মঞ্জু কাকিমার মিহিন
গলা মনে পড়লেই এই দূর
দেশে বসেও বুকটা ধক করে
ওঠে। সেই কোন ছোটবেলায়
শোনা ছোট্ট একটা ছড়া
আজও কোন গহিন ভেতরে
ঘুর্ণি তুলে তুলে ফিরে
আসে। মঞ্জু কাকিমা সুর
করে মিহি গলায় সেই
ছড়া কাটত আর হি হি করে
হেসে গড়িয়ে পড়ত। কত আজব
আজব ছড়া যে জানত কাকিমা!
আমরা সে সব শুনে হেসে
গড়িয়ে পড়তাম সেসব দিনে।
তবে আজকাল আমার সেই
মজার ছড়াগুলো মনে আসে
না কোনোভাবেই,
দুঃস্বপ্নের মতো ঘুরে
ফিরে মনে পড়ে কেবল
একটিই ছড়া।
এই ছড়া কাটার আগে মঞ্জু
কাকিমা প্রতিবার তার
পটভূমি ব্যাখ্যা করত কী
কারণে, আমরা বুঝতাম না
অবশ্য। প্রায়
প্রতিবারই ঠিক একইভাবে
গল্প শুরু করত কাকিমা।
সকাল, দুপুর, রাত ছিল না
কাকিমার, যখন তখন দুম
করে কোনোকিছুর মাঝখানে
এসে সে বলত-
ওই, তোমরা বোলে ফির
ইংরাজি ফিংরাজি পড়েন
ইশকুলোত যায়া? তাইলে
একটা গল্প শোনো। ঐ যে এক
গেরামের একটা ছওয়া
ঢাকা গেচিলো পড়ালেকা
করির জন্য। তার বাপ মাও
তো ম্যালা খুশি, ওমার
ছওয়া কত ল্যাকাপড়া
কইরবে, বড়ো বড়ো পাশ দিবে,
তাইলে ওমার সউক দুক্কো
ঘুইচবে। তারপর সেই ছওয়া
একবার তার ছুটির সময়
বাড়িত আসিল ব্যাড়েবার
জইন্যে। ভাত খাবার বসি
অর মাক কইল মা, মোক
ওয়াটার দে। অর গরিব
মাও তো আর ওয়াটার মানে
জানে না। ওয়াটার চাইতে
চাইতে ছওয়াটার গালাত
নাগিল ভাত, তারপর ছটফট
কইরতে কইরতে মরি গেল।
ছওয়া মরি যাবার পরে সেই
হতভাগি মাও ওয়াটার মানে
বুঝিল। তারপর থাকি সেই
মাও কান্দি কান্দি
বেড়ায় পাগলি হয়া আর
কয়-
ওয়াটার ওয়াটার করি
মোর জাদুটা গেল মরি
কায় বা জানে ওয়াটার
মানে পানি।
সুর করে এই ছড়া কাটতে
কাটতে মঞ্জু কাকিমা এক
সময় হড়হড় করে কেঁদে
ফেলত। বোধহয় ছেলে
হারানো সেই মায়ের
ব্যথাতুর আকুলতা তার
বুকের ঘরে বাতাসের অভাব
এনে দিত।
মঞ্জু কাকিমার সেই
কান্না আর চোখের জলের
ইতিহাস আজকাল খুব মনে
পড়ে। এই মাইনাস
টেম্পারেচারের ভেতরও
মাঝেমাঝে ঘুমের মধ্যে
জেগে উঠে বসি বিছানায়,
ভীষণ গরমের অনুভূতি হয়,
মনে হয় ঘামে ভিজে চপচপে
হয়ে যাচ্ছে আমার শরীর।
তারপর শুকিয়ে আসা গলা
ভেজাতে ঘুমচোখে ঢকঢক
করে পানি খাই। অনেকক্ষণ
বসে থাকি জেগে।
মাঝেমাঝে আমি উঠলে
প্রসেনও জেগে যায়।
প্রথম কয়েকদিন আমাকে
সান্তনা দেবারও চেষ্টা
করেছে ও, আজকাল তা করে
না। যতক্ষণ ঘুম না আসে,
পাশ ফিরে শুয়ে থাকে,
তারপর কখন নিঃশব্দে
ঘুমিয়ে যায় আবার।
এই একটিমাত্র ছড়া আজকাল
আমাকে সব সময় ছায়ার মতো
ঘিরে থাকে। এখানে এখন
সাদা বরফের চাঁই ঢেকে
রেখেছে সকল কিছু।
এখানকার আদিগন্ত
বিস্তৃত সাদার মধ্যে
ছায়ার কোনো মালুম নেই।
তবু মনে হয় এই ছোট্ট, তিন
লাইনের ছড়াটা আমাকে
আষ্টেপৃষ্ঠে গিলে খাবে;
আমি বুঝি চোখ মেললেই
দেখতে পাব এই ছড়ার শরীর
ক্রমাগত লম্বা হচ্ছে
ছায়ার মতো, আর আমার
পায়ের নিচে আঠার মতো
লেগে থাকছে! আতঙ্কে আমি
এই হিমশীতল দেশে আরো
গাঢ়তর কোনো হিমের অতলে
তলিয়ে যেতে থাকি একা।
আমাদের পাশের রুমে
টুকুস ঘুমায় গুটিসুটি
মেরে। ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া
রাতগুলোতে আমি প্রায়ই
টুকুসকে দেখতে যাই এক
নজর। ওর কিন্তু নড়াচড়া
নেই, ছোটো ছোটো
নিঃশ্বাস ফেলে ও দিব্যি
নিজের ঘুমের দেশে মগ্ন
থাকে। আমি সাবধানে ওর
পাশ থেকে ফিরে আসি। কী
জানি, আমার নিঃশ্বাসের
শব্দেও যদি মেয়ের ঘুম
ভেঙ্গে যায়! তারপর যদি
উঠে বসে অবাক হয়ে
জিজ্ঞেস করে- হোয়াট আর
ইয়্যু ডুয়িং হিয়ার, মম?
না না, কী দরকার এসবের?
আমি তাই আবার বিছানায়
ফিরি, চোখ বন্ধ করে শুয়ে
থাকি কিছুক্ষণ, কোনো
কোনো রাতে ঘুমিয়ে পড়ি
চুপচাপ, কোনো কোনো রাত
ঘুম ছাড়াই পার হয়ে যায়।
ব্যাপারটা এত ঘন ঘন ঘটে
আজকাল, এমন ঘুম আর
ঘুমহীনতার মধ্যে
নিরন্তর নিজের আর দশটা
স্বাভাবিক ঘটনার মতোই
হয়ে যাচ্ছে হয়তো।
কিন্তু তবু মঞ্জু
কাকিমার হাহাকারভরা
কণ্ঠটা মনে পড়লেই বুকের
ভেতরে কী থেকে কী হয়ে
যায়! দেশ থেকে বহু বহু
দূরে এমন নিশ্চিন্তির
জীবন কেমন তেতো জেল
টেনে আনে মুখের ভেতর!
প্রসেন বিরক্ত হয়ে বলে
মাঝেমাঝে- এখানে আসার
ব্যাপারে তোমারই তো
বেশি আগ্রহ ছিল, নদী।
আমিই তো বরং নিশ্চিন্ত
চাকুরি ছেড়ে শুধু তোমার
জন্য পালিয়েই এলাম
প্রায়। সেই তুমি কেন
এমন করছো আজকাল? কীসের
এত অশান্তি তোমার?
প্রসেনকে আমি বোঝাতে
পারি না কীসের এত
অশান্তি আমার বুক জুড়ে
তোলপাড় করে। আমি নিজেও
কি ছাই বুঝি সব? গত পাঁচ
বছরে তিল তিল করে গড়ে
তোলা আমার কষ্টের
সংসার, ম্যাপল পাতার
কাটাকাটা সৌন্দর্যের
ভাঁজে কোন গহীনের
তিরতির করতে থাকা
অনুভূতিগুলোকে মুড়িয়ে
দেবার আপ্রাণ চেষ্টা সব
মিলেমিশে কেবল আমিই সে
বিষাদজলে সাঁতার কাটতে
না পেরে হাবুডুবু খাই।
প্রসেন এদেশে আসতেই
চায়নি, অথচ সেই কেমন
দিব্যি সাহেব হয়ে উঠছে
দিনে দিনে! ইঞ্জিনিয়ার
হবার সুবাদে ওর কষ্ট
আমার চাইতে অনেক কম ছিল,
পড়ালেখা করতে করতেই কী
ভালো একটা চাকুরিও পেয়ে
গেল।
আর আমি! কোনোরকম হাঁচড়ে
পাঁচড়ে পোস্টগ্র্যাড
শেষ করে এখন অফিসের
কাজেও হিমশিম খাই! অফিস,
বাড়ি, টুকুস- এই অচিন
দেশের অচিন বরফের
পাহাড়, সবকিছুই আমার
কাছে অর্থহীন লাগতে
থাকে কখনো কখনো। যেন এর
কোনোকিছুই আমার নয়,
আমার ছিল না কোনোকালে!
সত্যিই তো, অন্য সব কিছু
বাদ দিলে, কেবল টুকুসের
কথাই যদি ভাবি- ওকেই কি
ঠিকঠাক চিনি আমি? আমারই
পেটের সন্তান এই সেদিন
যার জন্ম হলো, তার সাথেও
নাকি মন খুলে একটু গল্প
করতে পারি না! এত
চেষ্টার পরও দুই লাইন
বাংলা ঠিক করে বলতে
শিখল না পর্যন্ত
মেয়েটা! কত করে বাংলা
শেখাতে চাইলাম আমি ওকে,
শিখল? একটুও আগ্রহ নেই,
আগ্রহ নেই প্রসেনেরও।
মাঝেমাঝে খুব ধন্দে পড়ে
যাই, মনে হয় টুকুস সত্যি
আমার মেয়ে তো! আমার মেয়ে
বাংলা কথা বলতে
ভালোবাসে না এ কী করে
সম্ভব! প্রসেনের অবশ্য
এ নিয়ে কোনো হেলদোল
নেই। এ প্রসঙ্গ তুললেই
সে বলে-
টুকুসের বয়স কেবল তিন
বছর, নদী। বাংলা শেখার
জন্য ওর সারাটা জীবন
পড়ে আছে।
আমার তখন মনে হয় চিৎকার
করে বলি- ইংলিশ শেখার
জন্যও তো সারাটা জীবন
পড়ে আছে, প্রসেন,
বাংলাটাই বা কেন দেরিতে
শিখতে হবে?
চিৎকার করা হয় না শেষ
পর্যন্ত, এই ‘সভ্য
দেশে’ কেউ চিৎকার করে
কথা বলে না বলে।
প্রসেনের
নির্লিপ্ততায় অভিমান
জমে জমে পাহাড় হয়ে যায়
বলে। টুকুসের বাংলার
প্রতি মোটেই আগ্রহ
দেখতে পাই না বলে।
জীবনের প্রতি সব
দায়িত্ব পালন করতে
করতে আমি এক নিথর
মানুষে পরিণত হতে থাকি।
কেবল মা যখন ভিডিও কলে
টুকুসের সাথে কথা বলতে
না পেরে দীর্ঘশ্বাস
ছেড়ে বলে- তোর বেটির
সাথে মুই ওগুলা ইংলিশ
কথা কবার না পাইম, বেটি-
তখন সেই দীর্ঘশ্বাসের
ঝাপটা আমাকে এ ফোঁড় ও
ফোঁড় করে দেয়। এমন
সময়গুলোতেও মঞ্জু
কাকিমার হি হি হাসির
শব্দ আচমকাই ফিরে আসে
আর তার সাথে সেই তিন
লাইনের ছোট্ট ছড়া-
ওয়াটার ওয়াটার করি
মোর জাদুটা গেল মরি
কায় বা জানে ওয়াটার
মানে পানি!
আমি মাকে কোনো
সন্তোষজনক জবাব দিতে
পারি না এ কথার।
বেশিরভাগ সময় প্রসঙ্গ
বদলে ফেলে হাঁফ ছেড়ে
বাঁচি। আজ সন্ধ্যায়
মার সাথে কথা বলার সময়
জিজ্ঞেস করেছিলাম,
মঞ্জু কাকিমা কেমন আছে।
মার ওখানে তখন সকাল। মা
জানালো কাকিমার শরীর
বেশি ভালো নেই, খুব নাকি
ভেঙ্গে পড়েছে কাকু
মারা যাবার পর। আমি
মাকে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস
করেছি- মা, কাকিমা কি আর
ছড়া কাটে আগের মতো?
না, মা দুপাশে মাথা
নেড়ে জানিয়েছে, কাটে
না। আমি অবাক হতে
গিয়েও হইনি। এতকিছু
বদলে গেছে এই কয় বছরে যে
আজকাল অবাক হতেও ভুলে
যাচ্ছি। এই কয় বছরে
আমার চারপাশে এত কিছু
বদলে গেছে যে মঞ্জু
কাকিমার ছড়া না কাটা
আমার আশ্চর্য বিষয় বলে
মনে হয় না।
কফি খেতে ইচ্ছে করছে
খুব। আমি এখনো সব খাওয়া
বাঙালি হয়েই থাকলাম,
টুকুস বা প্রসেনের মতো
কফি ড্রিংক করতে পারলাম
না! সব অন্যমনস্কতা
কাটিয়ে কিচেনের দিকে
যেতে থাকি। এক মগ কফি
খেয়ে আবার কাজে বসব।
এখন ওয়ার্ক ফ্রম হোমের
চক্করে পড়ে সারাদিনই
টুকটাক কাজ করতে হয়।
নির্দিষ্ট অফিস আওয়ার
জিনিসটাই বোধহয় চলে গেল
জীবন থেকে।
কিচেনের আগেই টুকুসের
ঘর। টুকুস এখন বাবার
সাথে খেলছে
ব্যাকইয়ার্ডে। আমি
মেয়েটার ঘরে ঢুকি। ওর
ছড়ার বই, খাতা, পেন্সিল
সব এলামেলো ছড়ানো। রং
পেন্সিলগুলো হোল্ডারে
গুছিয়ে রাখতে গিয়ে তার
তলা থেকে ছোট্ট একটা
চৌকো কাগজের টুকরো চোখে
পড়ল হঠাৎ। সাদা ছোট্ট
টুকরো কাগজটার উপরে
কালো আর লাল রংয়ে ভাঙা
ভাঙা অক্ষরে টুকুস
লিখেছে- মা!
আমার সমস্ত অন্তরাত্মা
সেই লেখাটুকুর উপর নুয়ে
পড়তে চায়। অনেক অনেকদিন
বাদে মঞ্জু কাকিমার বলা
আরেকটা ছড়ার লাইন মনে
পড়ে এবার-
আরে তার পরে তো দ্যাখেন
ভালো
ইন্দিরা গান্ধীর নাতনি
এলো
হোতলাইটা নিচে করো
নিকাশটা ধীরে ছাড়ো…
বাইরে পাহাড়ের মতো জমে
থাকা অসীম সাদা সাদা
তুষারখন্ডের রেখা ধরে
আমার বন্ধ হয়ে থাকা
নিঃশ্বাস অনেকদিন পর
যেন পথ খুঁজে পায়!