মৃণালবাবুর সঙ্গে
প্রতি রোববার দেখা হয়।
বাজারে। রোববার রোববার
করে আমরা যারা বাজার
করি, তাদের কয়েকজনের
মুখ-চেনা হয়ে যায়।
পাশাপাশি দাঁড়িয়ে
বেগুনটা, ফুলকপিটা
বাছতে বাছতে বাছতে
দু-একটা সুখদুঃখের কথা
হয়। বাছার অবশ্য তেমন
কিছু নেই! যে-কটা সাজিয়ে
রেখেছে, তার মধ্যেই
মন্দের ভালোটুকু তুলে
নেওয়া। সেই করতে করতেই,
কখনও কেউ হয়তো বলি, — এ
বছর আর ফুলকপিতে স্বাদ
নেই, দেখেছেন খেয়াল করে ?
– হুঁ – কিন্তু কী আর
করবেন? – সে-ই, না খেয়েই
বা যাবেন কোথায়? আর,
খাবেন-ই বা কী? – এদিকে
দাম দেখুন, বাড়ছে তো
বাড়ছেই – সেদিন দেখলাম
জোড়া দশ, আজ এখানে একটাই
পনেরো – ও নামেই জোড়া দশ,
সব ফচকে কপি, একবেলারও
তরকারি হয় না – অথচ আগে
যখন স্বাদ ছিল, তখন এত
দাম ছিল না – স্বাদের
জন্য কি আর দাম হয়? – তা
যা বলেছেন, — এইসব
অবান্তর বলতে বলতে যে
যার ছোটো ঝুড়িটা ভরে
সবজিওলার দিকে এগিয়ে
দিই। সে ত্বরিতে
মাপামাপি শুরু করে।
রোববারের বাজারে তার
হাতের বিশ্রাম নেই।
মুখেরও। এক মুখে
‘মার্কেটিং’ করছে, অন্য
মুখে হিসেব করছে।
আশ্চর্য দক্ষতা। এরকম
দক্ষতা যে ধুলোয় ধুলোয়
মিশে থাকে, ক-জন বা তার
খবর রাখে আর দাম দেয়।
বড়ো কোম্পানিদের আলাদা
আলাদা বিভাগ আছে,
বিভাগে বিভাগে কর্তা
এবং কর্মী আছে; কিন্তু
এই ছোটোদের? সব, ওয়ান
ম্যান শো। তাতেই এঁরা
আশ্চর্য পারঙ্গম।
বাজার যে কতভাবে
মানুষকে বিস্মিত করতে
পারে, তার ঠিক নেই।
বিস্ময়েরও তবু মাত্রা
থাকল না, যেদিন
মৃণালবাবু আচমকা বললেন,
আমাকে নিয়ে একটা গল্প
তো লিখতে পারেন?
আমি থতমত খেয়ে বললাম,
গল্প? মানে, কেন? হঠাৎ
গল্প কেন?
মৃণালবাবু দু-নুটি
ধনেপাতা ঝুড়ির কোনায়
গুঁজে দিতে দিতে বললেন,
কেন, আমায় নিয়ে গল্প
লেখা যায় না?
না না, সে-কথা বলিনি। আমি
একটু গলা খাঁকারি দিই।
বলি, হুট করে আমায় যে
গল্প লিখতে বললেন, সেই
জন্য অবাক হলাম। আমি
গল্প লিখতে পারব, এ-কথা
আপনি ভাবলেন কী করে?
মৃণালবাবু একটু হাসেন।
জলপাইয়ের দিকে আঙুল
তুলে বলেন, নেব কি-না
বলুন তো? চাটনি খেতে তো
ভালোই লাগবে, নাকি? আমি
বলি, হুঁ। কিন্তু ওই
গল্পের ব্যাপারটা কী
করে ধরলেন, বললেন না যে?
মৃণালবাবু আমার দিকে
একটু তেরছা তাকিয়ে
বললেন, কী ভাবেন মশাই,
শুধু আপনারই নজর আছে।
আমাদের নেই? আপনি যে
সেদিন একটা কানা বেগুন
ঝুড়িতে তুলেও নামিয়ে
রাখলেন, সে কি আর আমি
খেয়াল করিনি?
তাতে কী বোঝা গেল? আমি
এবার হতবাক হয়ে প্রশ্ন
করি।
মৃণালবাবু তখন
টোম্যাটো বাছছেন।
একখানা হাতে তুলে নিয়ে
বললেন, দেখুন, টকুটুকে
লাল জিনিসে একটুকুন দাগ
লাগলেও চোখে পড়ে।
কিন্তু একদম মিশমিশে
বেগনি রঙের ভিতর কোথায়
একটা সরু পোকার গর্ত
আছে, তাকে কি আর দেখা
যায়! দিব্যি মিলেমিশেই
থাকে। ওই তো সরু সুচের
মতো একটা সুড়ঙ্গ, আর অমন
ঢিড়িঙ্গে একখানা
বেগুন। নজর যাবে কী করে!
কিন্তু আপনার চোখ এড়াল
না। ঝুড়িতে তুলেও
নামিয়ে দিলেন।
আমি ভারি অপ্রস্তুতে
পড়লুম। ব্যাপারটা উনি এ
ভাবে ব্যাখা করবেন
ভাবিনি। সত্যি বলতে,
ব্যাপারটা যে আদৌ
গুরুত্বের তা-ও তো
ভাবিনি। বরং তার আগে
একদিন কানা বেগুন কিনে
এনে স্ত্রীর মুখ শুনেছি
খুব। বেজায় বিরক্ত হয়ে
সে বলেছিল, কথায় কথায় এত
লোকের বানান ভুল ধরো আর
বেগুনের পোকা দেখতে পাও
না! আমার যদিও বলা উচিত
ছিল, দুটো এক জিনিস নয়,
দুরকম কাজের তুলনা চলে
না, কিন্তু রবিবারের
সদ্য কিশোর হয়ে ওঠা
বেলা যেন আমায়
ফিসফিসিয়ে বলেছিল, এ
নিয়ে আর কথা বাড়িয়ে কাজ
নেই। তাতে হিতে বিপরীত
হবে। তাই আমি চেপে
গিয়েছিলাম। শুধু মনে
মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম
যে, পরের দিন যা কিনব,
দেখেশুনেই কিনব।
কিন্তু মৃণালবাবু তাঁর
ব্যাখ্যায় অনড়। বললেন,
দেখুন, কেন বলছি আপনি
গল্প লেখেন; যা সাদা
চোখে দেখতে পাওয়া যায়,
তা তো যায়ই। কিন্তু যা
দেখতে পাওয়া যায় না অথচ
দেখা উচিত, সেটা নজর
করাই তো আসল ব্যাপার।
আপনার সে নজর আছে।
আমি বললুম, কিন্তু তাতে
আমাকে গল্পলেখক ভাবলেন
কেন? সাংবাদিক ভাবতেও
তো পারতেন? তাঁদেরও তো
এরকম নজর আছে।
মৃণালবাবু এবার বললেন,
ধুর মশাই, আপনার অমন
মায়াবি চোখ; আপনি
সাংবাদিক হতে যাবেন
কেন? আপনি নিশ্চিত
লেখক। লিখুন না প্লিজ,
আমাকে নিয়ে একটা গল্প।
এমনভাবে মৃণালবাবু
কথাগুলো বলছিলেন, যে
শুনে সবজিওলা অবধি একটু
হেসে ফেলল। আমার লজ্জা
লজ্জা পেল ঈষৎ। কথা
ঘুরিয়ে বললুম, আচ্ছা সে
হবেখন। এখন বাজার করি।
বেশি দেরি হলে কপালে
দুঃখ আছে... বোঝেনই তো।
২)
পরের রোববার ফের ধরলেন
মৃণালবাবু। বললেন, কিছু
ভাবলেন?
আমি খানিক যেন-মনেই-নেই
ভান করে বলে বললুম, কী
ব্যাপারে বলুন তো?
ওই যে গল্প লেখার
ব্যাপারে। ভুলে গেলেন?
আমি খানিক ম্যানেজ করে
বললাম, না না ভুলিনি।
কিন্তু অমন লিখব বললেই
তো লেখা যায় না। গল্প তো
বের করতে হবে। আপনাকে
জানতে হবে। আপনার
জীবনের গল্প জানতে হবে।
আপনি কী কী পারেন, পারেন
না...
আমার কথার মাঝখানেই
মৃণালবাবু বলে উঠলেন,
জানেন, আমার ঠাকুরদাও
লেখক মানুষ ছিলেন।
আমি খানিকটা হালকা
চালেই বললুম, তাই নাকি?
কী নাম?
মৃণালবাবু বললেন, না না
নামধাম তেমন কিছু নেই।
তবে উনিও লিখতেন,
জানেন। আর আমার
ঠাকুমাকে সব শোনাতেন।
আমাদের গল্পের বহর
বাড়ছে দেখে সবজিওলা
অধৈর্য। মৃণালবাবু
বুঝতে পারেন। আমাদের
ঝুড়ি প্রায় বাছা সবজিতে
ভর্তি হয়ে এসেছিল।
আগেভাগে সেদুটো বাড়িয়ে
দিয়ে বললেন, এই তুমি
মাপো, আমরা এক কাপ করে চা
খেয়ে আসি।
আমি বললাম, এখন আবার চা!
বড্ড দেরি হয়ে যাবে যে
মৃণালবাবু...
উনি আমার হাতটা একটু
টেনে বললেন, আরে এক কাপ
তো মোটে চা। এমন কিছু
দেরি হবে না। আসুন তো।
গেলাম। চা খেতে খেতে
মৃণালবাবু বললেন, আসলে
ঠাকুরদার কথা শোনানোর
লোক তো তেমন পাই না। আজ
আপনাকে পেলাম যখন,
পাকড়াও করি। তো, আমার
ঠাকুরদা যা লিখতেন, সেই
খাতাপত্র নিয়ে মাঝে
মাঝে চলে যেতেন বাড়ির
পিছনে।
আমি একটু অবাক হই। বলি,
পিছনে কেন?
মৃণালবাবু বলেন, সে এক
কাণ্ড বুঝলেন। আমার
ঠাকুরদার সব উদ্ভট
খেয়াল। বাড়ির পিছন
দিকটায় একটা গাছ পড়ে
গিয়েছিল। সেই গুঁড়িটার
পাশে ঠাকুরদা আর ঠাকুমা
বসতেন। ঠাকুমা বসে বসে
একটা জনতা জ্বালিয়ে
তাতে দু-কাপ চা করতেন।
তারপর চা হলে, দুজনে
খেতে খেতে, নতুন লেখা
শুনতেন। এসব কিন্তু
দিনের বেলাকার কথা নয়।
সব চাঁদনি রাতে হত।
আকাশে চাঁদ উঠেছে।
গাঁ-ঘরের সেই অঢেল
নৈঃশব্দের ভিতর দুজন
মানুষ-মানুষী রাত
জাগছেন। একজন তাঁর নতুন
লেখা পড়ে শোনাচ্ছেন।
একটা গল্প। আর, অন্যজন
কী করছেন বলুন তো?
এক-একটা লেখা শেষ হলে,
মনের ভাবে যে গান মনে
আসছে, সেই গানখানা
গাইছেন। অনেকবার হয়েছে
কি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পাড়ার
মানুষ ঠাকুমার গলায় গান
শুনেছেন। পরে পাড়ার লোক
সকালে জিজ্ঞেস করেছে,
বউ তোদের ভিটেয়
রাতবিরেতে গান গায় কে?
আমার ঠাকুমা লজ্জায়
ঘোমটা টেনে দিয়ে বলত, কে
জানে, পরি-টরি নামে
বোধহয়!
এবার আমি মৃণালবাবুকে
থামালাম। বললাম, এসব
আপনার ঠাকুরদার গল্প?
মৃণালবাবু অবাক হয়ে
বললেন, হ্যাঁ, কেন বলুন
তো?
আমি বললাম, এ গল্পের
সঙ্গে বিভূতিভূষণের
অনেক মিল। বিভূতিভূষণ
আর তাঁর স্ত্রী কল্যাণী
দেবী এমন চাঁদনি রাতে
বাইরে বসে চা খেতেন, এমন
গল্প আছে বটে, ওঁর ছেলেই
লিখেছেন সে-কথা। কিন্তু
বিভূতিবাবু লেখা পড়ে
শোনাচ্ছেন, তারপর পরির
গান- এসব তো সেই গল্পে
ছিল না।
মৃণালবাবু এবার
যারপরনাই অবাক হয়ে
বললেন, আরে ওঁর গল্পে
থাকবে কেন? এটা তো ওঁর
গল্প নয়। আমার দাদুর
গল্প। আমি নিজে ঠাকুমার
কাছে এসব শুনেছি। তা
ছাড়া কি জানেন...
আমার চোখে প্রশ্ন।
মৃণালবাবু বললেন, আমার
ঠাকুরদার নামও তো
বিভূতিভূষণ।
আমি বলি, বলেন কী! মানে,
সেই বিভূতিভূষণ...
মৃণালবাবুর কথার
মাঝখানেই কাঁধ ঝাঁকিয়ে
বলতে শুরু করেন, এবার
আপনি ক-জন বিভূতিভূষণকে
আর চেনেন বলুন? কতজনের
গল্পকে আপনার এক চেনা
বিভূতিভূষণে ফেলতে
পারবেন? এমন তো হতেই
পারে, আপনি একজন
বিভূতিভূষণকে একরকম
চেনেন, তাঁর ক-টা গল্প
জানেন মাত্র, তাও লেখা
হয়েছে বলে; কিন্তু সেই
ক-টা গল্পের বাইরেও
কতগুলো অচেনা
বিভূতিভূষণ থেকে যেতে
পারে, ভেবে দেখেছেন?
আমি দুদিকে মাথা নাড়ি।
এমনিতেই দেরি হয়ে
যাচ্ছে। চা-ও শেষ। আমি
মৃণালবাবুর কিস্সায়
ইতি টানতে বলি, তা আখেরে
আপনার ঠাকুরদার সেইসব
লেখাপত্তর নিয়ে কী হল?
ছাপাতেন না?
মৃণালবাবুর চোখে ছায়া।
পরক্ষণেই তা চকচক করে।
বলেন, বলছিলাম না, উদ্ভট
লোক। কী করেছেন জানেন,
সমস্ত লেখা লিখে একটা
কালো ট্রাঙ্কে তুলে
রেখে দিয়েছিলান। এমনকি
ঠাকুমাও জানত না।
লেখাগুলো হারিয়ে গেছে
বলে খেদ করত। আমি তো
খুঁজে পেলাম এই হালে।
আমরা, ভাবতাম বুঝি
বাক্সর ভিতর শুধু বাড়ির
দলিল আছে। এই যে এন আর সি
হবে বলে খুব ভয়
দেখাচ্ছে। কাগজ-ফাগজ
খুঁজতে গিয়ে দেখি,
দিস্তে দিস্তে লেখা
বেরোচ্ছে। কী অদ্ভুত
মানুষ বলুন তো...
আমি এবার একটু জোরেই
বললাম, এটা কিন্তু পুরো
জীবনানন্দের গল্প হয়ে
গেল মৃণালবাবু।
ঠাকুরদার গল্প আমার
কিছুতেই বিশ্বাস হয় না
দেখে মৃণালবাবু বললেন,
আসুন একদিন তবে আমার
বাড়ি; দেখাব সব; আমি
খামখা মিথ্যে কেন বলতে
যাব বলুন!
আমরা বাজারের দিকে
এগোলাম। যে যার ব্যাগ
নিলাম। দাম দিলাম।
তারপর মাছবাজারের দিকে
চলে গেলাম আলাদা আলাদা।
কিন্তু কথাটা আমার মনে
গেঁথে রইল। সত্যি
মৃণালবাবু খামখা
বানিয়ে বানিয়ে আমায়
মিথ্যে বলতে যাবেন
কেন!
৩)
সারা সপ্তাহ মন খচখচ
করছে। হাজার একটা কাজ
করছি। কিন্তু
মৃণালবাবুকে নিয়ে একটা
গল্প কিছুতেই ভেবে উঠতে
পারছি না।
আচ্ছা, মৃণালবাবুকে
নিয়ে কি গল্প লেখা যায়?
মানুষটার জীবনে তেমন
কোনও ঘটনা আছে বলে আমার
তো মনে হয় না। সেই কবে
থেকে ওঁকে চিনি। সপ্তায়
একদিন বাজার করেন।
ছুটির দিনে। বাকি সারা
সপ্তা অফিস করেন।
ব্যাংকের চাকরি। আগে
মাথায় অনেক চুল ছিল, এখন
একটু পাতলা হয়েছে এই
যা। সে বাদ দিয়ে না
চেহারায় পরিবর্তন, না
অন্যকিছু। বছরে একবার
সপরিবারে বেড়াতে যান।
ফিরে এসে ক-দিন সেই
গল্পই করেন। তা-ও শুনে
মনে হয় যেন বেড়ানোর
পত্রিকার ‘কোথায় যাবেন,
কোথায় থাকবেন’ গোছের
ব্যাপার। মিটিং-মিছিলে
যান না। রাজনীতি নিয়ে
মতামত নেই। কিছুই নেই।
একেবারে গাঁয়ের
ভিতরকার ডোবা যেন। কেউ
নামেও না। ঢেউ-ও ওঠে না।
এই মানুষকে নিয়ে আমি কী
গল্প লিখব?
পরের রোববার দেখা হতে
বললাম সে কথা। বললাম,
মশাই কিছু ঘটনা বলুন
তো। নইলে লিখব-টা কী?
মৃণালবাবু একগাল হেসে
বললেন, এই যে বেঁচে আছি,
এই তো বিরাট ঘটনা। আবার
কী ঘটনা ঘটবে বলুন?
আমি বললুম, ওরকম করলে
হবে না। ব্যক্তিগত
জীবনে সেরকম কিছু
না-হলে অফিসে ঘটেছে এমন
কিছু বলুন।
মৃণালবাবু একটু মাথা
চুলকে বললেন, কী আর বলব!
এনপিএ যে হবে, সে তো আমরা
জানি। বাড়বে যে সে-ও
জানি। লোন-টোন আদায়
করতে গিয়ে যা সব ঘটনা
ঘটে সে-ও কতজন লিখে
গেছে। সবই তো মশাই এক
গল্প। একজন শুষছে, আর
একজন ছিবড়ে হচ্ছে।
অনেকদিনের আখমাড়াইয়ের
কল। এর মধ্যে আলাদা কী
বলি বলুন তো!
আমি বললাম, কেন এই যে নোট
বাতিল হল? তখনকার কিছু
গল্প নেই?
মৃণালবাবুর চোখ বড়ো
বড়ো। বললেন, সে এক দিন
গেছে বলিহারি। ঘণ্টায়
ঘণ্টায় রিপোর্ট দিতে
হচ্ছে। এদিকে বাইরে
লোকে লোকারণ্য।
প্রথমদিন কখন ফিরেছি
জানেন? কাজ শেষই হল রাত
দেড়টায়। পরদিন আবার
সকাল সকাল অফিস। এই তো
চলেছে টানা। একসময় তো
মনে হচ্ছিল আর টানতে
পারব না। শরীর ছেড়ে
দেবে। আমাদের কি আর
কম্যান্ডো ট্রেনিং আছে,
বলুন? অথচ নামিয়ে দিল
যুদ্ধে।
কিন্তু পেরেছেন তো।
আপনারাই তো পেরেছেন।
মৃণালবাবুকে চাঙ্গা
করতে বলি আমি।
মৃণালবাবু কিছু বলেন
না। এক লহমা চুপ করে
থেকে বললেন, কিন্তু যে
কারণে এত কিছু করলাম
সকলে, সেটা যদি পূরণ হত,
কত ভালো লাগত বলুন তো।
আর...
আমি বললাম, কী?
মৃণালবাবু আক্ষেপ করে
বললেন, এসব দুঃখ-কষ্টর
কথা কেউ বলেও না, লিখেও
রাখে না। এই যদি আমি
যুদ্ধে যেতাম, আপনি
এতক্ষণে আমাকে
কালটিভেট করা শুরু করে
দিতেন। অন্তত একটা
ডায়রির জন্য পাঁচজন
হামলে পড়ত কিনা বলুন?
আমি বললাম, কী আর করবেন?
ওরকমটাই দস্তুর। ও নিয়ে
খেদ করে লাভ নেই। তা,
আপনার দাদুর লেখাগুলো
পেলেন যখন ছাপানোর একটা
বন্দোবস্ত করছেন না
কেন?
মৃণালবাবু একটু
অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন
যেন। তারপর বললেন, কী আর
ছাপাব! মনে হবে যেন
নিজের কেত্তন নিজেই খরচ
করে করাচ্ছি।
আমি অবাক হয়ে বললুম,
মানে?
মৃণালবাবু বলেন,
ঠাকুরদা মশায় সারাজীবন
ধরে আমার গল্পই লিখে
গিয়েছেন।
আপনার? আমার অবাক
প্রশ্ন। আপনার কথা উনি
কী করে জানবেন? মানে,
কতটুকুই বা জানবেন?
সেইটেই তো ভাবি।
মৃণালবাবু বলেন। অথচ
ঠাকুরদার লেখায়, সবটাই
আমি। আমি সংসার করছি।
জেরবার হচ্ছি। আমার
সংসারের টানাটানি।
মেয়ের জন্মদিনে ঘরে
পৌঁছাতে পারছি না। বউ
রেগে কাঁই। তারপর
ট্রান্সফার হল।
ফ্যামিলি ছেড়ে দূরে
গিয়ে একা একা ভাড়া
বাড়িতে আছি। সব টাকা
বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে
কায়ক্লেশে দিন
কাটাচ্ছি। ছা-পোষা
জীবনে যা যা হয় আর কি।
তাতে অবসাদ হচ্ছে। মাঝে
মাঝে ভাবি, পালিয়ে যাই।
কিন্তু পালাই না। জীবন
যেন জামার মতোন। আবার
পরেরদিন ঘুম ভেঙে উঠে
একই জীবন গায়ে গলিয়ে
নিচ্ছি। এই গল্পই তো
ঠাকুরদা লিখে গিয়েছেন।
আমি বললাম, কিন্তু সেটা
যে আপনিই, কী করে জানলেন?
আপনার মতো আর কেউ তো হতে
পারেন?
কিন্তু আমি যে আমাকেই
দেখতে পাই। এই দেখুন না
কেন, ঠাকুরদার গল্পের
লোকটাও আমারই মতো ঘুরে
ঘুরে কথা বলে। বাজারে,
দোকানে, রাস্তায়, অফিস
ফেরতা বাসে- একটা না
একটা লোক জুটিয়ে নিয়ে
ঠিক বলে যায় নিজের কথা।
অনর্গল। অথচ, শোনার মতো
কিছু নেই তাতে। কোনও
চমক নেই, বিস্ময় নেই। এ
লোক আমি ছাড়া আর কে হবে
বলুন?
আমি কিছু বলি না। সত্যি
বলতে, কী বলা যায় সেটাই
ভাবি। মৃণালবাবুই বরং
বলতে থাকেন, এমনকি
অসুখে পড়লে আমি যে
মাঝেমধ্যে মরে যাওয়ার
কথা ভাবি, ভাবি যে আর
বুঝি ফেরা হল না, সেই
কথাও তো লিখে গিয়েছেন।
আমি বলি, এ তো মানুষের
ধর্ম মৃণালবাবু। সকলেই
তো বাঁচতে চায়। সব অসুখ
পেরিয়ে, সব ঝঞ্ঝাট
মিটিয়ে বেঁচে থাকাই তো
মানুষের ইচ্ছে। ভারি
মহৎ কিন্তু সেই ইচ্ছে।
কেন-না তার ভিতরই প্রাণ
আছে। সেইটেই তিনি
উপলব্ধি করেছিলেন, তা-ই
লিখে গিয়েছেন।
মৃণালবাবু, এবার ভুরু
কুঁচকে বললেন, আপনি
বলছেন এ-কথা?
আমি বললাম, হ্যাঁ, কেন
ভুল কী বললাম?
মৃণালবাবু এবার বললেন,
তাহলে আপনি আমাকে নিয়ে
গল্প লিখতে চাইছিলেন না
কেন?
আমি আমতা আমতা করি।
মৃণালবাবু বলেন, আপনিও
তো ঘটনা খুঁজছিলেন। অথচ
আমার জীবনে একখানাও
বলার মতো ঘটনা নেই।
এদিকে ঠাকুরদা আমাকে
নিয়েই দিস্তে দিস্তে
লেখা লিখে গিয়েছেন। আমি
তো একটু ধন্দে পড়েই
আমাকে নিয়ে গল্প লিখতে
বলেছিলাম।
আমি বললাম, মানে?
মৃণালবাবু হাসেন। বলেন,
আপনি একখানা গল্প লিখলে
মিলিয়ে নিতাম যে,
ঠাকুরদা আমাকে নিয়েই
লিখেছিলেন কি-না। আদৌ
আমাকে নিয়ে গল্প লেখা
যায় কি-না। বা লেখা
গেলেও ঠাকুরদার
লেখাটার সঙ্গে একটা
তুলনা টানা যেত।
আমি বলি, কী যেন
বলেছিলেন আপনার
ঠাকুরদার নাম?
মৃণালবাবু বলেন,
বিভূতিভূষণ...
ওঁকে কথা শেষ করতে না
দিয়েই আমি বলি, আর, তিনি
জীবনানন্দের মতো সমস্ত
লেখা কালো ট্রাঙ্কে
ঢুকিয়ে রেখে চলে
গিয়েছেন, তাই তো?
মৃণালবাবু মাথা নেড়ে
হ্যাঁ বলেন। আমি বলি, আর
আপনি চাইছেন আমি একটা
গল্প লিখি আর আপনি
মিলিয়ে দেখবেন যে, এক
মানুষকে নিয়ে লেখা গল্প
কারটা কেমন হল? বা সেই
মানুষকে নিয়ে এখনও গল্প
লেখা যাচ্ছে কি-না?
মৃণালবাবুর চোখেমুখে
এবার রোদ ওঠে। আমি
বুঝতে পারি, আমি ভিতরে
ভিতরে ঘেমে নেয়ে উঠেছি।
যে মৃণালবাবুকে নিয়ে
গল্প লেখা হয়েই গেছে,
আমি তাকে নিয়ে কিছু
ভেবেও উঠতে পারিনি।
এমন নেহাত ছাপোষা
মানুষের জীবন যে কী করে
দেখতে হয়, সে আমি দেখতেও
শিখিনি। শুধু কানা
বেগুন চিনতে শিখেছি
এতদিনে!
আমি এবার কোনক্রমে গা
বাঁচিয়ে নিই। বলি,
গপ্পে গপ্পে কত দেরি
হয়ে গেল বলুন তো? আজ
কপালে ভাত জুটলে হয়! বলে
দ্রুতপায়ে মাছবাজারের
দিকে এগোতে থাকি। যেন
পালিয়েই যেতে চাইছি।
শুনতে পাই, মৃণালবাবু
তখনও আমাকে ডেকে কিছু
বলছেন। কিন্তু আমি আর
সে-কথায় কান দেওয়ার
সাহস পাই না।
~