বাংলাদেশ স্বাধীন
হওয়ার আবশ্যিক শর্ত ছিল
ভাষার জয়। উর্দুর
বিরুদ্ধে জিতেছেন
তাঁরা। সে ইতিহাস এখনও
জ্বল জ্বল করছে। কিন্তু
উর্দুর বিরুদ্ধে জিতল
কোন বাঙলা ভাষা?
বাংলাদেশে যারা
পেট্রোল বোমা ছুঁড়ছেন
তাঁদের বাঙলা? না কি
যারা সে বোমায় পুড়ছেন,
তাঁদের? হায়! ভাষা এখানে
অক্ষম! এই অক্ষমতার
কারণ সে মনুষ্যসৃষ্ট।
সব মানুষের ভাষায় ঈশ্বর
আছেন এবং সব ভাষাতেই
ঈশ্বর দিয়েছেন উপদেশ।
এই কারণেই পৃথিবীতে
শ্রেষ্ঠ ভাষা বলে কিছু
নেই। ভাষা অনেকটা মায়ের
মত। প্রত্যেকের মা
প্রত্যেকের কাছে সেরা।
বাবাদের ভাগ্য এত
প্রসন্ন নয়।
২১শে ফেব্রুয়ারি নিয়ে
আমি মনে মনে রোমাঞ্চিত
হতে গিয়ে মাঝে মাঝে
থমকে যাই। রাঢ়,
বরেন্দ্র, বাগড়ি, বঙ্গ,
চট্টল --- প্রত্যেকের
বাঙলাই জোরালো।
ব্যাকরণ নিজেদের মতো,
উচ্চারণ ভঙ্গী আলাদা।
এর অধিকাংশই তো যে
বাংলায় লিখছি, তাতে
অনুপস্থিত। মনে হয় এক
সময় আমাদের দু-টি রাজ্য
সমেত গোটা বাংলাদেশের
বঙ্গভাষী একটা
বাঙলাতেই বলবেন,
লিখবেন। ভাবতেই মাথা
গরম হয়ে যাচ্ছে।
মানুষের বৈচিত্র্যকে
মুছে দিয়ে, সুক্ষ্ম
পার্থক্যগুলোর ওপর
রোলার চালিয়ে ছাঁচে
ঢালাই করা মানুষ
বানানোর ফন্দি এখন
জনপ্রিয়। উন্নতি আর
বাণিজ্যের স্বার্থে।
দেশ আর পরাধীন হবে না
কিন্তু ভাষার
প্রাণদন্ড হবে।
পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা
আর বাংলাদেশ --- এই তিন
ভূখন্ড পরস্পরের কাছে
অনেকটা বিচ্ছিন্ন
দ্বীপের মতো। যাবো
ভাবলেই যাওয়া যায় না।
তাই তিন ভূখন্ডের ভাষা
চর্চা আর সাহিত্য
সৃষ্টি তিন ধারায় বইছে।
সমান্তরাল বইছে।
সুতরাং মিলবে না। ভাষার
ক্ষমতা নেই আমাকে ভিসা
পাসপোর্ট ছাড়া
বাংলাদেশে ঢুকতে দেবে।
বিদ্বেষ এমন একটা জিনিস
যা শত-সহস্র আলাপেও দূর
হয় না। ভাষায় সব কিছু
বুঝতে পারার পরেও
পৃথিবীতে যুদ্ধ হয়েছে।
ভাষার তেমন জোর থাকলে
সব যুদ্ধ শুরু হওয়ার
আগেই ভাষার দাপটে থেমে
যেত। মহাভারতের
যুদ্ধও।
ইতিহাসে অনেক অদ্ভুত
ঘটনা ঘটে। পাকিস্তানে
কেন নিজেদের ভাষা
হিসেবে উর্দুকে পছন্দ
করলো, সেটাও এক রহস্য।
সেখানকার মানুষ কথা
বলতেন মূলতঃ পাঞ্জাবির
বিভিন্ন উপভাষায় আর
সিন্ধ্রিতে। উর্দু
তাঁদের ভাষাই ছিলো না।
অবশ্য উর্দু একটি অতি
শক্তিমান ও শ্রুতিমধুর
ভাষা। এই ভাষায়
উচ্চাঙ্গের সাহিত্য
রচিত হয়েছে। বাঙালিদের
মধ্যে উর্দু চর্চা হতো।
একটি ভাষা হিসেবে
আরেকটি ভাষার মধ্যে
কোনও বিরোধ তাঁর ছিল
না। কেবল ইতিহাসের
অদ্ভুত নিয়মে তাঁর
প্রতি আক্রোশে গর্জে
উঠেছিল বাংলাদেশের
মানুষ। আসলে সব কিছুরই
একটা ভালো দিক থাকে।
দেশ ভাগ না হলে বাঙলা
ভাষার জন্য একটা
স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে
উঠত না। বাঙলা ভাষার
জন্য হয় তো এই ছিল
ইতিহাসের উপহার।
ধর্মকে যত জন ভালোবাসে,
ভাষাকে তাঁর এক শতাংশও
কি বাসে? আমার খুব
সন্দেহ হয়। হিন্দুরা
রামকে নিয়ে যত আপ্লুত,
সংস্কৃত ভাষাকে নিয়ে
তাঁর কণামাত্রও নয়।
উলটে এমন দেখানো হয় যে
রামায়ণ লেখা হয়েছে
হিন্দিতে এবং লিখেছেন
তুলসীদাস। কলকাতা
নগরের পথে ঘাটে বাঙলা
ভাষা তেমন চোখে পড়বে
না। সরস বাঙলায়
বিজ্ঞানের বই লেখা
হচ্ছে, এমন ঘটনা ভারত
থেকে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
অজস্র বাঙালি পাওয়া
যাচ্ছে যারা বাঙলা ভাষা
বুঝতেই পারছেন না (আসলে
তাঁরা কোনও ভাষাই বুঝতে
পারছেন না)। এই অবস্থায়
বাংলাদেশের ভরসা ছাড়া
আমি দ্বিতীয় কোনও
বিকল্প পাচ্ছি না।
তবুও বলতে লজ্জা হচ্ছে
যে, যে বাঙলা টিকে
যাচ্ছে, তা বাঙলা গদ্য
রচনার জন্য বেছে নেওয়া
একটা বিশেষ ভূখন্ডের
বাঙলা। সাহিত্যে,
বেতারে, চলচ্চিত্রে,
সংবাদপত্রে এই বাংলাই
চলে। এটাই
স্ট্যান্ডার্ড। কেন
স্ট্যান্ডার্ড, তা
অবশ্য জানা যায় না। এই
স্ট্যান্ডার্ড বাংলার
বাইরে বাকি বাঙলা থাকছে
না মিলিয়ে যাচ্ছে, তা
নিয়ে কিছু হাহাকার
মিশ্রিত আলোচনা ছাড়া আর
কিছু হচ্ছে না। যারা
ভাষার জন্য প্রাণ
দিয়েছিলেন, তাঁরা কি
এটা সমর্থন করতেন?
একমাত্র উপায় আঞ্চলিক
গানগুলিকে বাঁচিয়ে
রাখা। অবিভক্ত
বঙ্গভূমির লোকগানে
এখনও বাঙলা ভাষার
বিচিত্র রূপ বেঁচে আছে।
এই বিষয়টা কি একুশের
অন্যতম শপথ হতে পারে
না?