কল্পমায়া
মালতি ভ্রমরে করে ওই
কানাকানি... হেমন্ত
মুখোপাধ্যায়ের এই গান
আমি মাঝেমাঝেই শুনি।
শুধু এ গান নয়।
নানানরকম গান শুনি।
ইদানীং দুপুরের দিকে
অফিস ফেরতা স্নান
খাওয়ার ফাঁকফোকর এইসব
গানই ভরে রাখে।
আজ দুপুরেও অভ্যাসে
শুনছিলাম গান। হঠাৎ
খটকা লাগলো- মালতি বলে
ওগো মিতা/ আমি যে তোমারই
জানো কি তা... এই মিতা কি
তা অন্তমিল নিয়ে। খেয়াল
করলাম- প্রাণের পরশ দাও
আনি/ তোমারেই জানি আমি
জানি... এই পঙক্তিদুটোও।
আমার শব্দ বিশ্বাস, যদি
কিছু থেকে থাকে আদপেই,
তার সাথে কতখানি খাপ
খায় এইসব পঙক্তি? অথচ
আশ্চর্য এ’ গান খালি
ভালোলাগা, কেবল
ভালোলাগাই নিয়ে আসে।
তুলাদণ্ডে শব্দ
নিক্তির যে অভ্যাস গড়ে
তুলেছি আজ এত বছরে, সে
অভ্যাসে এ গানকে বিচার
করতে পারি না। কেন?
কেনর উত্তর আমাকে এক
শরত দুপুর এনে দিল।
দুপুর প্রায় শেষ, টিনের
চালার ছোট্ট বাড়ির থেকে
রোদ পালিয়েছে।
বারান্দায় ভারী হচ্ছে
ছায়া। চাপা বাতাসে উড়ছে
পর্দা, নতুন পর্দা।
পুজার সময়ই বদল করা
হয়েছে। পাশের এক বিঘৎ
গলি ওই পর্দা ওড়ার
ফাঁকে চোখে আসছে, ঢাকা
পড়ে যাচ্ছে। প্রতিবেশী
বাড়ির কাঁচা ইটের
দেয়ালে আলতো রোদ্দুর।
ছোটো সিঙ্গল বেড চৌকিতে
এক ধোয়া চাদরে চিৎ বা
উপুড় হয়ে দেখা ওই দুপুর
পালানোর দৃশ্য। আর তখন
পাশের ঘরে ছোট্ট তিন
ব্যান্ডের রেডিও বাজছে-
প্রাণের পরশ দাও আনি...
না, কোনও উত্তমকুমারের
পা গুটিয়ে বসে
হারমোনিয়াম টেনে গাওয়া
দৃশ্য নয়। শেষ শরতের এক
মফস্বল দুপুর ফিরে আসে
এই গানের হাত ধরে। অথচ,
গান- চলে আজ সারাবেলা
ফাগুনের খেলা নিয়ে।
কোথায় ফাগুন? আমি এই
গানে সেই মফস্বল শেষ
শরতে ফিরে যাই যখন
শরতের শেষভাগ পুরোপুরি
দখল করে নিত শীত। প্রথম
দুপুরে সদ্য লাগানো
সিলিং ফ্যান একটু আধটু
লাগলেও, যত বিকেলের
দিকে এগোতো দুপুর তত
তিরতিরে এক শীত নেমে
আসতো। সেই তিরতিরানির
মজা আজও খুঁজে পাই
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের
এই গানে। গানে তাই
তুলাদণ্ড ধরতে পারি না।
সুর শব্দের মিল ও বন্ধন
সময় অতিক্রম করে এক
অন্য সময় এনে দেয়
সামনে। এক একটা গান- এক
এক সময়। অর্থাৎ দেখতে
গেলে এটাই মজার হবে
চোখের, যে এক এক গানে
এক-একবার নিজেকে দেখতে
পাবো। নানান বয়সে।
নানান আবেগে, অনাবেগে।
আলো অন্ধকারের শ্বাস
শুনতে পাবো। নক্ষত্র
রাত্রির কেঁপে ওঠা যে
তীব্র শীতে অথবা
সন্ধ্যা যখন ঘরের জমা
জলে মুখ দেখত প্রদীপে-
সে বর্ষা দেখতে পাবো।
এ মজা নিজের সাথে নিজের
মজা। গান- গানের হাত ধরে
মনের ঘর বারান্দায়
ঘুরঘুর। এ জানালা, সে
জানালা উঁকি। এই মজা যে
কোনওদিন, যে কোনও সময়
করে দেখবো। এক বাঁচায়
বহু বাঁচা নেবো। কাল
হয়তো অন্য গান- অন্য
গল্প।
কাল
মজা বললাম। আসলে বিষয়
ঠিক মজা নয়। অকিঞ্চিৎকর
মানুষ, সাধারণ মানুষ,
রবি ঠাকুরের ভাষায় ছোটো
প্রাণ মানুষের যাপন
সঙ্কট হয়তো এখানে- অতীত
তাকে ছাড়ে না, বর্তমানে
সে যেখানে পৌঁছাতে
চেয়েছিল তার ধারেকাছে
সে পৌঁছায় না। সে শুধু
আরও তীব্র ভবিষ্যতে
বিশ্বাস করে। লটারি-
মাদুলি- দৈব- উৎকোচ;
সম্ভাব্য- অসম্ভাব্য
সমস্ত ন্যায়- অন্যায়
পন্থা মাথায় ঘুরে
বেড়ায়। সে পৌঁছাতে চায়
কোথাও। সেই অনাদি থেকেই
সে চায় নিশ্চিত কিছু।
কিন্তু নির্দিষ্ট
নিশ্চিন্ত বলে কিছু
নেই। শুধু চাহিদাই আছে।
আর এই তীব্র চাহিদাই
একসময়ে হয়তো তাকে পিছু
ডাকে জড়িয়ে দেয়। আশাহীন
বর্তমানের হাত ছেড়ে সে
পিছু ফেরে। এক সদ্য
বর্ষা থামা সন্ধ্যায়
হাতের তালি মারা ছাতা
গুটতে গুটতে রাস্তায়
জমা জলে পা নামিয়ে অন্য
দিনের মতো সে শহরের
নিকাশি ব্যবস্থার
বাবা-মা উদ্ধার করে না,
হঠাৎ ভাবে শৈশবের জমাজল
দিনগুলোর কথা, সেই জল
ছিটিয়ে ধাঁ দেওয়ার মজা
এই স্যাঁতস্যাঁতে
নোংরা জলকেও তার পায়ে
সহনশীল করে তোলে। বড়জোর
ভাবে শৈশবের জল আরও
পরিষ্কার, ঠাণ্ডা ও কি
যেন ছিল...
আমার এই খেলাও সেই কি
যেন খোঁজার খেলা। আজ পথ
চলতি দোকানে শুনলাম-
ভালোবাসার আগুন জ্বেলে
কেন চলে যাও... লতা
মংগেশকর। যতদূর জানি
সুর কিশোর কুমার।
সর্বনাশের মাতাল কলি
শুনলাম। দাঁড়িয়ে পড়লাম
দোকানের সামনে। মেঘ
ভাঙা রোদে গরম লাগছে
যদিও তবু দাঁড়িয়ে
পড়লাম। বিজবিজে ঘামের
অস্বস্তির পুরনো দিন
মনে পড়ার একটা সুখ
পেলাম। স্বস্তি নয়।
অস্বস্তিই। তবে পুরনো
তো। তাই সুখের
অস্বস্তি। হাতার
চৌহদ্দিতে চা দোকান
একটা। বেঞ্চে বসে
গেলাম। একটা চিনি ছাড়া
দুধ, এইটুকু বলেই
অস্বস্তির সুখে ডুব
মারলাম।