মুদ্রাদোষটা রক্তেই
ছিল । কিছু হলেই ছড়া
কাটা । যেমন ধরুন , ‘
হাবিল পড়িল শাস্ত্র
কাবিল কোরান / তাহা হতে
সৃষ্টি হল হিন্দু
মুসলমান ... ’। ছড়াটি
সমাজ - বিস্তারের আদি
কথা । দুই ভাই হাবিল আর
কাবিল আকালিমা ও
গাছবিবি নামে নিজের দুই
বোনকে বিয়ে করেছিলেন ।
আকালিমা সুন্দরী এবং
গাছবিবি দেখতে খারাপ ।
দুই ভাইয়ের মধ্যে তাই
শুরু হল হিংসাহিংসি ।
হিংসার জেরে মারা পড়ল
কাবিল । শোকে পাগল হল
হাবিল । তাহলে কি থমকে
গেল সব ? কোনও এক
কল্পনাবিলাসী পটুয়া
সহজেই
বললেন , ‘ না ’ । আরও
বললেন , ‘ মা হব গর্ভ হল ,
হাবিল কাবিল জন্ম
নিল / তাদের দুইটি ভাই
দুই ধর্ম নিল ,
শাস্ত্রেতে আছে প্রমাণ
। ’ আর বিশ শতকের এক
মরমিয়া বললেন , ‘ এক সে
আকাশ মায়ের কোলে , যেন
রবি - শশী দোলে ’। তফাতটা
এইটুকুই ...। কেবল
মুদ্রাদোষটা রক্তেই
ছিল ।
হাবিল আর কাবিলের এই
কাহিনিটির সূত্র
মেদিনীপুর জেলার
ঠেকুয়াচকের অজিত
চিত্রকর । এর আগে হাবিল
ও কাবিল নিয়ে যা
পড়েছিলাম , তা
সলিমুল্লাহ খান কৃত
শার্ল বোদলেয়ারের
কবিতার অনুবাদ ।
কবিতাটির নামও ছিল ‘
হাবিল ও কাবিল ’ —
‘১
হাবিলের জাত , ঘুমাও ,
পিয়ে যাও আর খাও
দিলখোশ মাবুদের মুখে
মিঠা হাসি
কাবিলের জাত , দাও
গড়াগড়ি দাও
পচা কাদায় , আর দাও নিজের
গলায় ফাঁসি ।
হাবিলের জাত , তোর লোবান
আতরদান
নজরান সুড়সুড়ি দেয়
ফেরেশতার নাকে !
কাবিলের জাত , তোর
যাতনার অবসান
কখনো হবে না হাজার কাতর
ডাকে ?
হাবিলের জাত , তোর মাঠের
ধান বাড়ে
মোটা তাজা হয় তোর গরু যত
,
কাবিলের জাত , তোর পেটের
ভোক ঘাড়ে
খালি কঁকায় নেড়ি
কুত্তার মত ।
হাবিলের জাত ,
চোদ্দপুরুষের চুলা
জ্বেলে
পোহা রে আগুন , গতর তাতা
কাবিলের জাত , মাটির
তলায় গর্ত মেলে
কাঁপ তোরা , গায় দে
খেকশিয়ালের কাঁথা !
হাবিলের জাত , প্রেমে
মশগুল হ , বাড়া !
ঝাড়বংশ , বাড়া রে
সোনাদানা ।
কাবিলের জাত , হে প্রাণ
পোড়া
প্রেম করতে তোর মানা ।
হাবিলের জাত গাল ফোলা
পেট খোলা
খেয়ে খেয়ে যেমন ফোলে
ঘূণপোকা !
কাবিলের জাত , পথে পথে বস
পথভোলা
সংসার তোর পথে বসা হে
বোকা ।
২
আহা , হাবিলের জাত , একদা
তোর লাশ
করবে সবুজ পোড়া ছারখার
জমিন !
কাবিলের জাত কাজ তোর
নাগপাশ
আজও হয় নাই ছেঁড়া , জীবন
কি সঙ্গীন
হাবিলের জাত , তোর লাজ
ঢাকবে কে আজ
লোহা খান খান হবে যে
চেলাকাঠে !
কাবিলের জাত , উঠ আসমানে
আসমানবাজ
যা মাবুদরে ঠেলে ফেল এই
দুনিয়ার মাঠে ! ’
তবে দূরে বসে গূঢ় কথা
কতটাই বা অনুভব করা যায় !
তাই বেরিয়ে পড়েছিলাম ।
গন্তব্য অবশ্য
ঠেকুয়াচক নয় । পশ্চিম
মেদিনীপুরের নয়া ।
হাওড়া থেকে সকালের
ট্রেন । বালিচক স্টেশন
ঘণ্টা দুই - আড়াই পথ।
তারও পরে বাসে পুরো
একটি ঘণ্টা । অনাথের
দৈব সখার দেখা পাবার
আশায় অবশেষে পৌঁছলাম
পিংলা থানার
অন্তর্ভুক্ত ছোট্ট
গ্রাম
নয়া 'য় । সরু রাস্তার
সাঁকো পেরতেই পটুয়াদের
ঘর । বাকচিতের আশায়
চলতে চলতে মনে পড়ছিল
একটি কিংবদন্তি । দেশে
তখন রাক্ষসরাজ
বকরাক্ষসের দাপট ।
প্রতিদিন খাদ্য হিসেবে
একজন করে মানুষ যেত তার
কাছে । এটিই ছিল চুক্তি
। পালা পড়ল যুদ্ধাপতি
গুণিনের । তিনি জাদুকরও
। কিন্তু প্রাণের ভয়ে
জাদুটোনা যদি বৃথা যায় ?
ঈশ্বরই সহায় তখন ।
ঈশ্বর এলেন ফকিরের বেশে
। অভয় দিলেন , ‘ ভয় নেই ’।
শুধু বকরাক্ষসকে বলতে
হবে , তার মতো দেখতে একটা
রাক্ষস জাদুকরকে খেতে
চায় । আগে বিচার হোক তার
। যথাসময়ে জাদুকরের
কাছে এ কথা শুনল রাক্ষস
। রেগে জানতে চাইল , ওই
রাক্ষসের ঠিকানা ।
ভগবানের কথা মতো
জাদুকরের জবান উচ্চারণ
করল , ‘ আয়নাপাহাড় ’।
তারপর ওই আয়নাপাহাড়ে
নিজের প্রতিবিম্ব দেখে
নিজেকেই ক্ষতবিক্ষত
করে মারা গেল বকরাক্ষস
। জাদুকর গামছায়
বকরাক্ষসের রক্ত
মাখিয়ে
বলল , সে হত্যা করেছে
রাক্ষসকে । নবাব খবর
পেতেই নির্দেশ এল , এই
কাহিনি সমাজে প্রচার
করে মানুষের ভয় ভাঙানো
হোক । জাদুকরও গল্পটি
নিজের সুরে লিখে এবং
এঁকে শুরু করল প্রচার ।
আর এতে তার রোজগারও
বাড়ল । বর্তমান পটুয়ারা
তারই উত্তরপুরুষ ।
পুলিন চিত্রকর মারা
গিয়েছেন বছর পাঁচ হল ।
তাঁর তিন ছেলে ননীগোপাল
চিত্রকর , আনন্দ
চিত্রকর এবং এবাদৎ
চিত্রকর । বাবার কাছ
থেকে শোনা এই কাহিনিটির
ভরণপোষণ করে চলেছেন
তাঁরা । জানা গেল , এমন
কিংবদন্তি সৃষ্টি
হয়েছিল মুসলমান আমলে ।
বৌদ্ধধর্মের কাহিনি ,
জাতকের নানা কাহিনিও
পেশ করা হত পটের
মাধ্যমে । আবার সপ্তম
শতকের প্রথম দিকে রচিত
বাণভট্টের ‘ হর্ষচরিত ’
- এ ‘ যমপট ’ ব্যবসায়ীদের
কথা উল্লেখ আছে ।
সেখানে রাজা হর্ষবর্ধন
নিজে একজন পটুয়াকে
কয়েকজন ছেলের মাঝে বসে
পট বোঝাতে দেখেছিলেন ।
আগ্রহ বাড়ছিল । তাই
কৌতূহলে খোঁজ লাগালাম
দুখুশ্যাম চিত্রকরের ।
বাড়িতে অনুপস্থিত । তখন
চায়ের দোকানে উনি ।
চায়ের ধোঁয়া উড়ল । এক
কাপ চায়ের মৌতাতে শুরু
হল কথা বলা । দুখুদার
বয়স সত্তর ছাড়িয়েছে ।
জন্ম কবে জিজ্ঞেস করতেই
বললেন ,
‘ বাংলায় ১৩৫১ । ’
— তারিখটা মনে আছে ?
— বিহসপতিবার ।
আত্মভাবে মশগুল । তাই
ওই দিকে কথা না বাড়ানোই
ভালো । অবাক ব্যাপার কি
জানেন ? দুখুদার জন্ম
কলকাতার শম্ভুনাথ
পণ্ডিত হাসপাতালে ।
নিবাস ছিল কালীঘাট । পট
আঁকার হাতেখড়ি
কালীঘাটেই । প্রতিমাও
গড়তেন । রক্তে যাযাবরের
নেশা । বাবা মারা যাবার
পর পূর্ব মেদিনীপুরের
ঠেকুয়াচকে মামাবাড়িতে
ঠাঁই নিলেও বড়মামার
সঙ্গে নয়ায় এলেন ।
ষাটবছর ধরে নয়ায় তাঁর
ওই ছোট্ট বাসা যেন
শিল্পীঘর । স্থানভেদে
কি পটের তফাত ? বিশ্বাস
করেন । কিন্তু স্থানীয়
বিশ্বাসে পটের তফাত ,
বিশ্বাস করেন না । পট
শাস্ত্র - বিশ্বাসে
বিবর্তিত ।
— হিঁদু , মুসলিম ,
সাঁওতাল — সবাই নিজেদের
শাস্ত্র অনুযায়ী পট
আঁকে ।
শাস্ত্র - বিশ্বাসে পট ।
পট পুরাণের কথা গায় ।
গাজির গান গায় ।
— এ সব জানলেন কী করে ?
— শুনে শুনে ।
ভাবছিলাম । বেদ যদি
শ্রুতি হয় , তবে এও যে
তাই ! ধর্মকথা মুখে শুনে
, মনে রেখে , গানবেঁধে ,
ছবি এঁকে আজও মাধুকরী
খোঁজেন চিত্রকরেরা ।
— গাজির পটের একটা গান
গাইবেন ?
— নাহ , বারণ আছে ।
হাতে পট ছাড়া নাকি পটের
গান গাওয়া বারণ । কার
বারণ , এই উত্তর থাকুক না
অজানা । “ জগতে কেন
জানতে হবে সবকিছু ?
মানুষের ভাবনাচিন্তার
চিরকালীন বিষয় বা
বিষয়াতীত বলে থাকে কিছু
— বহুকিছু — অনন্ত , যার
‘ কিছু ’ নেই ; সমগ্রও
নেই । এটুকু না - থাকলে ,
মানুষ কি সবই বুঝে
ফেলবে ! — বুঝে ফেলার পর
করবে কী সে ! এক অতি -
শূন্যতার মধ্যে পড়ে
যাবে না ! ”
( ক্রমশ )