কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে
কোনো আন্দোলনকে সে
অর্থে রাজনৈতিক
আন্দোলন বলা যায় কি?
যাদবপুরের ছাত্রীটির
শ্লীলতাহানির তদন্তের
দাবিতে গড়ে ওঠা
আন্দোলনে পুলিশ, গেঞ্জি
পুলিশ লাঠি না চালালে,
সবাই জানি, বিষয়টা এ
জায়গায় পৌঁছতো না। সারি
সারি প্রতিবাদে দৃপ্ত,
বৃষ্টি উপেক্ষা করে
শক্ত চোয়ালে এগিয়ে যেতে
থাকা মুখ দেখতো না
রাজপথ; দেখতো না
রাজতন্ত্রের বিপন্ন
আগ্রাসী দার্ঢ্যের
সামনে হাতে হাত সুরেলা
মানববন্ধন।
বৃষ্টি-ভেজা দেশলাই
আমার থেকে চেয়ে যখন
সিগারেট ধরাতে যায়
যাদবপুরের অচেনা
ছাত্রীটি, মিছিলের
সামনের দিকের গাড়িতে
তখন প্রাণপাত গেয়ে
চলেছেন ‘ব্যর্থ
প্রাণের আবর্জনা
পুড়িয়ে ফেলে আগুন
জ্বালো!’ মেয়েটি
ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘দূর শালা!
একে জলে ভিজে দেশলাই
জ্বলছে না, তার মধ্যে কে
বে তুই আগুন জ্বালো!’
স্বভাবতই সেই
প্রতিবাদী গায়কের কানে
পৌঁছয় না কথাটা।
কিন্তু, এই
মন্তব্যগুলোর নিরিখে
প্রতিবাদকে খাটো করে
দেখেন কেউ কেউ। যেমন
দেখেন মেয়েটির সিগারেট
খাওয়ার নিরিখে, বা
পৃথিবীর যাবতীয়
নিষিদ্ধ মারণ নেশা
প্রেসিডেন্সি
যাদবপুরে হয়, সেই
ঈর্ষাকাতর
বিচারপ্রবণতায়। আদতে
ওই মন্তব্যটি
আন্দোলনের নিজস্ব
গ্রামার। রাজনীতি হয়তো
বৃহত্তর অর্থে সব
ক্ষেত্রেই হয়, কিন্তু
ঠিক যেভাবে রাজনীতি
বলতে আমরা যা কিছু বুঝি,
ছাত্রছাত্রীর
দাবিদাওয়া-ভিত্তিক
আন্দোলন তার আওতায়
সবসময় পড়ে না। পড়ে না
বলেই এই আন্দোলনের
পথচলতি ব্যাকরণ
প্রচলিত রাজনৈতিক
ব্যাকরণের শিংগুলোকে
উপড়ে দেয় অনায়াসে। আবেগ
এখানে মূল মন্ত্র,
যুক্তি এখানে আবেগের
অনুসারী। এদের কেউ হয়তো
‘রঙ্গ দে বসন্তি’-কে
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ
রাজনৈতিক ছবি মনে করে।
কেউ পালটা মারের কথা
বলে কথায় কথায়। মিছিলে
নিছক গড়িয়াহাটের
ফুটপাথের সঙ্গে
অনায়াসে সমগোত্রীয়
মহার্ঘ্য লিভাইস। কেউ
হয়তো যাবার পথে
বন্ধুদের সঙ্গে একবার
ঢুঁ মারবে সিসিডি-তে।
দিনটা অন্যরকম।
ফেসবুকে সরল প্রোফাইল
পিকচারে প্রাণ ভরবে না
আর। কিন্তু, এ সবই ওই
আবেগের কাছে গৌণ। যেমন
গৌণ হতে পারে বিগত
শাসকের হাস্যকর
নিষ্প্রভ দরদী সাজার
ক্লান্তি ভরা
প্রচেষ্টা।
‘অকল্পনীয়’,
‘শিক্ষাক্ষেত্রের
রাজনীতিকরণ’ আরো কতো
বস্তাপচা শব্দ! যেন
শব্দগুলো নতুন ঝুলি
থেকে বেরলো, এমন
চোখগোল্লা অবাক ভাব
দেখানোর মরিয়া বোকামো।
অথচ ২০০৫ যাদবপুর হয়,
অথচ ৬ই জানুয়ারি
প্রেসিডেন্সি হয়, অথচ
কতো শত ‘ছোটো ঘটনা’
সেকালেও হয়েছিলো এলিট
শিক্ষাঙ্গন যার খবর
রাখেনি। ক্রমশ কোপ পড়ার
সম্ভাবনা ‘ঘেরাও’
ব্যাপারটির ওপর।
‘ঘেরাও’ ছাত্রসমাজের
এক চিরন্তন
প্রকাশভঙ্গি। তাকে
আটকায় সাধ্যি কার!
বুদ্ধিজীবী মিছিলের
বিষয়গুলো আবার একটু
আইডিয়ালাইজড।
‘শিক্ষাক্ষেত্রে
শান্তি ফিরুক’, ‘সবাই
ভোট দিতে পারুক’
ইত্যাদি প্রভৃতি। আরে
ভোট দিয়ে কী রামরাজত্ব
হবে ঠিক নেই, ভোট দিতে
পারুক! এ-ও আসলে এক
পপুলিস্ট ন্যাকামো,
ছাত্রদের মিছিল যা থেকে
আলাদা। আবেগ এখানে
সর্বগ্রাসী, কিন্তু
ঋজুতা, সারল্য, সততা
এখানে সপাট। জনপ্রিয়
হবার তাগিদ তাদের নেই,
আর ওই একদিনের জন্যে সব
ভুল ভুলে মেরে দেবে,
দেবে না একটাও খিস্তি,
মেয়েরা সিগারেট ছোঁবে
না, ছুঁলেই আন্দোলন
‘ভুল’, কে বললো!
ভুল শুধু একটাই হতে
পারে, হতে পারতো- ২০০৫-এর
যাদবপুর ভুলে গেলে। এক
প্রতিষ্ঠিত
শৃঙ্খলাসর্বস্ব
‘রাজনৈতিক’ ছত্রছায়ায়
আশ্রয় নিলে।
স্বতঃস্ফূর্ততার
বিপ্রতীপে ‘যাদবপুরে
বহিরাগত ভিসি’-র
বিরুদ্ধে হাঁটতে বাধ্য
করা ‘ছাত্র’দের পালটা
মোচ্ছব মিছিলকে নেহাত
খিল্লি করলে ভুল হয়।
এখনো তারা শাসক; আর
শাসকের একটা নিজস্ব
জোরালো আবেদন, এক কুহক
সমাজমননকে আচ্ছন্ন করে
প্রতিনিয়ত। সেটা নিছক
মজার ব্যাপার নয়। আর নয়
বলেই নম্র
ক্ষমাপ্রার্থনার
পরিবর্তে উদ্ধত
মিছিলের পালটা
চোখরাঙানি, লাইট ভেঙে
পুলিশ ঠ্যাঙানোর
তত্ত্ব। অবিরত
মিথ্যাচার, কারণ অপর
পক্ষ আবেগস্নাত,
কমবয়সি। প্রকাণ্ড
মিথ্যাজাল, ভোটাররাও
জানে, তবু ‘অচ্ছে দিন’
যেভাবে আসে, দু লক্ষ
কর্মসংস্থান যেভাবে
আলাদিনের প্রদীপের
মন্ত্রবলে নিমেষে হয়,
তেমনই এই মিথ্যের
আতিশয্যে একটা ভুলের
অপেক্ষায় তারা। কারণ,
অপর পক্ষ অস্ত্রহীন
ছাত্রছাত্রী। আবেগের
নিজস্ব লালিত্য যেন এই
মায়াজালে ফিকে না হয়।
আন্দোলনের সবচেয়ে বড়ো
ভুল হবে সেটা। মন এবার
যুক্তি আঁকড়ে ধরুক,
মেধা পুরোদমে
যুক্তিকাঠামোয় ভরসা
রাখুক। মিথ্যে, মিথ্যে,
মিথ্যে, ভোটাররাও
জানেন। কিন্তু একটা
প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক
দল, একটা পালটা মারের
অন্তঃসারশূন্যতা, একতা
যুক্তি-গুবলেট রঙ্গ দে
বসন্তি প্রতিক্রিয়া, আর
অমনি পালটি খাবে
সচেতনতা। ‘পড়তে গেছিস
পড়্ না বাপু, রাজনীতির
কী দরকার!’, ‘পরীক্ষা না
দিয়ে, ক্লাশ না করে মদ
সিগারেট খাওয়ার কী
দরকার!’
যুক্তিহীনতার
বিরুদ্ধেও যুক্তিই
আসলে সব। আন্দোলনের
নিজস্ব ব্যাকরণ
ভুলক্রমেও যেন এটা না
ভোলে।