সেই রাতগুলো আমাকে
অমরত্বের স্বপ্ন
দেখিয়েছিল
সেই দিনগুলো কেড়ে
নিয়েছিল আমার শান্তির
ঘুম
তারপর কেমন জানি সবটাই
রাত হয়ে গেল
তারাখসা ছুঁয়ে গেল
শীতঘুমে নিঃঝুম ...
এলোমেলো পায়ের ছাপ
ফেলতে ফেলতে কখন হঠাৎ
হাঁটতে শিখে গেল সব্বাই
। সূর্যটা ছিল কেন্দ্রে
। আর পৃথিবীটা , ঘুরছে তো
ঘুরছে তো ঘুরছেই ,
লাট্টুর মত । পণ্ডিতরা
বললেন পৃথিবী স্থির ,
বাকি জগতটা ঘুরছে । সে
দূরবীন তুলে বলল , কোই না
তো ! এসব কি বলছেন আপনারা
? উপড়ে ফেলা হল তার চোখ ।
তারপরও সে চিৎকার করে
বলতে লাগলো ,পৃথিবীটা
ঘুরছে ঘুরছে , সূর্যের
চারপাশে ঘুরছে ... তারপর
হুমকি দেওয়া হল জ্যান্ত
জ্বালিয়ে দেবার । দাবী
এলো স্বীকার করো
পৃথিবীটা স্থির , সূর্য
একে ঘিরে ঘুরছে । এবার
সে ভয় পেয়ে গেল । পা
টলছিল , তাও শেষবার বলে
গেল – আমি না বললেও
পৃথিবীটা ঘুরছে ।
পৃথিবীর ঘোরার মতই
সত্যি ছিল শাসকের লাল
চোখ । সেই চোখ দেখেনি এ
বাংলায় , এ ভারতে এমন লোক
খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ।
দেখেছে মানুষ সেই
কবেকার বেদের যুগ থেকে ,
তারও আগে হরপ্পায় ।
মানুষ বাঁধা পড়েছে
নিয়মের আবর্তে আর বড় বড়
স্নানাগারের পাশে শোভা
পেয়েছে ছোট ছোট কুঁড়েঘর
। পেট ভরা খিদে আর মাথা
ভরা অপমানের বোঝা মানুষ
বইতে শিখেছে
সহিষ্ণুতার সাথে । সেই
সহিষ্ণুতার নাম হয়েছে
আইন , আর সমাজ পেয়েছে
স্বীকৃত বিভেদ , নারী
পেয়েছে ভোগ্য হবার রায় ,
কর্মী পেয়েছে শ্রম –
মজুরির শিকল । সেই সব
টুকরো টুকরো
শৃঙ্খলগুলো ক্রমশ চেপে
বসেছে মানুষের গলায় ।
কখনও হার , সিঁদুর , শাখা ,
বোরখা হয়ে , কখনও
কারাগার , ফাঁসি ,
ফায়ারিং স্কোয়াড ,
গ্যাস চেম্বারের মধ্যে
দিয়ে । আর মানুষের
যন্ত্রণা কান্না
প্রতিবাদ একলা একলা
হারিয়ে যেতে থাকে ।
অথবা অন্ধকারে , শীতে ,
বৃষ্টিতে অথবা কুয়াশায়
জমাট বাঁধে গর্ভধারিণী
কোন দশকের যন্ত্রণায় ।
তারপর তারাখসার ছোঁয়া
লেগে বিস্ফারিত হয় কখনও
কখনও । বেদনা যন্ত্রণা
এসব আর একলার থাকে না ,
মেলে প্রতিবাদে –
প্রতিরোধে – জেগে ওঠে
কলরব ।
যাদবপুরের কলরব
বিষয়টা এমন নয় যে কলরব
এই প্রথম । যাদবপুর
বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌবন
কলরব করেছে সেই কত যুগ
আগে থেকে । সন্ন্যাস
নেওয়ার আগের অরবিন্দ
ঘোষ , যার হাতে তখন
অগ্নিযুগের বারুদের
ঘ্রাণ , সেই হাতে
জন্মানো এক
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ।
তাই হয়তো ধাতে নেই মাথা
নিচু করা । গল্পে শোনা,
খাদ্য আন্দোলনে নীরব
থাকায় যাদবপুরের
ছাত্রছাত্রীদের
উদ্দেশ্যে চুড়ি উপহার
পাঠিয়ে ছিলেন
প্রেসিডেন্সীর
পড়ুয়ারা । বিষয়টার
মধ্যে মানবিক আবেগের
পাশাপাশি
পিতৃতান্ত্রিক
দৃষ্টিভঙ্গির ছাপ মিশে
ছিল সন্দেহ নেই , কিন্তু
তারপর ? যাদবপুরের
ছাত্রছাত্রীদের সাথে
মিলিটারির সংঘর্ষ ,
ব্যবস্থা বদলের লড়াই ,
গ্রাম অভিযান , আশু
মজুমদার , তিমিরবরণ
সিংহের শাহাদাত এবং
তারপরও থেমে নেই । বাম
শাসনের ৩৪ বছরে যাদবপুর
ইউনিভার্সিটির মেন
হোস্টেল এবং
ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ
ছিল শাসক দলের
দলতন্ত্রের বাইরে
দাঁড়িয়ে থাকা
দুর্ভেদ্য ঘাঁটি । ফলে
অন্যান্য কলেজ –
বিশ্ববিদ্যালয়ের
তুলনায় যাদবপুরে
ক্যাম্পাস গণতন্ত্রের
মাত্রা বহুগুণে বেশি
এবং খোলামেলা । কিন্তু
যাদবপুরের সংগ্রামী
মেজাজ অব্যাহত থেকেছে
দশকের পর দশক ।
ক্যাম্পাসের ভিতরে বা
বাইরের সামাজিক
অন্যায়ের বিরুদ্ধে
রুখে দাঁড়ানোর কলরব
শোনা গেছে ধারাবাহিক
ভাবে । এমনকি এই শতকে
২০০৫ এ , ২০১০ এ ,
সিঙ্গুরে , নন্দীগ্রামে
। তাই যাদবপুর থেকে ১৭ই
সেপ্টেম্বর মাঝরাতে
পুলিশের ও শাসকদলের
গুণ্ডাদের
ছাত্রছাত্রীদের উপর
নামিয়ে আনা বর্বর
আক্রমণের বিরুদ্ধে
যাদবপুর থেকে যে কলরব
উঠলো , তা কিন্তু নতুন নয়
। বরং এবারের কলরব
ছাড়িয়ে গেল
ক্যাম্পাসের সীমানা ,
‘বহিরাগত’ জগতেও সে
আওয়াজ পৌঁছল , এবং কেঁপে
উঠলো ইন্টারনেট , কেঁপে
উঠলো রাজপথ । আক্রান্ত
যাদবপুর নয় , প্রতিরোধী
যাদবপুরের পাশে
দাঁড়ালো
ছাত্রছাত্রীদের একটা
বিশাল একটা অংশ এবং আরও
আরও অনেক ক্ষেত্রের
মানুষ । এই কলরব সুযোগ
করে দিল সকলের
যন্ত্রণার সাথে সকলের
যন্ত্রণাকে জোরবার ।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে একে
অপরের পাশে দাঁড়ানোর ।
কর্তৃপক্ষের লাল চোখের
বিপরীতে সত্যকে
বাঁচিয়ে রাখার । আর
হ্যাঁ ক্যাম্পাসের
মধ্যে বা বাইরে
স্বাধীনতার প্রশ্নকে
সোচ্চারে তুলে ধরার ।
আন্দোলন কেন হয় ?
এ বাংলার মাটি এত
অনুর্বর ছিল কই ?
উর্বরতা এর রন্ধ্রে
রন্ধ্রে । সেই
অগ্নিযুগের সময় কিংবা
তারও আগে কৃষক জনতার
প্রতিরোধ । তারপর
শ্রমিকশ্রেনীর
সংগ্রাম । বাংলার মাটির
উর্বরতা বেড়েছে ,
স্বাধীনতার আগে পরে ।
নিয়ম ভাঙার ও ন্যায়
প্রতিষ্ঠার লড়াইতে
বাংলা পিছু হঠে নি কখনও
। অনেক ভুল আর ঠিকের
মাঝখানে দাঁড়িয়েও পাঁচ
, ছয় , সাত বিগত শতকের এই
তিন দশক মানুষকে
দেখিয়েছে স্বাধীনতার
স্বপ্ন , ভালবাসার
স্বপ্ন , লাল চোখ হীন
একটা সমাজের ভাবনা ।
কিন্তু আটের দশক থেকেই
বোধহয় মানুষের দুঃখ
যন্ত্রণার
এলাকাভিত্তিক বা
একান্তই একাকী হবার
সূচনা । একটা বিশাল বড়
বাজার । তার সবটাই খোলা
। আর তার বিশাল বড় হাঁ-এর
মধ্যে সবাই আটকে গিয়ে
সবাই আরও একা হয়ে যায় ।
নয়ের দশক শূন্য দশকের
শুরুটা এভাবেই চলছিল ।
কিন্তু বাধ সাধল
সিঙ্গুর । একটা
সিঙ্গুরের প্রতিরোধ
একসাথে করে দিয়েছিল
বাংলার মানুষের এত
বছরের এত বছরের জমে
থাকা রাগ , অভিমান ,
যন্ত্রণা , আর
স্বাধীনতার প্রশ্নকে ।
বাংলার মানুষ দিকে দিকে
লড়তে শুরু করেছিলেন
দলতন্ত্রের বিরুদ্ধে ,
স্বাধীনতার দাবীতে ,
এমন একটা বাংলার
স্বপ্নে যেখানে
গণতন্ত্র মানে শাসক দল
ও প্রশাসনের লাল চোখ
শুধু নয় , বছর বছর ভোট
দেওয়া শুধু নয় , থাকবে
স্বাধীন মত প্রকাশের
স্বাধীনতা , থাকবে
মানুষের প্রতি মানুষের
সম্মান । সে লড়াইতে
ছাত্র সহ চিন্তাবিদরা
রাস্তায় নেমেছেন ,
আক্রমণ এসেছে , এবং
ক্যাম্পাসগুলোতেও
দেখা গেছে দলতন্ত্র
বিরোধী লড়াই । সরকার
বদলেছে । বদলায় নি
দলতন্ত্র , বদলায় নি
শাসকের লাল চোখ । বরং
বিচ্ছিন্নতা বেড়েছে
মানুষের , বেড়েছে
হতাশার ভাব । কিন্তু সব
কিছুর মধ্যেও কোথাও
বেঁচে ছিল সেই সুপ্ত
স্বাধীনতার আকাঙ্খা ।
ক্যাম্পাসগুলোতে
দলতন্ত্রের বোঝা একই
ভাবে গেঁড়ে বসলেও
যাদবপুর ,
প্রেসিডেন্সীর মত কিছু
ক্যাম্পাসের বাইরে
ন্যায়ের জন্য
সংগ্রামের প্রশ্ন দমে
গেছিল বেশ কিছু সময়
যাবত । যাদবপুরের লাঠি
চার্জের ঘটনার পর দমে
যাওয়া সাধারণ কলেজ বা
প্রাইভেট
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের
ছেলে মেয়েরাও ভয় কাটিয়ে
প্রতিরোধে সামিল হতে
চেয়েছে । কারণ
ক্যাম্পাসে মাত্র নয়
সমাজের গর্ভেও সত্যের
সন্ধান , মানবিকতার
সন্ধান , স্বাধীনতার
সন্ধান , রক্ত চক্ষুকে
উপেক্ষা করে অধিকার
অর্জনের সন্ধান বেঁচে
ছিল বিচ্ছিন ভাবে । তাই
সুযোগ ছিল মিলে যাবার ,
অন্তত ২০ শে
সেপ্টেম্বরের মিছিল
সেই ইঙ্গিত দিয়ে যায় ।
প্রশ্নগুলো কলরব করুক
না আমাদের সাথে
স্বাধীনতা মাঝরাতে চায়
লাঠির আদর বন্ধ আলো
স্বাধীনতা সকাল বেলায়
এলো রাস্তায় ঘুম ভাঙাল
প্রশ্নরা ছিল শিরদাঁড়া
হয়ে , কলরব ছিল বাঁধ ভাঙা
ঢেউ
হুমকি শাসক – গেঞ্জি
শাসক ভয়েতে দুচোখ খুলল
না কেউ
চোখ খুলেছিল কলরবে যারা
স্বাধীনতা ছিল ঘর বাড়ি
দেশ
প্রশ্নরা ছিল শিরদাঁড়া
হয়ে হৃদয়ে তখন রক্তের
লেশ
হল কলরব এলো আদালত
কমিটি আসলো ,দমাবেই
যারা
হোক কলরব তবু জনগণ
প্রশ্ন কোথায় , সেই
শিরদাঁড়া ??
আচ্ছা আমরা ২০ তারিখ
রাস্তায় হেঁটেছিলাম
কেন ? তার আগে বা পরের
প্রতিটা মিছিলে ?
প্রতিটা নিঃশ্বাসে
আমরা যখন সুবিচার
চেয়েছিলাম ? অথবা এসবের
আগে , নন্দীগ্রামে ,
সিঙ্গুরে , আমাদের
কলেজে কলেজে দলতন্ত্র
আর পুলিশী রাজের
বিরুদ্ধে , কামদুনী ,
গেদে তে মহিলাদের উপর
সমস্ত রকমের অন্যায় ও
আক্রমণের
প্রশ্নগুলোকে সামনে
রেখে ? আর সেই সব
প্রশ্নগুলো ২০ তারিখের
মিছিলে আমাদের ভিড়ে
আমাদের সাথে রাস্তায়
হাঁটেনি কি ? আক্রান্ত
মাত্র নয় আমরা
হেঁটেছিলাম প্রতিরোধী
যাদবপুরের পাশে , তার
সাথে । আর সেই সময় যারা
সেই মিছিলকে ভয় পেয়েছিল
তারা বোধহয় আমাদের
মধ্যে দেখেছিল
স্বাধীনতার জেদ । আর
সেই জন্য ভয় পেয়েছিল ।
কেউ পেয়েছিল ভোট
হারানোর ভয় , কেউ বা
সুযোগ খুঁজছিল ভোট ধরার
। কিন্তু সেসবের বাইরে
সমস্ত কর্তৃপক্ষ এক হয়ে
গিয়েছিল আমাদের চোখের
বাইরে । আদালতের রায় ,
সরকারের কমিটি আর বাকি
কিছু প্রচার যন্ত্র
মিলে ঢেকে দিতে চেয়েছে
স্বাধীনতার –
গণতন্ত্রের – মেয়েদের
অধিকারের
প্রশ্নগুলোকে ।
ছাত্ররা হয়েছে বহিরাগত
আর নিরাপত্তা বাহিনী
হয়ে অবতীর্ণ হয়েছে সেই
উর্দিধারী পুলিশ । তা
সত্ত্বেও এক একের পর এক
মিছিল একের পর এক কলরব
উঠেই চলেছে , এমনকি
ভারতের পরিধি ছাড়িয়ে
গোটা দুনিয়ায় । কিন্তু
প্রশ্নগুলো আমাদের
সকলের প্রতিটা মার
খাওয়ার , প্রতিটা
অত্যাচারের আর প্রতিটা
প্রতিরোধের ? সেগুলো
কোথাও কলরবের ভিড়ে
হারিয়ে যাচ্ছে না তো ?
হারিয়ে যাচ্ছে না তো
ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো
লক্ষ কোটি মানুষের
স্বাধীনতার প্রশ্ন এই
কলরবে ? আচ্ছা এই এই
প্রশ্নগুলোকে
শিরদাঁড়া করে সত্যিই কি
হাতে হাত রাখতে পারি না
আমরা ?
ভূমিকার পর
তারাগুলো খসে গেলে বাকি
থাকে হাত
আঁকড়ে ধরার মত জোর ছিল
তাই
পৃথিবীটা ঘুরে চলে
নিজের গতিতে
সূর্যের আলো ছুঁয়ে ভোর
এঁকে যাই
তারপর ব্রুনোর দিকে
আগুন ছুঁড়ে দিল ।
জ্যান্ত দাহ হবার সময়
ব্রুনো মনে মনে আহ্নিক
গতির আঁক কষছিলেন । এক
মুহূর্তে মনে হল সত্যের
শেষ আজ কিনা । ব্রুনো
চোখ খুললেন । আগুনের
লাল আভায় খুঁজে পেলেন
একটা দাঁড়িওয়ালা উদ্ধত
মুখ - ক্রুশে গাঁথা
শরীরখানা । ব্রুনো
সত্যের দিব্যি কেটে
ভবিষ্যতের দিকে চাইলেন
। কয়েক প্রজন্ম আর
গোলার্ধ পেড়িয়ে দেখতে
পেলেন আর এক দাঁড়িওয়ালা
মানুষকে । গুলি খাবার
আগে তিনি বলে চলেছেন
তার দেশের নাম কিউবা ,
রাশিয়া , বলিভিয়া , চীন ,
কঙ্গো , ভারত ...। তাহলে
আগুনের ওপারেও পৃথিবী
সূর্যের চারদিকে
ঘুরবেই । সত্যের মৃত্যু
হবে না । ব্রুনো
নিশ্চিন্তে চোখ বুজলেন
।