তিনদিন লাগে না ।
একদিনেই যুক্তি তার
মোটারকম দাঁড়িপাল্লায়
স্বচ্ছন্দে বুঝিয়ে দেয়
সেই ফিরে যাওয়া আসলে
আমাকে এক নতুন জীবন এনে
দিয়েছিল । ফিরে যাওয়া
যদিও খুব দীর্ঘস্থায়ী
হয় নি । বড়জোর মাস খানেক
। কেননা তারপরই ঝেঁপে
বর্ষা এল । আমাদের নিচু
জমির মাঠে জল সেজে উঠল
আর সুশ্রী ঢ্যাঙা বিদায়
নীল মাঠ থেকে ,
চাঁটিবাঁটি গুটিয়ে ।
বেচারার বর্ষা দিন সহ্য
হতো না । স্কুলে যেত
ছাতা বাগিয়ে । আর আমি
সারাবছর না হোক পঁচিশ
বার সর্দিজ্বরে ভুগলেও
বৃষ্টি আমাকে কখনও
অসুস্থ করে নি । আজও যদি
তার শরীর খারাপ হয় বা সে
কষ্ট পায় তা আমার চরম
উদ্বেগ , কিন্তু বৃষ্টি
আমাকে অসুস্থ করে না
এখনো ।
স্মৃতির সমস্যা সে
চঞ্চল শৈশবের মতো ।
কোনমতে পড়াশুনো শেষ করে
খেলতে পালিয়ে যায় ।
বইখাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে
রেখে । আর স্মিতমুখ
কটুভাষী মায়ের মতো
সেইসব স্মৃতিকণাকে
যত্নে গুছিয়ে তুলতে হয়
। আর গোছানর সমস্যা হল
বান্তর অবান্তর সব
একাকার হয়ে যায় তখন ।
সেটাই হচ্ছে । আসলে
প্রসঙ্গ নতুন জীবন ।
বিকেল যখন বিকেলের
নিয়মে এল আর আমি বুঝতে
পারলাম আমার মাঠ আর
আমার মাঠ নেই - তখন আমাকে
বিকল্প খুঁজতে হল । ঘরে
বসে থাকা যাবে না , বাবা
রাগ করবে । বন্ধুদের
পাবো না , ওরা বল
পেটাপেটিতে ব্যস্ত ।
নতুন কিছু চাই । নতুনের
খোঁজ দুটো সন্ধান দিল ।
এক - আজাদ হিন্দ
পাঠাগারের পেল্লায় সব
আলমারি ভর্তি বাঁধানো
বইয়ের তাক । আর দুই -
পর্ণমোচী চিরহরিৎ
একাকার মফস্বলের সরু
সরু রাস্তায় পাক দেওয়া
সাইকেলে ।
এইখানে আমি আমার বড়
হওয়াকে পরিষ্কার দেখতে
পাই । বেখাপ্পা জামা ,
ঢোলা হাফ প্যান্ট সে
একখানা ২৬ ইঞ্চি
সাইকেলের প্যাডেলে
লাথি মারতে মারতে
লাইব্রেরি চলেছে ।
ক্যারিয়ারে দুটো বই ।
তার দুটো কার্ড পিছু
বরাদ্দ সম্পদ । এ গুলো
জমা দেবে আর নতুন বই
তুলবে । ফেরার পথে
দীপ্তি সিনেমা হলের শো
বোর্ডে সিনেমার স্টিল
গুলো দেখবে , হলের ভেতর
থেকে ভেসে আসা সংলাপের
সাথে , সিগারেট - বিড়ি -
ঘামের গন্ধের সাথে
দেখবে ৭টার শোয়ের
টিকেটের জন্য তখন থেকেই
কাউন্টারে লাইন পরা
শুরু । সিনেমার ভালোত্ব
বিষয়ে নিঃসংশয় হয়ে সে
একই সাথে হতাশ হবে ।
কেননা সিনেমা হিন্দি
ভাষার । হিন্দি ভাষায়
সর্বজনস্বীকৃত ছোটদের
ছবি ছাড়া আর কিছু দেখার
সুযোগ তার নেই । বাংলা
ভাষায় অবশ্য যে কোনও
চলচ্চিত্র বাবা মার
সাথে হলে গিয়ে দেখার
সুযোগ তার আছে । খানিক
দুঃখ , খানিক
সদ্যজাগ্রত সিনেমা
বিষয়ে কি যেন কৌতূহল আর
অনেকটা আগ্রহ নিয়ে সে
বাড়ি ফিরবে , সঙ্গে
লাইব্রেরি থেকে বরাদ্দ
বই দুটি । যেহেতু
অন্ধকার নামে নি , ফলে
লেখাপড়ার সময় হয় নি , তাই
বারান্দায় পা ঝুলিয়ে
বসে সে গোগ্রাসে শুরু
করবে - পাঁচ মুন্ডির আসর
- হরিনারায়ণ
চট্টোপাধ্যায় - শারদীয়া
বেণুবীণা - দেব সাহিত্য
কুটির থেকে । এই বইই সে
পাঠাগার থেকে নিয়ে
এসেছে । এখন ঘনিয়ে আসা
অন্ধকারের সাথে পাল্লা
দিয়ে এই গল্প তাকে শেষ
করতে
হবে । ভুতের গল্পের
শিউরানিটা এই হবু
সন্ধের জন্য বরাদ্দ ।
রাত পাঠ শেষের আতঙ্ক
আনুক । কিন্তু লেখাপড়া
শুরুর আগে পাঁচ মুন্ডির
আসর তাকে ফুরতেই হবে ।
হয়ত এ সময় বাড়িতে
গ্যাসের চুল্লি এসে
গেছে । কিন্তু স্মৃতি
নিজের মতো করে এক হাত
চাললে মনে হয় তখনও
বাড়িতে তোলা উনুনের
ব্যবহার ছিল । সন্ধের
মুখে মুখে ওই সময়টায় মা
উনুনে গুল আর ঘুঁটে
সাজিয়ে আঁচ দিয়ে উঠোনে
নামিয়ে দিত । ধীরে পাক
দিয়ে উঠত ধোঁয়া । পঞ্চ
মুণ্ডের আসর থেকে মন
সরিয়ে সে দিকে নজর যেত ।
ল্যপা উনুনের ছোট ফাঁকে
লাল আগুন গনগন করছে ।
ধোঁয়া উঠছে । লাগোয়া
বাড়ির প্রতিবেশী দিদি
হারমোনিয়াম নিয়ে
রোজকার সঙ্গীতচর্চায়
বসে গেছে , দূর
দ্বীপবাসিনী , চিনি
তোমারে চিনি ।
ধোঁয়া আধা অন্ধকার
আকাশে অবয়ব তৈরি করছে
নানানরকম । আধা পড়া
পাঁচ মুন্ডির আসরের
অসংস্কৃত দাড়ি গোঁফের
মাত্রা নিয়ে সেই
চারজনের ( আসলে পাঁচজন ,
গল্প শেষ করলে বোঝা যায় )
একজনের মুখ এঁকে স্পষ্ট
হতে না হতেই ধোঁয়া খেলা
দেখিয়ে দারুচিনি
দ্বীপের সেই
বিদেশিনীকে আঁকতে শুরু
করে । কোথায় দারুচিনি
দ্বীপ আমি জানি না ।
কিন্তু সেই অজ্ঞাত ,
অগম্য দ্বীপে আগতা
বিদেশিনী ক্রমে ধোঁয়া
পোশাকে তার সমস্ত পেলব
ও ভাঁজ নিয়ে গড়ে উঠতে
থাকে বৃহত্তর এক
অন্ধকার প্রেক্ষাপটকে
পেছনে রেখে । যেন অসীমে
টাঙানো অন্ধকারে
ধূম্রবর্ণা , ধূম্রগঠনা
এই ধোঁয়ার সুন্দরী তার
পরিসর স্থির করে নিচ্ছে
। মাটি ও আকাশের
প্রভেদের যে অমিত
বিশ্বাস তাকে তুচ্ছ করে
এ গঠন মাটি আকাশে
প্রসারিত হচ্ছে । আরও
প্রসারিত হচ্ছে
কল্যাণী ও মাতৃবৎ
মূর্তি । শৈশব যৌনতা
মেশাতে ভুলে গেছে সে
গঠনে ; তবু সে গঠন দৃপ্ত ,
রমণীয়, পরম কান্তির
সাথে লাবণ্যর
সহাবস্থান । পাঁচ
মুন্ডির গা ছমছমে
আতঙ্কে সে তার ভরসা দেয়
। মন ফিরে যায়
বেণুবীণায় । চরাচরে
বেণু ও বীণা যুগপৎ বেজে
ওঠে , হয়তো সান্ধ্য শঙ্খ
রবে , হয়তো ঘর ফেরতা শেষ
পাখির ডাকে , হয়তো
গ্রীষ্ম বাতাসের ক্ষীণ
মর্মরে ।
ঘরে বৈদ্যুতিক লম্ফ
জ্বলে ওঠে । বাইরের ঘর
থেকে বাবার শেষ ব্যচের
ছাত্ররা ঘরমুখী হয় ।
নিঃশ্বাস লয়ে ফেরে ।
আমার অগোচরে আমার
সুমন্দভাষিণী ভাষা
আমায় গ্রাস করতে থাকে ।
বনসুর বেজে ওঠা পাহাড়ি
বাঁশি কোন একখানে
স্পর্শ করে ।পাঁচ
মুন্ডির টাটকা আতঙ্ক ও
বনান্ত ছেয়ে যাওয়া
বাসন্তী হাসি একাকার হয়
। বাংলা ভাষার জাদু ও
অসীমশক্তি আমাকে
আচ্ছন্ন করে দেয় ।
করে রাখে ততক্ষণ যতক্ষণ
না বাবা আমাকে পাঠ্য
বইতে গুঁজে দেয় । আর
অমনোযোগের মনোযোগে
পাঠ্যবই আওড়াতে
আওড়াতেও আমি কিন্তু
আসলে স্থির থেকে যাই ওই
সন্ধ্যার কাছে , ওই
ভুতের গল্প , ওই ধোঁয়ার
প্রতিমা - যার গঠনে কি
যেনর অভাব । সেই কি যেন
যেন খানিক খুঁজে পাই - তব
কবরীমুলে / নব এলাচের
ফুল / দোলে কুসুম
বিলাসিনী - এই সুর
শব্দের যুগল বন্ধনে।
রাত বাড়তে থাকে । বিষয়
থেকে বিষয়ান্তরে সুর
করে দুলে দুলে যেতে
থাকি আমি । দেওয়ালে
টিকটিকি তার আহার্য
খুঁজে পায় । আমি আরও
নিবিষ্ট আর ঘনীভূত হতে
হতে মা ভাত বাড়ে । রাতের
খাওয়ার সময় কোলে
বেণুবীণা নিয়ে বসে পড়ি
। এক / একাধিক গল্প দিয়ে
ভাত মেখে রাতের খাওয়া
শেষ হয় । মশারি টাঙান হয়
। আলো নেভে । বাবা তিন
ব্যান্ডের রেডিও চালায়
। অন্য গান , অন্য গল্প
আমাকে ঘুম দেখায় । ঘুম
জড়তায় ক্ষীণ যেন শুনি
দিদিটির স্বর -
প্রশান্ত সাগরে তুফানে
ও ঝড়ে ...
আকুল কি যেন লিখতে গিয়ে
নিজেই হেসে ফেলি । কি
যেন তো শুনেছি তোমারই
অশান্ত রাগিণী । বাল্য
যাচ্ছে , কৈশোর আসছে ।
জীবনের এই সবচাইতে
গোলমেলে সময়ে তাকে যে
নামেই ডাকি না কেন , সে
তো যৌন চেতনা । সে তার
আগমন প্রতিনিয়ত বোঝাতে
চাইছে বর্ণে - শব্দে -
ধ্বনি - নির্জনে - আকারে -
নিরাকারে । প্রতিবেশী
দিদির গানে , নজরুলের
ঐশ্বরিক নির্মাণে ,
হরিনারায়ণ
চট্টোপাধ্যায়ের জাত
ভুতের গল্পে সে শান
দিচ্ছে তার তীক্ষ্ণতায়
। ওই তোলা উনুন , ধোঁয়া ,
অতিপ্রাকৃতিক গঠন সবই
তো প্রতীক । নিজেকে
চিনে না চেনার খেলা ।
নিজের সাথে নিজের
লুকোচুরি তো সব জেনে না
জানা । অথবা অনেক জানা
।
কিন্তু যুক্তি এই যে
বছর পাঁচেক আগে ঘোলা
সন্ধ্যায় শিয়ালদার
বাইরে খুঁটিতে গা এলিয়ে
সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে
দেখলাম পাইস হোটেলের
উনুনের ধোঁয়া পাক
দিচ্ছে আর অবয়ব তৈরি
হচ্ছে দৈত্যাকৃতি বিল
বোর্ডকে প্রেক্ষাপটে
নিয়ে আমার মাথায় কেন
দুম করে ফিরে এল
ছেলেবেলা ? কেন ফিরে এল
তব কবরীমুলে / নব এলাচের
ফুল / দোলে কুসুম
বিলাসিনী ? কেন ? আর এলাচ
তীব্রতায় আমি আচ্ছন্নই
বা হয়ে পড়লাম কেন ? কেন
এলাচ ? কেন ?
থেমে যাই । অতিকথনে
খানিকটা অতিই তো আবার
পুরো কথনকে ঢেকে দেয় !!
ক্রমশঃ