থ্রিলার মুভি দেখতে
আমার বরাবরই খুব ভালো
লাগে । কিন্তু এই
মুভিটা দেখতে গিয়ে কেমন
যেন দমবন্ধ হয়ে আসছিল ।
অবাক লাগছিল , বিরক্ত
লাগছিল , নিজেকে খুব
অসহায় লাগছিল । এতগুলো
মানুষ , কি করে এমন
পাগলের মতো ব্যবহার
করতে পারে সেটা ভেবেই
পাচ্ছিলাম না । শেষ
পর্যন্ত যখন জেলখানার
বাইরে বেরিয়ে এলো সবাই ,
আমিও যেন অনেকক্ষণ থেকে
আটকে রাখা নিঃশ্বাসটা
ছাড়লাম ।
ছবিটার নাম ‘ দ্য
এক্সপেরিমেন্ট ’।
মুক্তি পেয়েছিল ২০১০
সালে । যখন জানতে
পারলাম ছবিটা একটা
সত্যি ঘটনা অবলম্বনে
তৈরি , কৌতূহলটা জাগল
তখনই । হাতের কাছে ছিল
ইন্টারনেট । খুঁজলাম ,
পেয়েও গেলাম । জানতে
পারলাম গল্পের পিছনে
সত্যি ঘটনাটা ।
ঘটনাটা একটি বিখ্যাত
ঘটনা । বিখ্যাত না বলে
কুখ্যাত বলাটাই বোধ হয়
ঠিক হবে ।
সালটা ১৯৭১ । আমেরিকার
স্ট্যানফোর্ড
বিশ্ববিদ্যালয়ের
সাইকোলজি বিভাগের
প্রোফেসর ডঃ ফিলিপ
জিমবারডো দুই
সপ্তাহব্যাপী একটি
গবেষণামূলক পরীক্ষা
করবেন ঠিক
করলেন । জেলখানা
মানুষের ব্যবহারকে
নিয়ন্ত্রন করে কিনা ,
সেটা যাচাই করাই ছিল
ওনার মূল উদ্দেশ্য ।
জেলে কয়েদীদের সঙ্গে
যেরকম কদর্য ব্যবহার
করা হয় বা জেলের
পাহারাদাররা
পদাধিকারবলে যে
ক্ষমতার অধিকারী হয় তা
এই মানুষগুলির
মানসিকতায় কোনও প্রভাব
ফেলে কিনা - সেটাই দেখতে
চান উনি । এই পরীক্ষায়
স্বেচ্ছায় যোগদানকারী (
volunteer ) চেয়ে স্থানীয়
সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন
দেওয়া হল । দিনে পনেরো
ডলার করে দেওয়া হবে ।
১৯৭১ সালের পনেরো ডলার
আজকের হিসেবে প্রায় ৮৮
ডলার । ভারতীয় টাকায়
প্রায় ৫৩৩৫ টাকা ।
অঙ্কটা নেহাত কম নয় !
একটু বাড়তি আয় হলে কার
না ভালো লাগে ? ৭০জনেরও
বেশি পুরুষ এই
বিজ্ঞাপনের ডাকে সারা
দিল । এদের মধ্যে থেকে
বাদ গেল তারা , যারা
অপরাধী বা মাদকাসক্ত ।
যাদের শারীরিক বা
মানসিক সমস্যা আছে এমন
সকলেও বাদ গেল । শেষ
পর্যন্ত ঝাড়াই বাছাই
করে পরীক্ষার
অংশগ্রহণকারী হিসেবে
নেওয়া হল মাত্র
চব্বিশজন কলেজ ছাত্রকে
। এরা সবাই আমেরিকা বা
কানাডার নাগরিক । সুস্থ
, স্বাভাবিক , শক্তসমর্থ
, বুদ্ধিমান ও
মধ্যবিত্ত যুবক ।
ইউনিভার্সিটির
সাইকোলজি বিভাগের
বেসমেন্টে জেলখানা
সাজানো হল বেশ
নিপুণভাবেই । কয়েদীদের
সেল , তার দরজা , খোলা
জায়গা , লাউড স্পিকার ,
এমন কি একদম সত্যিকারের
জেলখানার মতই এই সাজানো
জেলখানায় একটা
অন্ধকূপও রাখা হল । আরও
কঠিন শাস্তি দেওয়ার
জন্যে সেই অন্ধকূপে
অবাধ্য কয়েদীকে একদম
একা আটকে রাখা যাবে ।
সারা জেলখানায় কোন ঘড়ি
বা জানলা নেই , তাই সময়
বোঝারও কোনও উপায় নেই ।
সমস্ত ঘটনা রেকর্ড করে
রাখার ব্যবস্থা করা হল
। মানে , নাটকের মঞ্চ
প্রস্তুত , শুধু নাটকটা
শুরু হলেই হয় । কয়েদী আর
রক্ষী , মূল কুশীলবদের
ভাগ করা হল এই দুই ভাগে ।
এখন কোন বারো জন হবে
কয়েদী আর কোন বারো জন
হবে রক্ষী , সেটা ঠিক করা
হল কয়েন টস করে । মজার
ব্যাপার হল এই যে
পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে
পর্যন্ত এরা সবাই
কিন্তু পরস্পরের অচেনা
ছিল । ডঃ জিমবারডো
নিজেও মঞ্চে নামলেন ,
নিলেন জেলসুপারের
ভূমিকা ।
এক্সপেরিমেন্ট শুরুর
দিন বেশ ঘটা করে লোকাল
পুলিশের সাহায্যে
সর্বসমক্ষে হাতে
হাতকড়া পরিয়ে বাড়ি থেকে
তুলে আনা হল বন্দীদের ।
অভিযোগ - দলবদ্ধ
সশস্ত্র ডাকাতির ।
তারপর চোখ বেঁধে ওদের
নিয়ে আসা হল সাজানো
জেলখানায় । সাজানো এই
গ্রেপ্তারের ঘটনায়
কিন্তু কোনও ফাঁক ছিল
না । বন্দীদের অপরাধের
গুরুত্ব বুঝিয়ে
বলা , তাদের অধিকার
সম্পর্কে সচেতন করিয়ে
দেওয়া থেকে শুরু করে
তাদের হাতের আঙ্গুলের
ছাপ নেওয়া , নগ্ন করে
সার্চ করা , ওদের শরীরে
কোন উকুন থাকতে পারে এই
সন্দেহে ওষুধ স্প্রে
করা কোনও কিছুই বাদ রইল
না । বরং বাড়তি যোগ হল
অন্তর্বাসহীন ঢলঢলে
মেয়েদের পোশাকের মতন
ইউনিফর্ম আর পায়ে শিকল
। এই মেয়েদের পোশাকের
মতন ইউনিফর্মের
ব্যাপারটা কিন্তু আসল
জেলখানার থেকে আলাদা ।
এখানে ইচ্ছাকৃত এই
বিশেষ ধরনের
ইউনিফর্মের উদ্দেশ্য
একটাই । কয়েদীদের
ম্যাসকুলিনিটিকে
প্রশ্নের মুখে রাখা ।
জেলখানায় কয়েদীর কোনও
নাম নেই । সবাই
জেলকয়েদী । আর জেলে
ঢোকার পর থেকে সবাই এক
একটি নম্বর মাত্র । এই
নম্বরের বাইরে কোনও
অস্তিত্ব নেই ওদের । এক
কথায় , পুরুষ তো নয়ই ,
এমনকি আর মানুষও নয় ।
জেলকয়েদী হিসেবে ওরা
অসহায় এবং ওদের যে কোনও
ক্ষমতা নেই সেটাও
নাটকের একদম শুরুতেই
বুঝিয়ে দেওয়া হল ।
অপরপক্ষে
এক্সপেরিমেন্ট শুরু
হওয়ার আগের দিন কোন
বিশেষ ট্রেনিং না দিলেও
রক্ষীদের এটা বুঝিয়ে
দেওয়া হল যে এই
জেলখানায় ওরাই
সর্বেসর্বা । ওরাই
কয়েদীদের নিয়ন্ত্রক ।
শারীরিক কোনও ক্ষতি না
করে কয়েদীদের ভয় দেখানো
বা বিভিন্নভাবে
উত্যক্ত করা
জেলরক্ষীদের অধিকারের
মধ্যেই পড়ে । রক্ষীদের
হাতে থাকবে একটা করে
লাঠি আর পরনে থাকবে
খাকি পোশাক । চোখে
থাকবে আয়নার মত রোদচশমা
। কয়েদীরা সারাদিনই
জেলখানায় বন্দী । অপর
পক্ষে রক্ষীরা শুধু যে
স্বাধীন তাই নয় , ওরা
সারাদিন কাজও করবে না ।
একসঙ্গে তিনজন করে
রক্ষী দিনের আংশিক
সময়ের জন্য কাজ করবে (
শিফট ডিউটি ) । মানে
বারো জন কয়েদীকে তিনজন
রক্ষী নিয়ন্ত্রন করবে ।
শুধু তো কয়েদীদের নয় ,
রক্ষীদেরও ডঃ জিমবারডো
লক্ষ করবেন । তাই ঠিক
যেমন নম্বরের বাইরে
কয়েদীদের কোন পরিচয় ছিল
না , তেমনই ইউনিফর্ম
ছাড়া জেলরক্ষীদেরও
কোনও আলাদা পরিচয় ছিল
না । একদল হঠাৎ করে সব
ক্ষমতা হারিয়েছে , আর
একদল হঠাৎ করেই অনেক
ক্ষমতা পেয়ে গিয়েছে ।
কেমন করে এই নতুন পাওয়া
পরিচয় জেলকয়েদী আর
জেলরক্ষী দুজনেরই
ব্যবহারকে
প্রভাবান্বিত করে ডঃ
জিমবারডো সেটাই তো
দেখতে চান ।
শুরু হল
এক্সপেরিমেন্ট।
প্রথমদিন সারাদিন ধরে
বারেবারে নম্বরগুলো
বলে বলে কয়েদীদের মাথায়
নতুন পরিচয়টা গেঁথে
দেওয়া হল । আর এই কাজটা
করল জেলরক্ষীরা । একই
সঙ্গে দুটো কাজ হল এই
বারেবারে নম্বর
কাউন্টিং এর ফলে । এক ,
কয়েদীরা নিজেদের নতুন
পরিচয় মেনে নিল । আর দুই
, এই রক্ষীরাই যে
কয়েদীদের নিয়ন্ত্রণ
করবে সেটাও কয়েদীদের
বুঝিয়ে দেওয়া হল ।
প্রথমদিনটা বেশ
নির্বিঘ্নে কাটলেও
ঝামেলা শুরু হল পরের
দিন । ডঃ জিমবারডো এটা
ঠিক আশা করেন নি ।
কয়েদীরা আর রক্ষীদের সব
কথা শুনে চলতে রাজি নয় ।
ওরা প্রতিরোধ গড়ে তুলল
। বিছানার সাহায্যে
সেলগুলোর দরজা বন্ধ করে
রাখল কয়েদীরা । সেই
পরিস্থিতিতে কি করে জোর
করে প্রতিরোধ ভাঙ্গা
হবে রক্ষীরাও সেই
পরিকল্পনা শুরু করল ।
কয়েদীদের দেখিয়ে দিতে
হবে জেলখানার ভিতরে কে
বস আর কে প্রায় দাসের
মতো সব আদেশ মেনে চলতে
বাধ্য । ক্ষমতার কি
অপার মহিমা ! সাজানো
রক্ষীরা গায়ের জোরে
সাজানো কয়েদীদের
বিছানা কেড়ে নিল , ওদের
নগ্ন করে রেখে দিল ।
শুরু করল আরও নানান
উপায়ে উত্যক্ত করা ।
কয়েদীদের কারনে অকারনে
পুশ - আপ করানো বা সেলে
আটকে রাখা কিম্বা
শৌচাগার ব্যবহার করতে
না দেওয়া ইত্যাদি নানান
উপায়ে অত্যাচার করা
শুরু হল । শৌচাগার
ব্যবহার করতে না দিয়ে
কয়েদীদের একটা করে
বালতি দেওয়া হল মলমূত্র
ত্যাগ করার জন্য ।
শাস্তিস্বরূপ সেই
বালতিও পরিষ্কার করা হল
না । সমস্ত জেলখানা হয়ে
উঠল নোংরা আর
দুর্গন্ধময় । এদিকে
অন্ধকূপটাও তো রয়েছে।
সেটাই বা বাদ যায় কেন !
রক্ষীরা প্রতিরোধের
দলনেতা কয়েদীকে রেখে
দিল অন্ধকূপে ।
কিন্তু এক এক শিফটে
রক্ষীর তুলনায় কয়েদীরা
সংখ্যায় বেশি ।
সেক্ষেত্রে কয়েদীদের
কি করে একটানা চাপে
রাখা যাবে , তাই নিয়ে বেশ
চিন্তায় পড়ল রক্ষীরা ।
এবার রক্ষীরা বুঝতে
পারল যে শারীরিক নয় ,
মানসিক চাপ তৈরি করা
দরকার । মানসিক চাপই
বরং অনেক বেশি কার্যকরী
হবে । সুতরাং রক্ষীরা
একটা বিশেষ প্রিভেলেজ
সেল বানিয়ে ফেলল চটপট ।
প্রতিরোধের পিছনের
সারিতে ছিল এমন তিনজন
কয়েদী সেই বিশেষ
প্রিভেলেজ সেলে থাকার
অধিকার পেল । বাকি
কয়েদীরা দেখল যে ওই
তিনজন কয়েদী ইউনিফর্ম ,
বিছানা আর দরকারে
শৌচাগারে যাওয়ার মত
সামান্য কিছু সুবিধা
ফেরত পেল । বাকি
কয়েদীদের দেখিয়ে
দেখিয়ে ওদের ভালো
খাবারও দিল রক্ষীরা ।
উদ্দেশ্য একটাই ,
কয়েদীদের মনোবল ও
একতাকে ভেঙ্গে দেওয়া ।
আশ্চর্য ব্যাপার এটাই
যে রক্ষীরা কেউই কিন্তু
পেশাদার রক্ষী নয় ।
সবাই সাধারণ মধ্যবিত্ত
কলেজগামী যুবক । কিন্তু
আরও কয়েকটি একই রকম
কলেজে যাওয়া সাধারণ
মধ্যবিত্ত যুবককে দমন
করার জন্য ক্ষমতার
ব্যবহারটা একদম
পেশাদার রক্ষীদের মতই
করা শুরু করল ওরা । নকল
ক্ষমতার অপপ্রয়োগটা
রক্তে ঢুকে গেল ।
কারারক্ষীর পরিচয়টাই
যেন ওদের আচরণকে দিল
আমূল বদলে ।
এই মানসিক চাপ সৃষ্টির
খেলাটা আরও জমে উঠল যখন
রক্ষীরা এই বিশেষ
সুবিধা পাওয়া তিনজন
কয়েদীকে আবার ফিরিয়ে
দিল তাদের পুরনো জায়গায়
। আর তার বদলে অন্য
তিনজন কয়েদীকে
প্রিভিলেজ সেলে রাখল ।
যারা তাদের পুরনো
জায়গায় ফিরে গেল, তারা
কিন্তু আর বাকি
কয়েদীদের বিশ্বাস ফিরে
পেল না । সত্যিকারের
জেলখানায় যেমন হয় ঠিক
তেমনই বাকি কয়েদীরা
সন্দিহান হয়ে উঠল যে
এরা নিশ্চয়
জেলরক্ষীদের ইনফর্মার
। ঠিক যেমনটা রক্ষীরা
চেয়েছিল তেমনটাই ।
দ্বিধা বিভক্ত হয়ে গেল
কয়েদীদের একতা । এই
বিভেদনীতি প্রয়োগের
ফলে একদিকে যেমন
কয়েদীরা সবাই সবাইকে
অবিশ্বাস করতে শুরু করল
, তেমন অন্যদিকে
কয়েদীদের একতা ভেঙ্গে
যাওয়ায় রক্ষীদের
নিজেদের মধ্যে একতা গেল
বেড়ে ।
মাত্র দেড় দিন । তার
মধ্যেই ঘটে গেল এত কিছু
। এক্সপেরিমেন্ট আর
নিছক এক্সপেরিমেন্ট
রইল না । নাটকের
প্রতিটি চরিত্র যেন
রক্ত মাংসের হয়ে উঠল । এ
যেন সত্যিকারের জেলে
সত্যি কয়েদী আর সত্যি
রক্ষীদের মধ্যে
ক্ষমতার লড়াই ।
পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালো
যে কয়েদীরা সত্যিই
রক্ষীদের কোনও ক্ষতি
করতে পারে এই ভেবে
রক্ষীরাও হয়ে উঠল আরও
আক্রমনাত্মক । বেড়ে গেল
কয়েদীদের নিগ্রহ করার
মাত্রা। এই শারীরিক ও
মানসিক নিগ্রহের ফলে
দেখা গেল একটি কয়েদী
অদ্ভুত অসংলগ্ন
ব্যবহার শুরু করেছে ।
কিন্তু ততক্ষনে
রক্ষীরা আর
কর্তাব্যক্তিরাও
কর্তৃত্বের মোহে পড়ে
গিয়েছে। ওরা সেই কয়েদীর
কান্না , রাগ, বা
মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়া
দেখেও ভাবছে যে ঐ কয়েদী
নিশ্চয় অভিনয় করছে ওদের
বোকা বানানোর জন্য ।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য
কর্তৃপক্ষ মেনে নিল যে
ঐ কয়েদী সত্যিই অসুস্থ
। তাকে এক্সপেরিমেন্ট
থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হল
।
এরপর এল পরিবারের
লোকজনের সঙ্গে দেখা
করার দিনটা । ইতিমধ্যে
জেলের যা চেহারা হয়েছিল
তাতে ডঃ জিমবারডো ভয়
পেলেন যে বাবা মায়েরা
যদি তাদের ছেলেদের ফেরত
নিয়ে চলে যান ! তড়িঘড়ি
জেলখানা আর কয়েদীদের
সাফ সুতরো করে ফেলা হল ।
অদ্ভুত ব্যাপার , বাবা
মায়েরাও কিন্তু তাদের
ছেলেদের সঙ্গে দেখা
করার জন্য নানান অদ্ভুত
সব নিয়ম মেনে নিলেন ।
তারাও যেন এই সাজানো
জেলখানার নাটকে অংশ
নিলেন সত্যিকারের
মধ্যবিত্ত কয়েদীর বাবা
মা হিসেবে ।
নাটকের পরবর্তী অংশে
একটা গুজব ছড়িয়ে পড়ল ।
এক্সপেরিমেন্ট থেকে
বেড়িয়ে যাওয়া কয়েদী
নাকি বেশকিছু লোকজন
নিয়ে ফিরে এসে বাকি
কয়েদীদের মুক্ত করবে ।
এবার গবেষকের মতো
ঘটনাকে শুধু লক্ষ করে
যাওয়ার বদলে একদম
সত্যিকারের জেলখানার
কর্তৃপক্ষের মতই ডঃ
জিমবারডো সেটা আটকানোর
চেষ্টা করলেন । এমন কি
সত্যিকারের একজন
ইনফর্মার রাখার কথাও
ভেবে ফেললেন তিনি । এই
সময় সাজানো জেলখানার
কয়েদী, রক্ষী ,
কর্তৃপক্ষ সবাই তাদের
নিজ নিজ ভুমিকায় এমন
ভাবে ঢুকে গিয়েছে যে
পরিস্থিতি হয়ে উঠল
অগ্নিগর্ভ । যে কোন
মুল্যে কয়েদীদের বাগে
রাখতে হবে , তাদের
পালানো আটকাতে হবে ।
এমন কি যে ছেলেটি
এক্সপেরিমেন্ট ছেড়ে
চলে গিয়েছে তাকে ফিরিয়ে
এনে আরও বেশি করে
শাস্তি দেওয়ার কথাও
ভেবে ফেললেন ডঃ
জিমবারডো । নিয়ম
অনুযায়ী এই
এক্সপেরিমেন্ট থেকে
যেকোন যোগদানকারী
যেকোন সময় ছেড়ে চলে
যেতে পারে । কিন্তু ডঃ
জিমবারডো তখন আর
স্বাভাবিকভাবে ভাবতেই
পারছেন না । উনি তখন
একজন জেলসুপারের মতই
ভাবছেন ঐ কয়েদী নিশ্চয়
ওনাকে বোকা বানিয়ে চলে
গিয়েছে ।
একটা সম্পূর্ণ দিন কেটে
গেল কয়েদীদের পালানো
আটকানোর পরিকল্পনায় ।
যখন দেখা গেল গুজব শুধু
গুজবই ছিল তখন রক্ষীরা
যেন আরও ক্ষেপে উঠল ।
কয়েদীদের প্রতি
অত্যাচারের পরিমাণ গেল
মারাত্মক বেড়ে । এরপর
সমস্ত ব্যাপারটা আরও
জটিল হয়ে গেল যখন একজন
পাদ্রিকে ডেকে আনা হল
সব কয়েদীদের সঙ্গে কথা
বলার জন্যে । দেখা গেল
কয়েদীরা আর নিজেদের নাম
নয় , নিজেদের নম্বর বলেই
নিজেদের পরিচয় দিল ।
এমন কি জেল থেকে
বেরোনোর জন্য আইনের
সাহায্য নেওয়ার কথাও
তারা বলল। ওরা ভুলেই
গিয়েছে যে ওরা একটা
এক্সপেরিমেন্টে
কয়েদীর ভূমিকা পালন
করছে। এই
এক্সপেরিমেন্ট মাত্র
দুই সপ্তাহের । তারপর
বেশ কিছু টাকা পকেটে
নিয়ে ওরা যে যার বাড়ি
চলে যাবে । স্বাভাবিক
জীবনযাপন করবে । কিম্বা
এক্সপেরিমেন্ট থেকে যে
কোন সময় বেড়িয়ে গেলেও
যে ওরা এই জেলখানা থেকে
মুক্তি পাবে সেটাও যেন
ওরা ভুলে গিয়েছিল ।
জেলখানার পরিবেশ আর
পরিস্থিতি ওদের
এমনভাবে প্রভাবান্বিত
করেছিল যে ওরা নিজেদের
সম্পূর্ণ অসহায় বলে মনে
করছিল ।
অন্য আরেকজন কয়েদী ( ৮১৯
নম্বর ) এবার পাগলের মত
ব্যবহার শুরু করল ।
পাদ্রি না , ও একজন
ডাক্তারের সঙ্গে দেখা
করতে চায় । ওর শরীর
খারাপ লাগছে । ওকে
আলাদা একটা ঘরে রাখা হল
একজন ডাক্তার দেখানো
হবে বলে । ঠিক এই সময়
কিছু রক্ষী বাকি
কয়েদীদের দিয়ে একসঙ্গে
বলাতে শুরু করল যে ৮১৯
নম্বর কয়েদী একজন
‘ খারাপ কয়েদী ’। এই
শুনে ঐ অসুস্থ কয়েদী
সত্যিই আবার তার পুরনো
সেলে ফিরে যেতে চাইল ।
বাকি কয়েদীদের কাছে ওকে
প্রমান করতেই হবে যে সে
‘ খারাপ
কয়েদী ’ নয় । ছেলেটি
সত্যিই অসুস্থ , তাই
এবার ডঃ জিমবারডো ওকে
মনে করিয়ে দিলেন যে ওর
একটা নাম আছে । ও একটা
সাজানো জেলখানায়
সাজানো কয়েদীর অভিনয়
করছে । এবং বাকি কয়েদী
বা রক্ষীরাও তাই । শুনে
যেন একটা দুঃস্বপ্ন
থেকে জেগে উঠল ছেলেটি ।
জেলরক্ষী আর কয়েদীদের
উভয়ের আচরনেই বিভিন্ন
পরিবর্তন দেখা গেল ।
দেখা গেল অসহায় , ভগ্ন
মনোবল কয়েদীরা নানান
উপায়ে এই সাজানো
জেলখানায় টিকে থাকার
চেষ্টা করছে । কেউ কেউ
মানসিক ভাবে ভেঙ্গে
পড়লেও কেউ কেউ আবার
মারামারি শুরু করে দিল
। আবার , একজন কয়েদী
অসুস্থ হয়ে পড়ল যখন
জানতে পারল যে তার শর্ত
সাপেক্ষে মুক্তির
আবেদন গ্রাহ্য হয় নি ।
কেউ কেউ আবার প্রাণপণ
চেষ্টা করল ভালো কয়েদী
হয়ে থাকার । কিন্তু
কয়েদীদের মধ্যে একটা
বিশেষ পরিবর্তন
কর্তৃপক্ষের নজর এড়াল
না । দেখা গেল ওদের
মধ্যে আর কোনও একতা নেই
। সবাই যেন এক একটা
বিছিন্ন দ্বীপের মতন ।
সবাই স্বার্থপরের মত
শুধু নিজেকে টিকিয়ে
রাখতেই মরিয়া । নিজের
ছোট ছোট সুবিধা পাওয়ার
জন্য অন্য কয়েদীর
নিগ্রহ যেন ওদের গায়েই
লাগছিল না । এরকমটাই তো
দেখা যায় সত্যিকারের
জেলখানাগুলোতে । তাহলে
প্রশ্ন উঠে ,
সত্যিকারের জেলখানার
কয়েদীদের মধ্যে
পরস্পরের প্রতি যে
বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব
দেখা যায় তা কি আসলে
জেলব্যবস্থা বা
জেলকর্তৃপক্ষেরই তৈরি
করা ? অপরপক্ষে রক্ষীরা
যেন আনন্দ পাচ্ছে তাদের
এই ক্ষমতার অপপ্রয়োগ
করে । রক্ষীরা কেউ দেরি
করে কাজে আসতো না ।
কিম্বা কেউ তাড়াতাড়ি
কাজ থেকে চলেও যেত না ।
এমনকি একজন রক্ষীও
বেশিক্ষণ কাজ করার জন্য
অতিরিক্ত পারিশ্রমিক
চায় নি ।
‘ স্বভাবগত চরিত্র নাকি
পরিবেশ ও পরিস্থিতি
মানুষের চরিত্র ঠিক করে
দেয় ? ’ এটা একটা বড়
জিজ্ঞাসা ছিল ডঃ
জিমবারডোর । এখন আরও
অনেক অনেক প্রশ্ন ভিড়
করে এল । কি করে সুস্থ ,
বুদ্ধিমান , সাধারণ
মধ্যবিত্ত মানুষগুলো
এত তাড়াতাড়ি এমন পাল্টে
গেল ? কেন সাজানো
জেলখানায় সাজানো
জেলরক্ষী হিসেবে কাজ
করতে গিয়ে সেই সাধারণ
মানুষগুলো এমন অকারণ
নিষ্ঠুর হয়ে উঠল ? কেন
তারা ক্ষমতার
অপব্যবহার করতে শুরু
করল ? কেন সাজানো
কয়েদীরা সব অত্যাচার
মেনে নিল ? কেন ওরা ভুলে
গেল যে যেকোন সময় ওরা
এক্সপেরিমেন্ট ছেড়ে
বেড়িয়ে যেতে পারে ?
এমনকি বাবা মায়েরা যারা
সরাসরি এই নাটকের
কুশীলব নন , তারাই বা কেন
মেনে নিলেন তাদের
সন্তানের নিগ্রহ ? এই সব
প্রশ্নের হয়তো একটাই
উত্তর হয় । আর সেই
উত্তরটা হল ‘ ক্ষমতা ’।
বিভিন্ন কারনে ও
বিভিন্ন সময়ে প্রায়
পঞ্চাশজন লোক বাইরে
থেকে এসেছিল এই সাজানো
জেলখানায় । একমাত্র
ক্রিস্টিনা ম্যাসলাক (
ডঃ জিমবারডোর ভবিষ্যৎ
স্ত্রী ) নামক পিএইচডির
ছাত্রীটি এর প্রতিবাদে
সরব হয়েছিল । তার মতে
এটা মনুষ্যত্বের অপমান
। যেভাবে গবেষণা করার
জন্য এতগুলো মানুষকে এত
অত্যাচার সহ্য করতে
হচ্ছে বা কিছু মানুষ
অত্যচার করছে তা মেনে
নেওয়া মানবিক নয় ।
মাত্র ছদিন । কয়েদী আর
রক্ষীদের ক্ষমতার
টানাপোড়েনে পরিস্থিতি
এমন উত্তপ্ত হয়ে উঠল যে
বাধ্য হয়ে ডঃ জিমবারডো
এক্সপেরিমেন্ট বন্ধ
করার সিদ্ধান্ত নিলেন ।
এক্সপেরিমেন্ট শেষে
ছদিনের দিন একটা
মুখোমুখি কথা বলার
ব্যবস্থা করা হল । সব
কয়েদী , রক্ষী এবং
অন্যান্য কর্মীদের
মধ্যে । গবেষণার কারনে
কেউ যেন সত্যিকারের
অপরাধী বা অপরাধের
শিকার না হয়ে পড়ে , এটাই
ছিল এই মুখোমুখি কথা
বলার উদ্দেশ্য ।
আশ্চর্য ব্যপার এটাই যে
কয়েদীরা খুশি হলেও
এক্সপেরিমেন্ট হঠাৎ
শেষ হয়ে যাওয়ায় রক্ষীরা
কিন্তু মোটেই খুশি হতে
পারল না ।
১৯৭১ সালের আগস্টের ১৪
থেকে ২০ এই ছ’টা দিন ঠিক
ছিল না ভুল ছিল সেই নিয়ে
বিতর্ক শেষ হবার নয় । ডঃ
জিমবারডো যখন বুঝতে
পারছেন যে কয়েদীরা আর
রক্ষীরা তাদের নাটকের
ভুমিকার সঙ্গে নিজেদের
অস্তিত্বকে গুলিয়ে
ফেলছে উনি তখনও
এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে
গিয়েছেন । এমন কি উনি
নিজেও জেলসুপারের
ভূমিকায় এমন ভাবে
নিজেকে মিশিয়ে
ফেলেছিলেন যে তার নিজের
গবেষক পরিচয়টাও যেন
ভুলতে বসেছিলেন।
এক্সপেরিমেন্টে
যোগদানকারীদের কোন
মানসিক বা শারীরিক
ক্ষতি হওয়া উচিৎ নয় । ডঃ
জিমবারডো তার সাজানো
জেলখানায় সেই পরিবেশ
বজায় রাখতে সক্ষম হন নি ,
তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর
গবেষণা চালিয়ে গিয়েছেন
। একদিক থেকে যেমন এটা
একটা বড়
ভুল , তেমন সেই ভুলের অপর
পিঠে কি এই সত্যটাও উঠে
আসে না যে আসলে
জেলখানায় মানুষকে
মানুষ বলে গণ্যই করা হয়
না ? যে বিভেদনীতির
প্রয়োগ রক্ষীদের
দলবদ্ধ করে তোলে , সেই
একই বিভেদনীতির প্রয়োগ
কয়েদীদের পরস্পরের
শত্রু করে তোলে । ডঃ
জিমবারডোর
এক্সপেরিমেন্ট দেখিয়ে
দিল ক্ষমতার অভাব
কয়েদীদের মধ্যে হতাশা ,
অবিশ্বাস , স্বার্থপরতা
বা আরও বড় অপরাধী হবার
সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে ।
আবার এটাও দেখা গেল
ক্ষমতা প্রয়োগের
ক্ষমতা কখন যেন অতি
সাধারণ মানুষকেও
নিষ্ঠুর করে তোলে ।
জেলখানা অপরাধীদের
ভিতরে রেখে সমাজকে আরও
নিরাপদ করে রাখার
প্রতিশ্রুতি
দেয় । কিন্তু আজ এটাই কি
বারে বারে দেখা যায় না
যে সমাজে অপরাধ কমার
বদলে বেড়েই চলেছে ?
মানুষকে সবসময় মানুষের
মর্যাদা দেওয়া উচিৎ ,
এমনকি জেলেও এই কথাটা
হয়ত ভুলে যাওয়া উচিৎ নয়
। ডঃ জিমবারডোর গবেষণা
এটাই দাবী করে , জেলখানা
এমন হওয়া দরকার যেখানে
কোন মানুষের মানবিকতা
ধ্বংস হয়ে যাবে না । বরং
এমন হওয়া উচিৎ যেন
অপরাধী তার ভুলটাকে
সংশোধন করার সুযোগ পায়
। কিন্তু সেই রকম
জেলখানা সত্যিই কি আজও
তৈরি হয়েছে ? তাই ডঃ
জিমবারডোর ছ’দিনের
সাজানো জেলখানার
গবেষণা চালিয়ে যাওয়া
ভুল , নাকি সেই
গবেষণালব্ধ তথ্য
ব্যবহার করে মানবিক
সংশোধনাগার বানানোর
প্রচেষ্টা না করাটা ভুল
, এই প্রশ্নের কোন সহজ
উত্তর নেই ।
জেলখানা কি অপরাধীকে
আরও বড় অপরাধী করে তোলে ?
এই জেলখানার উৎপত্তি কি
ভুল ? একজন অপরাধীকে
দেশের অন্য নাগরিকদের
করের টাকায় ভালভাবে
বেঁচে থাকার সুযোগ
দেওয়া কি ঠিক ? নাকি
তাদের জীবন কেড়ে
নেওয়াটাই ঠিক ? সব রকম
চিন্তাই উঠে আসে ।
জীবনদায়ী ওষুধের
গবেষণায় কত প্রাণী
প্রতিদিন জীবন
হারাচ্ছে , সেটা কি ঠিক ?
বিজ্ঞানের অগ্রগতির
কথা মাথায় রাখলেও এই
প্রশ্নের উত্তর দেওয়া
সহজ নয় । ঠিক তেমনই
রাষ্ট্রের বৃহত্তর
স্বার্থরক্ষার খাতিরে
প্রতিদিন এত মানুষের
ব্যক্তিগত সুখ , সুবিধা
এমনকি প্রাণের
জলাঞ্জলি দেওয়া ঠিক না
ভুল তার উত্তর দেওয়াও
সহজ নয় ।
মানব সভ্যতার ইতিহাস
দেখলে এইরকম ‘ ভুল না
ঠিক ’ ঘটনার অজস্র
উদাহরণ পাওয়া যায় ।
সেটা দেশের শিক্ষা
ব্যবস্থায় ভাষার
প্রয়োগ হোক, অন্য দেশের
সঙ্গে যুদ্ধের
সিদ্ধান্ত হোক বা
চাকরিক্ষেত্রে
সংরক্ষণের ব্যবস্থাই
হোক । একমাত্র সময়ই
হয়তো সেই সব প্রশ্নের
সঠিক উত্তর দিতে পারবে
। অথবা হয়ত মানব
সভ্যতার অন্তিম কাল
পর্যন্ত চলতেই থাকবে
ভুল ঠিকের এই দ্বন্দ্ব
।
রেফারেন্স
http://en.wikipedia.org/wiki/Stanford_prison_experiment
৩০/৮/১৪ তে দেখা হয়েছে।
http://www.prisonexp.org/ ৩০/৮/১৪ তে
দেখা হয়েছে।