আর, ভাষা ফিনিক্স পাখির
মতো জেগে ওঠে। ভাষা
হেরে যায় না। ভাষাই হয়ে
ওঠে আন্দোলন। আন্দোলন
হয়ে ওঠে ভাষা।
পরিপূর্ণতার আখ্যানে
সেতু বেঁধে ভাষা আমাদের
পারাপার করায় শৈশব থেকে
মৃত্যু, দেয়ালা থেকে
বোধ; ভাষা আমার মায়ের
মতো অসুখের দিনরাতে
মাথায় হাত বুলিয়ে
ভাললাগা খুঁজে দেয়।
শিশুটি দেখেছিল মিছিল।
বহু মানুষ তার ভাষায়
হেঁটে চলেছে। তখন খেলার
দিন নয় তখন পড়ার সময় নয়
তখন খুব আলোর রাত নয়...
তখন অবরোধী হাওয়া
রক্তের ঘ্রাণে ভারী।
তখন অস্তিত্ব মুছে দিতে
সক্রিয় আইন। শিশুটি
শুনেছে, তার বাবার ভয়ের
স্বর শূন্যতার কিনারে
দাঁড়িয়ে ক্রোধে বদলে
যাচ্ছে। সে যখন বছর
পাঁচেকের, তখন খুব আবছা
মনে পড়ে কর্কশ স্বর,
‘উর্দুই হবে
পাকিস্তানের
রাষ্ট্রভাষা’! তার মনে
পড়ে অবিরাম মিছিলের
পদধ্বনি, মিছিল
রক্তাক্ত হয়, মিছিল বড়
হয়। অথচ, তার মনে পড়ছে
বাবার আনন্দ; তার ছোট
হাতে মিষ্টি। ‘আমরা
স্বাধীন’ এই খুশির
স্লোগানে আলিঙ্গন
করছিল সবাই। আরও ছোট
তখন সে। পরাধীনতার বোধ
সে বুঝে ওঠেনি তখনো।
শুধু তার বোধে গাঢ় ছায়া
ফেলেছিল দাশগুপ্তদের
ধূধূ উঠোন; রাজীবের লাল
শরীর, রোকেয়ার মা’র
প্রতিদিন বিকেলে
কান্না; কাঁটাতার কাঁটা
তার... বাবা তাকে বলেছিল,
এবার আরো আলো আরো ভাত।
কিন্তু, কই? সেই যে
একইরকম রইল সব। তাদের
পাকা বাড়ি হল না, ভাতের
ক্ষিধেটা রয়েই গেল। তার
বাবা স্বাধীনতা
সংগ্রামের গল্প করত! কী
রঙিন; সাদা-কালো বাধ্য
অভিযোজনে গা শিরিশির
করত সেই থানা ঘেরাওয়ের
গল্পে, ঢাকা মেডিক্যাল
কলেজে লোম্যান-সাহেবকে
খুনের গল্পে, চাটগাঁর
অস্ত্রলুঠের রোমাঞ্চে!
সে শুনত আর স্বপ্নগুলো
তার কপালে টী দিয়ে যেত।
একা একাই কতবার
বন্ধুদের সাথে
স্বদেশি-ব্রিটিশ
খেলেছে সে। কিন্তু,
বাবা কেন তার সেই
ছ’বছরের জন্মদিনে ওর’ম
উত্তেজিত হয়ে ফিরল? বলল,
‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়/
লাখো ইন্সান ভুখা
হ্যায়’! শিশুটি অব্যক্ত
যন্ত্রণায় শিউরে
উঠেছিল যেদিন ওর কিছু
বন্ধু ‘তুই উর্দু জানিস
না?’ বলে তাকে খেলায়
নেয়নি। তার ভাষা তবে কী?
সে যে শব্দে মা’কে ডাকে,
সে যে উচ্চারণে খেতে
চায় সেইস-ব আর বলা যাবে
না? কী করবে তবে সে?
আচ্ছা, সে কী উর্দুতে
ভাববে এবার থেকে?
ভবিষ্যৎ অন্ধকার, আরো
মিছিল, ঘরছাড়া অনিশ্চয়
সম্বন্ধে কোনোই ধারণা
তার নেই, শুধু আছে
ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়া বোধ,
নিয়ত কার্ফিউ-এর নিকষ।
ভাল নেই সে। তার মনে আছে,
বছরটা শুরু হল আরো
আন্ধকারের বার্তায়।
তখন সে জানতে শিখেছে
কিছু শব্দ, জিন্নাহ্,
নাজিমুদ্দিন,
পাকিস্তান,
ভাষা-আন্দোলন সংগ্রাম
কমিটি এইসব। ১৯৫২-র
২৭শে জানুয়ারি খাজা
নাজিমুদ্দিন ফের বাংলা
ভাষাকে প্রত্যাখ্যান
করল; কাগজে দেখেছে
ন’বছরের শিশুটি।
দেখেছে ৪ঠা ফেব্রুয়ারি
কী বিশাল এক মিছিল,
বাবার হাত ধরে সেও
গেছিল। আর বলেছে যে ২১
তারিখ আবার মিছিল হবে,
সেদিন নাকি সব বন্ধ!
কিন্তু, একটা জিনিস বেশ
মজার লাগছে তার। বছর
চারেক আগে তাদের পাড়ার
মতিন দাদা ঢাকায় পড়তে
গিয়ে ভাষা-মিছিলে মারা
গেছিল। তখন তাদের
মহল্লায় কয়েকদিন বিষাদ
ছিল; কিন্তু, বাংলা না
উর্দু এই নিয়ে তাদের
মহল্লায় তেমন শোরগল ছিল
না। তার বাবা বন্ধুদের
নিয়ে বরং বেশি আলোচনা
করত কী’সব ‘কর্ডন
প্রথা’, ‘লবণ-নিয়ন্ত্রণ
আইন’ নিয়ে। কিন্তু, এখন
যেন সবাই ভাষার কথা
বলছে, এখন অন্য
স্লোগানগুলোও কেমন
মিশে যাচ্ছে ‘বাংলা
চাই’ কলধ্বনির সাথে!
কেন এরকম হল সে জানেনা,
তার শুধু ভাল লাগছে
খুব। বাবার মুখে শোনা
সেই টগ্বগে দিনগুলো কি
ফিরছে? আহা! এতখানি
অনুভব শেষে শিশুটি
মা-বাবার সাথে যায় ২১ শে
ফেব্রুয়ারির মিছিলে,
মা’র হাত ছেড়ে গেছিল
ভিড়ের মধ্যে। ঢাকা
মেডিক্যাল কলেজের গেটে
অনেকক্ষণ বক্তৃতার
পরেও সরকারের তরফে
বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি
দেওয়ার কথা ঘোষণা না
করায়, মিছিল এগোয়
আইন-পরিষদের দিকে,
ভেঙ্গে যায় ১৪৪। শিশুটি
শুনছিল ‘রাষ্ট্রভাষা
বাংলা চাই’ আর সেই
সমস্বরকে চিরে হঠাৎ কান
ফাটানো আওয়াজ, ধোঁইয়া।
শিশুটি পড়ে যাচ্ছিল।
তার বুকে তীব্র
যন্ত্রণা, রক্ত নামছে
গড়িয়ে। এক অনন্য বোধে
পৌঁছে যাচ্ছিল ন’বছরের
অহিউল্লাহ্। বোধহয়
সেই মুহূর্তে সে দেখতে
পাচ্ছিল তার হাতে ধরা
এক রঙিন পতাকা, তার
রক্তে পতাকার মাঝখানে
লাল রংটা গোল হয়ে ছড়িয়ে
পড়ছিল। মৃত্যু আসছিল,
আরো অনেক জীবন জাগছিল।
[b]“মেকী আজাদীর রঙিন ছটা
আর উজ্জ্বল নতুন দিনের
সোনালী স্বপ্ন কোথায়
মিলিয়ে গিয়েছে জাতির
জীবনে, সমগ্র দেশের
বুকে নেমে এসেছে
নিরন্ধ্র অন্ধকারের
কালো বিভীষিকা।
সামন্তবাদ ও
সাম্রাজ্যবাদের দোসর
প্রতিক্রিয়ার দানবীয়
নিষ্পেষণে দেশের
অর্থনৈতিক জীবন পঙ্গু,
শিক্ষার অধিকার, ভাষা ও
স্বাধীনতার অধিকার
বিপর্যস্ত, গনতন্ত্র
নির্বাসিত।...
প্রথমদিকে ছাত্র এবং
শহরের মধ্যবিত্ত
বুদ্ধিজীবীদের
উদ্যোগে ভাষা ও
সংস্কৃতির এই
আন্দোলনের সূত্রপাত
হলেও একুশে ফেব্রুয়ারি
তাকে ছড়িয়ে দিল দেশের
আনাচে কানাচে, গ্রাম
গ্রামান্তরের দূরতম
প্রান্তে। শহীদের রক্ত
ডাক দিল দেশজোড়া
কিষাণের শক্তিকে, দেশের
প্রতিটি দেশপ্রেমিক
মানুষকে।” [একুশে
ফেব্রুয়ারিঃ হাসান
হাফিজুর রহমান
সম্পাদিত, মার্চ
১৯৫৩।]
[/b]
বৌ আর দুই ছেলেকে অক্ষত
শরীরে আনতে পেরেছিল
শুধু । ব্যস । যশোর রোড
ধরে হাঁটতে হাঁটতে কোন
ফাঁকে পৌঁছেছিল এক
অজানা দেশে । সেই দেশকে
সে নিজের বলে শুনেছিল
শুধু , চেনেনি তখনও । আর
যে দেশটাকে সে নিজের
বলে চিনত , সেটাও সদ্য
বিদেশ হয়ে গেছে তার মত
আরও অনেকেরই কাছে ।
খোলা মাঠে গাছের
পাতাগুলো দুলতে দুলতে
যেটুকু ছায়াকে চুরি করে
আনে আপাতত সেখানেই তার
পরিবার । দুই পায়ে
ব্যথা করে ভীষণ । এত দূর
হাঁটা , ক্লান্তিতে
নুয়ে পড়ে যেন । পা ছড়িয়ে
বসে ভাবে , আজ থেকে দুই
দেশ হল । দুই দিকে ভাষা
দু’রকম নয় কেন , শুধু
দু’দিকের কশায়েরা
একইভাবে কাটতে শিখেছে
।
জমির গন্ধ ভুলে যাওয়া
মন
ওপাড়ে হিসেব মাটি -
বন্ধন
গোধূলি বিকেলে
কাঁটাতার ছুঁয়ে
সীমারেখা শুধু হাসছে
তিস্তার স্রোতে ভাঙল
পাথর
সমতলে দিল শান্তি খবর
এদিকে জমিতে আমার কবর
পায়ের শব্দ মাপছে
[b]“গ্রাম থেকে
গাড়ীওয়ালা, মাঝিমাল্লা
আর কৃষক-মজুর,
ছাত্র-শিক্ষকরা এসে
শহরে বিক্ষোভ প্রদর্শন
করেছে। শহরের সকল
প্রান্ত থেকে জনসাধারণ
নিজেরাই মিছিল সংগঠিত
করে বিক্ষোভ প্রদর্শন
করেছে।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের
রেলওয়ে কারখানায়
ধর্মঘট ঘোষিত হয়েছে।
কারখানার শ্রমিকরাই
রেলের চাকা বন্ধ করতে
এগিয়ে এসেছে।... রাত্রে
আজিমপুর কলোনীর মেয়েরা
এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন
করেন। সেই সভায়
যোগদানের জন্য সেই
আমলের সুদূর কমলাপুর
থেকেও মেয়েরা আসেন।”
[একুশের ইতিহাসঃ কবির
উদ্দিন আহমদ]
[/b]
এক বিপন্নতা প্রবহমান।
১৯৫২ হয়তো তার বিস্ফার
মাত্র। বারুদ জমেছিল
বহু আগে থেকেই।
ঔপনিবেশিক শাসন থেকে
মুক্তির পাশাপাশি
পূর্ব পাকিস্তানের
বৃহত্তর মানুষের
আকাঙ্ক্ষা ছিল
অর্থনৈতিক নিপীড়ন থেকে
মুক্তি। আর, তৎকালীন
নিপীড়কদের অধিকাংশই
বোধহয় ছিলেন হিন্দু
জমিদার শ্রেণি। বাঙালি
মধ্যবিত্ত মুসলমান
সম্প্রদায় ন্যায্য
কারণেই হয়তো বন্দিদশা
থেকে মুক্তি চাইছিলেন
এবং তাঁদের এ আশাও ছিল
যে, নতুন সরকারের আমলে
জমিদারের শোষণ ও
ব্রিটিশ অত্যাচার
না-থাকার ফলে তাদের
শিল্প-কৃষি দ্রুত
বিকশিত হবে, বেকার
সমস্যার অবিলম্বে
সমাধান হবে। যদিও,
তৃতীয় বিশ্বের দেশে
উত্তর-ঔপনিবেশিক
পর্যায়ে এই আশাই করে
থাকেন মানুষ। আর, এই
আশাকে সমূলে বিনাশ করে
গড়ে ওঠে আমলাতান্ত্রিক
পুঁজিপতি শ্রেণি, ফড়ে
শ্রেণি। পূর্ব
পাকিস্তানের মূল
শাসনকেন্দ্র পশ্চিম
পাকিস্তানে হওয়ার ফলে
পুঁজির প্রায় সবটুকু
লাভের গুড় চলে যেতে
থাকল ভারত পেরিয়ে,
পশ্চিমে। কৃষকদের
পবস্থার উন্নতি হল না
কারণ জমিদারি প্রথা
প্রায় উঠে গেলেও,
উদ্বৃত্ত জমি আর আইন
চলে গেল উঠতি শোষকদের
হাতে। শ্রমিকদের মজুরি
বৃদ্ধি ঘটল না; অধিকাংশ
পাটচাষ পূর্ব
পাকিস্তানে হলেও
পাটকলগুলি মূলতঃ ছিল
পশ্চিমবঙ্গে, ফলে পাট
সমৃদ্ধি হারাল। আর, এর
ওপরে তৎকালীন
পাকিস্তান সরকার দুই
প্রদেশের সাংস্কৃতিক
ভিন্নতা, আত্মমর্যাদার
প্রশ্নকে গুরুত্ব না
দিয়েই ‘এক রাষ্ট্র, এক
ভাষা’ চাপিয়ে দিতে
চাইল। ফলে, সংঘাতের
ক্ষেত্র আরো বিস্তৃত
এবং গভীর হল। দীর্ঘদিন
ভারত ঔপনিবেশিক তাপ ও
চাপ সহ্য করে
সাংস্কৃতিক
আত্মবিশ্বাস প্রায়
হারিয়েই ফেলেছিল।
ভারত-ভাগের পরও তাই
বিভক্ত
প্রদেশ-দেশগুলিতে
সাংস্কৃতিক
আত্মমর্যাদার
সমস্যাটি থেকেই গেল।
আর, সেই কারণেই বোধহয়
ক্ষমতা হস্তান্তরের
প্রথম মাসেই ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু
ছাত্র এবং শিক্ষকের
উদ্যোগে তৈরি হয়
‘তমুদ্দুন মজলিস’,
১৯৪৭’র ২রা সেপ্টেম্বর;
যার মূল দাবিই ছিল
রাষ্ট্রভাষা হোক
বাংলা। আর, এরপর থেকেই
জোরালভাবে এই দাবি
ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কারণ,
যত দিন যাচ্ছিল, ততই
উত্তর-ঔপনিবেশিক
সরকারের শাসন
অক্টোপাসের বাঁধন হয়ে
উঠছিল। উর্দুভাষী না
হলে চাকরি পাওয়া যাবে
না, সমস্ত অন্য
মাতৃভাষাকে ভাষাকে
বর্জন করে উর্দুকেই
একমাত্র মেনে নিতে হবে-
ঘৃতাহুতিসম এহেন
নির্দেশিকা
পুর্ববঙ্গের ক্ষোভ
বাড়িয়ে দেয় আরও। ১৯৪৮
সালের ফেব্রুয়ারি মাস
থেকেই শিক্ষামহলে
তীব্রি প্রতিক্রিয়া
শুরু হয়। স্কুল-কলেজ
ধর্মঘট শুরু হয় বাংলা
ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার
মর্যাদা দিতে। তৈরি হয়
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম
পরিষদ। মার্চ মাস থেকে
তীব্রতর হয় আন্দোলন;
তৎকালীন জিন্নাহ্
সরকারের বিরুদ্ধে চলতে
থাকে একের পর এক
ছাত্র-বুদ্ধিজীবীদের
মিছিল। খাজা
নাজিমুদ্দিন
ভাষা-সংগ্রাম কমিটির
সাথে মিটিঙয়ে কোনওরকমে
পিঠ বাঁচিয়ে বাংলা
ভাষার স্বিকৃতির
প্রতিশ্রুতি দেন।
কিন্তু, জিন্নাহ্ ২১শে
মার্চ পূর্ব
পাকিস্তানে এসে
ভাষা-আন্দোলনকারীদের
দেশ ও জাতির শত্রু বলে
অভিহিত করার পাশাপাশি,
উর্দুকেই একমাত্র
রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করে
দেন। জিন্নাহ্র
উত্তরসুরী
নাজিমুদ্দিন আগের
সিদ্ধান্ত বাতিল করে
উর্দুকেই বহাল রাখেন।
খর্ব হতে থাকে
মাতৃভাষার অধিকার।
আন্দোলন চলতেই থাকে,
আরও ছাত্র-শিক্ষক সামিল
হতে থাকেন। কিন্তু,
বদরুদ্দিন উমর বা আতিউর
রহমান প্রমুখের লেখা
থেকে এটা উঠে আসে যে,
১৯৪৮ থেকেই মাতৃভাষার
মর্যাদা রক্ষার লড়াই
চললেও, তা মূলতঃ
সীমাবদ্ধ ছিল
শহরকেন্দ্রিক
অবস্থানে।
ছাত্র-বুদ্ধিজীবিদের
মধ্যে। ১৯৪৮-১৯৫২ এই
চার বছরে বহুবার
ছাত্ররা মিছিল করেছে,
মার খেয়েছে, গ্রেপ্তার
হয়েছে, খুন হয়েছে-
কিন্তু সেভাবে কি
জেগেছিল মধ্যবিত্ত বা
নিম্ন-মধ্যবিত্ত
শ্রেণি? অথচ,
জাতীয়তাবাদী
ভাষা-কেন্দ্রিক
অভ্যুত্থানের ভিত তৈরি
হচ্ছিল তখন থেকেই।
ক্ষমতা হস্তান্তরের পর
থেকেই অর্থনৈতিক
নিরাপত্তাহীনতা এবং
অস্বাভাবিক
মূল্যবৃদ্ধি চলতে
থাকে। দুর্ভিক্ষের
করাল ছায়া গ্রাস করে
গ্রামীণ অর্থনীতি। আর,
অবস্থা সামাল দিতে
উপমহাদেশের চিরকালীন
শাসক-নীতি অনুযায়ী
১৯৫০-র সাম্প্রদায়িক
দাঙ্গা। প্রগতিশীল
বুদ্ধিজীবি ও বামপন্থী
ছাত্ররা দাঙ্গা
মোকাবিলায় সক্রিয়
ভূমিকা নিলেও,
অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার
সুযোগ নিতে দাঙ্গায় মদত
দেয় সরকার। এর পরপরই
রাজশাহী সহ অন্যান্য
বেশ কিছু গ্রামীণ
এলাকায় মোহাজেরদের
পুনর্বাসনের নামে আদি
বাসিন্দাদের উচ্ছেদ
করতে গিয়ে স্থায়ী
কৃষকদের বিক্ষোভের
মুখে পড়ে সরকার।
একদিকে, আর্থ-সামাজিক
অবক্ষয় অন্যদিকে
প্রতিনিয়ত
ব্যক্তি-স্বাধীনতা
ক্ষুণ্ণ করার সম্মিলিত
ক্রাইসিস
ভাষাকেন্দ্রিক
অভ্যুত্থানের পরিসর
বাড়ায়।
শিল্পক্ষেত্রেও
ব্যাপক সংকট সুতাকল
শ্রমিক থেকে বন্দর
শ্রমিক সকলকেই সরকারের
প্রতি আস্থাহীন করে
তুলেছিল। ১৯৫২ সালের
গণ-অভ্যত্থানে
মাতৃভাষা বাংলাকে
প্রতিষ্ঠা করার দাবি
একসূত্রে বেঁধে
ফেলেছিল
আর্থনীতি-সমাজ-সংস্কৃত
কে। আর, ভাষা মানে শুধু
কিছু অক্ষর বা ধ্বনির
সমষ্টি নয়, কিছু
বর্ণমাত্র নয়। ভাষা
মানে শব্দসমষ্টি,
সিনট্যাক্স,
পাংচ্যুয়েশন নয়। বরং,
ভাষা একটা আস্ত
জাতি/সম্প্রদায়ের
ভাবনা, সংস্কৃতি। আর,
প্রতিটি ভাষাই যেন
সংকেত যা সেইসব
ভাষাভাষী মানুষের
সাহিত্য, বিজ্ঞান,
প্রযুক্তি, দর্শন
সবকিছুকে বয়ে নিয়ে চলে।
ভাষা এক সঘন
ক্রাইসিস-মুহূর্তে
চীৎকার করে ওঠার জোর
দেয়, ‘আর পারছি না’ বলে
বিদ্রোহে ফেটে পড়ার
সমষ্টি তৈরি করে নেয়।
ভাষা আগুন হয়ে উঠে
দাবানলের মতো ছারখার
করে দেয় সমস্ত
ব্যক্তিগত ব্যর্থতা;
আর, সে আগুনে পুড়ে
ইস্পাত হয়ে ওঠে মানুষ...
[b]“১৯৪৮ সালের মার্চ
মাসে ভাষা আন্দোলনের
সময় সরকারের সঙ্গে
ছাত্র, শিক্ষক ও
বুদ্ধিজীবিদের
একাংশের যে সংঘর্ষ হয়
তাতে জনগণের বিশেষ কোন
ভূমিকা ছিল না। কিন্তু,
১৯৫২ সালের
ফেব্রুয়ারিতে যে
আন্দোলন হয় সে সম্পর্কে
একথা বলা চলে না... ১৯৫২
সালের আন্দোলন নিছক
রাষ্ট্রভাষার জন্য
আন্দোলন ছিল না।... ১৯৫২
সালের পূর্ববর্তী
রাজনৈতিক
হত্যাকাণ্ডগুলি কোন
দাবানল সৃষ্টি করতে না
পারলেও ১৯৫২ সালের ২১শে
ফেব্রুয়ারি
ছাত্র-জনতার ওপর
পুলিশের গুলীবর্ষণ ও
হত্যার ঘটনা দাবানল
সৃষ্টিকারি
স্ফূলিঙ্গের কাজ
করেছিলো কারণ দেশের
সামগ্রিক পরিস্থিতি এই
সময়ের মধ্যে ব্যাপক ও
গভীরভাবে পরিবর্তিত
হয়েছিলো।”[পূর্ব
বাংলার ভাষা আন্দোলন ও
তৎকালীন রাজনীতি(তৃতীয়
খণ্ড): বদরুদ্দীন উমর]
[/b]
এর বহুদিন পর উদ্বাস্তু
শিবির থেকে বেড়িয়ে
কিছুটা চিনে যাওয়া
পরিবেশে অভিযোজিত হয়ে
ওঠে তারা । বলা যায়
বাঁচতে শিখেছে । অথবা
বাঁচতে হয়েছে এভাবেও
দেখা যেতে পারে , কিন্তু
ততদিনে ওপারের ভাষার
লড়াই জেনে গেছে তারা ।
জাতিকে বুক ছিঁড়ে কেটে
দিলেও , কশাইরা মুখের
ভাষাটুকু কাড়তে পারেনি
সাথে সাথে । এবার
সেদিকেও নজর দিয়েছে ।
চড়ে - ভেসে যাওয়া
মানুষের দল
বাঁধের তলায় খুঁটি
সম্বল
মুক্ত হাওয়ায় লাশগুলো
শুধু বাঁচবার কথা
ভাবছে
মর্গে ঘুমানো বেহিসাবী
দেহ
ধারালো দাঁত আর ইঁদুরের
স্নেহ
বুকের আগুনে ঘোচে
সন্দেহ - বিদ্রোহভাষা
ডাকছে
আজ তাদের দিন। এ যে
তাদেরও বিপন্নতা। বেশ
কিছুদিন থেকেই আঁচ
আসছিল। কারা যেন মায়ের
ভাষাকে গলা টিপে মারবে
বলছে। আরো অন্ধকার
অধিকারহীন অস্তিত্ব।
ক্ষমতা হস্তান্তরের
আগের দিনগুলোও এরকমই
ছিল; না, তাদের কিছুই বদল
হয়নি। বদলায়নি কিছুই।
শুধু জুঁইয়ের প্রিয়
বন্ধু এখন কাঁটাতারের
ওপারে, বাধ্যতঃ। তার
পরিচয় কি হয়েছে, কতটা
বদলেছে সর্বনাম, জানা
নেই। সেই কোন এক
দাঙ্গার সময়ে এই
ঝালাই-পটিতে চলে এসেছিল
জুঁই। বাঁচার তাগিদে।
অতীত থেকে কিছুই আনা
হয়নি সের’ম। অতীতের
নাম, স্কুলে যেটুকু বয়স
পড়তে পেরেছিল, সেইসব
কিছু পড়ে আছে অন্য
কোনোখানে। কিন্তু, তাকে
ছেড়ে যায়নি মাতৃভাষা।
ঝালাই-পটির অন্যদের
সাথে মন-ভালো করা গল্প,
বিকেলের উদাস-মন
বেতারের গান,
যন্ত্রণাবিদ্ধ চীৎকার
সবই যে এই বাংলা ভাষায়।
এই মহল্লাকে এড়িয়ে চলে
‘ভদ্রবাবু’রা; এই
মহল্লায় চুপিচুপি আসে
ভদ্রবাবুরা। রাজনীতির
গরম হাওয়া এখানে অত আসে
না। ক্ষমতার হাতবদলের
পরেও পূর্ব পাকিস্তানে
যে নিয়ত দুর্ভিক্ষ, তার
ছায়া পড়ে এখানে।
কিন্তু, তাদের নিয়ে কেউ
ভাবেনা আন্দোলন; তারা
তো ব্রাত্য থেকে যায়।
জুঁই বুঝেছে যে, এই
মহল্লা শুধু ব্যবহৃত
হতে শিখেছে, তেমনটাই
শেখানো হয়। অভাব
তাদেরও, সংকট তাদেরও...
জুঁই খবর পেত মাঝেমধ্যে
মিছিলের, রক্তপাতেও হার
না-মানা
ক্রমবিদ্রোহের।
কিন্তু, কোনও মিছিলেই
যাওয়া হয়নি। তবু,
হাওয়ায় খবর ভাসে, ভেসে
এল ছাত্রদের ধর্মঘটের
খবর। সরকারি বেনিয়ম,
তাদের মহল্লায় যখন-তখন
এসে অত্যাচার যেন এতই
মূল্যহীন তারা, তাদের
অস্তিত্ব আরো দুর্বিষহ
করে তোলা এসবের
বিরুদ্ধে মাথা তুলতেই
চেয়েছে তারা, পারেনি
এতকাল। ওই
ছাত্র-ছাত্রীরা তো
পারছে। পুলিশের লাঠি আর
গুলির সামনেও মেরুদণ্ড
টানটান। আর, ওরাই তো এসে
মিটিং করেছে লুকিয়ে এই
আপাত ‘নিষিদ্ধ’
মহল্লায়। ডেকেছে
জুঁইদের। সাথে নিয়েছে।
মুক্তির ইস্তাহারের
শরিক কি জুঁইরাও নয়?
ওদের কাছ থেকেই আরো
স্পষ্টতঃ জানা, ভাষা
বিপন্ন। আর, ভাষা
হারিয়ে গেলে, কী বা পড়ে
থাকে? আজ তাই তাদেরও
দিন। হ্যাঁ, এই
প্রতিবাদে তারাও আছে।
এই হরতাল তাদেরও।
বিপন্নতা গড়িয়ে চলেছে
শহর থেকে শহরে... আর, এর
কিছু পরেই, ১৯৪৮-র ১৩ই
মার্চ বেলার দিকে
জুঁইরা দেখবে যশোরের
কালেক্টরেট ভবনের
সামনে ছাত্র-ছাত্রীদের
জমায়েত। উতল হাওয়ায়
অবিরাম স্লোগান, বাংলা
ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা
করতে হবে! জুঁই শুনবে
গুলির আওয়াজ আর পুলিশের
লাঠি আছড়ে পড়ছে মিছিলে।
জুঁউই দেখবে রক্তাক্ত
ছাত্ররা ছড়িয়ে পড়ছে;
পেছনে পেছনে পুলিশ
ধাওয়া করে আসছে। একটু
পরেই বাড়িতে বাড়িতে
শুরু হবে অত্যাচার
তল্লাশি। বাঁচাতেই হবে
আগুনমুখর
তরুণ-তরুণীদের।
বাঁচাতেই হবে বাংলাকে।
বাঁচাতেই হবে নিজেদের...
ঝালাই-পটির ‘পতিতা’
মেয়ে তারা, আজ ভাষার
জন্য, জীবনের জন্য
ব্যর্থ করে দেবে
রাষ্ট্রের সব আয়োজন...
“গুলীবর্ষণে জনতা
হতভম্ব হয়ে যায় এবং
মিছিলকারীরা
বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে... এ
সময়ে শহরের ঝালাই-পটিতে
অবস্থিত পতিতালয়ের
মেয়েরা ছাত্রদের
সাহায্যে এগিয়ে আসে। ৪০
জন ছাত্রকে তাদের ঘরে
লুকিয়ে রেখে বাইরে থেকে
তালা মেরে রাখে।
পতিতাদের এই ধরণের
সাহায্যের ফলে ছাত্ররা
তাদের গ্রেফতার এড়াতে
সক্ষম হয়।” [বিচিত্রা,
একুশে ফেব্রুয়ারী
সংখ্যা ’৮৬: সামসুর
রহমান]
দশক কেটে যায় । কেটে যায়
শতক । কেটে যায় প্রজন্ম
। ওধারে উর্দু আর এধারে
হিন্দু – হিন্দি –
হিন্দুস্তান । ছেড়ে
যাওয়া বিদেশী শাসকের
ভাষার দক্ষতাই
সংস্কৃতির উৎকর্ষের
মাপকাঠি । উপরে আরও
উপরে ওঠার সিঁড়ি সামনে
ঝোলানো , সেই বিদেশী
ভাষার সিঁড়ি বেয়ে উঠে
যেতে হবে ।
এপারে এটা শুধু
বাংলার কথা নয় । প্রথম
যে ভাষায় যে নিজের মাকে
মা বলে ডাকতে শিখেছে
সবার জন্য সত্যি । সেই
জন্ম ডাক মুছে দিতে
ছুটে আসে বাজার , সামনে
সাজানো বিশাল লম্বা
আকাশ ছোঁয়া একটা মই ।
বিজ্ঞাপনের পর
বিজ্ঞাপন , ওই মই বেয়ে
সকলেই ওঠে , বাকিদের
ল্যাং মারার প্রশিক্ষণ
দেওয়া হয় । সকলেই ভেবে
নেয় স্বর্গকে ছোঁবে ।
সরীসৃপের মতো বেয়ে বেয়ে
ওঠে , উপরে দেখে না কখনও
। ওখানে মেঘ করে আছে
পর্দার মতো । ঝুলে আছে
লাশ – ঝুলে আছে জন্ম ডাক
সমস্ত মাতৃভাষার ।
ঋণ-
১- বাংলা ভাষা
২- ভাষা আন্দোলনঃ
পরিপ্রেক্ষিত ও বিচার,
সম্পাদনা- আতিউর রহমান
ও লেনিন আজাদ, দি
ইউনিভার্সিটি প্রেস
লিমিটেড
৩- ভাষা আন্দোলনঃ
অংশগ্রহণকারীদের
শ্রেণীঅবস্থান,
সম্পাদনা- আতিউর রহমান
ও সৈয়দ হাশেমী, দি
ইউনিভার্সিটি প্রেস
লিমিটেড