফার্তা চলত।
তারা রুটি-সবজী বানিয়ে
আনত গ্রাম থেকে।
যশোবন্তের জীবন চলছিল
ভালোমন্দে, সেলা ও
নুরার সাথে ভালোবাসায়,
মন্দবাসায়। চীন
আক্রমণের গুপ্ত খবর দিত
তারা যশোবন্তকে।
প্রেমিক যশোবন্তের
মৃত্যু মেনে নিতে
পারেনি এই দুই মংপা
ভগিনী। কিছুদিন পরেই
অদূরে সেলা লেক সংলগ্ন
হিমালয়ের উঁচু এক
শৃঙ্গ থেকে ঝাঁপ
দিয়েছিল সেলা আর
অসাধারণ সুন্দর এক
রাজকীয় জলপ্রপাত থেকে
ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা
করেছিল নূরা। এই মংপা
কন্যার স্মৃতিতে
তাওয়াং শহরে প্রবেশ
করার উপত্যকার নাম সেলা
পাস ।আক্ষরিক অর্থে
মৃত্যু উপত্যকা। সেলা
লেকটিও অসাধারণ।
শীতকালে পুরোটাই বরফের
চাদরে মোড়া থাকে।
উচ্চতা ১৩৭০০ ফুট।
মেঘের চাদর সরিয়ে
রোদের মৌরসীপাট্টা
তখন। দূরে পাহাড়ের
মাথায় বরফ আর বরফ।
ডিজিটাল ক্লিকে মুখর হল
সেলা পাসের আশপাশ।
পাহাড়ের চোখেমুখে সে কি
হাসি তখন্! আবার গল্প
শোনা। এবার নামার পালা।
সৈনিক যশোবন্তের সাথে ঐ
দুই মংপা ভগিনীর
প্রেমকথা.... পাহাড় আজো
আগলে রেখেছে সেই
ত্রিকোণ প্রেমকে। সেই
কিংবদন্তীর সত্যতা
যাচাই করার চেষ্টা
করিনি তবে অনেক কথার
আভাস পেলাম
যশোবন্তগড়ে গিয়ে।
পাহাড়ের ওপরে
সারেসারে মসে ঢাকা
বাংকার যেখানে লুকিয়ে
বসেছিল যশোবন্তের
স্মৃতিচিহ্ন রযেছে
সযত্নে। ব্যবহৃত
কিটব্যাগ থেকে জুতো,
হাওয়াই চপ্পল থেকে
কম্বল সবকিছুই সাজানো
শুধু সেই মানুষটি নেই
যার সাহসের কাছে কিছুটা
হলেও পরাজিত হয়েছিল
চাইনিজ সেনাবাহিনী।
বীর যশোবন্ত সীংহের
সম্বন্ধে লেখা
ইনস্ক্রিপশন গুলি
তাওয়াংয়ের পাহাড়ে আজো
যেন কথা বলে।
মরণোত্তর মহাবীরচক্র
দান করা হয়েছিল তাঁকে
কিন্তু তিনিই একমাত্র
একা নিরলস যুদ্ধ করে
চাইনিজ সেনাদের
বাহাত্তর ঘন্টার মত
রুখে দিয়েছিলেন এই
স্থানে। প্রাণ হয়ত
দিয়েছিলেন কিন্তু
বমডিলার পর আর এগুতে
সাহস করেনি চীনারা। তাই
আজো কুদোস যশোবন্ত সিংহ
রাওত। তাওয়াংয়ের
হিরো তিনি।
নূরানাং নদীর উত্পত্তি
সেলপাস থেকেই। আর সে
গিয়ে পড়েছে তাওয়াং
নদীতে। এ যেন
বিচ্ছেদপুরের নিশানা।
পরপর শহীদ হওয়ার বাসনা
প্রাণে। একজনের দেশকে
ভালোবেসে আর অন্য
দু'জনের সেই
দেশপ্রেমিককে
ভালোবেসে পৃথিবী থেকে
বিদায় নেওয়া।
সেলাপাস-যশবন্তগড়-নুর
নাং ফলস্ যেন তেমনি
বিষাদময় লাগে।
আশপাশের প্রকৃতি
ভুলিয়ে দেয় সেই
মৃত্যু উপত্যকার করুণ
সুর। পাহাড়ের চোখের
কোণে দেখি জলের ফোঁটা।
আবারো চলতে থাকি
পথমায়ায়...যেন ক্লড
মোনে বা রেনোয়ারের
তুলির টানে মূর্ত
আকাশ-পাহাড়-গাছ নিয়ে।
যত্রতত্র অরুণাচল
ম্যাকাকের উত্পাত। দু
চারটে হিমালয়ান ভালচার
ডানা ঝাপটে উড়ছে ঐ অত
ওপরে।
তাওয়াং পৌঁছলাম বেশ
সন্ধ্যের ঝুলে। ১০০০০
ফুটে অবস্থিত তাওয়াং
শহর। লেকসাইডে গাড়ি
পার্ক করে দেখলাম ধুধু
কুয়াশায় অন্তহীন
পাহাড় আর পাহাড়।
পাহাড় বললে, ঐ তো তোমার
তাওয়াং এল। আমি আজ চলি?
আবার কাল আড্ডা হবে।
কোথায় লেক? বললাম্,
ধুস্ ! এমন কি জায়গায়
নিয়ে এলে? বলতে না বলতে
হঠাত মেঘের চাদর সরিয়ে
যেন একফালি সুয্যি
বেরিয়ে এল আর তার
আলোতে পিটিসো লেকের জল
চিকচিক করে উঠল চোখের
সামনে। যেন ভেল সরিয়ে
লজ্জাবনত বিয়ের কনের
শুভদৃষ্টি হল
ক্যামেরার লেন্সের
সাথে।
পাহাড় বলল "যেমন তেমন
মেয়ে বিয়োব, বয়েসকালে
রূপ দেখাব"
পাহাড়ের গায়ে ফুটে
রয়েছে রংবেরংয়ের
রডোডেনড্রন। সত্যি
রবীন্দ্রনাথ তুমি পারো
বটে! পাহাড়, তুমিও পারো
বটে গল্প শোনাতে! মনে
মনে বলে উঠি। গুচ্ছ
গুচ্ছ ফুলগুলো যেন মাথা
উঁচিয়ে সত্যি সত্যি
বলতে চায়, আমাকে দেখো।
পাহাড় বলে ওঠে, এবার
ঝগড়া শুনবেনা?
হিমালয়ের ওপারে চীন,
এপারে ভারতের সেই
বিদ্ধ্বস্ত টেরেন যার
পূর্বনাম ছিল নর্থ-ইষ্ট
ফ্রন্টিয়ার এজেন্সি
(বর্তমানে অরুণাচল
প্রদেশ)। অমন তুষার
সুন্দরীকে কে ভোগ করবে
সেই নিয়ে কোঁদল। তাই
মাঝেমাঝেই ঝাঁপিয়ে
পড়া। নিরীহ
মংপা-আপাতনীদের
ওষ্ঠাগত প্রাণ ।১৯৬২ র
চীন-ভারত যুদ্ধের এই হল
প্রেক্ষাপট। আজো হাসে
রডোডেনড্রণ খিলখিল
করে। রডোডেনড্রণের
খুশি তখন আমার শরীরে।
আরো উত্তরে এগুলাম সেই
ভয়াবহ সীমানা দিয়ে । এল
বমলা পাস। যার ওপাশে
সেই ঐতিহাসিক ম্যাকমহন
লাইন। ছবি নিতে মানা
করল। অগত্যা ক্যামেরা
শাটডাউন করে সীমানার
দিকে তাকিয়ে রইলাম।
যাবার পথে ইয়াক মনের
আনন্দে চরে বেড়াচ্ছে।
তার গলায় কোন্ দেশের
পাসপোর্ট জানা নেই।
বয়ে বেড়াতে লাগলাম সেই
পাহাড়ী স্মৃতি, কিছুটা
বিষাদে, কিছুটা গৌরবে,
রডোডেনড্রণে,
ম্যাকমহনে।
কোয়েলার শুটিং করে গেল
মাধুরী-শাহরুখ।
বিখ্যাত হল নুরানাং
ফলস। চীন যখন ভারত
আক্রমণ করল দলাই লামা
তিব্বত থেকে পালিয়ে এই
তাওয়াং দিয়েই এসে
আশ্রয় নিলেন ভারতে।
তিব্বত ও ভারতের সীমানা
নির্ধারিত হয়
তদানীন্তন বিদেশ সচিব
স্যার হেনরী
ম্যাকমহনের নামে
বিখ্যাত ম্যাকমহন লাইন
নামে । যশোবন্ত সিং
মৃত্যু বরণ করে আগলে
রাখলেন সেই পাহাড়কে।
সেই একই পাহাড়ে কত
গল্প, কত গান লেখা হয়ে
থাকে ইতিহাসের পাতায়।
পাতা উল্টে যাই আমরাও।
সন্ধানে থাকি পাহাড়ের
মুক্তিতে। ওরা বলে
তাওয়াং আমার। আমরা বলি
তাওয়াং আমাদের.. আর
চলতেই থাকে সেই পাহাড়ী
গসিপ। পাহাড় শোনায় কত
গল্প, যেন ঠাকুরদাদার
ঝুলি ঝাড়লেই বেরিয়ে আসে
সেগুলো।
ঘুম ভাঙতেই দেখি আমি
মহানগরের কফিশপে। মন্দ
আড্ডা হলনা । সঙ্গে ছিল
শুধু এক কাপ কড়া কফি।