খাটটা ছোট, পাশ ফিরতে
গেলে স্বপ্ন থেকে ছিটকে
বেরিয়ে আসে হাত পা নখ,-
খাটের বাইরে। স্বাতী
পাশের খাটে ঘুমিয়েছে
অনেকক্ষণ হল। ওর ঘুম
আসে। আমার ঘুম নেই।
পাশ ফিরলাম।
হালকা নীল দেওয়ালে
মেয়েরা নিজেদের নাম
লিখে গেছে। নাম ছাড়াও
আরো অনেক রকম কিছু লেখা,-
মেয়েদের ইতিহাস। যেন
লিখে ফেলতে পারলেই থেকে
যাওয়া যাবে। অথচ এখানে
কিছুই থাকে না। পি জি
গুলো পৃথিবীরই
মিনিয়েচার। জানলা দিয়ে
কাঁচ চুইয়ে আসা আকাশের
কিছুটা ঘরের ভিতর এসে
পড়ছে, যেন পাশ ফিরেছে,-
ঘুম নেই বলে।
তীব্র কাঁচ ভাঙার
শব্দে
পাশ ফিরলাম।
পাশের ঘরের মেয়েটার
ব্রেক আপ চলছে, রোজই
কাঁচ ভাঙছে বার তিনেক।-
মাঝরাতে। এসব সময় আমি
শান্ত হয়ে আসি, কিছু
ভাবি না। মেয়েটার
গোঙানি আমায় জাগিয়ে
রাখে। আমি আর গোঙানিটা
পাশাপাশি শুই। আমাদের
সঙ্গম চলে মিনিট পনেরো।
গতবছর বাপ্পাই যখন আমায়
ছেড়ে গেল, তখন থেকেই
গোঙানির সাথে আমার এই
ফ্রেন্ডস উইথ বেনেফিটস
রিস্তেদারি। (এক এক সময়
গোঙানি ছাড়া আর কোনো
কাঁধও থাকেনা, যেখানে
মাথা রেখে ঘুমানো যায়।)
মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে
লবিতেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
আমি
পাশ ফিরলাম।
“তোমার ঘুম আসেনা
কেন?”
“কে জানে?”
“সত্যি বলো!”
“আমি জানিনা...”
“কিছু তো কারণ আছেই,”
“কি কারণ?!”
“ঘুম পায় না, নাকি কষ্ট
করে জেগে থাকো?”
“ঘুম পায়, কিন্তু ঘুম
পাই না।”
“মানে?”
“কিছু না।”
“শোনো, বালিশের নীচে
ছুঁড়ি, কাঁচি... যে কোনো
লোহার জিনিস রেখে
শোবে”
“কী হবে তাতে? ঘুম
আসবে?”
“আমাদের ওখানে যে সব
বাচ্চারা ঘুমের মধ্যে
দুঃস্বপ্ন দেখে, তাদের
বালিশের নীচে এগুলো
রেখে শুতে বলা হয়, তাতে
খারাপ খারাপ স্বপ্ন আর
আসেনা।”
“অঞ্জলী...”
“কি?”
“আমি স্বপ্ন দেখি না।”
পাশ ফিরলাম।
বাইরের গাড়ির আওয়াজ
অনেক কমে এসেছে। রাস্তা
থেকে কুকুরের চিৎকার আর
ঘুম হেঁটে যাওয়ার শব্দ
শুনতে পাচ্ছি। একেকটা
ঘুম একেকটা বিল্ডিঙে
এসে একেকটা মানুষের
মাথার মধ্যে ঢুকে আসছে।
মাথার মাপে মাপে
মানুষের ঘুম। আমি গুণতে
গুণতে ঘুমানোর চেষ্টা
করি। ঘুম ১, ঘুম ২, ঘুম ৩...
ঘুম ২৩, ঘুম ২৪... ঘুম ৮৬,
ঘুম ৮৭, ঘুম ৮৮... আমার
খাটের পাশে মানুষের
ঘুমেরা জমে জমে পাহাড়
হয়ে যায়, সেখানে আমার
মাথার মাপের কোনো ঘুম
নেই।
হঠাৎ মনে পড়ল, বছর তিনেক
আগে নিজের খাটে শুয়ে
শুয়ে বাপ্পাই “তোর ঘুম
খেয়ে নিলাম” বলেই শুষে
নিয়েছিল সমস্তটা। ঘুম
কি তাহলে... ওর ভিতরেই
ফেলে এসেছি! ফোন তুলে
বাপ্পাইয়ের নাম্বার
ডায়াল করি, ফোন বেজে
বেজে থেমে যায়।
বাপ্পাই ঘুমোচ্ছে।
আমি পাশ ফিরি।
স্বাতী ঘুমের মধ্যেই
বলে ওঠে “সোয়ি নহি?”
আমি কিছু বলে ওঠার আগেই
বলে, “সো জাও”
স্বাতীর পা দুটো খাটের
বাইরে ঝুলছে। মেঝেতে
সেই পায়ের ছায়া
জন্মিয়েছে। পা থেকে টুপ
টুপ করে চুঁইয়ে পড়ছে
ঘুম। আমি লোভীর মত
স্বাতীর পায়ের দিকে
তাকিয়ে থাকি।- লম্বা,
উত্তেজক, রোমহীণ, ঘুমে
ভেজা মসৃণ পা। আমার মুখ
থেকে লাল ঝরে পড়ে। আমি
খাট থেকে নেমে এসে
স্বাতীর পায়ের কাছে
দাঁড়াই। একটু ঝুঁকে পড়ে
দুই হাত দিয়ে ভীষণ জোরে
আঁকড়ে ধরি স্বাতীর ঘুম,
টেনে হিঁচড়ে তাকে
স্বাতীর পায়ের থেকে
আলাদা করার চেষ্টা করতে
থাকি। স্বাতীর ঘুমের
সঙ্গে আমার এই লড়াই চলে
বেশ কিছুক্ষণ। অবশেষে
স্বাতী ঘুমের মধ্যেই
বলে ওঠে, “নিন্দ আয়ি?”
আমি জবাব দেওয়ার আগেই
আমার খাট থেকে কে যেন
জড়ানো গলায় বলে দেয়,
“আয়ি”
-কে?
অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে
আমি আমার খাটের দিকে
এগিয়ে যাই, দেখি, আমার
জায়গায় শুয়ে আছে আমার
ঘুম। তার হাত, পা, নখ
বেরিয়ে আসছে স্বপ্ন
থেকে। আমি খাটের পাশে
দাঁড়িয়ে থাকি, আমার
ঘুম
পাশ ফিরে শোয়।