পাখি
কতদিন ডেকে যাচ্ছি
তোকে। শুনতে পাস,
দিনরাত হাহাকারে ডাকি
তোকে দোয়েল, দোয়েল! একা
লাগে খুব। শুনছিস? আমি
বলছি আমার এ-কা লাগে
খুব। কি করে হারিয়ে
ফেললাম তোকে বল তো! সে
যেবার অনেকটা সবুজের
মাঝে আমরা খেলা করছিলাম
আর মা বলছিল, অতটা দূরে
যাসনে, পথ হারিয়ে ফেলবি..
মনে আছে তোর?
সত্যি ঝড় উঠেছিল সেদিন
আর সেই ঝড় শেষে দেখি পড়ে
আছে পথজুড়ে কেবল ব্যথার
পালক। তুই নেই, আর তাই পথ
হারালাম আমি। হারিয়ে
ফেললাম মা-কে। দোয়েল,
তুই আমার মায়ের ঠিকানা
জানিস?
তোমাকে খুঁজতে মা,
পেরিয়ে এলাম আরও কত
উথাল-পাথাল পথ, মা গো
কোথায় তুমি?
না দোয়েল, না তুমি কেউ
আমাকে আর ভোরের গান
শোনাও না। কেবল এক অন্ধ
জাদুকর আজকাল কখনও আমার
পাশে এসে কিছুক্ষণ বসে
যখন, তার ঝুলি থেকে
হঠাৎই বেরিয়ে পড়ে এক
আলো আয়না। সে আয়নায়
আমাকে হাত রাখতে বলে
সেই জাদুকর।
আমার তো দ্বিধার হাত,
কেঁপে কেঁপে ওঠে। সে
কাঁপন থামিয়ে আয়নাতে
রাখি হাত। ধীরে ধীরে
ফুটে ওঠে, সূর্যের লাল,
পাতার সবুজ, আকাশের নীল
আর তার মাঝে জ্বলজ্বল
করে ওঠে আমার
ঐশ্বর্যময়ী মা। কখনও
উঁকি দেয় দোয়েল!
বাড়ির উঠোন জুড়ে দেখি
ছড়িয়ে আছে আমার
বর্ণমালা। মা আর দোয়েল
মিলে সে বর্ণমালার গায়ে
হাত বুলিয়ে দিচ্ছে,
ধুলো মুছে দিচ্ছে।
চোখ উপচে তখন জলের
প্লাবণ।
স্পর্শের বাইরে অথচ
নিয়ত অনুভবে মা এভাবেই,
রোজ রেখে যায় একুশ
আগুনফুল আমার শিথানে।
মাটি
দিনগুলো কী ভীষণ আগুন
ঝরার। রুখুসুখু জমিনে
চিড় ধরিয়ে হা-মুখো
ফাটলগুলোর দিকে
তাকালেই, মন খারাপের
ক্ষণ। এদিকে কিছু মাটি
আমি মুঠোয় ধরতে চাইছি
তখন। চাইছি আদল দিতে
আমার অক্ষর মালার
কিন্তু শুকনো মাটি মুঠো
গলে ঝুর ঝুর ঝুর ফের
মাটির টানে। আর সে তো
খুব সুখের সময়ও নয়।
অনেকদিন ধরে মুখ খুলবার
আগেই মুখ চেপে ধরছিল
যেন কারা। কালো কালো
ছায়া, লালচোখ, ভীষণ
শাসাচ্ছিল।
চোখ থেকে টপ টপ জল ঝরে
রুক্ষ মাটির বুকে। নোনা
সে জল আর কতটুকু তবু
শুষে নিচ্ছিল মাটি, কত
জন্মের তিয়াসে। আহ.. আমি
তখন ভাবছি, রুদ্ধবাক
এইসব দিন আমার ফুরাবে
কবে! বেশি কিছু তো পারি
না। কেবল নিশিদিন চেয়ে
থাকি, কাছে থাকি। মাটির
কাছাকাছি। মাটি আর মা
দুজনের কাছে তো আমার
আজন্ম ঋণ। মা আর মাটি
মলিন হলে তাই বুকে বড়
ব্যথা বাজে। মনমরা হয়ে
মায়ের আশপাশ ঘুরি,
মাটির কাছে হাঁটু মুড়ে
বসি, যদি দুজনের কেউ
একবার তাকায় আমার দিকে।
দূরে অনেকটা দূরে তখন
ঝোপে ঝোপে পাহারা
বসেছে। ভয়ে আমি মা’কে
খুঁজি এঘর থেকে ওঘর।
দেখতে পাই না।
মাটি ঝুরঝুর, মা শূন্য
ঘর..
মাটি ঝুরঝুর, বর্ণমালার
জ্বর
কোথায় তুমি? মা?
আমায় তুমি ধারণ করো আজ..
নদী
ক-র-তো-য়া। ব্যঞ্জনবর্ণ
নদী আমার। ঠিক দুপুরের
পর যেখানে রোদ হেলান
দেয় সেখানটায় বসে আমি
ছাতিমগাছটাকে ভাবি।
রবির ছাতিমগাছ থেকে
বাবার ছাতিমগাছে
দৃষ্টি ফেরাতেই কী
অবাক, কোথা থেকে ভেসে
আসে পোড়া গন্ধ। শ্বাস
চাপ খেয়ে ফিরে যায় ফের
বুকের গভীরে। আকাশের
দিকে মুখ তুলি, বৃত্ত
আঁকছে চিল। ওপরে ওঠার
নিয়ম নেই, ঘুরে ফিরে তাই
নদীর কাছেই আবার হাত
পাতি। জলে রাখি হাত।
জলের মাঝ বরাবর, হঠাৎ
মুখ তোলে মা। জলে তার
তিরতিরে ছায়া পড়ে কেঁপে
ওঠে জলের আকাশ। মাকে
দেখে আমি দু’হাত বাড়িয়ে
ডাকি, জলে কেন মা! উঠে
এসো..
পোড়া গন্ধে বাতাস ভারি
হয়ে ওঠে ফের। চমকে দেখি
মায়ের বিবর্ণ মুখ।
ঠোঁটে চেপে ঠোঁট,
যন্ত্রণা ভোলার কী
প্রবল চেষ্টা। এবার
বুঝে যাই পোড়া সেই
গন্ধের উৎস আমারই মায়ের
পুড়ে যাওয়া শরীর!
গলাজলে দাঁড়িয়ে মা আমার
বিষাদপ্রতিমা, অপলক
চেয়ে আছে আমারই দিকে।
যেন বলতে চাইছে, বাবু,
তুইও ভুলে গেলি শেষে!
মায়ের মুখের পাশে
ছাতিমের ডালগুলো ঝুঁকে
পড়ে অবাক চোখে মাকে
দেখছে আর সে ডালে থেকে
ডালে দুলছে
ব্যঞ্জনবর্ণ, স্বরবর্ণ
পাতা। আমার সমস্ত শরীরে
মিশে যাচ্ছে করতোয়ার
জল। ঝড় উঠছে প্রবল।
দুলে যাচ্ছে আমার
অবস্থান। মায়ের ভাষা
পড়তে চাইছি, মায়ের ঠোঁট
কাঁপছে, চোখ ভরে যাচ্ছে
জলে।
করতোয়া, কই গো এসো! এসো
আজ পোড়াক্ষত বিষাদ
মায়ের সমস্ত ক্ষততে
জলচন্দনের প্রলেপ দিই।
মুছে দিই এসো চোখ থেকে
নেমে আসা জলধারা আর
সমস্ত অপমান।
নুন
ঝিনুকের ভেতর মুক্তো
লুকিয়ে রেখেছে বহুকাল
তার আভা। আর আমি, লুকোতে
চাইছি আজ বুকের বর্ষণ।
জলের ভেতর, এলোমেলো
চুলের ফাঁকে জমে যাচ্ছে
স্ফটিক হিম। আছড়ে পড়ছে
ঝড় আর সেই থেকে চোখের
কোণে জমে উঠছে নুন।
কাঁদতে কাঁদতেই কখন যেন
ঘুমিয়ে পড়ছি। কখন আবার
জেগে উঠে ভাবছি, আধখানা
চাঁদের সাথে তারাটিকে
জুড়ে দিলেই তো হয় আমার
চন্দ্রবিন্দু। অ এ
অজগর, উহুঁ আর কিছুতেই
নয়।
আর আমি, কই একা তো নই! ওই
তো মা আমার, একা একা ঘুরে
ঘুরে গাইছে কি একটা গান
আর আমাকে ঘুমপাহারা
দিচ্ছে। আমি ঘুমিয়ে
গেলে মা’ও কি তবে
কাঁদছিল, নইলে আমার
চারপাশে অমন
বর্ষাধারা।
ও মা, তুমি টুপটাপ অঝোর
ঝরিও না তো আর! দেখো,
আমার বর্ণমালার গায়ে
গায়ে জমা এখনও কত নুন।
রক্ত ঝরার দিন থেকে আজ
অবধি কালচে দাগ বহন করে
চলা অক্ষরমালার এই,
এইখানে- রাখো হাত।
একবার ছুঁয়ে দেখো মা,
আমরা ভুলিনি কেউ...