কমলকুমার মজুমদারের
'কয়েদখানা' গল্পটি নিয়ে
কিছুকাল আগে কাজ
করছিলাম। অভিনেতাদের
বারবার করে পড়াতে
হচ্ছিল গল্পটি।
অভিনেতারা সকলেই
কমবেশী শিক্ষিত, স্নাতক
এবং কেউ কেউ
স্নাতকোত্তর। সেখানে
এক জমিদারের চরিত্র
আছে, যে সদ্য
ভূসম্পত্তি কিনেছে, কোন
এক কালে যার ঠাকুর্দার
জমিদারী ছিল, প্রতাপ
ছিল অত্যাচারীর এবং সেই
ফেলে যাওয়া জুতোয় পা
গলাতে নব্য
জমিদারবাবুটি উন্মুখ।
সে জমি কিনেছে, কিন্তু
তাতেই জমিদার হয়নি। হয়ে
ওঠার পাঠ নিচ্ছে তার
লেঠেলের থেকে, যে
ঠাকুর্দার আমলের লোক,
নানা হিংস্র
অত্যাচারের সাক্ষী।
যা হোক, কাহিনীর মধ্যে
বেশী যাওয়ার প্রয়োজন
এখানে নেই। কমলবাবুর
জমিদার জমিদারী দেখতে
বেরিয়েছেন। কত জমি
কোথায় কোথায় বুঝে
নিচ্ছেন নায়েবের থেকে।
মূলবাসী, অন্তজ হিন্দু
এবং মুসলমান অধ্যুষিত
অঞ্চলের তিনি জমিদার
হয়েছেন। তো নায়েব জমি
দেখাতে দেখাতে একজনকে
আচমকাই ধরে বসে,
জমিদারকে প্রণাম করতে
বলে। সে ঘোতাই মান্ডি।
বাবুর সমূহ জমিদারীর
মধ্যে একমাত্র একটি
অঞ্চল আছে, যা তাঁর
ঠাকুর্দার আমল থেকে
কখনোই তাঁদের কর দেয়নি।
নিষ্কর, পতিত জমি
হিসেবে অঞ্চলটি
চিহ্নিত। ঘোতাই সেই
অঞ্চলের বাসিন্দা। তার
এই বাবুটিকে জমিদার
হিসেবে মানার কোন কারণ
নেই। কিন্তু নায়েবের
চাপে এবং নিজ চরিত্রগত
দুর্বলতায় সে জমিদারকে
প্রণাম করে বসে।
নায়েবের কাছে অঞ্চলের
নাম শুনে জমিদারের
খেয়াল হয় এই সেই অঞ্চল
যার কর আদায় হয় না। তখন
তিনি নায়েবকে বলেন, এই
প্রজাদের পরদিন তাঁর
কাছারিতে আসতে বলতে।
সেই বলার সংলাপটি লেখার
আগে কমলকুমার মজুমদার
একটি তির্যক এঁকেছেন,
যার কথা বলতেই এতদূর
আসা।
হুজুর এক রকম কেমন
যেন অদ্ভূত প্রকৃতির
বাংলায় বলেছিলেন,
'নায়েবমশাই ওদের আমার
সঙ্গে দেখা করতে বলে
দিন।
ঘোতাই মান্ডি
ল্যাক্প্যাক্ করতে
করতে এই খবরটা
কালাদিক্রমে শাজাদ
অব্দি পৌঁছেছিল। শাজাদ
কেন্দ্রীয় চরিত্র এক,
যারা খাজনা দেয় না
তাদের দলনেতা এবং
কালান্তরে
ডাকাতি-লুটপাটে পেট
চালায়। তার এ প্রসঙ্গে
সংলাপটা লিখে সরে যাবে
এ বিবেচনার অন্য
অভ্যন্তরে।
শাজাদ
বেয়াড়া-তাড়ানো গলায় হে
হে করে বলে উঠল, 'থাম
শালা পাখুরে হারামি
শালা "হুজুর হুজুর"
বলি হুজুরের বুকজোড়া
ব্যঙ্গমী-রাঁঢ়! হুজুর
বলতে পরাণ তুয়ার
লগবগাইছে
রে...দাখিলা-পরচা চিনলাম
না...হুজুর কেনে?
বাংলাভাষার সঙ্গে এ
প্রান্তে ঠিক এটাই
হয়েছে। দাখিলা-পরচা না
চিনেই আমরা হুজুর মেনে
নিয়েছি। ভাষাতো শুধুই
প্রাকৃতিক বিষয় নয়,
ভাষা এক জনগোষ্ঠীর, এক
জনপদের উত্থান-পতনাবৃত
চলন। গাছপালা যেমন করে
জন্মায়, যে ভাবে পাখির
কন্ঠে সুর সেভাবেই ঠিক
ভাষা এসে দাঁড়ায় না।
কারুময়তার এক নিবিড়
ইতিহাস রয়েছে তার।
বাংলা ভাষাও ব্যতিক্রম
নয়। এই জনপদের ইতিবৃত্ত
এক অর্থে ভাষার
ইতিহাসও। সেখানে
হুজুরি নেবার জন্য যখন
আমরা ইংরেজীর কাছে
দাখিলা-পরচা না চেয়েই
সেলাম ঠুকে দিলাম তখন
থেকেই আমাদের মেরুদন্ড
শিথিল হতে শুরু করল।
আগের বাক্যটা কিছুটা
মন্তব্যধর্মী হয়ে
দাঁড়িয়েছে ব্যখ্যার
অনুপস্থিতিতে। কাজেই
এভাবে ব্যখ্যাতে যাই
এর। ইংরেজ শাসনের শুরুর
দিক থেকে আগের শাসনে
যেমনভাবে ফার্সি শেখার
চল, তেমনই ইংরেজী শেখার
ধূম এল। কিন্তু আগের
শাসনের সঙ্গে পরের এই
শাসনের ফারাক হয়ে গেল
শাসকের চরিত্রগত
পার্থক্যে। আগের
শাসকেরা ভাল-মন্দ সব
ক্ষেত্রেই এই ভূখন্ডের
অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
ধর্মের ফারাকে এ
ভূখন্ডে নতুন কোন বিষয়
ছিল না। এমনকি হিন্দু
বলে যে একটি অখন্ড ধর্ম
নির্মাণ প্রকল্প আঠারো
শতকের শেষ এবং উনিশের
শুরু থেকে জাতীয়তাবাদী
প্রকল্পে এল, তাও
কোনদিনই অখন্ড ছিল না।
মুখ্যত ছটি দর্শনের এবং
শাখা এবং তারও বিরোধী
চার্বাকাদি
লোকজ-বুদ্ধিজ শাখাগুলি
জনগোষ্ঠীর ভাবপ্রকৃতি
নিয়ন্ত্রক ছিল। বেদের
বিরোধ বেদান্তে হয়নি,
ভাগবত পারেনি সাংখ্য
যোগাদিকে শেষত মিলিয়ে
দিতে - এসেছে জৈন এবং
বৌদ্ধ ধর্মও। শাসক কখনো
বৌদ্ধ, কখনো বৈষ্ণব,
কখনো শাক্ত বা কখনো
ব্রাহ্মণ্যবাদী বিধায়
আখ্যাত। অন্যান্যদের
সে কখনো মেনেছে, কখনো
মেরেছে। কাজেই ইসলাম
ধর্মীয়দের শাসনে নতুন
করে শাসক-শাসিতের বিরোধ
তীব্র হয়নি।
তীব্র বিরোধ কল্পনাটি,
কল্পনা লিখলাম এই কারণে
যে ঐতিহাসিকভাবে ইসলাম
ধর্মীয় শাসনে এবং
হানাদারিতে হওয়া
প্রতিটি ঘটনাকে মাথায়
রেখেও বলা চলে যে এমন
বহুতর ঘটনা পূর্বের
ইতিহাসে রয়েছে, যা
জাতীয়তাবাদী প্রকল্পে
বর্জিত হয়েছিল।
ইতিহাসপাঠ,
অসম্পূর্ণতার ছলে কিছু
বিষ দিয়েই রেখেছে।
মন্দির ভেঙে মসজিদ হলে,
উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আছে
জৈন মন্দির ভেঙে শৈব বা
শাক্ত মন্দির গঠনও। এবং
কখনো কখনো শাক্ত মন্দির
ভেঙে শৈব বা বৈষ্ণবের
আখড়া উড়িয়ে শাক্তের
আশ্রমও। আবার কালে কালে
এ সব বিরোধ পেরিয়েও
পাশাপাশি সকলের
অবস্থানও ইতিহাস
দেখেছে। ইতিহাস দেখেছে,
মহাভারত-রামায়ণের
অনুবাদে ব্রতী
ইসলামধর্মীয় শাসকদের,
বাংলা ভাষায়
সাহিত্যসৃষ্টির
প্ররোচনাদানকারী
নবাবদের। এর অর্থ এই নয়
যে যখন দুষ্কর্ম হয়েছে
তাকে সমর্থন করার কথা
বলছি বা তার গুরুত্ব
খাটো করতে চাইছি। বরং
ইতিহাসের
প্রবাহমানতায় এই
দুষ্কর্মাদি যে শাসনের
রীতির অন্তর্গত এবং এই
জাতীয় দুষ্কর্মের
সঙ্গে আমরা
ঐতিহাসিকভাবে পরিচিত
ছিলাম, সেই চিহ্নটুকুকে
রাখার চেষ্টা করছি।
ইংরেজ আমল এ সব
দুষ্কর্মকে ছাপিয়ে
যাবে কেন তার
পূর্বপ্রস্তুতি
হিসেবে এই অংশটুকু
গ্রন্থন করা।
মন্দির ভেঙে গীর্জা হয়ে
গেল? যত লোক পেল সবাইকে
খ্রীষ্টান করে দেওয়া
হল? জোর করে নিষিদ্ধ
মাংস খাইয়ে জাত মেরে
দেওয়া হল? খেয়াল করলে
দেখবেন, এ সব শুরুর দিকে
অল্প-বিস্তর। পরের
দিকে, বিশেষ করে ১৮৫৭-র
অভিজ্ঞতার তিক্ততায়,
ব্রিটিশ সরকার এই জাতীয়
কার্যক্রমকে বেশ কড়া
হাতে নিয়ন্ত্রণ করেছে।
শাসনের জন্য যে নীতি
তারা ব্যবহার করেছে তা
বস্তুত বাংলায় মুঘল
আমলের শাসনরীতি।
অর্থাৎ জনগোষ্ঠীর
নিজস্ব আচরণে
না-হস্তক্ষেপ করার
নীতি। অতি প্রয়োজনীয় না
হলে কোন সংস্কার চেষ্টা
নয়। এই
অতিপ্রয়োজনীয়তার
খাতিরেই সতীদাহপ্রথা
রদ অথবা বিধবা-বিবাহ
এবং নারীশিক্ষা জাতীয়
সংস্কার আসবে। আসবে,
তার কারণ শাসক, শাসিতের
সঙ্গে এক ভুখন্ডে বসবাস
করেন না, সংস্কৃতির
উপাদান ভাগাভাগি করে
যৌথতার দিকে কখনোই
যাচ্ছেন না।
দ্বীন-ই-ইলাহি সৃষ্টির
কোন বাসনা নেই। জিজিয়া
কর আদায় করেও ধর্মের
বিশুদ্ধতা রক্ষার
জিগির নেই। কিন্তু
শাসকের নিজের দেশের
পার্লামেন্ট এবং
জনগোষ্ঠীর কাছে প্রমাণ
করার দায় আছে, যে এই শাসন
আসলে 'শ্বেত-মানুষের
বোঝা', যা বর্বরদের সভ্য
করছে।
এই প্রমাণ দিতে
সতীদাহের মত প্রথা
অসামান্য কাজে লাগে,
বিধবা-বিবাহ ও
নারীশিক্ষাও বেশ
লাভজনক। ব্যঙ্গোক্তি
করছি ভাবলে ভুল হবে,
একটু যদি সমকালীন
ইতিহাস ঘেঁটে দেখেন
তাহলে দেখবেন ইংরেজ তার
নিজের দেশে নারীর
সম্পত্তির অধিকার বা
শিক্ষার অধিকারকে ঠিক
কেমন ভাবে দেখেছে!
নারীশিক্ষার অধিকার
আদায় করতে সে দেশের
নারীদের বোমা মারতে
হয়েছে, আগুন জ্বালিয়ে
দিতে হয়েছে - সম্পত্তির
অধিকার নিয়ে লড়াই তো
ভেতরে ভেতরে অতি
হিংস্র। সে বিষয়ে বিশদে
যাবার উপায় নেই আমার।
শুধু ঐতিহাসিকতার
খাতিরে বলে যাওয়া যে এ
দেশে এ সব নিয়ে বিশিষ্ট
ব্রিটিশরা যখন এত
চিন্তিত তখন নিজের
ভূখন্ডের হালটি যথেষ্ট
সভ্য একদমই নয়। কিন্তু
এখানে সংস্কার
ব্রিটেনে এবং
ইংরাজীভাষী আমেরিকায়
এই শাসনের যৌক্তিকতা
প্রমাণ করার জন্য
তৎকালীন মানবতাবাদী
ইংরাজ
দার্শনিক-ঐতিহাসিকদের
বড় অস্ত্র। না হলে
মানবতাবাদের জামাটাও
কিন্তু খুলে পড়ে যাবে।
একটু অন্য প্রসঙ্গে এসে
আরেকদিক থেকে শুরু করি
এই দেখা।
দার্শনিক-তাত্ত্বিক
সন্দর্ভ রচনার
উদ্দেশ্যে এ লেখা নয়।
আয়নায় নিজ মুখ
ঘুরে-ফিরে দেখার বাসনা
মাত্র। খবরে প্রকাশ
গ্যারি লিনেকার নামক
ইংরেজ ফুটবলারের
স্ত্রী ড্যানিয়ালে
সাম্প্রতিকে এসেছিলেন
বাংলাদেশের সিলেটে।
তাঁর দাদু, সিলেটে
জন্মেছেন, নাম জালাল
অব্দি জানতে পারা
যাচ্ছে। অবিভক্ত ভারত
সাম্রাজ্যের সিলেটের
বাসিন্দা, ব্রিটিশ
বাহিনীতে যোগ দেন, পরে
লন্ডন চলে যান।
ড্যানিয়েলার মুখের
গড়নে স্বাভাবিকভাবে
এশীয় আদল থাকায় ইস্কুলে
তাঁকে অনেক কটুক্তি
ইত্যাদি সহ্য করতে
হয়েছে। সেই ড্যানিয়েলা
লিনেকার সহ চলে
এসেছিলেন ঢাকা ও সিলেট
দেখতে। ঢাকা দেখে তিনি
সন্তুষ্ট, কিন্তু সিলেট
দেখে যারপরনাই
শোকগ্রস্ত। প্রায়
সদ্যপ্রসূতি মা তাঁর
সন্তান কোলে নিয়ে
আস্তাকুঁড় থেকে খাবার
কুড়িয়ে খাচ্ছে,
খাওয়াচ্ছে। তিনি এ সব
দেখে খুব কষ্ট পেয়েছেন
এবং তাঁর ক্রন্দনরত
ছবিটি পশ্চিমবঙ্গের
একটি দৈনিকে দেখলাম।
তাঁর অনুভূতির
বিন্দুমাত্র অমর্যাদা
না করেই ক'টা কথা লিখি!
আমাদের উপমহাদেশের
দিনের ছবিগুলো আমাদের
দেখে দেখে এমন গা সওয়া
হয়ে গিয়েছে যে আমরা টের
পাইনা বহুসময় তার
নিষ্ঠুরতা। উনি তো
দেখেননি এমন। কেন
দেখেননি? ওনাদের
অর্থনীতি কি চূড়ান্ত
কৃষ্টি লাভ করেছে যে ওই
সমস্ত দেশে এ সব দেখাই
যায় না? আজ্ঞে, দেখেননি,
কেন না ওঁদের যাবতীয়
অর্থনীতির অনর্থপাত
এখানে ঘটেছে। এখানকার
মত দেশগুলো যারা
বিশ্বজুড়ে ছায়ার আড়ালে
সেখানে ঘটেছে। এখানে
তাঁতির আঙুল কেটে ওখানে
সম্পদের উচ্চতা
বেড়েছে। পূর্বতন
শাসকদের সম্পদ লুটে
নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি বাদ
দিলেও শুধুমাত্র
বাজারের হিসেবে এতবড়
বাজার বানিয়ে ফেলা,
দিনে দিনে ওঁদের
রাষ্ট্রব্যবস্থাকে
ততটা ধনী করেছে যেখানে
এই দৃশ্যটা দেখা যাচ্ছে
না তেমন! কিন্তু ভাববেন
না যে এ দৃশ্য কখনো
ওদেশে ঘটেনি। না ঘটলে
কি আর চ্যাপলিনের
সিনেমায় এমনি উঠে আসে
প্লেটে জুতো রেখে
কাঁটাচামচে খাওয়া? আজ
ঘটছে না আর। তদানীন্তন
এবং নতুন
বিশ্বঅর্থনীতির
প্রক্রিয়ায় ওঁদের এখনো
সম্পদ সুরক্ষিত।
কথা হচ্ছে বাংলাভাষার
সঙ্গে এর সম্পর্ক কই! এই
যে শাসক কোনোদিন
শাসিতের কাছে এল না, সে
শাসককে সর্বতোভাবে
উচ্চতর অবস্থানে ঠাঁই
দিল। আমাদের
হীনমন্যতায় আমরা,
ভদ্রলোক বাবুসমাজ,
যাঁরা আপাদমস্তক
আংরেজীয়ানায় সজ্জিত
এবং তাকেই প্রায়শই
পাশ্চাত্য বলে ভুল করে
থাকি, এঁদেরকে ঈশ্বর
বানিয়ে নিলাম। ভাষার
প্রক্রিয়াতেও চলে এল
সেই ভাব। ভাষা তো
শাজাদেরও আছে আবার
কমলকুমারের জমিদার
বাবু মোহনগোপালেরও
আছে। কোন ভাষার জোর
বেশী হবে? কেন, যার দাপের
জোর বেশী? জমির মত ভাষাও
তো দাপের বিষয়। অন্তত
বেশ ততকাল, যতকাল না
শাসকবদল হচ্ছে।
মোহনগোপালের ভাষাটি
সংবাদমাধ্যম থেকে
সাহিত্যে অগাধ বিস্তার
লাভ করলো।
ইস্কুলে-কলেজে
পুঁথিপত্রে পড়ানো চললো
বেশ ক'শতাব্দী! শাজাদের
ভাষা প্রান্তিক থেকে
প্রান্তিকতর। ওই যে
ভাষার ওই চমৎকার লাফ, ওই
বাক্যবন্ধের এবং
সর্বোপরি কল্পনার
ষড়ৈশ্বর্য বাবুদের
ভাষা থেকে বিদায় নিয়ে
রক্তহীন হয়ে যেতে
থাকলো। হুজুরের
বুক-জোড়া
ব্যঙ্গমী-রাঁঢ়?
আরবি-ফারসি, রূপকথা,
পরণকথা, লোকজীবনের গাদ,
ক্লেদ সকল মিশিয়ে যে
অস্তিত্ব তা মুছে যেতে
থাকলো বাংলাভাষা
থেকে।
অর্থনীতি রাজনীতির
চালিকাশক্তি, রাজনীতি
সামাজিকনীতিসমূহকে
চালনা করছে। অতএব বাবু
মোহনগোপালের অদ্ভূত
বাংলাটি যা কার্য-কারণ
সম্পর্কের সূত্রে
দিব্য ছিমছাম, যা
বিভাষীর বুঝতে খুব
সমস্যা হবে না, পাটের
দালালি, চাল কিম্বা
কয়লার বা লোহার খনি
সর্বত্রই দরাদরির কাজে
ব্যবহার করাই যাবে বলে
আশা, সেই স্বল্পায়তনের
মার্জিত ভাষাবিন্যাস
ভদ্রজনের কলকাতার ভাষা
এবং সেই সুবাদে কালে
কালে অন্যান্য অঞ্চলের
মান্য ভাষা হয়ে উঠলো।
তাঁতী কলে কাজ নিল আঙুল
কাটার পরে, ভদ্রজনেরা
নির্বিকার হয়ে
অন্যদিকে তাকিয়ে
রইলেন। ভূসম্পত্তি
বাড়ালেন এককালে। গ্রাম
বাংলার
গাছগাছালি-পাখপাখালির
সঙ্গে সেভাবে কিছু
সম্পর্ক রইলো এবং শহরেও
ভূমি কিছু অবশিষ্ট
থাকায়, কিছু পুকুরাদি
হর্ম্যদ্বারা অধিকৃত
না হওয়াতেও বাতাস থাকায়
এক রকমের আঞ্চলিক
সুগন্ধ একটু আধটু ছড়িয়ে
ছিটিয়ে থাকতো। কালে
কালে শহরের বাবুরা জমির
চেয়ে শেয়ারের কাগজ এবং
গ্রামের বাবুরা জমিই
একমাত্র অস্ত্র জ্ঞান
করায় সেখানেও ছেদ এল।
যেহেতু দূরত্ব একটি
নির্বাচিত বিষয়, তাই
নিকটে যা তার সম্ভাবনাই
বেশী, অতএব শহরের
বাবুদের ভাষা, গ্রামের
বাবুদের দ্বারা
সাহিত্যরচনায়
দীর্ঘকাল অনুকৃত হতে
থেকেছে এই
পশ্চিমবঙ্গে। উল্টোটা
কদাচিৎ।
ভাষা একটি ভূগোলও বটে।
সে ভূগোল যদি উঠে না আসে
লেখায় তাহলে তার
বিস্তার ঘটে না।
স্থানিকতা না থাকলে
আন্তর্জাতিকতা আসে না।
ব্যবেলের বাজারে সকলে
এক রকম সেজে গেলে কে
কাকে স্বতন্ত্র বলে
চিনবে? বাংলা যত সহজ সরল
হবে তত পাঠকের মনোরঞ্জন
করবে, এই নীতি অনুসৃত
হচ্ছে। পাঠক, নিজ
মস্তিষ্কটি বন্ধক
দিয়েছেন পূর্বেই
শাসকের বিবেচনার কাছে।
অতএব যা খাওয়ানো হবে,
তাই খাবেন। যা খাওয়ালে
শাসনের সুবিধে তাই
খাওয়ানো হবে। এই শাসকের
মত, মতাদর্শ। দেশ না
বাঁচলে ভাষা বাঁচে না।
দেশ বাঁচাতে গেলে
মেরুদন্ড চাই, যার বড়
অভাব। বাঁকাপথের
যাত্রী বেশী। পাটের
দালালের সংখ্যা বড্ড
বেশী ভাষাতন্ত্রে।
আবার ভাষা বাঁচানোর
লড়াইও দেশ বাঁচাতে
অগ্রপথিক। ভাষা
একাধারে
ইতিহাস-ভূগোল-দর্শন-স্ম
ৃতিসমূহ ও ভবিষ্যৎ।