করমণ্ডল ট্রেনের জন্য
অপেক্ষা করছি।চেন্নাই
যাব,পদ্মশ্রী পুরস্কার
প্রাপ্ত
অর্থোপেডিক্সের
সার্জন Dr.Mayil Vahanan Natarajan এর
কাছে।কে,বি,এস, এম, ফজলুল
কবীর এর আগে বাংলাদেশের
ডাক্তার সালেক
তালুকদার ও ডাক্তার
আমজাদ সাহেবের
পরামর্শে
ছিলেন।অপারেশন
পরবর্তী সময়ে নি
জয়েন্টে জায়েনসেল
টিউমার আবার ফিরে এলে
আমরা দুহাজার এগার সাল
থেকে তাঁকে নিয়ে কলকাতা
হয়ে চেন্নাই যাই
বেশকবার।সেবার এপ্রিল
মাসের তীব্র গরমে রোগী
নিয়ে যাত্রা তাই একটু
আগে,ভাগেই শিয়ালদা
স্টেশনে
পৌঁছাই।ট্রেনের
অপেক্ষায় অসংখ্য
যাত্রী।কোথাও বসার
জায়গা নেই।বসার
সিমেন্টের বেঞ্চিগুলো
সব ভরে রয়েছে।কোন ভাবে
রুগীকে বসার একটু
ব্যবস্থা করতে পারলেও
দাদো আর আমি দাঁড়িয়ে
আছি।প্রচণ্ড গরমে
কুলকুল করে
ঘামছি,বোতলের পানিও গরম
হয়ে গেছে।আমার কাছেই
একটি পরিবার বসে
আছে।ওরা ছেলেকে
স্যালাইন মেশানো পানি
খাওয়াচ্ছে।দেখে আমারও
মনে হলো আমরাও পানির
বোতলে স্যালাইন মিশিয়ে
নেই।টুকটাক কথা হচ্ছিল
দাদোর সাথে।বাঙালি
মহিলা জানতে চাইলেন
রোগী আমার কে?বললাম
স্বামী।স্টেশনের
একপাশে একদল শ্রমিক
একটি বড় রুমাল বিছিয়ে
খুব যত্ন করে তাতে ছাতু
ঢেলে নেয়।তারপর চারভাগ
করে সাজায়।চারটি ভাজা
লাল মরিচও বের করে
পুটলি থেকে।শব্দ না করে
একটু একটু করে মুখে দেয়
চারজনে।কালো শরীর থেকে
ঘাম ঝরছে ভিজে
যাচ্ছে,তবুও ওরা
নিঃশব্দেই সময় পার
করছে।সবাই নিজেদের
সাথে কথা বলছে তামিল
অথবা হিন্দি
ভাষায়।শুধু আমরা আর
বাচ্চা ছেলেকে
স্যালাইন পানি খাওয়ানো
পরিবারটির ভাষা
বাংলা।তাদের সাথে থাকা
পানি শেষ হয়ে যাওয়ায়
পানি কিনছে তাও বাংলা
ভাষায়।শাখা সিঁদুর
দেখে বুঝেছি বাঙালি।
ইতোমধ্যে আর একটি
পরিবার এসেছে
কিচিরমিচির করতে
করতে।কোন এক মন্দির
থেকে এসেছে,হাতে
ফুল,প্রসাদ।হাসছে,কথা
বলছে হিন্দিতে।আমি
হিন্দি, ইংরেজি কোনটাই
বলতে পারি না।তাদের
আনন্দ ভালোলাগছে।আমার
গা ঘেঁষে দাঁড়ানো অথচ
আলাপ করতে পারছি
না।দীর্ঘ সময় চুপ করে
না থাকতে পেরে রুগীকে
নানা বিযয়ে প্রশ্ন
করছি,পানি খাবে কি
না,অসুবিধা হচ্ছে কি
না।বাঙালি মহিলার সাথে
চোখাচোখি
হয়।বাচ্চাটার
অস্থিরতা দেখি।একটু
পরে হিন্দিভাষার মহিলা
সরে গিয়ে বেঞ্চের পাশে
দাঁড়ায়।বাঙালি মহিলা
গুছিয়ে নিচ্ছেন
বাচ্চার খাবারসহ
সবকিছু। তাদের ট্রেন
এসে গেছে।আমাদের ট্রেন
প্লাটফর্মে আসবে আরো
পরে।হঠাৎ বাঙালি মহিলা
হাত ধরে আমাকে টেনে
বসায় তার স্থানে।দ্রুত
যাবার সময় বলে, বসে
পড়ুন,তা না হলে ঐ মহিলা
বসে পড়বে।আমি অবাক হয়ে
তাকিয়ে থাকি হিন্দি
ভাষার মহিলা আর
বাংলাভাষার মহিলা একই
ধর্মের হলেও শুধুমাত্র
বাংলা ভাষার কারণে সে
আমার আপন হয়ে উঠলো।আমি
তার পথের দিকে বিস্ময়ে
তাকিয়ে থাকি,দ্রুত ছুটে
যাচ্ছে।
২.
ইশারার ভাষা
M.N.Orthopaedic Hospital,Bank Street,New Avadi
Road,Kilpauk.এর কাছেই 'বব
হাউস'।হাসাপাতালের
কাছে বলেই এখানের একটি
রুমে বেশি ভাড়া দিয়ে
আমরা থেকেছি
দুবার।চেন্নাইয়ের
খাবারে আমরা তখনও
অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি তাই
বাসায় থেকে রান্না
করতাম। কাপড় কাচার ও
শুকাবার সুব্যবস্থা
ছিলো ভেতরে ও
বাইরে।পাশের রুমে ছিলো
একজন তামিল নারী ও তার
অসুস্থ ছেলে।কালো,
শক্ত-পোক্ত ও-ই নারীর
ছিলো মায়াবী একজোড়া
চোখ।আমি চাইতাম বাইরের
কাপড় কাচার কলতলায় আগেই
চলে যেতে,তা হলে লনে
কাপড় শুকাবার ভালো
জায়গাটি পাওয়া যাবে এবং
তাড়াতাড়ি হাসপাতালে
যেতে পারবো।বয়স্ক
তামিল নারীকে আমি মনে
মনে বুড়ি
ডাকতাম।কোনদিন যদি
দেখতাম বুড়ি আগেই চলে
এসেছে কলতলায় খুব রাগ
হতো ভেতরে।দেখতাম বুড়ি
হাত ইশারায় আমাকে
ডাকছে,ইশারায় বলছে
আমাকে আগে কাপড়
কাচতে।ধীরে ধীরে একটা
অলিখিত নিয়ম হয়ে গেলো
আমি আগে কাপড়
কাচবো,তিনি কাচবেন
পরে।
কাপড় কেচে দ্রুত
রান্না করে হাসপাতালে
যেতাম টিফিন
ক্যারিয়ারে খাবার
নিয়ে।এই পরবাসে আমি
খেয়েছি কি খাইনি দেখার
কেউ ছিলো না।প্রতিদিন
বিকেলে আমি যখন বাসায়
ফিরতাম বুড়িমা আমাকে
ইশারায় ডেকে মুখের কাছে
হাত নিয়ে, সাপার,সাপার
বলে অদ্ভুত ভঙ্গি করে
জানতে চাইতেন আমি
খেয়েছি কি না।তাঁর
ইশারার ভাষায় স্নেহ ঝরে
পড়তো।একদিন খাবার নিয়ে
যাবার সময় আমি ভুল করে
চাবি ভেতরে রেখে বাইরে
তালা লাগিয়ে দেই।ভয়ে
আমি ঘামতে থাকি,কেমন
করে ভেতরে ঢুকবো?রাতের
খাবার নিয়ে হাসপাতালে
কেমন করে যাবো? রান্না
করবো কেমন করে?এদেশের
ভাষা বুঝি না,ইংরেজি
ভালো বলতে পারি না।রাত
হয়ে আসছে,পারলে তালা
ভেঙে ফেলি। খটখট করে
তালায় শব্দ
করছি।বুড়িমা
এলেন,ইশারায় বোঝালেন
দোতলায় গিয়ে যেন
বাড়িওয়ালার সাথে কথা
বলি।হঠাৎ মাথায় এলো
বাড়িওয়ালা মিস্টার
রাজার কাছে ডুপ্লিকেট
চাবি থাকতে পারে।কী যে
বলবো,ইংরেজি চর্চা করি
মনে মনে।বুড়িমা আমার
সাথে সিঁড়ি পর্যন্ত
গেলেন, আমি দোতলায় উঠে
ড্রয়িংরুমে বসা
মিস্টার রাজাকে শান্ত
স্বরে বললাম,Please Another key.
রাজা আমার দিকে
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে
চাবি এগিয়ে দিলেন।
অপারেশন শেষে যেদিন
রুগী নিয়ে বাসায় এলাম
বুড়িমার সে কি
খুশি।আমার হাত ধরে টেনে
রুমে নিয়ে গেল,বড় এক
প্লেট ইডলি ও সাম্বার
সাজিয়ে দিয়ে আবার
কিচিরমিচির করে বলতে
চায় যেন রুমে গিয়ে
সবাইকে নিয়ে
খাই।খাবারগুলো রুমে
নিয়ে এলে ওরা ভ্রু
কুঁচকে তাকায়।ইডলি
তখনো আমাদের পছন্দের
খাবার হয়ে ওঠেনি।দাদো ও
ফজলুল কবীর লুলুকে
বুঝালাম এই পরম স্নেহের
উপহার ফিরিয়ে দিতে
পারবো না।খেতে হবে।
অপারেশন শেষে শরীর একটু
ভালো হলে আমরা যেদিন
খুব সকালে এয়ারপোর্টে
যাওয়ার জন্য একটা গাড়ি
ভাড়া করি ও মালামাল
টেনে গাড়ির কাছে নিয়ে
যাই সেদিন বুড়িমা তাঁর
ছেলেকে ঘুম থেকে টেনে
এনে আমাদেরকে সাহায্য
করার জন্য বলে।সেদিনও
তামিল ভাষা বুঝতে
পারিনি,তবে মায়ের ভাষার
স্নেহের তরল ঠিকই বুঝতে
পেরেছি যখন দেখেছি তাঁর
চোখ দিয়ে জল
পড়ছে।দুজনেই আবারও
ইশারার ভাষায় কথা বলতে
বলতে গাড়িতে
উঠেছি,বুড়িমা রাস্তা
পার হয়ে গাড়ি পর্যন্ত
এলেন।যতদূর দেখা গেলো
হাত নেড়ে যাচ্ছি, মনে
হলো কী যেন রেখে
যাচ্ছি।আলো-আঁধারি ভোর
আর গাড়ির জানালা জানলো
চেখের জলের ভাষা।