চিঠি এল৷ 'সরকারি
প্রেমপত্র' বলে টিটকিরি
কেটে গেল কেউ। টিচার্স
রুমের গড় রাজনৈতিক
প্রজ্ঞা বলতে বছরভর
ক্যারাম বোর্ড বা টেবিল
দাবড়ে
বিজেপি-তৃণমূল-কংগ্রেস-
সিপিআইএম। কিন্তু এই
ক'দিন ঝালিয়ে নেওয়া হবে
ভোটগ্রহণের
খুঁটিনাটি৷
আধা-স্বাধীন ভারতবর্ষে
গণতন্ত্রের উদযাপনের
প্রস্তুতি।
'উই দ্য পিপল অফ
ইন্ডিয়া হ্যাভিং
সলেমলি রিসলভড টু
কনস্টিটিউট ইন্ডিয়া
ইন্টু আ সভরেইন
সোশালিস্ট সেকিউলার
ডেমোক্রেটিক
রিপাব্লিক…'
হায়ার সেকণ্ডারি
স্কুল।
শিক্ষক-শিক্ষিকারা
প্রিসাইডিং অফিসারের
ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন৷
সামান্য দু-এক জন
মাস্টারমশাই বা
ক্লার্ক ফার্স্ট পোলিং
অফিসারের ভেক ধরবেন।
ওদিকে ফোর্থ ক্লাস
দাদা-দিদি থার্ড
পোলিং-এর চিঠি হাতে
ব্যাজার মুখে ঘুরবেন।
মহিলারা ‘বুথে বাথরুম
আছে, বুথে বাথরুম নেই,
বাথরুম আছে, বাথরুম
নেই…’ মর্মে ফুলের
পাপড়ি ছিঁড়বেন। আসন্ন
গণতন্ত্রের উৎসব।
গণতন্ত্র এক রূপকথা৷
তাতে বিশ্বাস যাও, হে
নাগরিক!
তড়িঘড়ি প্রথম ট্রেনিং
হয়ে যায়। ট্রেনার কীসব
বলার চেষ্টা করেন
পিপিটি সহযোগে৷
কুমীরছানাসদৃশ দুটো
প্রাচীন ইভিএম-কে
দেখানো চলে।
অত্যুৎসাহী
প্রিসাডিং-রা সেগুলো
হাতে নিতে চান। সকলে
পান না। ইভিএম মিছে বলে
না, হ্যাক হয় না৷ এমত
বিশ্বাস যেতে হয়৷
দ্বিতীয় বা তৃতীয়
ট্রেনিং-এ দেখা হয় চার
প্রান্তের চার
মানুষের। সেকণ্ড পোলিং
বলেন,‘ ভালো চোখে
দেখিনা। একটু সামলে
দেবেন।’ থার্ড পোলিং
বলেন, ‘আর দুটো বছর
সার্ভিস। বাঁচাবেন।
সার্ভিস বুকে দাগ পড়লে
পেনশন নিয়ে টানাটানি!’
ভোটের এক বা দুদিন আগে
ডিসিআরসি-তে সক্কাল
সক্কাল। জিনিষপত্র
পেতে দেরি। জিনিষপত্র
জুটে গেলে ট্যাগড
ট্রান্সপোর্ট পাওয়া
যায় না। বাস যদি বা মেলে,
তবে সেই বাসে ট্যাগড
অন্য পোলিং
পার্টিগুলোর মধ্যে
অন্তত একটি অবশ্যই
বেপাত্তা থাকে৷ মোদ্দা
কথা, সন্ধে নামার আগে
বুথে পৌঁছলে
গণতন্ত্রের অদৃশ্য
দেবতা পাপ দ্যান। অনেক
কৃচ্ছ করে আলো নিবে এলে
কিছু অপদেবতা তাই
মেশিনপত্র নিয়ে বুথে
হানা দ্যায়৷
পৌঁছে দেখা যায়, বুথ’
বলে থ্রিডি-তে যে বস্তু
দেখানো হয়েছিল, তার
সঙ্গে উক্ত স্থানের মিল
নেই৷ অবুথ-কেই তারা বুথ
বলে বিশ্বাস যায়৷ দারুণ
সৃষ্টিশীল হয়ে বুথ
বানিয়ে ফেলে। আড়মোড়া
ভেঙে ভারতীয়
সামরিক/আধা সামরিক
ব্যাটেলিয়ন মলিন
স্যান্ডোর উপর উর্দি
চাপিয়ে ন্যায়। বন্দুক
কাঁধে টহল দ্যায়৷
আশ্বস্ত করে, আগামীকাল
প্রিজাইডিং হুকুম দিলে
গুলি চালাতে তারা
পিছ-পা হবে না৷
বাথরুম খোঁজার আবশ্যিক
কাজটি সেরে,
সর্বশক্তিমান
প্রিসাইডিং (যিনি আদেশ
দিলেই পরদিন ঠাঁইঠাঁই)
নির্ধারিত কেরানিগিরি
নিয়ে বসে পড়ে। ফর্ম
টর্ম, খাম টাম, সিল টিল...
মাঝে পোলিং এজেন্ট
শাসিয়ে যান দু-চারজন৷
একশ ওয়াটের বালবে বা
কুপির আলোয় বা হুমকিতে
মাথা ধরলে শক্তিধর
প্রিসাইডিং কচ্ছপ
জ্বেলে ঘুমিয়ে পড়ে।
পরদিন নাক-টাক চেপে
প্রাতঃকৃত্য সেরে মহান
প্রিসাইডিং, (যিনি আদেশ
দিলেই আজ
ঠাঁইঠাঁইঠাঁই), হাঁ করে
পোলিং এজেন্টদের পথ
চেয়ে হাই তোলে।
সবে আলো ফুটেছে।
এজেন্টের দেখা নেই,
কিন্তু দাঁতন হাতে
হাজির দু-এক গ্রামবাসী।
তাঁরা হতে চান প্রথম
ভোটার। চাপা গলায় বলেন,
গতবার অমুক গাঁয়ের তমুক
ভোট না দিতে পেরে
কেঁদেছিল খুব। এবার ভোট
তাঁরা দেবেনই।
মক পোল দেখিয়ে,
এজেন্টদের সন্তুষ্ট
করে, মেশিন সিল করে,
সাতটায় ভোট শুরু করতে
হবেই। বাইরে হট্টগোল
শুরু হয়। লাইনে দাঁড়ানো
প্রতিজন...যাদের মতামত
তিনশ চৌষট্টি দিন কেউ
পোছেনি, তাদের আজ
‘মত-দান’ পর্ব। ভোট
দেওয়ার অধিকার অন্যতম
অর্জন। বাম তর্জনিতে
কালি হল জয়টীকা।
লোলচর্মসার, ন্যুব্জ যে
বৃদ্ধা আসেন ভোটকক্ষে
অসংবৃত জামাকাপড়ে, তাকে
ভারতবর্ষ বলে ভুল হয়।
ভোট হয়। কখনও ছাপ্পা
হয়৷ ছাপ্পা আটকালে
রাজকুমার রায় হয়।
বয়স্কদের সানস্ট্রোক
হয়। নির্দিষ্ট সময়ে
ঝাঁপ ফেলার কথা
প্রিসাইডিং স্বপ্নেও
ভাবেন না৷ বরং সন্ধে
নাগাদই কাজকম্ম সেরে
সাদা-কালো, মহার্ঘ, ছোট,
চৌকো কার্ডটি হাতে
পিলপিল করে জড়ো হয় ‘মত
দান’-এ বিশ্বাসী
ভারতবর্ষ,
ক্ষেতে-কাজ-করা
ভারতবর্ষ, ডেলি-ওয়েজের
ভারতবর্ষ। সেই চৌকো
কার্ড অথচ নাগরিকত্ব
নিশ্চিত করে না। ভোটার
কি নাগরিক? আর যিনি ভোট
নিতে এলেন, তিনি? আপনি কি
নাগরিক, ভোটবাবু?
'আমি অন্য কোথাও যাব না,
আমি এই দেশেতেই থাকব।'
ভারি ভাইরাল হয়েছে
নাকি। শুনলে হু হু করে
বুক। অসমের এক
বন্যাকালীন পনেরই
অগাস্ট মনে পড়ে।
হাঁটুজলে ভেঙে স্কুল
প্রাঙ্গনে স্বাধীন
তিরঙ্গাকে স্যালুট
করছেন এক মাষ্টারমশাই।
পরের বছর সংবাদপত্র
বলল, তিনি নাগরিক
পঞ্জিতে ঠাঁই পেলেন না৷
'যাব না' ঘোষণা করতে পারে
তারাই, যাদের 'যাব' আর
'যাব না'-র মধ্যে বেছে
নেওয়ার চয়েজটুকু আছে।
সে চয়েজ আদৌ নেই যাদের?
চাইলেও চলে যাওয়ার উপায়
নেই যাদের?
একসময় ভোট শেষ হয়৷ আরও
ঘণ্টা খানেক খাম- ফর্ম-
গালা- সিল- কন্ট্রোল
ইউনিট- ব্যালট ইউনিট
নিয়ে গলদঘর্ম হয়ে,
পোলিং টিম জওয়ান পরিবৃত
হয়ে আরসি-তে পৌঁছয়৷
আবারও লাইন৷ কেওস।
হিসেব বুঝিয়ে কেউ বাড়ি
ফেরে মাঝরাতে। কেউ
বাধ্য হয়ে আরসি-তেই
থেকে যায়৷ কয়েক ঘণ্টা
আগে যার কথায়
ঠাঁইঠাঁইঠাঁই হতে পারত,
ভোট ফুরোলে তার মাথার
উপর ছাদের ব্যবস্থা কেউ
দ্যাখে না। তবু কেউ এই
সুখানুভূতি নিয়ে ফেরে
যে, গত বছর সন্ত্রাসে
ভোট দিতে না পারা মরিয়া
লোকগুলোর ভোট সে
নিয়েছে। বিকেল পাঁচটায়
কাজ সেরে ভিড় করা
প্রতিজন
খেতমজুর-কারখানা
শ্রমিক-রাজমিস্ত্রীর
ভোট সে নিয়েছে।
বাড়ি ফিরে ফেসবুক খোলে।
সেখানেও মানুষ আজ
ব্যস্ত সারা দিন৷ ভোট
মানে ভোট-দানের ছুটি।
হাতে-কালি হয়ে গেলে
হাতে অঢেল সময়।
বিশ্লেষণ, মন্তব্য,
প্রতি-মন্তব্য। ভোট
ব্যবস্থার মুণ্ডপাত
করছেন কেউ। বলছেন, ইয়ে
মতদান কি আজাদি ঝুঠা
হ্যায়। কেউ একলাফে যৌথ
খামারে ল্যাণ্ড করতে
চাইছেন। প্রিসাইডিং
জানে না, কোথায় সেই
কার্যকরী ও কংক্রিট
ভাবনা-চিন্তার খসড়া,
ব্লুপ্রিন্ট?
কে যেন ‘নিউটন’ বলে এক
ছবি বানিয়েছে৷ ছবির
ছোঁড়া ভোট-ব্যাবস্থাকে
বাঁচাতে চাইছে খোদ
রাষ্ট্রের হাত থেকেই।
বেচারা তাই ঘাড়-টাড়
ভেঙে বাড়ি ফিরল। তবু
ফিরল, সিনেমা বলে।
রাজকুমার রায় ফেরেনি।
বোদ্ধারা বলেন, নিউটন
গণতন্ত্রের সার্কাসে
জোকার। আর বাকিরা?
প্রত্যেক স্বাধীন ‘মত
দাতা’, যাঁরা ইভিএম-এর
বোতাম টিপে বছরে একদিন
‘মত’ দ্যান অথবা
কীবোর্ডের বোতাম টিপে
অহরহ মত দ্যান, তাঁরাও
কি আসলেই জোকার নন?
তাঁদের ফেবু-বক্তৃতায়
ব্যস্ত রাখে কে? সরকার
গড়ে কে? সরকার ভাঙে কে?
একে অন্যকে জোকার
দাগিয়ে ভার্চুয়াল
সমালোচনায় ভুলিয়ে রাখে
কে?
সব জোকারের প্রতি
সমানুভূতি নিয়ে জোকার
ভোররাতে ঘুমিয়ে পড়ে।
স্বপ্নে রূপকথা ফের আসা
যাওয়া করে।
'… অ্যান্ড টু সিকিওর
টু অল ইটস
সিটিজেনস..জাস্টিস...
লিবার্টি...ইকুয়ালিটি...ফ
্র্যাটার্নিটি...ডু
হিয়ারবাই অ্যাডপ্ট,
এন্যাক্ট অ্যান্ড গিভ
টু আওয়ারসেলভস দিজ
কনস্টিটিউশন।'