মহামারী সরছে কিন্তু
মানুষের দীর্ঘশ্বাসের
শব্দ বড় হচ্ছে।
আমাদের চারপাশে হাজারো
ভাষা ছড়িয়ে থাকে। যে
ভাষার কোনো শব্দ নেই।
শব্দতরঙ্গ নেই।
আমাদের মনের গহীনে না
বলা কথার অনুরণন
প্রতিটি মুহূর্তে।
বেঁচে থেকে আমরা মাত্র
কয়েকটি ভাষা বলতে পারি,
বুঝতে পারি। কথায় যে
ভাষা বলি, এক জীবনে
অনুচ্চারিত ভাষা
প্রতিক্ষণে অনেক
অনেকবার বলি, যা পরস্পর
ও সবাইকে বলা হয়না।
আমাদের গোপন আনন্দের
ভাষা আছে, ব্যাধির ভাষা
আছে, একাকীত্বের ভাষা
আছে, রাত্রি যাপনের
ভাষা আছে, দিনে
কর্মজীবনের ভাষা আছে।
রাখালের গবাদি পশু
খেদানোর ভাষা আছে।
কৃষকের বীজতলার
হাহাকারের ভাষা আছে।
শ্রমিকের লকআউটের
যন্ত্রণার ভাষা আছে।
কলম মজুরের কলমের লিখে
যাওয়ার খস খস শব্দের
ভাষা আছে। প্রাকৃতিক
মহাশক্তি আমাদের
কণ্ঠের শক্তি দিয়েছেন।
সেই শক্তির ক্ষমতায়
কিছু সাংকেতিক শব্দ
মনের গভীরে নিজেরাই
টোকা দিয়ে যাই। কিন্তু
সেই শব্দের অনুশাসিত
কোনো বর্ণলিপি নেই।
কেনই বা থাকবে? আমরা
কথায় তা কোনোদিনই
প্রকাশ করি না। সেই সব
সাংকেতিক শব্দই আমাদের
না বলা কথার গোপন
অভিব্যাক্তি। এক একজন,
গভীর যাপনে নিজের সঙ্গে
নিজেই কথা বলেন।
রাষ্ট্রের প্রতি তার
দায়বদ্ধতা, রাষ্ট্রের
দায়বদ্ধতা তার প্রতি,
বিশেষ করে
রাষ্ট্রক্ষমতা
পরোক্ষভাবে এক একজন
মানুষকে কি ভাবে
নিঃসঙ্গ করে দিচ্ছে,
সমাজবিজ্ঞানীরা তা
নানারকম দৃষ্টিভঙ্গী
থেকে ব্যাখ্যা করছেন।
মহামারী পৃথিবী থেকে
সম্পূর্ণ বিদায় নিয়েছে,
এ কথা বলার সময় এখনও
আসেনি। তবে আমাদের
সমাজজীবন ও নাগরিক জীবন
আস্তে আস্তে ভয় ভীতির
খোলস ছাড়াতে শুরু
করেছে। দেশ, রাষ্ট্র
সমাজ নগর গ্রাম মন্থর
সুস্থ হয়ে ওঠার
পাশাপাশি মানুষের
দীর্ঘশ্বাস কিন্তু
ক্রমশ দীর্ঘ হয়ে উঠছে।
আসলে দীর্ঘশ্বাসের
কোনো শব্দ হয়না। না বলা
কথার মতো দীর্ঘশ্বাস
জীবনের ক্ষত হয়ে থেকে
যায়। কান পাতলে শোনা
যাচ্ছে, মানুষের
বিপন্নতার কথা। শুধু কি
কাজ ও রুজিরুটির
প্রশ্ন? রাষ্ট্র তার
ক্ষমতার ভাষা দিয়ে
মানুষের ক্ষুধার ভাষা,
কাজ হারানোর বেদনার
ভাষা বুঝতে চায় না।
বুঝতে চায় না মানুষের
গোপন বেদনার কথা।
রাষ্ট্র শুধু মগ্ন থাকে
জাতীয় ভাষার স্বীকৃতির
এক্কাদোক্কা খেলা
নিয়ে। যে কোনো রাষ্ট্রে
রাষ্ট্র যদি মানুষের
জীবন জীবিকার, কাজের
ক্ষেত্র ও রুজিরুটি
হারানোর প্রশ্ন বুঝতে
না পারে সেখানে জাতীয়
ভাষা নিয়ে কৃত্তিম
লম্ফঝম্প গৌণ হয়ে যায়।
কোটি কোটি মানুষের
অনুচ্চারিত গোপন
বেদনার ভাষাই হল, এক
একটি দেশের জাতীয় ভাষা।
যে ভাষার কোনো লিপি
নেই। যে দেশ, যে রাষ্ট্র
সেই ভাষা বুঝতে পারে, সে
দেশের মানুষেরর থেকে
সুখী কে আছে?
সাম্প্রতিক ও বেশ কয়েক
দশক ধরে ঘটে চলা
রাজনৈতিক নষ্টামি,
মাছের আঁশের মতো
পরিত্যক্ত,- মাতব্বরদের
মুল্যবোধহীন
জাতীয়তাবোধ দেশের
প্রতিটি মানুষকে কতটা
নিঃসঙ্গ করেছে, তা আমরা
সবাই মর্মে মর্মে
উপলব্ধি করছি। খেটে
খাওয়া মানুষের আর্তির
ভাষা রাষ্ট্র কোনোদিনই
বুঝে উঠতে পারেনা।
রাষ্ট্রক্ষমতা
মানুষের না বলা
কথাগুলিকে কোনোদিনই
বুঝে উঠতে সক্ষম হয়ে
ওঠেনা। যত দিন যাচ্ছে,
আমার স্বদেশের খেটে
খাওয়া সর্বস্তরের
মানুষ রাস্তায় নেমে
আসছে। রাস্তাই যেন
তাদের একমাত্র
প্রতিবাদের ভাষা। এই
প্রতিবাদের যন্ত্রণার
ভাষা কি আজও আমরা
আবিষ্কার করতে পেরেছি?
কাজেই, “ভাষা এমন কথা
বলে বোঝে যে সকলে উঁচা
নীচা ছোটো বড় সমান”...
অধিকাংশ সময়েই আমরা
অসংখ্য কথা বলি
মাতৃভাষায় মাধ্যমে বা
বলতে পারি অন্য যে কোনো
ভাষায় সেই ভাষা আমরা
পরস্পর বুঝতে পারলেও,
বিশেষ করে আঙ্গুল তুলে
অনাচার ও দুর্নীতির কথা
যদি সরাসরি বলতে পারি
তা হলে রাষ্ট্রক্ষমতার
রোষের শিকার হতে হয়।
মানুষের না বলা ভাষাকে
রাষ্ট্র কি কোনোদিন
গুরুত্ব দিয়েছে? দেশের
মানুষ তার জীবনের
অভিজ্ঞতা থেকে
যন্ত্রণার যে না বলা
ভাষা মনের গহীনে রেখে
দেয়, সেই না বলা ভাষাকে
বুঝতে না পারলে, আমরা
সবাই যেমন গভীর
অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি,
তা ভবিষ্যতে অন্ধকারের
এক ভয়ানক বিস্ফোরণ
সৃষ্টি করবে।