চারিদিকে থৈ থৈ জল, তার
মাঝে বাতাসের কল, আরও
আছে সবুজের সমারোহ,
শোনা যায়, এই দ্বীপে আছে
স্বর্ণের খনি আর
মানুষেরা
স্বয়ংসম্পূর্ণ।
অনেকটা বইয়ের পাতায়
পড়া, গোলাভরা ধান আর
পুকুর ভরে গেছে মাছে।
কাগজেকলমে এই দ্বীপের
মানুষের থাকার কথা দুধে
ভাতে। তবু, কেন যেন
তাদের মনে নেই কোন সুখ,
কারো কারো মনে হতে পারে
এসব হয়তো সুখের অসুখ,
তবে মানুষেরা সুখে নেই,
তাদের নিদারুণ
নির্লিপ্ততা এ কথার
সাক্ষ্য দেবে। আবার
অনেক সুখের কারণেই
এসেছে এই উদাসীনতা,
এমনও মনে হয় অনেকের
কাছে। এই মনে হওয়া আর না
হওয়ার মাঝে যখন পা
রেখেছি এই দ্বীপে
বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে
তখন প্রথম আমাকে নিয়ে
যাওয়া হলো মিস্টার
এক্সের কাছে।
মিস্টার এক্সের পুরো
নাম জানে না কেউ। কবে সে
এসেছিল এই দ্বীপে, কেন
এসেছিল, কার হাত ধরে,
কোথায় তার আদি বাড়ি,
কোথায় তার বাবা-মা, তারা
বেঁচে আছে নাকি মরে
গেছে? এসব প্রশ্নের কোন
উত্তর কেউ পারে না
দিতে। তবে, সকলেই জানে
মিস্টার এক্স এই
দ্বীপের মাথা। যারা
প্রবীণ তারা বলে,
বহুকাল আগে তাদের বাবার
বাবা ছিল মিস্টার
এক্সের বন্ধু, তবে
তাদের কথা কেউ তেমন
বিশ্বাস করে না। কেননা,
সকলের মনে হয় মিস্টার
এক্স কারো বন্ধু হতে
পারে না। মিস্টার এক্স,
যার চুল দাঁড়ি শাদা, যে
হয়তো এতিম এবং যার নেই
কোন বউ বাচ্চা, কেউ বলতে
পারে না তার সঠিক বয়স।
অনেকেই বিশ্বাস করে,
মিস্টার এক্স হয়তো
পৃথিবীর ঊষালগ্ন হতেই
এই দ্বীপে আছে আর যারা
বিজ্ঞান কিংবা ধর্মে
বিশ্বাসী তারা ভাবে,
এসব গালগপ্পো, কে আর কবে
পেরেছে মৃত্যুকে ফাঁকি
দিতে? তারা হয়তো
অপেক্ষা করে মিস্টার
এক্সের মরে যাওয়ার
কিংবা তারা জানতে চায়
এই বেঁচে থাকার রহস্য।
পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন
এই দ্বীপে তেমন কেউ আসে
না কখনও। যদিও
মানচিত্রে আছে।
পৃথিবীর মাঝে এমন একটা
দ্বীপ কেন কেউ করে
নিচ্ছে না দখল এসব কথা
ভেবে জাতিসংঘের প্রধান
মাঝেমাঝে অবাক হয়। এই
দ্বীপের বদৌলতে তার
মাঝে এখনও কিছুটা
বিস্ময় বেঁচে আছে এই
ভেবে, সে মনে মনে
ধন্যবাদ দেয় মিস্টার
এক্সকে। দ্বীপের
মানুষেরাও ভাবে, এই না
আসার পিছনে হয়তো রয়েছে
মিস্টার এক্সের হাত।
তাদের মধ্যে কারো কারো
মনে হয়, ভিনদেশী
মানুষের দেখা পেলে হয়তো
তারা সুখী হতো, আবার কেউ
কেউ ভাবে মিস্টার এক্স
নিজের ক্ষমতা হারিয়ে
ফেলার ভয়ে কাউকে পা
রাখতে দেয় না এই
দ্বীপে।
ঘটনা যাই হোক, যখন পা
রেখেছি এই দ্বীপে তখন
কোন প্রতিবন্ধকতাই
আমার ছায়া মাড়ায়নি বরং
খুব যত্ন করে আমাকে
নিয়ে যাওয়া হয়েছে
মিস্টার এক্সের কাছে।
মিস্টার এক্স, যার
থাকার কথা ছিল কোন এক বড়
অট্টালিকায়, সে থাকে
একটা সামান্য মাটির
ঘরে। দুটো মাত্র রুম।
তার সাথে কথা বলার মাঝে
এ কথা ও কথায় জানা গেলো,
সেও অপেক্ষায় আছে, এই
দ্বীপ ছেড়ে চলে যাওয়ার।
যখন বিস্তারিত জানতে
চাইলাম, তার ইতিহাস
সম্পর্কে, তখন সে এক
অদ্ভুত জাদুর কথা
জানালো আমাকে। যে জাদুর
সফলতার জন্য সবাই তার
পক্ষে কথা বলে, যদিও
অন্য সবকিছুতেই তারা
তার বিপক্ষে। এই জাদু
দেখাতে হবে মিস্টার
এক্সকে এবং দেখাতে
পারলেই তার কিংবা
দ্বীপের মুক্তি।
মিস্টার এক্স, অনেকটা
ধর্মের মতো, কতো কতো
নিয়মে ঠাঁসা। মানুষের
কাছে এসব নিয়ম হয়তো মনে
হয় একটা বাধা, ধর্মকে
মানুষ নিজের ইচ্ছেমত
সহজ করে নিলেও মিস্টার
এক্সের ক্ষেত্রে এমন
কিছুই ঘটে না, তাই হয়তো
মানুষ পড়েছে ক্লান্ত
হয়ে। মিস্টার এক্স যে
কিনা এই দ্বীপের
প্রধান, যার উছিলায় আমি
আমার শহরে ফিরে যাবো
সফল ব্যবসায়ী হয়ে তাকে
দ্বীপের মানুষ আর
ভালোবাসে না। মিস্টার
এক্স পঙ্গু হওয়া
সত্ত্বেও কেউ করুণাও
করে না তাকে। তবে, এ কথা
সত্য তারা এখনও মিস্টার
এক্সের নির্দেশ মেনে
চলে। আপাতদৃষ্টিতে এসব
শ্রদ্ধাবোধ মনে হলেও,
দ্বীপের মানুষেরা আসলে
জানে না, কীভাবে তৈরি
করতে হয় নতুন সংবিধান,
সত্যিটা হয়তো এমন। তারা
অপেক্ষা করে মিস্টার
এক্স শিখে ফেলবে
জাদুবিদ্যা এবং সত্যি
ছেড়ে যাবে এই জনপদ।
এই অপেক্ষার মাঝে তৈরি
হয় বিশ্বাস, অবিশ্বাসের
সেতু। দ্বীপের
মোড়েমোড়ে তৈরি হয় জটলা।
কেউ কেউ বলে, মিস্টার
এক্স কখনওই ছেড়ে যাবে
না এই দ্বীপ, এসব শুধুই
তার ভাঁওতাবাজি। আবার
কারো কারো বিশ্বাস, যে
মানুষ পঙ্গু, সে তো
উড়তেই চাইবে। যারা
ধর্মে বিশ্বাসী তারা
প্রার্থনালয়ে মিস্টার
এক্সের জন্য প্রার্থনা
করে, যারা বিজ্ঞানী
তারা চেষ্টা করে এমন
কোন পাখা আবিস্কারের
যার সাহায্যে উড়ে যেতে
পারে মিস্টার এক্স।
চিকিৎসকরাও ঘন ঘন যায়
মিস্টার এক্সের
চিকিৎসা করার
উদ্দেশ্যে, যদিও তারা
পায় না তেমন সুযোগ।
কখনও মিস্টার এক্স
ব্যস্ত থাকেন দ্বীপ
শাসনে, কখনও নিজ মনে জপে
যান জাদুর মন্ত্র।
জটলা দিনে দিনে বেড়ে
যায়, এমনকি বিদেশী
নাগরিক হিসেবে আমি এই
দ্বীপে পা রাখার পরেও
যখন আসে না সুখ তখন
সকলের মনে হয়, সুখ আর
আসবে না কোনদিন যেমন
মিস্টার এক্স কখনওই
শিখবে না জাদু। তারা
স্বর্ণ খনির মালিক হতে
হতে আফসোস করে, তারা
সমুদ্রকে শাসন করতে
করতে আফসোস করে,
সূর্যের গতিবিধি
নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আফসোস
করে তারা। এর মাঝে
একদিন হঠাৎ করেই শূন্য
মিলিয়ে যায় মিস্টার
এক্স। কেউ দেখে নাই
তাকে, তবু সকলের কাছে সে
হারিয়ে যায়। কারো কারো
মনে হয়, মিস্টার এক্স
শিখে ফেলেছিল জাদু
বিদ্যা, কারো মনে হয়
অন্য কোন দ্বীপ শাসন
করার জন্য মিস্টার এক্স
গেছে চলে, আর যারা
ক্ষমতার অপেক্ষায় ছিল
বহুদিন ধরে, তারা বলে,
বুড়ো মরে গেছে লোক
চক্ষুর অন্তরালে। তারা
ভাবে মিস্টার এক্স হয়তো
ফিরে আসবে আবার, তারা
ভাবে মিস্টার এক্স হয়তো
আর কোনদিন ফিরবে না।
যখন ছেড়ে যাচ্ছি দ্বীপ,
তখনও সুখ আসেনি এইখানে।
দ্বীপের মানুষের বোধ
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের
মাঝে খেলা করে। তারা
খুঁজতে থাকে সঠিক পথ।
একবার ভাবে মিস্টার
এক্সের সমস্ত মূর্তি
ভেঙে ফেলবে, আবার ভাবে
প্রত্যেক মোড়ে মোড়ে
তৈরি করবে মিস্টার
এক্সের ভাস্কর্য। তারা
ভাবে, মিস্টার এক্স
ফিরে আসবে, আবার তারা
ভাবে মিস্টার এক্স
কখনওই ফিরবে না। যখন
ছেড়ে যাচ্ছি এই দ্বীপ,
সফল ব্যবসায়ী হয়ে, যখন
এসে দাঁড়িয়েছি জাহাজের
মাস্তুলে, তখন একটা
অচেনা হাওয়া এসে যেন
বলে গেলো কানে কানে,
মিস্টার এক্স, কখনওই
ছাড়ে নাই এই দ্বীপ।
দ্বীপের মানুষদের এ কথা
জানানোর আগে, ছেড়ে দিলো
জাহাজ আর আমি দূর থেকে
দেখছিলাম, দ্বীপের এক
প্রান্তে ভেঙে ফেলা
হচ্ছে সমস্ত ভাস্কর্য,
আরেকপ্রান্তে হচ্ছে
তৈরি।
…