পশ্চিমের আকাশ লাল হয়ে
আছে । নাদু ভাবতে ভাবতে
যাচ্ছিল এখন রবি
মাস্টারের বাড়ি যাওয়া
ঠিক হয় কিনা । হাতে কোন
কাজ ছিল না , তাই দুপুর
থেকে পরানের ঠেকে বসে
অকারণে অনেকটা নেশা করে
ফেলেছে । বাইরে এসে
দেখে আলোতে হাত পা লাল
হয়ে গেছে । খুব মজা
লাগলো তার । সন্ধ্যেটাও
কাটাবে ভেবেছিল
এখানেই। আর যাওয়ার
জায়গায়ই বা আছে কোথায় ।
আগে কয়েকদিন সন্ধ্যে
হলেই শ্যামলীদের বাড়ি
যেত গপ্পো করতে । আর
মাসিমার হাতের চা ।
মাসিমা শ্যামলীকে নিয়ে
একাই থাকে , ঠোঙ্গা
বানিয়ে ওরা সাপ্লাই দেয়
সাজিদপুরের সাপ্তাহিক
হাটে । তাতে যা দু পয়সা
...। নাদু যেত , কিছু সুখ
দুখখের কথাও হত , তারপর
ঠিক আটটায় এক কাপ গরম
গরম চা খেয়ে সোজা বাড়ির
পথ ধরত । কদিন হল বন্ধ
করেছে । আসলে সে নিজে
ভেবে দেখেছে । দুজন
একলা মেয়ে মানুষের বাড়ি
, সেখানে রোজ যাওয়া কি
ভাল দেখায় ? বিশেষ করে
শ্যামলী এখন সোমথ্থ
হয়েছে , গতরও বেশ
আঁটসাঁট ...দুদিন পরে
লোকে বলাবলি করবে ,
নাদুরও বাড়িতে বউ রয়েছে
... কথা এক কান থেকে
পাঁচকানে যাবে ... একি
শহর বাজার নাকি ? যে অন্য
মেয়েমানুষের গায়ে হাত
দিতে লোকে দুবার ভাবে
না ? এখানে সমাজের ভয় আছে
। তার ওপর আছে পার্টি
...তিল থেকে তাল হবে ।
নাদু নিজেকে বোঝায় ,
কিন্তু সন্ধ্যেবেলা
বাড়ির দিকে মন টানে না
তার ...পাও চলে না ।
কিছুদিন স্টেশনে গিয়ে
বসে থাকত । একা । নির্জন
স্টেশনে এক আধটা ট্রেন
এসে
থামে , কিছু লোক
নামানামি করে ... ট্রেন
চলে গেলে আবার
অনেক্ষণের জন্য ফাঁকা
স্টেশন । অন্ধকার ,
জোনাকি জ্বলত , ঝিঁঝিঁ ,
কাদের গোয়াল থেকে একটা
বাছুর ডাকল , দখিণের
ধানক্ষেত দিয়ে হাওয়াও
দিত খুব কিন্তু কুলি
লাইনের আলোগুলোর সেটা
সহ্য হল না । মিটমিটে
শয়তানের মত নাদুর সঙ্গে
মশকরা করতে উঠে পড়ে
লাগল । ছোট হলুদ
আলোগুলো একবার জোরে
জ্বলে ওঠে আবার
পরক্ষণেই প্রায় নিভু
নিভু । নাদু বুঝতোও যে
ওটা ভোল্টেজ আপ ডাউন ।
কিন্তু অনেক্ষণ একলা
চুপ করে বসে থাকলে যা হয়
, অলস একঘেয়েমিটাকে ভাল
লাগতে আরম্ভ করে
...বিকেলটা সন্ধ্যেয় আর
সন্ধ্যেটা রাতে গড়ানোর
ছন্দ , সময়ের গায়ে দৃশ্য
আর শব্দকে আটকে আটকে যে
আল্পনা তৈরি করে সেটা
নাদুর ভেতর একটা
শান্তির জাল বুনে দেয় ...
সেই আলসেমিটাকে
কিছুতেই কাটাতে পারে না
সে । উঠতে উঠতে সাড়ে
নটার আপ লোকালটা হয়েই
যায় । তাতেও খারাপ লাগত
না নাদুর , যদিনা
কুলিলাইনের আলোগুলো
এতবার আপ ডাউন করত । তাল
তাতে কাটে ... ঝিঁঝিঁ
গুলোকে বেসুরো মনে হয় ,
হাওয়া না দিলে মনে হয়
মশা কামড়াচ্ছে ...
বিরক্তি বাড়ে ... আর তখনই
মনে হয় মানুষের সঙ্গে
কথা বলা দরকার । তাই
কদিন হল পরানের ঠেকে
যাতায়াত শুরু করছে ।
আজও কেমন কথা বলতে বলতে
নেশাটা বেশি করা হয়ে
গেছে । একটা অম্বলের
ঢেঁকুর ওঠে ‘ শুয়োরের
বাচ্ছা ! ’ বলেই পরানের
মুখটা মনে পড়ে তার ।
আবার এগোতে থাকে । বউ
মোবাইলে কল দিয়েছিল ,
ছোট মেয়েটার শরীরটা
ভালো যাচ্ছে না
কয়েকদিন হল ... আজ খুব
বাড়াবাড়ি । রবি
মাস্টারের কাছে বলে কয়ে
ওষুধ আনতে যাচ্ছে সে ।
চারিদিকে এখনো সন্ধ্যে
নামেনি তবে আলো ফিকে
হয়ে আসতে আরম্ভ করেছে
এবার ঝিঁঝিঁ ডাকতে
আরম্ভ করবে । মেঝো
পুকুরের দিক থেকে হাওয়া
দিচ্ছে নেশাটা জমে
উঠেছে । টলতে টলতে
রবিকান্ত রায়ের বাড়ির
দিকে হোমিওপ্যাথি ওষুধ
নিতে চলেছে নাদু ।
দিনমজুর নাদু মণ্ডল ।
রবিকান্ত রায় লোক ভাল ।
কিন্তু বিদঘুটে । কি সব
আজব ব্যাপারস্যাপার
আছে তার । সবকিছু নাদু
নিজে বুঝতেও পারে না ।
কি দরকার ? মাঝে সাঝে
বিপদে আপদে কাজে লাগছে
এই ভাল । এমনিতে নবমোহন
ইস্কুলের মাষ্টার আর
হোমিওপ্যাথিতে অল্প
বিস্তর হাতযশ । কিন্তু
লোকে বলে মাথাটা খারাপ
আছে । সারাক্ষণ কি যেন
ভাবে আর হঠাৎ হঠাৎ
বিড়বিড় করতে থাকে মনে
হয় সামনে কয়েকজন
দাঁড়ানো , তাদের সঙ্গে
কথা চলছে । আর যত্রতত্র
ঘুরে বেড়ায় লোকটা । বনে
বাদাড়েও যায় । একদিন
ভোর রাতে দুলেদের
বাঁশবাগানে পাতকেত্যর
সময় রবি মাষ্টার হাজির
। নাদু তো ভিরমি খাওয়ার
জোগাড় ! পেট খারাপ সারতে
তো দুদিন সময় দিতে হবে ?
সকাল সকাল রবি মাষ্টার
কি নিজের ওষুধের
গুনাগুন যাচাই করতে
হাজির এই বাঁশবাগানে ?
নাদু তখনো উঠেও দাঁড়াতে
পারেনি , ধাঁ করে ওর ডান
পাশ ঘেঁষে বিড় বিড় করতে
করতে রবি মাষ্টার
মাঠপুকুরের দিকে চলে
গেল । তার পর থেকেই
লোকটাকে একটু সমীহ করে
চলে
নাদু । কে জানে যদি
গুনিন ফুনিন বেরোয় ? বলা
তো যায়না কিছুই ...
কিন্তু ওষুধ দেয় এক
নম্বর ।
এইসব ভাবতে ভাবতে প্রায়
মাস্টারের গেটের কাছেই
পৌঁছে গেছে নাদু ।
কিন্তু হাত চোদ্দ দূরে
এসেই থমকে দাঁড়ালো ।
গেটের কাছে দাঁড়িয়ে
বিকট শব্দে হাসছে
রবিমাস্টার ! সামনে
দাড়ি গোঁফ ওয়ালা সাদা
কাপড় পড়া একটা লোক
দাঁড়িয়ে দেখছে ।
রবিমাস্টার তাহলে কি
পাগলই হয়ে গেলো ? এবার কি
গেট খুলে বেরিয়ে দৌড়বে ?
বাঁদিকে গেলে কোন
সমস্যা নেই কিন্তু
ডানদিকে এলেই তো
চিত্তির ! একেবারে
নাদুর সামনে পড়ে যাবে ।
তখন কি করবে নাদু ? এই
আশঙ্কায় নাদু দু পা
পিছিয়ে আসে ।