‘
মুক্তোছড়া নেইকো কন্যা
নেইকো মতির হার
মনের মুক্তো দিলাম
তোমায়-গড়ো অলংকার।’
আনন্দ মুখোপাধ্যায়ের
কথায় সুর করেছিলেন
অভিজিৎ
বন্দ্যোপাধ্যায়।
গন্ধরাজের গন্ধে মন ভরে
দেওয়া এবং পারিজাতের
রঙে বিভোর করার
প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবার
সঞ্চারী অংশে প্রবেশ
করবেন মানবেন্দ্র
মুখোপাধ্যায়, গাইবেন-
আর দেব মোর হৃদয়খানি
তোমায় উপহার।
আমার ফাগুন দিয়ে তোমার
পরাণ ভরে নিও,
বিনিময়ে তোমার শ্রাবণ
না হয় আমায় মোরে দিও’
প্রায় ৫৬ বছর বয়সী এই
বাংলা আধুনিক গানটি আরও
দু’দুটো গানের কথা মনে
করিয়ে দেয়। একটি কাজী
নজরুল ইসলামের গান,
‘মোর প্রিয়া হবে এসো
রানি/ দেবো খোঁপায়
তারার ফুল/ কর্নে দোলাব
তৃতীয়া তিথির চৈতি
চাঁদেরই দুল।’ আর একটি,
বছর কয়েক আগে তৈরি হওয়া
গান, সৈকত কুন্ডুর কথায়,
জয় সরকারের সুরে
গেয়েছিলেন শ্রীকান্ত
আচার্য- ‘আমার সারাটা
দিন মেঘলা আকাশ বৃষ্টি
তোমাকে দিলাম/শুধু
শ্রাবণ সন্ধ্যাটুকু
তোমার কাছে চেয়ে
নিলাম’। প্রসঙ্গ অবশ্য
এই নয় যে, একটা গান শুনতে
আর কী মনে পড়ে যায়, এই
গানের অবতারণা এ কারণে
যে, এই গানটি প্রায় তিন
পুরুষকে এক সুতোয় এনে
বাঁধতে পারে। এবং প্রতি
পুরুষের যেহেতু নিজস্ব
ভাষা আছে তাই ডিএনএ
সূত্রে এক হলেও কোথাও
না কোথাও তারা নিশ্চয়ই
আলাদা। কাজীসাহেবের
কল্পনা যেমন বস্তু
উপহারকে হেলায় হারিয়ে
গানের সাতসুর দিয়ে
প্রিয়ার বাসরশয্যা
রচনা করে দিয়েছিল, সেই
একই ধরনের কল্পনা
মুক্তোছড়া আর মনের
মুক্তোর মধ্যে দেখে
থমকে যেতে হয়। কিন্তু এ
তো পূর্বপুরুষের মুখের
আদল। একধাপ এগিয়ে পরের
গান তাই বলতে পারল,
‘বিনিময়ে তোমার শ্রাবণ
না হয় মোরে দিও’।কিন্তু
তার পরের গানেও আবার
সেই তোমার কাছে শ্রাবণ
চাওয়ার আকুতি। এ গানও
প্রজন্মের ভাষা মেনে
এগিয়েছে। এবং
প্রতিবারই আখেরে
লাভবান হয়েছে বাংলা
ভাষা। তবু এই প্রসঙ্গ
উল্লেখের এ কারণেই যে,
মোটামুটি এই উদাহরণ
থেকেই বাংলা আধুনিক
গানের সমৃদ্ধি, সমস্যা
এবং বাংলা ভাষার সঙ্গে
তার সম্পর্কের আন্দাজ
পাওয়া যায়। বারবার আমরা
দেখি, কখনও বাংলা গান
দুরন্ত রূপকল্প, ভাবনা,
ভাষায় চমকে দিয়েছে, তো
কখনও আবার নিজেই নিজের
পুনরাবৃত্তি করেছে।
গানের আবেদন এবং
আধুনিকতা শুধু কথার
যৌবনের উপর কখনই নির্ভর
করে না। করলে
গৌরীপ্রসন্ন
মজুমদারের, ‘লজ্জা রাঙা
সিঁদুর রাঙা আর রাঙা
কৃষ্ণচূড়া,/রাঙা যে গো
সাঁঝ আকাশের ওই যে
অস্তরাগ/ কন্যা সবার
চেয়েও রাঙা রাঙা তোমার
আলতার ওই দাগ’-এহেন
লেখার পর সলিল চৌধুরী
বোধহয় আবার লিখতেন না, ‘
কুঁচ রাঙা শিমুল রাঙা
গোধূলির মেঘ রাঙা/তাহার
অধিক রাঙা শরম
রাগে/আমায় রাঙাইও
না,/সুনয়নী আউলা কেশের
মেঘ তুলে যাইও না।’
সুর-তাল-লয়, গায়নে-চলনে,
ভাব এবং প্রয়োগের
প্রেক্ষিতের উপর
নির্ভর করে গানের
পুষ্টি। নিজের সেই
পুষ্টির ধারাতেই বাংলা
ভাষার সঙ্গেই সে সেরে
নেয় বাংলা ভাষার সঙ্গে
মিথোজীবিতা। নইলে
শ্রাবণ চাওয়ার আকুতি কি
বাংলা ভাষায় তৈরি হওয়া
কল্পনারাজ্যে আগে
কোথাও ছিল?
ছোটখোকা যখন শেখেনি অ-আ,
কথা কওয়া তো নয়ই, তখন
থেকেই বাংলা গানের
সঙ্গে তার পরিচয় হয়ে
যায়। বুলবুলিতে ধান
খেলে খাজনা না দিতে
পারার আদ্যন্ত
রাজনৈতিক বক্তব্যও
তাকে অনায়াসে পাঠিয়ে
দেয় সন্ধ্যাকালীন
ঘুমের দেশে, যদিও
সান্ধ্যভাষার ধর্মের
সঙ্গে তার পরিচয় হবে
আরও অনেক পরে। বাংলা
গান ক্রমাগতই নিজের
সারবস্তু এভাবে প্রায়
অলক্ষে দিয়ে যায়। প্রথম
‘দুখজাগানিয়া’ শব্দের
সঙ্গে পরিচয় বুঝি সব
বাঙালিরই গানের হাত
ধরেই। তেমনই
‘আরশিনগর’। আবার রোদ
জ্বলা দুপুরে রুবি
রায়কে কল্পনায় ধরতে
ধরতে হঠাৎ যখন ‘কান্নার
খাঁচা’ কানে আসে তখন
চমকে উঠতে হয়। আসলে গান
যাকে দেয়, তাকে সবই দেয়।
কথা-সুর-গায়ন-বাদ্যযন্ত
্রের ব্যবহারের রস যিনি
নিতে পারেন তিনি
সংগীতের সুন্দরকে
সর্বাঙ্গে কামনা করতে
পারেন। আর নেহাতই
সুর-তালের মনলোভা
শক্তিতে আমার মতো অ-সুর
গোত্রধারীদের বেশি করে
টেনে রাখে কথার জানলা।
দেখি গীতিকবিতা থেকে
রওনা দিয়ে একদিন বাংলা
কবিতা গীতিকে ছাপিয়েই
নিজের ঋজু চরিত্র তৈরি
করে নিয়েছে। উলটোদিকে
গীতি এখনও চাইছে সেই
কবিতার কাছাকাছি আসনের
অর্জন।
রবীন্দ্রউত্তরকালে
বাংলা ভাষার প্রথম
শ্রেণির কবিরা কেউ গান
লেখেননি বলে চালু একটি
আক্ষেপ আছে। সে খেদ
মেটাতেই বোধহয় বেশ কিছু
কবিতাকে গান হয়ে উঠতে
হয়েছিল, জীবনানন্দ দাশ
থেকে সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায় সকলেই
সেই তালিকায় আছেন।
সুকুমার রায়ের কবিতাও
গান হয়েছে আচার্য
জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের
অবিশ্বাস্য দক্ষতায়।
তাহলে শৈলেন রায়, পুলক
বন্দ্যোপাধ্যায়,
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার
থেকে সলিল চৌধুরী,
মুকুল দত্তরা কি কিছুই
দিলেন না, বাংলা গানের
ভিতর দিয়ে বাংলা
ভাষাকে? শুনি,
অখিলন্ধুর কন্ঠ আশ্রয়
করে, পুলক
বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন,
‘আমার আকাশ কাঙাল করে
গো /পাঠায়েছি মেঘ যত/
তোমার কুঞ্জ বীথিকার
ফুল ফোটাতে মনের মতো’।
‘মনের মতো’ হতেই তো সে
চেয়েছিল। এই আমার আকাশ
কাঙাল করে মেঘ পাঠানো
কি কোথাও ছিল নাকি?
উত্তর আসে, ছিল। রবি
ঠাকুর তো প্রায় একইরকম
বলেছিলেন, ‘আজ মেঘলা
দিনের সকালে সেই আমার
বন্দী কথাটাই মনের
মধ্যে পাখা ঝাপটে মরছে।
ভিতরের মানুষ বলছে,
“আমার চিরদিনের সেই
আর-একজনটি কোথায়, যে
আমার হৃদয়ের
শ্রাবণমেঘকে ফতুর করে
তার সকল বৃষ্টি কেড়ে
নেবে! ”
আবার মেঘ পাঠানো থেকে
মনে পড়ে, সাহিত্যে
মেঘদূত ছিল বটে, কিন্তু
বাংলা গানই প্রথম বাংলা
ভাষাকে দিল ‘মেঘপিওন’
শব্দটি। বাংলা গান
এভাবেই মাতৃভাষাকে
দিয়ে গেছে তার গানের
দান।
‘চর্যাপদ’,
‘গীতগোবন্দ’-এর পথ বেয়ে
যে গীতিকবিতার ধারা
গীতি ছাড়িয়ে কবিতাকে
সমৃদ্ধ করল তা বাংলা
গানের ভাষাকেও সমান
সমৃদ্ধ করতে পারত।
করেওছিল। বাংলা আধুনিক
গানের কাঠামো নির্মাণ
শুরু সেই ১৯ শতক থেকেই।
রবীন্দ্রনাথকে
মাঝখানে রেখে আগে ও
পরের সময়ের গানের ভাষায়
চোখ রাখলেই দেখা যাবে
কোন ভাষাগত কোন
সমৃদ্ধির পথে গেছে গান।
তাঁর আগে অন্তত ভাষার
নিরিখে বাংলা গান যে
খানিকটা খেলোপথ ধরেছিল,
তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
শিক্ষিত নাগরিক মননের
থেকে ক্রমশ দূরে সরে
গিয়েছিল গান। ‘কলকাতার
বারোইয়ারি পূজা’র
বর্ণনা দিতে গিয়ে
হুতোমের নকশায় যে সমস্ত
গানের নমুনা উঠে
এসেছিল, তাতে সেই সময়ের
গানের ভাষা আর সস্তা
মনোরঞ্জনের একটা আদল
স্পষ্ট হয়। রঙ্গরসের
বেশি ভাষার সঙ্গে তার
দেনা-পাওনা নিয়ে তেমন
মাথাব্যাথা ছিল না।
অবশ্য বাংলা ভাষার
প্রথম যে কাব্য
‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’,
তাও ভাষা ও ভাবের দিক
থেকে অত্যন্ত স্থূল
ছিল। আবার পরবর্তী
মঙ্গলকাব্যগুলিতেও এক
ধরনের দ্বৈততা দেখা
যায়। ‘আজি হতে শতবর্ষ’
আগের স্মৃতিচারণ করতে
গিয়ে নীরদচন্দ্র
চৌধুরী এ প্রসঙ্গে
ভারতচন্দ্রের মতো
বিদগ্ধ কবির উদাহরণ
টেনে দেখিয়েছেন, যে একই
কবির লেখায় কীভাবে
স্থূলতা ও মার্জিত ভাব
পাশাপাশি থেকেছে।
‘অন্নদামঙ্গল’ থেকে
তিনি আমাদের মনে করিয়ে
দিয়েছেন এই পদ- ‘ মেনকা
দেখিল চেয়ে জামাই
লেঙ্গটা/ নিবায়ে প্রদীপ
দেয় টানিয়া ঘোমটা।/নাকে
হাত এয়োগণ বলে আই আই/
মেদিনী বিদারে যদি
তাহাতে সাফাই’। আবার
একই কবি
‘বিদ্যাসুন্দর’-এ
অসাধারণ কাব্যের পরিচয়
দিয়ে লিখছেন,
‘প্রভাত হইল বিভাবরী
বিদ্যারে কহিল সহচরী
সুন্দর পড়েছে ধরা শুনি
বিদ্যা পড়ে ধরা।’
মঙ্গলকাব্য বা
বিদ্যাসুন্দরের পালা
গাওয়া হত। বৈষ্ণবকাব্য,
কীর্তনের মতো বাংলা
গানের পূর্বপুরুষ
এরাও। নীরদচন্দ্রের
মতে, এ শুধু কাব্য বা
গীতিকবিতার ব্যাপার নয়,
বাঙালি সমাজের অন্তরেই
এই ‘একক’ (integrity)অভাব আছে।
অন্যত্র তিনি তাই
লিখেছেন, ‘ কবিতা এবং
গানে, বিশেষ করিয়া গানে,
লপেটি ভাব না থাকিলে
উহা সমাদর পাইত না।
কীর্তন, শ্যামা বিষয় ও
অন্যান্য ধর্মমূলক
সঙ্গীত ছাড়া অন্যত্র
আদিরস না থাকিলেও চলিত
না’। এক্ষেত্রে তিনি
আবার আমদে মনে করিয়ে
দিয়েছেন, ‘বিষবৃক্ষ’তে
হরিদাসী বৈষ্ণবীর বেশে
দেবেন্দ্রর গান- ‘কাঁটা
বনে তুলতে গেলাম
কলঙ্কের ফুল/ গো সখি, কাল
কলঙ্কেরই ফুল। ... মরি
মরব কাঁটা ফুটে,/ফুলের
মধু খাব লুটে,/খুঁজে
বেড়াই কোথায় ফুটে/নবীন
মুকুল।’ কমলমণি যে গান
শুনে বলেছিল, ‘বৈষ্ণবী
দিদি, তোমার মুখে ছাই
পড়ুক, আর তুমি মর। আর কি
গান জান না?’ এ তো
বঙ্কিমচন্দ্রের নিজের
কথাও। যাঁর হাতে বাংলা
গদ্যসাহিত্য আধুনিকর
ঊষায় এসে দাঁড়বে, তিনি
যে বাংলা গানের এই
পরম্পরা নিয়ে সন্তুষ্ট
হবেন না তা বলাই
বাহুল্য। পঞ্জাবি
টপ্পার দ্রুত লয়কে ঈষৎ
শ্লথ করে রামনিধি
গুপ্তের মতো জিনিয়াস
বাংলা টপ্পা আনন,
কিন্তু তাতে কথা বা
ভাষার যে তেম উন্নতি
হয়েছিল তা তো নয়। এমনকী
সংস্কৃতির আলোয় ভরে ওঠা
যে ঠাকুরবাড়ি, সেখানেও
পচিত চৌহদ্দিতে স্বয়ং
রবীন্দ্রনাথও খেউড়
শুনেছিলেন।
সংগীতের অন্যান্য দিক
বাদ দিলেও, শুধু
ভাষাতেই বাংলা গানকে
মার্জিত, শিষ্ট এবং
সমৃদ্ধ করার কৃতিত্ব
রবীন্দ্রনাথেরই।
কীর্তন, লোকগান এবং
ভক্তিমূলক গান চরিত্র
অনুযায়ী শুদ্ধতা বজায়
রাখলেও, বাংলা গান,
প্রধানত আধুনিক গান ভাব
ও ভাষার দিক থেকে যে
দৈন্য ছিল তা স্পষ্ট।
রামমোহন রায় বা
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ
ঠাকুর তাকে টেনে তোলার
চেষ্টা নিশ্চয়ই
করেছিলেন, কিন্তু এঁরা
কেউই রবীন্দ্রনাথের
মাপের কবি ছিলেন না।
ফলত গানে আধুনিকতার চোখ
ফুটিয়ে একমাত্র
রবীন্দ্রনাথই তাঁর
গানকে তাঁর কবিতার
সমান্তরাল আসন দিয়ে
বলতে পেরেছিলেন, ‘parallel growth
to my poetry’. বাংলা গানের
আদিতে যে গীতি ও কবিতার
যুগলবন্দি এই পর্বে
তাঁর হাতেই যেন তা পেল
নয়া মাত্রা। রবি
ঠাকুরের গান বাংলা
ভাষাকে কী দিয়ে গেছে তা
ব্যাখ্যা সঙ্গীত
সমালোচকের গভীর
অনুধ্যানের কাজ, কিন্তু
এটুকু প্রায় সব
বাঙালিলই জানেন,
রবীন্দ্রনাথ নিজে যেমন
তাঁর গানকে ভাবীকালে
স্থায়ী বলে জানতেন,
তেমনই বাঙালি তার গানেই
খুঁজে নিয়েছে স্থায়ী
ধ্রুবপদ। কাজী নজরুল
ইসলাম তাঁর গানে বাংলা
ভাষার সঙ্গে অন্য
বিদেশি ভাষার যে মিতালি
পাতিয়ে দিয়েছিলেন, তা
নিঃসন্দেহে ভাষাকে
সমৃদ্ধ করেছে।
কাজীসাহেবের কবিতার
ব্যাপক উচ্ছ্বাস সংহত
হয়ে যখন গানের কথায়
আত্মপ্রকাশ করেছে, তখন
অন্য সৌন্দর্য সৃষ্টি
করেছে, তবে তাতেও
আবেগের পানপাত্র যেন
অনেকখানি উছলে পড়ে।
রবীন্দ্র-নজরুল যেন সেই
স্তব্ধ চাঁপাতরু আর
পাগলাপার নদীর গল্প।
কাজীসাহেব স্বভাব
আবেগে বলেন, ‘তোমার
কুঞ্জ পথে যেতে হায়/
চমকি উঠিবে কাঁদি
বেদনায়/ দেখিবে কে যেন
মরে মিশে আছে/ তোমার
পথের ধুলিতে/ ... তবু
আমারে দেব না ভুলিতে।’
রবীন্দ্রনাথ তাঁর গভীর
চলা গোপন রেখে শুধু
বলেন, ‘ তব কুঞ্জের পথ
দিয়ে যেতে জেতে/বাতাসে
বাতাসে ব্যাথা দিই মোর
পেতে’। অনির্বচনীয়তা,
তবে দুটোরই মাত্রা
আলাদা, আলাদা বোধ ও
অনুভূতি এবং একই সঙ্গে
দুটোই বিশুদ্ধ।
হিন্দুস্থানী সংগীতের
কথাহীনতা থেকে বাংলা
গানকে এঁরা যে
কাব্যময়তা দিয়ে গেছেন,
তা নিঃসন্দেহে বাংলা
ভাষার অর্জন। এঁরা দুজন
এবং দ্বিজেন্দ্রলাল
রায়, অতুলপ্রসাদ সেন,
রজনীকান্ত সেন-এই
পাঁচেই বাংলা আধুনিক
গানের অমরাবতীতে
অভিষেক, এবং বাংলা ভাষা
ও সাহিত্যের তাতে লাভ
বই ক্ষতি হয়নি।
আশ্চর্য এই, কাজী নজরুল
ইসলাম, দ্বিজেন্দ্রলাল
রায়ের মতো গীতিকার যখন
রবীন্দ্র সমসময়েই তাঁর
ছায়ার ধার না ধরে
নিজস্ব পথ তৈরি করেছেন,
পরবর্তী গীতিকাররা ঠিক
সেই ছায়ার প্যাঁচে পড়ে
গেছেন। ‘ওগো আমার
সর্বনাশ, ওগো আমার
সর্বশ্ব’-রবীন্দ্রনাথ
রই ‘চন্ডালিকা’র এ
কথাকে সুধীর
চক্রবর্তীর মতো
বিদগ্ধজন কেন যে
রবীন্দ্রসংগীতের
উদ্দেশেই বলতে চান, তা
পরবর্তী গীতিকারদের
লেখাতেই স্পষ্ট হয়ে
ওঠে। দুর্ভাগ্য যে,
বাংলা গানের জন্য কোনও
জীবনানন্দ দাশ ছিলেন
না। ফলত ‘আমার এ পথ
তোমার পথের থেকে গেছে
বেঁকে’, হয়ে গেছে, ‘আজ
দুজনার দুটি পথ ওগো
দুটি দিকে গেছে বেঁকে।’
রবীন্দ্রনাথের
পছন্দের ‘ও’ কারান্ত
শব্দের প্রয়োগ তাঁরাও
অজান্তেই করে গেছেন।
এমনকী ‘গাঁয়ের বধূর’
কথা শোনানো সলিল চৌধুরী
পর্যন্ত কেন যে,
‘তোমারো পথো পানে’
লিখেছেন তার কোনও
ব্যাখ্যা নেই।
রবীন্দ্রনাথ বাংলা
গানের কথাকে যে উচ্চতায়
তুলে দিয়েছিলেন, তার
প্রেক্ষিতেই পরবর্তী
সময়ের বাংলা গান আর
কিছুতেই বাংলা ভাষাকে
আলাদা করে কিছু দেওয়ার
মতো জায়গায় থাকতে
পারেনি। হ্যাঁ
ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে,
মাঝে মাঝে
বিদ্যুতচমকের মতো খেলে
গেছে, অপূর্ব সব
চিত্রকল্প, আবেগ-বেদনার
ভাষায় বোনা গাঢ়
অনুভূতির শব্দমালারা।
তবে পুন্রাবৃত্তির দোষ
এত বেশি করে বাংলা গানে
লেগেছিল যে, গীতিকারদের
স্বতন্ত্রতা খুঁজে
পাওয়া মুশকিল। হিন্দি
গানের দাপট রুখতে
এক্সময় চালু হয়েছিল
‘রম্যগীতি’, তা
সুরে-যন্ত্রানুষঙ্গে
যে মাত্রায় আধুনিক,
কথায় তা নয়। বহু অমূল্য
সৃষ্টির পরেও তাই
পরবর্তী সময়ে হিন্দি
গানের আগ্রাসন রুখে
দিতে পারেনি বাংলা
আধুনিক গান। ছয়ের দশকের
গোড়ায়, ‘লিমবোরক’ নামে
এক বিদেশী
যন্ত্রসংগীতের
জনপ্রিয়তা মাথায় রেখে
ইলা বসুকে দিয়ে একটী
গাণ রেকর্ড করানো
হয়েছিল, কবীর সুমন তাঁর
‘কোন পথে গেল গান’ বইতে
সে ঘটনা জানিয়ে লিখেছেন
সে গানের কথা ছিল এরকম-
‘যদি না ভালোবাসিতাম/এ
মালা গেঁথে আনিতাম/তবে
আর তুমি এলে না/জীবনে
ক্ষতি ছিল কী’।
সঙ্গতকারণেই তাই তাঁর
বক্তব্য, ‘ আধুনিক
কথাটির একটি বড় শর্ত হল
যুগপযোগিতা। সেই
বস্তুটি আধুনিক বাংলা
গানে কোনওদিনই ঠিক ছিল
কি? সুর, গায়কী,
যন্ত্রসঙ্গীতের
প্রয়োগ হয়ে উঠছিল
যুগপযোগী। কিন্তু
লিরিক? গানের সার্বিক
আবেদন? এ কথা যে মানুষ
গান শোনে মূলত সুর তাল
ছন্দের কারণে। কিন্তু
তাই বলে ‘কথা’কে সে কি
কোনও গুরুত্বই দেয় না?
তা যদি না দিত তবে
বাংলার পল্লীগীতিতে
‘কথা’র মধ্য দিয়ে যুগ
যুগ ধরে এত বিচিত্র
ভাবনা, অনুভব, আবেগ ও
বর্ণনা প্রকাশিত হল কী
করে? মানুষ তো তাহলে একই
ধরনের কথায় বিভিন্ন
ধরনের সুর লাগিয়ে
লাগিয়ে কাজ চালিয়ে দিতে
পারত।’ জটিলেশ্বর
মুখোপাধ্যায়, প্রতুল
মুখোপাধ্যায়ের মতো কেউ
কেউ এই দৈন্যতা ঘোচানোর
চেষ্টা করেছিলেন ঠিকই,
তবে তা সার্বিক সাফল্য
পেল সুমনের সংগীতেই।
বাংলা গান আবার
যুগপযোগিতার শর্তে
অন্যান্য সবকিছুর
সঙ্গে কথাতেও আধুনিক
হয়ে উঠল।
বাংলা ভাষার সঙ্গে
বাংলা গানের দেওয়া
নেওয়ার প্রসঙ্গে
অনেকটা রাস্তা বাংলা
গানের যাত্রাপথের
সঙ্গে হাঁটা হল। সুমন
পরবর্তী বাংলা গান
নিজের মতো করে নিজেকে
ভেঙেগড়ে নিচ্ছে, গানের
কাঠামো (বাংলা রক) ও
কথায়। তবে গানে ভুবন
ভরিয়ে দেওয়া
অঙ্গীকারের জলসাঘরে
বারেবারে যা চোখে পড়ে
তা হল অনবদ্য সব
রূপকল্পের নির্মাণ।
বাংলা ভাষায় দিয়ে গড়া
কল্পনার রাজপ্রাসাদ আর
আবেগের সাতমহলা যদি
ফিরে দেখতে হয় তবে
বাংলা গানেরই দ্বারস্থ
হতে হবে। সময়, সময়ের
রাজনীতি, ক্রোধ, ঘেন্না,
চিৎকার তার ভান্ডারে
আছে বটে তবে সংখ্যায়
মুষ্টিমেয়। বাংলা
গদ্যসাহিত্য যেভাবে
প্রাগৌতিহাসিক
অন্ধকার ছুঁইয়ে থাকতে
পারে, বাংলা কবিতা
যেভাবে শূকরীর
প্রসববেদনা শুনতে পায়,
বাংলা গান তেমনটা নয়।
বেশিরভাগ সময়েই বাংলা
ভাষার ঘরদুয়ারে সে
নিকনো তুলসীমঞ্চ হয়ে
থেকেছে। একটু বাইরে
থেকে হলেও সেও ঘরের
সঙ্গেই সম্পৃক্ত।
বাংলা ভাষার সঙ্গে
বাংলা গানের
মিথোজীবিতা তাই আরও
গভীর নীরিক্ষার দাবি
রাখে, অন্তত সুমন
পরবর্তী সময়ে আবার
পুনরাবৃত্তির কলে যাতে
সে না পড়ে, সেই
স্বার্থেই।