আমাকে যখন ইস্কুলে বা
বাড়িতে কেউ বকাবকি
করতেন, তখন আমি চোখ বুজে
থাকতাম। কারণ, যাঁরা
বকাবকি করতেন, তাঁদের
অনেককেই আমি খুব
ভালবাসতাম। এখনও
ভালবাসি। সেই যে
ছোটবেলা থেকে একটা
অভ্যেস তৈরি হয়ে গেল
আমার, পরবর্তীকালে
ছোটখাটো ঝগড়ার সময়েও
দেখেছি, চোখ বন্ধ করে
রাখলে, রাগ খুব দ্রুত
শান্ত হয়ে আসে। এমনকী,
যার প্রতি রাগ হল, তার
প্রতি ঘৃণাও খুব একটা
আসে না। এর কারণ সম্ভবত,
যা শুনছি, তার সঙ্গে যা
দেখছি, তার মধ্যে
সম্পর্ক তৈরি না করতে
চাওয়ার মানসিক জটিলতা।
বলা বাহুল্য, এই
অভ্যেসের দাম দিতে
হয়েছে আমাকে অনেকবার।
কিন্তু একটা কথা
বুঝেছি, আমিও সমান
হিংস্র হয়ে উঠি তখন, যখন
আমি আমার কথা দিয়ে
কাউকে শাসন করতে চাই।
ভয় পাওয়াতে চাই। দুঃখ
দিতে চাই। তখন আমার
ভাষা আর আমি মিলে যা
তৈরি হয়, তা একপ্রকার
সন্ত্রাস।
পরে অনেক সময় ভেবে
দেখেছি, তাহলে কি
সন্ত্রাস লুকিয়ে ছিল
ভাষাতেই? অর্থাৎ, যিনি
শাসন করছেন, তাঁর কাছে
ভাষাটা একটা অস্ত্র, যা
আমার মনের ভিতর থাকা
ভাষার আবেগটাকে
সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে
দিচ্ছে। আমার মনের
ভিতরের ভাষার
কাঠামোগুলিকে ধ্বংস
করে ফেলে, রচনা করছে
তাঁর নিজস্ব কাঠামোর
ভাষাকে। আর তা যদি আমি
অনুসরণ না করি, তবে সেই
ভাষাতেই আবার আমায় শাসন
করছেন তিনি। কারণ তিনি
জানেন, আমাকে পরিবর্তন
করার একটাই রাস্তা, আর
তা হল, আমার ভাষার
কাঠামোকে সম্পূর্ণ
ভাবে তাঁর
নিয়ন্ত্রণাধীন করে
তোলা। অনেকেই এই শাসনে
সফল হন। তিনিও
হয়েছিলেন। কিন্তু এই
শাসনে অনেকটাই ভালবাসা
ছিল, ফলে খুব একটা
ক্ষতিকারক কিছু ঘটেনি।
কিন্তু এই পদ্ধতিটি
ক্ষতিকারক।
প্রসপ্যারো যে
ক্যালিবানকে তাঁর
নিজস্ব ভাষায় শিক্ষিত
করে তুললেন, এর ফলে,
ক্যালিবানের ক্ষতিই
হল। ক্যালিবান জানতেই
পারল না, তাঁর মনের
অবচেতনা থাকা
নির্জ্ঞানকে। যে
নির্জ্ঞান থেকে মায়ের
ভাষা উচ্চারিত হয়। যে
নির্জ্ঞান থেকে কেউ
ভাষার আবহমান অবচেতনার
গভীর সমুদ্রে ডুব দিতে
পারে। ভাষার এই
সর্বগ্রাসী ভয়ংকর
খিদের কথা আমরা বুঝতে
পারি যখন ভাষাকে
ব্যবহার করে এক একটা
প্রতীক তৈরি করে শাসক
বা ধর্ম। 'জয় শ্রী রাম',
বা আল্লা হো আকবর শুধু
মাত্র ভগবান বা আল্লার
নাম নয়, একপ্রকার ভয়ের
রেটরিকও বটে। জয় শ্রী
রাম বা হর হর মহাদেও যদি
সমস্বরে উচ্চারিত হতে
হতে পথ হেঁটে যায়, তবে,
তা একপ্রকার
প্রতিধ্বনিময়
সন্ত্রাসের জন্ম দেয়।
ভুক্তভোগীরা আজীবন এই
সব ধর্মীয়
ধ্বনি-প্রতিধ্বনিকে
মনে রাখেন, এমনকী
ট্রমাতেও ভোগেন।
সন্ত্রাসের ভাষা এমনই।
সে সন্ত্রাস নীরবেই
সম্ভব। সেই ভাষার মধ্যে
থাকে লোভের হাতছানি,
লিবিডোর পূর্বরাগ,
দমনের বুলডোজার। যে
ভাষা একেবারেই মায়ের
ভাষা নয়। মায়ের ভাষা হল,
যে ভাষার হাত ধরে
নিশ্চিতে থাকা যায়। সে
ভাষা চোখরাঙায় বটে, তবে
তা আশঙ্কায়। সে ভাষা
কাঁদে, কিন্তু তা
দুঃখে। সে ভাষা থমথমে
হয়ে যায়, কিন্তু তা
যন্ত্রণায়। কিন্তু
শাসকের ভাষা এসব কিছুই
করে না। সে ছদ্মবেশ
নিয়ে থাকে। বিষাক্ত
নেশার মতো। তার পর সে
ধীরে ধীরে মেরে ফেলে।
লোভ দিয়ে, ভয় দিয়ে,
আতঙ্কদিয়ে, মাথাটাকেই
সম্পূর্ণভাবে অধিকার
ক'রে।
সবচেয়ে কঠিন সময় আসে
জীবনে তখন, যখন এই মায়ের
এবং শাসকের ভাষার মধ্যে
প'ড়ে কেউ ভাষা থেকেই
পালিয়ে যেতে চায়। সে তো
আর অন্য কোনও ভাষাকেই
ভালবাসতে পারে না।
বিশ্বাস করতে পারে না।
তার মন চায় মায়ের ভাষার
কাছে ফিরে যেতে। কিন্তু
সে ততক্ষণে পরিণত হয়েছে
একটি যন্ত্রে, যার
নিজস্ব ইচ্ছে বলতে
কিছুই নেই। যার ইতিহাস
নেই কোনও। যার গল্প
নেই। যে একটা
গোলকধাঁধাঁর মধ্যে
হারিয়ে গিয়ে ঘুরপাক
খাচ্ছে। একজন মানুষ যদি
তার ভাষা থেকে হারিয়ে
যায়, তাহলে সে তার সত্তা
থেকেই হারিয়ে যায়। সে
নিজের মন থেকেই হারিয়ে
যায় অনেক দূরে। নিজেকে
খুঁজে পাওয়ার
রাস্তাটাও তার আর জানা
থাকে না। তখন সেও হয়ে
ওঠে সন্ত্রাসের ভাষার
এক অংশ।
কিন্তু এত সব কথা আমি
কেন লিখলাম? কারণ এই
সমস্ত কথাই তো বলা হয়ে
গেছে আগে। বহুবার
বলেছেন বিশ্বের
বিভিন্ন প্রান্তের
মানুষ। কোনও তো নতুন
কথা বললাম না। তাহলে কি
আমার ভাষা কোনও নতুন
কথা ভাবার ক্ষমতা
হারিয়েছে? তবে কি আমায়
সমস্ত ভাষা থেকে দূরে
নিজের ভাষার কাছে ফিরে
যেতে হবে? অজ্ঞাতবাস
প্রয়োজন? যেখানে
লিবিডোকে উদবোধিত করার
ভাষা নেই, ভয়ের
চোখরাঙানির ভাষা নেই।
আমার ভাষাকে তো আসলে
কেউই মারতে পারবে না
আমি ছাড়া। শাসক এই কথা
কি জানেন না? আমার ভাষা
তো আমার কাছে থাকবেই,
যদি আমি চাই। একজন
ব্যক্তি যে ভাষার
পরিমণ্ডল ও ভাষার সত্তা
নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন,
তা তার সঙ্গে থাকে
আজীবন।
বেশ কয়েকবছর আগে একবার
হাসপাতালে ভর্তি
ছিলাম। সেখানে জেনারেল
ওয়ার্ডে সারা রাত একজন
বৃদ্ধ 'মা' 'মা' বলে ডেকে
যেতেন। আমার বুকের ভিতর
যন্ত্রণায় কী যেন দলা
পাকিয়ে উঠত। সারাদিন
সারারাত তাঁর সেই মা-কে
ডেকে যাওয়া, পৃথিবীর
কোনও সন্ত্রাস, কোনও
শাসক পরিবর্তন করতে
পারবেন বলে তো মনে হয়
না। আমাদের সমস্ত
শিল্পজিজ্ঞাসা তো আসলে
এই ডেকে যাওয়াই।