যে আমাকে পালিয়ে যেতে
দেয় না, আমার পরিযায়ী
ডানা ভারী করে তোলে যে
নির্ভার নিরবয়ব
(অ)পদার্থটি, তার নাম
বাঙলা ভাষা। তাকে শুনতে
- পড়তে - বলতে না পারার
ভয়ে যেতে পারি না... যে
কোন দিকেই আমি চলে যেতে
পারি না। বাঙলা ছেড়ে
অনেক অনেক দূরে দীর্ঘ
চলে যেতে ভয় পাই।এই
ভাষা আমাকে নির্মাণ
করেছে। এই ভাষা আমাকে
বন্দী করেছে। কন্ঠে
সঙ্গীতের মতো, পায়ে
শেকলের মতো, সে বেজে
চলেছে ঝম ঝম। যেটুকু
মুক্তি আর যেটুকু
বন্ধন, তার নির্মিতি
যেন এই ভাষাটিকে
অবলম্বন করে।
ইস্কুল যাওয়া ছোটবেলায়
একদিন বন্ধুদের সাথে
বেড়াতে বেরিয়ে হঠাৎ
সামনে একদল গোরা
সাহেব-মেম। একজনের কোলে
এক শিশু। কয়েক মাসের
হবে। প্রবল কাঁদছে। এক
বন্ধু বলল, “দেখ,
বাচ্চাটা ইংরিজিতে
কাঁদছে”। হাসির প্লাবন
আমাদের। কান্নার আবার
ভাষা কী? ভাষার দৌড় তো
বাচিক ভাব প্রকাশের
মসজিদ অব্দি। তার পর যে
সমুদ্দুর আর আকাশ,
সেখানেই তো কান্নার
বাসা, হাসি - সুখ -
প্রেমের ঘর -
গেরস্তালি। মানুষের
ভাষা অতদূর যেতে পারে
না।
আজ আর হাসি পায় না কথাটা
মনে পড়লে। আমি আমার
কান্নার ভাষা, ভালবাসার
ভাষা দেখে ফেলেছি। অন্য
ভাষায় আমি লিখতে-পড়তে
পারি দিব্বি। এমনকি
সাহিত্য। তারিফ করতে
পারি। মুগ্ধ হতে পারি।
উর্দু শায়েরীর ছোঁয়ায়
প্রতিবর্ত “ক্যা বাত”!
খুশির মুহূর্তে ইংরিজি
বা হিন্দিতে হাসি
চালাচালিও চলতে পারে।
কিন্তু কান্না পারি না।
কারণ নানা শহর, নানা
ভাষা আর জীবনের প্রায়
চার দশক পেরিয়ে আসলে
একটি মাত্র ভাষা আমি
জানি। বাঙলা। যে সব
অনুভূতি কাউকে জানানোর
নয়, ভাষায় প্রকাশ করার
প্রয়োজনমাত্র নেই, সেই
সব অনুভবকে আমি
শুধুমাত্র বাঙলায়
চিনতে পারি। এ শুধু
আমার নয়, তোমারও গোপন
সত্যি। বুক উথলে ওঠা
মুহূর্তে একমাত্র
বাঙলায় তুমি ভাববে
অগোছাল অসহায়। এই ভাষায়
কাঁদবে। যে নারী বাঙলা
বুঝবে না, তার সাথে ঘর
বাঁধা হবে না আমার,
এমনকি তেপান্তরের
মাঠের ওপারেও। কে বলে
ভালবাসার ভাষা নেই?
সম্পাদক বলেছিলেন
বাঙলা ভাষা সম্বন্ধে
আবেগ-মমতা-ভালবাসা
লিখতে। তাই ঐ সত্যিটাই
প্রথমে লিখলাম। কিন্তু
আমি ধাতব মানুষ। শতকরা
নব্বই ভাগ শুষ্ক। তাই
ভালবাসার কথা দু-কলম
লিখতে গিয়ে মুক্তির
সাথে বন্ধনের উল্লেখ
করে ফেললাম। বন্ধন
মানেই খারাপ নয় অবশ্য।
সব বাঁধন কি আমরা
কাটাতে চাই? কিন্তু
মুক্তি আর বদ্ধতা,
দুটোকেই চিনে রাখা ভাল।
মাতৃভাষা নামক ধারণাটি
মায়ের মতোই মিষ্টি। সে
এক পরম আশ্রয়। কিন্তু
মাতৃভাষা কি সত্যি
মায়ের মতো মানুষকে ধারণ
করে? নাকি মানুষই ধারণ
করে তার মাতৃভাষাকে?
অস্ট্রিয়ান দার্শনিক
ইভান ইলিচকে যদি
বিশ্বাস করতে হয়, তাহলে
“মাতৃভাষা”
শব্দবন্ধটি প্রথম
প্রয়োগ করেন রোমান
ক্যাথলিক কিছু পুরুত
ঠাকুর, ল্যাটিনের
পরিবর্তে যে ভাষা তাঁরা
ব্যবহার করতেন, সেই
ভাষাকে বোঝাতে। তাহলে
“মাতৃভাষা” নামক ধারণা
আমাদের কাছে এসেছে
বিলিতি শাসকদের হাত
ধরে। মেনে নেওয়া যায়? না
মানার কিছু নেই। কারণ
যতদিন বাইরে থেকে
চাপিয়ে দেওয়া সরকারি
ভাষার সাথে পরিচয় না হয়,
ততদিন যে ভাষায়
স্বাভাবিক ভাবে কথা
বলি, সেটাই আমার ভাষা...
একমাত্র ভাষা। তাকে
আলাদা ভাবে মাতৃভাষা
হিসেবে চিহ্নিত করার
প্রয়োজন পড়ে না। জোর
করে উর্দু চাপিয়ে না
দিলে বাঙলার
স্বাধিকারের দাবিতে
উত্তাল হতে হত কি ঢাকা
শহরকে?
কিন্তু সমস্যা আছে।
ইউরোপে যেমন ল্যাটিন,
আমাদের দেশে তেমনি
সংস্কৃত (বা
প্রাক-পাণিনি যুগে
দেবভাষা) ছিল। বুদ্ধ
যখন সাধরণের পালনযোগ্য
ধর্মাচরণ প্রচার করেন
ব্রাহ্মণ্যবাদের
প্রতিস্পর্ধায় পালি
ভাষায়, তখনই তো আসার কথা
মাতৃভাষার প্রসঙ্গ।
পরবর্তী কালে আরবী এবং
ফার্সী, বাঙালির কাছে
শিক্ষণীয় প্রয়োজনের
ভাষা হিসেবে এসেছে।
তখনও কি আসেনি
মাতৃভাষার ধারণা? এর
সঠিক উত্তর আমার জানা
নেই।
আরেকটা খটমট প্রশ্ন হল,
চূড়ান্ত
পুরুষতান্ত্রিক
গোষ্ঠীর মানুষেরা কেন
“মাতৃভাষা” শব্দটি
ব্যবহার করলেন, যেখানে
তাঁদের
একমেবাদ্বিতীয়ম ঈশ্বর
পর্যন্ত প্রবল ভাবে
পুরুষ? শুধু কি বিনায়ক
যীশুর জন্ম দিতে যোসেফ
না হলেও চলে, কিন্তু
মাতা মেরীর একান্ত
প্রয়োজন বলে? তা নয়।
সম্ভবত মাতৃভাষা
শব্দটিও
পুরুষতান্ত্রিক।
প্রকৃতিকে নারী আর
সভ্যতাকে পুরুষ হিসেবে
দেখার ফলশ্রুতি এই
শব্দ। আদিম, প্রাকৃতিক,
অপরিশীলিত, আবেগপূর্ণ,
স্বাভাবিক যা কিছু, তা
যেন নারী। অপরপক্ষে
আধুনিক, শিক্ষাপ্রসূত,
শীলিত, বুদ্ধিলভ্য,
চর্চাযোগ্য যা, তাই
পুরুষ। নারী থেকে ক্রমশ
পুরুষ এবং পুরুষতর হয়ে
ওঠাই সভ্যতার ইতিহাস।
তাই সংস্কৃত, ল্যাটিনের
মতো বেদ-বাইবেলের
সাধনলভ্য শিক্ষণীয়
ভাষাগুলি পিতার ভাষা,
পাদ্রীর ভাষা,
ব্রাহ্মণের ভাষা। এর
বিপরীতে গ্রাম্য
অশিক্ষিতের কুড়িয়ে
পাওয়া মেঠো ভাষা হল
মাতৃভাষা। এর মধ্যে
মিশে আছে এক তাচ্ছিল্য।
কিন্তু আমরা মায়ের
ছেলে-মেয়ে। এই
তাচ্ছিল্যকেই মুকুট
করে নিতে পেরেছি বারে
বারে। বুদ্ধ পথ
দেখিয়েছিলেন। তাঁর পথ
ধরে সেই কবে পৌঁছে গেছি
আশ্চর্য এক দেশে...
চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়...
আশ্চর্যাশ্চর্যবিনিশ্
চয়। সেই মাতৃভাষা যুগ
যুগ ধরে বাঙলা হয়ে
উঠেছে একটু একটু করে।
সেই মাতৃভাষা যেদিন
রুখে দাঁড়িয়েছে, চুরমার
হয়ে গেছে সপ্তরথী,
চক্রব্যূহ।
মাতৃভাষার অধিকার
প্রতিষ্ঠার সেই লড়াই
শুধু ভাষার আঙিনায়
ভাবলে ভুল হবে। সে ছিল
প্রকৃত এক শ্রেণী
সংগ্রাম। বাঙলাদেশের
মধ্যেও অভিজাত শ্রেণীর
কিছু মানুষ কথা বলতেন
উর্দু-ফার্সীতে। সরকার
আর তার ব্যবস্থাকে
সাধারণ মানুষের হাতের
নাগালের বাইরে রেখে
অভিজাত শ্রেণীর
স্বার্থ সুরক্ষিত
রাখার, বাঙলাদেশের
আম-জনতাকে
রাষ্ট্রপরিচালনায়
অংশগ্রহন করতে না দেবার
এক চক্রান্ত ছিল
বাঙলাকে অস্বীকার করার
করাচি-সিদ্ধান্ত। ভাষা
আন্দোলন তাই প্রকৃত
প্রস্তাবে সাধারণ
বাঙালির প্রথম
গণ-অভ্যুত্থান। শুধু
কথা বলার নয়, বেঁচে
থাকার অধিকার
প্রতিষ্ঠার লড়াই। এ
লড়াই স্পষ্ট করেছে কী
ভাবে ভাষাকে অবলম্বন
করে মানুষ বাঁচে, আর
কেমন করে ভাষার
সাহায্যে তাদের অবদমিত
করা যায়। ভাষা দিবস
আমাদের কাছে বড় আবেগঘন
দিন... আমাদের চোখে
মায়া-অঞ্জন। “সে কাব্য
অনেক”। সে আনন্দে
বাঙালির অধিকার।
কিন্তু বাঁচতে না দেবার
এই চক্রান্ত আর বেঁচে
থাকার এই মৌল তাগিদের
কথা ভুলে গেলে চলবে না।
“মাতৃভাষা”-র বিকল্প যে
সব শব্দ ব্যবহার করা
যেতে পারে আমাদের ভাষা
হিসেবে বাঙলার অবস্থান
বোঝাতে, তারা মাধুর্যে
ন্যূন, আবেগে সামান্য।
যেমন প্রথম ভাষা,
স্থানীয় (আঞ্চলিক) ভাষা,
বা জাতিগত ভাষা,
ইত্যাদি। (ফার্স্ট
ল্যাঙ্গোয়েজ, নেটিভ
ল্যাঙ্গোয়জ, নেটিভ
স্পিকার শব্দগুচ্ছের
সাথে সবাই পরিচিত।
কিন্তু আজ কিছুতেই
ইংরিজি লিখব না। ভাষিক
অহংকারে লাগছে।)এরা সব
কেজো শব্দ। এদের ঘিরে
ভালবাসার জন্ম হয় না, হয়
শুখা তত্বের বিবৃদ্ধি।
প্রাথমিক বা আঞ্চলিক
ভাষার জন্য বুকের রক্ত
দেওয়া যায় না, যতক্ষণ না
তাকে মা-ভাষা ভাবা যায়।
কিন্তু এই শব্দগুলো
থাকবে। সুস্থির থাকবে
না অবশ্য। তর্কের
দুনিয়ায় যেমন হয়, নিয়ত
প্রশ্নবিদ্ধ অস্তিত্ব
এদের।
প্রথম ভাষা সেটাই যা
মানুষ প্রথম শেখে,
সবচেয়ে স্বাভাবিক আর
সবচেয়ে পোক্ত ভাবে
শেখে। তার মানে এই নয় যে
সেই ভাষার ব্যাকরণের
মোটা মোটা পুঁথি তাকে
মুখস্থ করতে হবে। সে সব
কিছু না জেনেও যে ভাষায়
মানুষ এমনিতেই
স্বচ্ছন্দ, সেই ভাষাই
তার প্রথম এবং আসল
ভাষা। কান্নার ভাষা।
নিরক্ষর হলেও স্বজাতির
ভাষায় সে জন্মগত
সর্দার। ভাগ-চাষি মনু
মোল্লা যে বাঙলা বলেন,
সেটাকেই মানা হবে আসল
বাঙলা হিসেবে।
এডওয়ার্ড সায়েব যতই
সুনীতি চাটুজ্জে পড়ে
নির্ভুল হন না কেন,
বাঙলা তাঁর দ্বিতীয়
ভাষা। এই জায়গায় মনু
মোল্লার প্রতিষ্ঠা
তিনি টলাতে পারবেন না।
কারণ এ হল মনুর জাতির
ভাষা, লোকায়ত ভাষা,
নিজের ভাষা, প্রথম ভাষা,
শিশুকালের ভাষা। মায়ের
দুধ, মায়ের হাসির সাথে
সাথে যে ভাষা তার কাছে
আশৈশব “যেমন আছে তেমনি
আসে”, সে তো মায়ের
ভাষাই। মায়ের ভাষাই তার
প্রথম ভাষা।
এত শব্দের মধ্যে প্রথম
ভাষা শব্দটা বোধহয়
সবচেয়ে নিরীহ। এটা
ব্যবহার করলে তর্কের
ফাঁদে পড়বার সম্ভাবনা
সবচেয়ে কম। যে ভাষা
প্রথম এসেছে জীবনে
স্বাভাবিক ভাবে, সেটাই
প্রথম ভাষা।
প্রতিষ্ঠিত তত্ব এই যে,
শৈশব এবং বাল্যের এক
বিশেষ সময়কালের মধ্যে
যে ভাষা শিখে ফেলা যায়,
তার সমতুল্য হয়ে উঠতে
পারে না আর কোনো ভাষাই।
গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষের
ক্ষেত্রে এই মতবাদ
সত্য। বিশেষ
প্রচেষ্টার দ্বারা
অবশ্যই এই সীমাবদ্ধতা
অতিক্রম করা যায়।
মানুষের অসাধ্য আছেই বা
কী?
কিন্তু ঝামেলা
পাকিয়েছেন টল্কিন
সাহেব (“হবিট”, “লর্ড অব
রিংস”-এর রচয়িতা
ব্রিটিশ
সাহিত্যিক-ভাষাবিজ্ঞা
ী)। ইংল্যান্ড আর
ওয়েলসের ভাষা নিয়ে
গবেষণা করতে গিয়ে তাঁর
মনে এক প্রশ্নের উদয়
হল। শৈশবের দোলনায় শুয়ে
হাত-পা নেড়ে খেলতে
খেলতে শেখা ভাষা আর
জাতির রক্তে বয়ে যাওয়া
ভাষা, দুটো যদি এক ভাষা
না হয়? তাহলে কি প্রথম
শেখা ভাষাটাই হবে তার
একমাত্র প্রেম?
স্বজাতির ভাষার কী আদৌ
কোনো প্রভাব থাকবে তার
মনে বা মগজে? তিনি
দেখেছিলেন তেমন
ক্ষেত্রেও দ্বিতীয়টার
অস্তিত্ব মুছে যায় না।
তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র
ছিল বিলেতে। কিন্তু সেই
আবিষ্কার ধার করে বলা
যায়, ঢাকার পোলা যদি
মার্কিন মুলুকে জন্মায়
এবং শৈশবে বাঙলা না
শেখে, তাহলেও সে
পরবর্তী জীবনে বাঙলা
শুনলে তার প্রতি আকর্ষণ
অনুভব করবে। হয়ত জাতির
মস্তিষ্কের কোষে, তার
জিনের গায়ে আঁকা হয়ে
গেছে এক ভাষিক
স্মৃতিচিহ্ন। না আঁকা
নয়, খোদিত হয়ে আছে হয়ত,
মোছার অযোগ্য গভীরে। এর
পর আর স্রেফ প্রথম ভাষা
অভিধায় সন্তুষ্ট হওয়া
যায় না। মাতৃভাষা
শব্দটাই আমার পছন্দ,
অন্তত ভাষা দিবসের
প্রাক্কালে। প্রথম
ভাষা ত্যাগ করা যায়।
মাতৃভাষা অত্যাগসহন।
ভাষা অবশ্যই মানুষের
একটি নির্মাণ... ধর্ম,
দেশাত্মবোধের মতন।
কিন্তু ভাষা আবার
মানুষকে নির্মাণ করে
নিজের মতো করে। ভাষা
শিখে ফেলার পর ভাষাকে
বাদ দিয়ে আমরা আর ভাবতে
পারি না। সুতরাং কিছু
মানুষ কী ভাবে ভাবতে
অভ্যস্ত, তার পরিচয়
তাদের ভাষার মধ্যে
থাকতে পারে। আবার তাদের
ভাষা খানিকটা
নিয়ন্ত্রণ করতে পারে
তাদের ভাবনা আর
ভাবপ্রকাশের
চৌহদ্দিও। অতএব
বাঙালির জাতি-চরিত্রে
বাঙলা ভাষার ছাপ
থাকবেই, আর বাঙলা ভাষায়
থাকবে বাঙালির ছাপ...
বাঙলার মাটির ছাপ... মিঠে
- নরম ভেজা - ভেজা সবুজ
সবুজ...
কিন্তু কেবলই কি মিঠে
নরম সবুজ? বাঙলার
সর্বত্র মাটি তো এক নয়,
বাতাস তো এক নয়।
খাদ্য-শ্রম-বিলাস এক
নয়। তাহলে? কোন বাঙলা
আমার মাতৃভাষা?
বাঁকুড়া, দিনাজপুর,
কোলকাতা, শ্রীহট্ট,
ঢাকা, চট্টগ্রাম...
কোথাকার ভাষা? যে
নাগরিক বাঙলা আমরা
নির্মাণ করেছি, যে
ভাষায় আমি-আমরা লিখছি
এখানে, সে কি কোনো
বাঙালির মাতৃভাষা? আমার
বাবা তাঁর মাতৃভাষা
আহরণ করেছিলেন
পদ্মাপারে
বিক্রমপুরে। ঠাকুমার
ভাষা আদতে ছিল
রাড়িখালের। আমৃত্যু
সেই ভাষা তাঁদের সাথে
থেকে গেছে। কোলকাতার
বাঙলা তাঁদের মাতৃভাষা
হয়ে উঠতে পারেনি।
বাঁকুড়া-পুরুলিয়া-মুর্
িদাবাদের মানুষের
সাথে নিত্যি মেলামেশা
কোলাকাতার হাসপাতালে।
আমি বলি এই শহরের বাঙলা
ভাষা, তাঁরা বলেন অন্য
অনেক বাঙলা। বুঝতে
বিশেষ অসুবিধে হয় না
কোনো পক্ষেরই। তাই তো
এই সবরকম বাঙলাই আদতে
বাঙলা। কিন্তু তাঁদের
বাঙলাগুলোকে
প্রান্তিক করে দিয়ে
কোলকাতা - নদীয়ার
বাঙলাকে আদর্শ করে
তোলার পিছনে যা আছে, তা
নেহাৎই ক্ষমতা আর
অহং-এর খেলা।
উর্দু সরকারি ভাষা হলে
বাঙলাদেশের কোটি কোটি
মানুষের চরম অসুবিধা
হত। সেই অত্যাচার তাঁরা
সহ্য করেননি। হিন্দি বা
ইংরিজি সরকারি ভাষা হলে
পশ্চিমবঙ্গের বহু
সাধারণ মানুষের একই
অসুবিধে হয়। তা তাঁরা
মেনে নিয়েছেন
অনেকাংশে। ঐ দুটো ভাষাই
জানা থাকার ফলে আমার
মতো মধ্যবিত্ত
সুবিধেবাদীরা এই বিষয়ে
বিশেষ মাথা ঘামায়নি
(ঘামাইনি বলা উচিত)।
কিন্তু লিখতে বসে
ইংরিজি, হিন্দি না জানা
মানুষের তুলনায় নিজের
বাড়তি সুবিধের
ইতিহাসটা অস্বীকার
করতে পারছি না। বাঙলা
ভাষায় পড়াশুনা,
পরীক্ষা, সরকারের কাজ,
বাণিজ্য যত বেশি করা
যাবে, সাধারণ বাঙালির
পক্ষে ততই ভাল। এই ভালর
কাছে না পৌঁছতে পারার
কোনো কারণ নেই।সারা
দুনিয়ায় প্রায় কুড়ি
কোটি মানুষ বাঙলা বলেন।
এই ভাষার সম্ভাব্য
অবলুপ্তি নিয়ে যে আজ
সান্ধ্য চায়ের আসরে
শঙ্কাতুর হচ্ছে শহর
কোলকাতা, সে আমার লজ্জা,
তোমার লজ্জা। হারিয়ে
যাবার ভয় নয়, মাথা উঁচু
করার সম্ভাব্য পন্থা
নিয়েই আলোচনা হওয়া উচিত
ছিল। বাঙলা না জানা
যাদের অহংকার, তাদের
অবজ্ঞা করে অনায়াসে
এগিয়ে যাওয়ার যথেষ্ট
রসদ বঙ্গ-ভান্ডারে
সঞ্চিত। কুড়ি কোটি
মানুষ নিজের ভাষায়
যাবতীয় কাজ করতে পারবে
না?
কিন্তু তার পরেই আসে
সেই প্রশ্ন। কোন বাঙলা?
কোলকাতার বাঙলা
পড়াশুনা বা পরীক্ষার
একমাত্র ভাষা হলে
কোলকাতাবাসী,
কোলকাতাভাষী আমরা
বাঁকুড়া-পুরুলিয়া-কোচব
হারের মানুষের তুলনায়
যে বাড়তি সুবিধে পেয়ে
থাকি, সেটা সর্বভারতীয়
পরীক্ষায়
হিন্দীভাষীদের পাওয়া
সুবিধার সাথে কিছুটা
তুলনীয়। তাহলে কী ভাষার
কোনো স্বীকৃত আদল থাকবে
না? নির্দিষ্ট ব্যাকরণ
থাকবে না? নিশ্চয়
থাকবে। সে থাকবে মার্গ
সঙ্গীতের মতো অসামান্য
সম্মানে, সৌন্দর্য -
সৌধে অমলিন। কিন্তু মা
তো সন্তানকে এত কঠিন
শর্তে মমতা দিতে পারেন
না। মাতৃভাষার এত শর্ত
থাকতে পারে না।
ব্যাকরণঋদ্ধ শুদ্ধ
সুন্দর নাগরিক বাঙলা
সিংহাসনে আসীন হতে
পারে, কিন্তু দীনু
মন্ডলের মাতৃভাষা হতে
পারবে কি? তার মাকে, তার
মায়ের ভাষাকে অবজ্ঞা
করার অধিকার নাগরিক
বাঙালিকে কেউ দেয়নি।
এ তো গেল বাঙলার নিজস্ব
উঠোন। ঠিক উঠোনের বাইরে
সংলগ্ন যে জমিটা আমরা
দখল করে আছি আর অনায়াসে
নিজের বলে দলিল লিখে
চলেছি, তার চোখে বাঙলা
আর বাঙালির চেহারা
কেমন? চাকমা মেয়েটির
মাতৃভাষা কী? ত্রিপুরার
ভূমিপুত্র ককবরক ভাষায়
জেলা - সদরে আবেদনপত্র
জমা দিতে না পারলে ঠিক
কতটা গর্বিত বোধ করত
সরকারি বাঙলার
জন্যে?এখানে বাঙলার রূপ
ইংরিজি-হিন্দী-ফার্সী-উ
র্দুর মতো।
রাষ্ট্রভাষা।
বাধ্যতামূলক ভাষা।
অবদমনকারী ভাষা। এ
আমাদের গর্ব নয়। অন্তত
বাঙলা ভাষাকে এই
ভূমিকায় মানায় না। যে
ভাষা পৃথিবীকে
চিনিয়েছে মাতৃভাষার
মূল্য, সেই ভাষা কি
অন্যের মাতৃভাষাকে
অপমান করতে পারে?
রাজনীতি না বোঝা
ইস্কুল-কালে যেদিন
প্রথম জানতে পারি
সুধন্য দেববর্মা
লিখেছেন ককবরক ভাষার
প্রথম উপন্যাস “হাচুক
খুড়িঅ”, সেদিন বড় আনন্দ
হয়েছিল... বাঙলা ভাষার
বিজয়প্রাপ্তির মতো
আনন্দ। ভালবাসার
আনন্দ। অপেক্ষায় ছিলাম,
কবে তার বাঙলা অনুবাদ
হবে আর সেই বই পড়ব!সেই
অনুবাদ, কী আশ্চর্য,
হঠাৎ পেয়ে গেলাম একদিন।
পড়লাম। আনন্দ পেলাম
অম্লান। এই ভালবাসা
মাতৃভাষা নামক বোধটির
জন্য। এই আনন্দ তার
মুক্তিতে। এই বোধ
বাঙলাই আমাকে দিয়েছে।
আমাদের সবাইকে দিয়েছে।
দুনিয়াকে দিয়েছে।
যে ভাষা ভালবাসা জানে,
সেই ভাষাই ভাল ভাষা।
সেই ভাষা আমার বাঙলা।
সেই ভাষা শীত থেকে
বসন্তের দিকে... বসন্তকে
পেরিয়ে শরতের দিকে
চলেছে বাউল। পৃথিবীর সব
ভাষা শীত চেনে, বসন্ত
চেনে, বর্ষা চেনে।
কিন্তু বাঙলার মতো করে
শরৎ চেনে আর কোন দেশ, কোন
ভাষা?হে প্রণম্য
হুইটম্যান, ঘাসের
একান্ত পাতাদের
মহাকাব্য লিখে আমাদের
অধিকার করেছেন আপনি।
কিন্তু শরৎ লিখতে গেলে
আপনাকেও বাঙলা শিখতে
হবে। অনন্যা বর্ষা
দেখেছেন আপনি। কিন্তু
সদ্যস্নাত আকাশ, মাঠ,
কান্নাভেজাএই নরম রোদ,
ধানের যৌবন, পুকুর-ঘাটে
এই গ্রাম্য বধূ,
কাশফুল... তুমুল কাশের
বুকে লুকোচুরি মেয়েটি...
যে মেঘবালিকা নয়,
আমাদের বাড়ির
লক্ষ্মী-রুমানা... তার
কবিতা বাঙলায় লিখে যেতে
পারলে এমনকি আপনিও
তৃপ্ত হতেন। শরতের
অনুবাদ হয় না।
হে সুতীব্র রিলকে,
জীবনানন্দের মতো করে
হেমন্তকে যদি কেউ চিনে
থাকেন কোথাও কোনোকালে,
সে আপনি। কিন্তু
ব্ল্যাক ফরেস্টে কি
আপনি সেই হেমন্ত
দেখেছেন, যে হেমন্তে
ধানেরা সুবর্ণ হয়? যে
হেমন্তে পাতারা ঝরে যায়
না নিঃশেষ? আমাদের
সন্ধ্যা লিখতে, এই
কুটির লিখতে, এই দুরূহ
ঘোমটা আর সুনিকট মুখ
ছুঁতে... স্নেহ ছুঁতে
হেমন্তের অন্ধকারে
প্রদীপ-আলোয়, আপনাকেও
বাঙলা ছুঁতে হত।
সেই বাঙলা আমাকে জড়িয়ে
ধরেছে স্বয়ং। সেই বাঙলা
তোমাকে জড়িয়ে ধরেছে
অযাচিত। এতই সহজে পেয়েছ
তাকে, ফিরেও দেখনি।
তুমি বিশ্বনাগরিক।
আমিও চেষ্টা করেছি তাই
হতে। ইংরাজি তোমার-আমার
প্রাত্যহিক ভাষা।
আমাদের দোষ দেওয়া যায়
না। উদর বড় দর কষায়।
কিন্তু উদরপূর্তির
পরেই আসে রাত্তির... আসে
নৈঃশব্দ... ভাষাহীনতা।
সেই ভাষাহীন অন্ধকারে
আসে মন খারাপেরা। সেই
রাত্তিরের সত্যি কথাটা
এবেলা বলে ফেলি। যখন
কথা থাকে না,
বাক্যবিন্যাস থাকে না,
তখন আমার বাঙলায় মন
খারাপ হয়। বাঙলায়
হাহাকার আসে। বাঙলায়
একা লাগে। তখন জানতে
পারি কাকে বলে
বিদেশ-বিভুঁই। খটখটে
রোদের দুপুরে আমি
বিশ্বনাগরিক, কিন্তু
ঘুমের ঘোরে নেহাৎ
বাঙালি। আজ পর্যন্ত
ইংরিজিতে স্বপ্ন দেখতে
শিখলাম কই? এই ঘুম থেকে,
এই স্বপ্ন থেকে পালাতে
পারি না। যেতে পারি না।
যে কোনো দিকেই আমি চলে
যেতে পারি না।
যেতে চাই না। কেন যাব?
ভাওয়াইয়া - গম্ভীরা -
রবীন্দ্রগানের মধ্যে
থৈ - থৈ জীবন কাটাব।এই
কাশ - ধান - ঘাসের বুকে
মুখ লুকিয়ে মরে যাব।
কেন মরব অন্যের
বিছানায়? সেদিন যদি শরৎ
না থাকে, শুধু ধু-ধু পড়ে
থাকে ধানকাটা নিঃস্ব
প্রান্তর, তাও সে
কবিতা। এই চূর্ণী -
কালজানি ঘরোয়া রুদালি
ছেড়ে, কোন শিলালিপির
লোভে শেষ-ঘুম অপরকে দেব?