নান্দীকারের ‘
নগরকীর্তন ’ নাটক হচ্ছে
। মঞ্চে যে জায়গাটা
পর্দার বাইরে থাকে,
সেখানে মঞ্চের সব আলো
এসে পৌঁছয় না অনেক সময় ।
ঐখানে এসে দাঁড়ালে
অভিনেতাকে স্পটও কভার
করতে পারে না ।
নগরকীর্তন নাটকে ,
রুদ্রপ্রসাদ একবার এসে
দাঁড়ালেন সেখানেই ।
সংলাপ বলতে বলতে । আলো
তাকে নিতে পারছে না ।
তবু তিনি দাঁড়ালেন ।
কিছুক্ষণ সেখানে
দাঁড়িয়ে সংলাপ বললেন ।
আবার ফিরে গেলেন ডীপ
স্টেজে । নাটক শেষে
গ্রিন - রুমে গেছেন এক
অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিক
। স্যর তখন মুখের মেকাপ
তুলছেন আয়নার সামনে
ব’সে । সাংবাদিক ঘরে
এসে নিজের পরিচয় দিলেন
। এবং অত্যন্ত বিনয়ের
সঙ্গে জানালেন তিনি
একটি জিনিস জানতে চান ।
স্যরের সম্মতিতে
সাংবাদিকটি শুধোলেন
তাঁর জিজ্ঞাস্য
প্রশ্নটি । নাটকে একসময়
রুদ্রপ্রসাদ স্টেজের
যে - জায়গায় এসে সংলাপ
বলছিলেন , সেটা তো
থিয়েটারের ব্যাকরণ
সম্মত নয় । তিনি এরকমটা
কেন করলেন ? প্রশ্ন শুনে
, আয়নার সামনে ব’সে
মেকাপ তুলতে তুলতে
রুদ্রপ্রসাদ
সাংবাদিকটিকে বললেন ,
গোলাপ কেন ফুটলো ?
ছেলেবেলায় বাবার মুখে
একটা গল্প শুনেছিলাম ।
সত্যাসত্য জানি না ।
একবার এক ফরাসি শিল্পী
অনেক রাত জেগে খুব খেটে
একটা ছবি এঁকেছেন ।
কোনো এক মেয়ের মুখ । তো ,
এঁকে ওঁর মনে হয়েছে , এই
ছবিটা নিখুঁত । তিনি
করলেন কি , প্যারিসের
রাস্তায় টাঙিয়ে দিয়ে
এলেন ছবিটা । আর নিচে
লিখে দিলেন , ‘ যদি কেউ
থাকেন যিনি এই ছবির ভুল
ধরতে পারবেন , দয়া ক'রে
তিনি সেই ভুল জায়গায়
একটা মার্ক ক'রে দেবেন ।
’ রাস্তা দিয়ে নানান
লোক যাচ্ছে । সবাই
দেখছে ছবিটা । কিন্তু
কেউ কোনো খুঁত বের
করতেই পারছে না । কোনো
কিছু করতে বলার পর , সেটা
করতে না - পারলে , যাঁকে
বলা হয়েছে কাজটি করতে
তিনি অনেক সময়েই বিরক্ত
হন । রেগে যান । এ’
জন্যেই মানুষ ‘ মানুষ ’
। তাঁর কিছু একটা করা
চাই । সেইসব পথচারীও
তাই - ই করছিলেন । রাগ
করছিলেন । ফলে , তাঁরা
করলেন কি, ছবিটায় কোনো
ভুল না পেয়ে রেগে গিয়ে
সারা ছবি জুড়ে হিজিবিজি
কাটাকুটি দাগ কেটে
দিলেন । এতো কষ্ট ক'রে
রাতের পর রাত জেগে আঁকা
শিল্পীর সেই ছবিটা এক
নিমেষে নষ্ট হয়ে গেল ।
সন্ধ্যায় , শিল্পী এসে
ছবিটার এই দশা দেখে খুব
দুঃখ পেলেন । তিনি
ছবিটা ওখান থেকে খুলে
নিয়ে ফিরে গেলেন নিজের
ঘরে । তারপরে আবার রাত
জেগে আঁকলেন সেই একই
ছবি । শুধু এবারে একটা
জায়গায় ইচ্ছে ক'রে একটা
ভুল রেখে দিলেন । এবং
আবার পরদিন সকালে
রাস্তায় টাঙিয়ে দিয়ে
এলেন সেই ছবি । নিচে
লিখে এলেন ঐ একই কথা । '
যদি কেউ থাকেন যিনি এই
ছবির ভুল ধরতে পারবেন ,
দয়া ক'রে তিনি... ' ইত্যাদি
ইত্যাদি । এবারে
পথচারীরা আবার দেখলেন
ছবিটা । দেখে সবাই - ই
বের করে ফেললেন কোথায়
এর ভুল । আর সেই ভুল
জায়গাটায় পেন্সিলে
একটা ছোট্ট মার্ক ক'রে
দিলেন । ছবিটা বেঁচে
গেল । এই যে ভুল ধরা
শ্রেণি , এঁদের নিয়ে
মনোজ মিত্র লিখেছিলেন
এক বড়ো মজার [ ? ] নাটক । '
চোখে আঙ্গুল
দাদা '। এঁরা সবসময় সবার
চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে
দেবেন কে কোথায় কোন্
ভুল করেছে । কোথায়
ব্যাকরণ মেনে চলা হয়নি
। কোথায় বচনজ্ঞান ভুল
আছে । উঁহুহুহুহুউউউউ
নুনটা না আর আধচামচ কম
দরকার ছিল বুঝলে হে ।
এঁরাও ইণ্টেলেকচুয়াল ।
নাট্যগুরু মনোজ মিত্র
বলেছিলেন , ‘ অহো ,
বুদ্ধি কিনা চোয়ালে ’ ।
আমার বাবাকে দেখেছি
বাঙলায় বড্ড ভয়ঙ্কর
রকমের কাঁচা । অথচ এই
মানুষটি কি অসাধারণই না
জানতেন ইংরেজি ভাষাটা ।
আমি আজ যদি কিঞ্চিৎ এই
ভাষাটা শিখে থাকি , বুঝে
থাকি , তবে তা ' দুজন
লোকের জন্যেই । একজন তো
এই পিতৃদেব । আর
দ্বিতীয়জন
স্টেটসম্যান পত্রিকা ।
তো যাই হোক , সে অন্য
গল্প । বাবার বাঙলা
কাঁচাত্বর একটা ঘটনা
খুব মনে আছে । তখন আমরা
মামাবাড়িতে । নদীয়া
জেলায় , পায়রাডাঙ্গায় ।
ঘর ভর্তি লোক । অতিথিরা
এসেছেন । বাবা , সে বাড়ির
জামাই , তাঁর হঠাৎ সাধ
হয়েছে তিনি একটু শুদ্ধ
বাঙলা বলবেন এইসব
অভ্যাগতদের সামনে ।
সেদিন বাবার খুব পেটে
ব্যথা হচ্ছিল কোনো
কারণে । মিষ্টি খেতে
দিয়েছে বাবাকে , বাবা
খাবেন না । তিনি বলছেন ,
বেশ জোরেই বলছেন , 'আসলে
আজ আমার নিতম্বে বেশ
ব্যথা , আজ এসব খাব না । '
মা তো বুঝে ফেলেছেন
ব্যাপারটা । কটমট ক'রে
তাকাচ্ছেন বাবার দিকে ।
বাবা বুঝতে পারছেন না
মা এইভাবে তাকাচ্ছেন
কেন তাঁর দিকে । পরে
সবাই চলে যাওয়ার পর মা
যখন বাবাকে বললেন
ব্যাপারটা , শুনে বাবার
কথা , 'আরে কথা তো হল
মানুষকে ব্যাপারটা
বোঝাবার জন্য । আমি তো
নিতম্ব দিয়েই ওনাদেরকে
বোঝাতে পেরেছি আমার
পেটে ব্যথা , তাই মিষ্টি
খেতে পারব না । সমস্যা
তো হয়নি কিছুই ।' কিন্তু
জগতে সব মানুষ হন না
এর'ম।
তরুণ ফারসি সমালোচক
পারহাম শাহরজের্দির
একটি প্রবন্ধ , ‘ Risquer la Poésie
’ [ রিস্ক অফ পোয়েট্রি /
কবিতার বিপদভূমি ]
বাঙলায় অনুবাদ
করেছিলাম কিছু মাস আগে
। সেখান একটা অংশ তুলে
দিচ্ছি এখানে — ‘‘...ভাষা
এই পৃথিবীর ভিতটাকে
নির্মাণ করেছে এবং করছে
। এই ভিতটাকে এক হাত
নিতে , সমস্ত পরিস্থিতি
ও কার্যক্রমের সাজানো
বিন্যাসটাকে হারাতে ,
এই সাজানো বিন্যাসের
ধারাটাকে ভাঙতে , আমরা
দুনিয়ার
ভিত্তিপ্রস্তরেই হাত
দেব । বিপদ শুরু হয় তখনই
যখন কবি উঠে
দাঁড়ায় , দৈনন্দিন
ভাষার বিরুদ্ধে ,
যোগাযোগের ভাষা ও
কথোপকথনের ভাষার
বিরুদ্ধে , ভাষার
সাধারণ ব্যবহারের
বিরুদ্ধে , যখন সে
অবিচলিত দৃঢ় উঠে দাঁড়ায়
চলতি দুনিয়ার বিরুদ্ধে
। [...]... ব্যাকরণ , ফারসিতে
একে বলা হয় ‘ Dasture zabaan ’, যার
আক্ষরিক অর্থ ‘ the order of tongue
’. অর্ডার ? এমন একটা জিভ
যে হাতকে আদেশ করছে ? কে
দিচ্ছে আদেশ ? কিসের
আদেশ ? ব্যাকরণ তো একটা
মরাল কনস্ট্রাক্ট একটা
নৈতিক কাঠামো , কি করা
যাবে আর কি করা যাবে না —
আগে থেকে ঠিক ক’রে
দেওয়া এরকম একটা তালিকা
থেকে যা ভবিষ্যতের
ভাষাকে নির্ধারণ করে ।
কিন্তু কবিতা আর কবি
থাকেন সেই আদেশ ও
আদেশের ভাষাকে
বিচ্ছিন্ন করতে , তাকে
দুনিয়া থেকেই সরাতে ,
ভাষার একটা নতুন বাঁক
সৃষ্টির জন্য। তবুও ,
বিপজ্জনক কবির জন্য
ভাষা শুধু একটা উপায় বা
কোনো মাধ্যমমাত্র
নয় , ভাষা তার কাছে
পুরোটা , এবং তার কাজের
মূল লক্ষ্যবস্তু । ...’’
‘ ব্যাকরণ তো একটা মরাল
কনস্ট্রাক্ট একটা
নৈতিক কাঠামো , কি করা
যাবে আর কি করা যাবে না —
আগে থেকে ঠিক ক’রে
দেওয়া এরকম একটা তালিকা
থেকে যা ভবিষ্যতের
ভাষাকে নির্ধারণ করে ’।
পৃথিবীর তাবড়
বৈয়াকরণদের এটা কে
বোঝাবে
বলুন ? আমি বলছি না
ব্যাকরণের প্রয়োজন নেই
। অবশ্যই আছে । আর
ব্যাকরণের প্রয়োজন -
অপ্রয়োজন নিয়ে আমিই বা
বলার কে ? আমি একটা ইশকুল
পালানো ছেলে । সে
অধিকারই নেই আমার ।
ব্যাকরণ না থাকলে ইশকুল
বিশ্ববিদ্যালয়ের
সিলেবাসে পড়ানোটা কি
হবে ? আর পাওয়ার প্লে -
টাই বা কে খেলবে বলুন ?
মুরুব্বিগিরি করার
জন্যে হাতে তো একটা ছড়ি
চাই নাকি ? ব্যাকরণের
প্রয়োজন আমার কাছে ,
ঐটুকুই । ঠিক যের’ম,
আমার কান্না পেলে আমি
এস.ডি.ও. অফিসে যাই না
অনুমতি নিতে । কিম্বা
কান্নাটা কেঁদে ফেলার
পরে মনোবিজ্ঞানের বই
খুলে দেখি না , আমি ঠিক
পদ্ধতিতে কেঁদেছি কিনা
। রেগে গেলে ডি.এম.-এর
কাছে রাগ প্রকাশের
কানুন - বিধি জানতে ছুটি
না । বরং কেঁদে ফেলি ।
রেগে যাই । সবাই - ই তাই -
ই করেন । তেমনিই ,
সাহিত্যেও , বলা ভালো ,
যেকোনো ক্রিয়েটিভ
কাজেই ।
‘ এদিকে বাঙালি বড়ো
অসহায় রবীন্দ্রনাথ
বিনে ’ । সেই রবি ঠাকুর ,
‘ চুম্বন ’ কবিতায় , গোটা
কবিতাতেই কোত্থাও ‘
ওষ্ঠ ’ কথাটা বললেনই না
। ইশশশ । বলুন তো , কি
যাচ্ছেতাই ভুল করে
গেলেন ভদ্রলোক । বারবার
ক’রে সারা কবিতায় খালি
বলে গেলেন , ‘ ভাঙিয়া
মিলিয়া যায় দুইটি অধরে
’, ‘ দুখানি অধর হতে
কুসুমচয়ন ’, ‘দুটি
অধরের এই মধুর মিলন ’। এ
কি কেলেঙ্কারি । একজন
মানুষের দুখানিই ঠোঁট
হয় জানি । কিন্তু , দুটো
ঠোঁটই নিচের ঠোঁট ?
কল্পনাও করা যাচ্ছে না
দৃশ্যটা । চুমু খাওয়া
তো দূরের কথা । নিচের
ঠোঁটে ডেঁয়ো পিঁপড়ে
কামড়ালে যখন ফুলে যায় ,
একমাত্র তখনই দুখানা
নিচের ঠোঁট গজাতে পারে
মানুষের ।
মাসখানেক আগে ফুটবলের
একটা বিশ্বকাপ হয়ে গেল
। ভাগ্যিস হ’ল খেলাটা ।
হ’ল বলেই তো আমি জানতে
পারলাম , এই যে আমি
আর্জেন্টিনা বলি , আমার
মতো আরো অর্বাচীন সেটাই
বলে আসছেন বহু যুগ ধ’রে ,
এটা নাকি ভুল । কথাটা
হচ্ছে, ‘ আর্খেন্তিনা
’। আমার স্প্যানিশ জানা
বিদ্বজন বন্ধুরা
এমনটাই বলছেন । ঐ ভাষায়
জ - এর উচ্চারণটা খ - এর
মতো । ব্যাপারটা
অস্বীকার করছি না ।
কিন্তু তাই ব’লে আমাকেও
বা একজন বাঙালিকেও কেন
আর্খেন্তিনা বলতে হবে
এইটে মাথায় ঢুকছেই না
কিছুতে । এই যে আমার নাম
অর্জুন , সমস্ত অবাঙালি
বন্ধুরা যে আমার ‘
আর্জুন ’ বলেন , তাঁরা কি
তাহলে ভুল বলেন ?
মাসখানেক হ’ল একটি
গ্রিক ক্লাসে ভর্তি
হয়েছি । ভাষাটি শিখব
ব’লে। গিয়ে জানতে
পারলাম আরো ভুলের গল্প
। আদতে ঐ দেশটার নাম
নাকি গ্রিসই নয় । তার
নাম ‘ এল্লাদা ’। অন্তত
গ্রিকরা সেটাই বলেন ।
প্লেটো আসলে প্লেটো নন ,
তিনি প্লাতন ।
আলেকজাণ্ডারও আসলে
আলেকজাণ্ডার নন । তিনি
আলেক্স আন্দ্রুস । কথা
হল , আমার জিভের
উচ্চারণের সাথে তো আমার
সভ্যতার জল - মাটি -
হাওয়া ও মানুষ — এঁরা
মিশে আছেন । একজন গ্রিক
আলেকজাণ্ডারকে আলেক্স
আন্দ্রুস বলছেন , সেটাই -
ই বলবেন তিনি । কিন্তু
আমার আলেকজাণ্ডারে ভুল
কোথায় ? আমি তো
আলেকজাণ্ডারকেই চিনি ।
শুনেছি , শিল্পী
কিশোরকুমার একবার কোনো
একটি গানে , যে গানটি
দরবারী রাগের ওপর ছিল ,
সেখানে একজায়গায় কোমল
'নি' ঠিকমতো লাগাতে
পারছিলেন না । কেউ তখন
তাঁর ভুল ধরিয়ে
দিচ্ছিলেন বারবার ।
একসময় কিশোর বললেন , যদি
ওখানে শুদ্ধ নি - তেই
ইমোশনটা প্রকাশ পায়
তাহলে আমি শুদ্ধ নি - টাই
লাগাবো , কোমল নি দেবো না
। দরবারীর জাত রাখার
কোনো দায় আমার নেই ।
ক্রিয়েটিভিটির কোনো
দায় নেই ব্যাকরণের মরাল
কনস্ট্রাক্ট - এর জাত
রাখার । আমার মাঝে
মাঝেই মনে হয় , ব্যাকরণ
অনেকটা সেন্সর বোর্ডের
মতো । লাল কালির
রাইট - কাটা দেবার জন্য
ব’সে আছে । কিন্তু
ব্যাকরণ তো নিজে নিজে
এ’ কাজ করতে পারে না ।
লাল পেনটা তো ধরতে হয়
কাউকে । তাঁরাই রায়
দেবেন, দেড় মাত্রা কম হল
এখানে । ঐখানে কোমল নি -
টা লাগলো না হে । এইখানে
বচনজ্ঞান ঠিক নেই তোমার
। আমি কিন্তু শুনতে পাই
এসব রায় ছাপিয়ে আরেকজন
রায় দিচ্ছেন।
‘ ব্যাকরণ মানি না ’।