প্রিয় তমাল,
ভাষাদিবসের ঠিক আগে
তোমার নির্দেশ এলো
বাংলাভাষা যেভাবে
আক্রান্ত হচ্ছে তা নিয়ে
লিখতে হবে । যে কাজ
ভাষাবিদদের, যে-কাজ
ভাষাশিক্ষকদের তা নিয়ে
বলবার যোগ্যতা নেই
আমার। তবে অর্ধশতাব্দী
এই ভাষার সঙ্গে কমবেশি
যুক্ত থাকার ফলে আমার
কবিতার ভাষা নিয়ে
সামান্য বেদনার কথা
তোমাকে জানাতে পারি।
আমি যখন লেখার জগতে
এলাম, সেই অগ্নিগর্ভ
সাতের দশকে, বাংলা
কবিতার সে এক বিস্ময়কর
আধুনিকতার সময়। আমার
অগ্রজ দেবদাস আচার্য
যিনি কখনো ছয়, কখনো
সাতের দশকে বিরাজ
করছেন, আছেন আমার
সমসাময়িক অমিতাভ গুপ্ত
রণজিৎ দাশ শম্ভূ রক্ষিত
পার্থপ্রতিম
কাঞ্জিলাল,বীতশোক
ভট্টাচার্য, আছেন অনুজ
গৌতম চৌধুরী জয়
গোস্বামী শ্যামল
কান্তি দাশ মৃদুল
দাশগুপ্ত নির্মল
হালদার গৌতম বসু সুবোধ
সরকার প্রমুখ কবি, আছেন
আরও অনেক উজ্জ্বল কবি ,
যাদের আমি কিছু কাল পর
চিনতে পেরেছি , কিন্তু
নানাকারণে
দুর্ভাগ্যক্রমে
প্রচারের আলোয় আসতে
পারেননি তাঁরা। কেন
তাঁরা যোগ্যতা
সত্ত্বেও স্বীকৃতি
পাননি সে তো অনেক জটিল
আর তর্কের বিষয়। আজ
তোমাকে আমার বলবার কথা
বাংলাভাষার সংকট নিয়ে
নয়, কবিতার ভাষা নিয়ে
আমার নিজের সামান্য
সংকটের কথা, যা তুমি
চাওনি আমার কাছে। তাই
ব্যক্তিগতভাবে যা
জানাচ্ছি তা এক তরুণ
কবির কাছে আমার
ব্যক্তিগত ভাষা সংকটের
কথা।
যাইহোক যাঁদের নাম
করলাম সেই সময় তাঁরা
প্রায় সকলেই খুব
বিখ্যাত কবি। অনেকের
কবিতা আমি বুঝতে পারছি,
মুগ্ধ হচ্ছি, আবার
অনেকের কবিতা সেরকম
বুঝতে পারছি না । সেই
সময় আমার দ্বিতীয়
কবিতার বই ‘স্লেজগাড়ি’
প্রকাশ হল। লক্ষ
করেছিলাম আমার
গ্রন্থটি ওই বিখ্যাত
কবিদের কাছে সেই সময়
খুব কদর পায়নি। কিন্তু
গ্রন্থ প্রকাশের
কিছুকাল পরে এমন কিছু
মানুষের প্রতিক্রিয়া
পেলাম (চিঠিতে নিবন্ধে
এবং আলাপচারিতায়), তার
ফলে আমার নিজের লেখা
সম্পর্কে যে সামান্য
আত্মবিশ্বাস তৈরি হল,
তাতে তখন অন্তত কলমটা
হাত থেকে ফেলে দিতে
ইচ্ছা করল না। আর আরো
কিছুকাল পরে ধীরে ধীরে
আমি বুঝতে পারলাম অনেক
জটিল ভাষা মানুষ বুঝতে
পারে, কিন্তু
আপাতদৃষ্টিতে সহজ ভাষা,
যার ভেতরে এক ভাবনার
ভুবন নিহিত আছে, তা
বুঝতে পারেন না অনেক
পন্ডিত পাঠক। কবিতার
উপরিতলের এই সহজতার
নিচে যে আরো কিছু কথা
আছে, তা সব পাঠক বুঝতে
পারছেন না। আর লেখার এই
সহজতাকে যে অর্জন করতে
হয়, তা কাকেই-বা বলা যায় !
তখন কোন সুদূর থেকে
ভেসে আসে – ‘তোমার ভাষা
বোঝার আশা দিয়েছি
জলাঞ্জলি’।
যারা মুখে বলেছেন আমার
কবিতা বিষয়ে, তাঁদের
কথা পাঠক মেনে নেবেন
কেন? তরুণ কবি অতনু
ভট্টাচার্যের
সম্পাদনায় দৈবক্রমে
একটি গ্রন্থ তৈরি হল,
যাতে পূর্ব উল্লেখিত
কবি সাহিত্যিকদের
লিখিত কিছু নিবন্ধ ও
চিঠিপত্র গ্রন্থিত
আছে।সঙ্গে অগজ ও অনুজ
কয়েকজনের সামান্য কিছু
রচনাও।
এক প্রান্তিক কবি বা
বলা চলে কবিতাকর্মী
হিসেবে ক্রমশ আমার
মনেহয় বিজ্ঞাপন শাসিত
এই সমযে আর ফেসবুক
শোভিত এই জগতে এই সংকট
আমার একার নয়। আমার মতো
প্রচারের কেন্দ্র থেকে
অনেক দূরে বাস করা
প্রান্তিক কবিদের
কবিতার ভাষা বুঝতে
পারছেন না অনেক বিজ্ঞ
পাঠক।
সুখের কথা তোমার মতো
অনেক তরুণ আজ আমার মতো
কবিতাকর্মীদের ভাষা
বুঝতে চাইছে আর আশার
কথা এমন কবিতার পাঠক
তৈরি হচ্ছে যারা
উত্তরকালে আমার মতো এমন
প্রান্তিক কবিদের ভাষা
বুঝতে পারবে আর তাঁদের
কবিতাও উচ্চারিত হবে
নতুন ভাবে। কিন্তু যে
কবি আমার কবিতায় প্রথম
খুঁজে পেয়েছিল কিছু
সারবত্তা, উচ্ছসিত
হয়েছিল (আবিস্কার
করেছিল বললে ভালো
শোনাবে না), আর যে তরুণ
কবি বলেছিলেন,
‘মনীন্দ্র গুপ্তর ‘লাল
স্কুলবাড়ি’-র পাশে আমার
‘স্লেজগাড়ি’ সে তার
উত্তর পুরুষের জন্য
রেখে দেবে’, যে তরুণ,
যিনি তাবৎ বাংলা কবিতার
নব্বই শতাংশ কবিতা
কবিতাকে নস্যাৎ করে
দেন, আর কী ভাগ্যক্রমে
‘স্লেজগাড়ি’-কে বলে
ফেলেন এক ‘বিস্ময়কর
গ্রন্থ’, তাদের নামটাও
বলা যাবে না এই লেখায়?
আমাকে মার্জনা কোরো
তমাল, সেদিন এই
অর্বাচিনের ভাষা যারা
বুঝতে পারেননি তা নিয়ে
আজ আর আমার কোনো বিস্ময়
নেই! কিন্তু যাঁরা
বুঝতে পেরেছিলেন আমার
সেই ‘সহজ ভাষা’ তারা
সবাই আমার অনুজ । তাঁরা
হলেন কবি সনৎ দে,
শুভাশিস মণ্ডল সেলিম
মল্লিক হিন্দোল
ভট্টাচার্য কুন্তল
মুখোপাধ্যায় ।
আর এখনো যে দু’চার
পাতা লিখে যাবার চেষ্টা
করছি, তা হয়তো তোমার মতো
আর ওই কিছু পাঠকের জন্য,
যাঁরা আমার কবিতার এই
‘সহজ ভাষা’ বোঝেন।
২
এবার বাংলাভাষা নিয়ে
আমার বেদনার দু’একটি
কথা বলি। টিভির এক
বেসরকারি চ্যানেলে
একটা জনপ্রিয় অনুষ্ঠান
ছিল ‘দাদাগিরি’। দিনের
পর দিন বাঙালি দর্শকরা
তা দেখেছেন। আমি ভাবতাম
দাদাগিরি মানে তো গায়ের
জোরে কিছু করা, যাকে এক
অর্থে বলা চলে
‘মস্তানি’। তো একটা
অনুষ্ঠানের নাম এরকম
হবে? একটা অনুষ্ঠানের
নাম হবে ‘দিদি নম্বর
ওয়ান’ ? এসব খুব জনপ্রিয়
অনুষ্ঠান। জনপ্রিয়
অনুষ্ঠান বুঝি ততটা
সাংস্কৃতিক না হলেও
চলে। আমার এক বন্ধু বলল
এসব সোপ-অপেরা নিয়ে কথা
না বলাই ভালো।
বাংলা কথার মধ্যে
অনিবার্যভাবে অনেক
ইংরেজি শব্দ চলে আসে।
অনেক ইংরেজি শব্দকে
আমরা বাংলা করেই
নিয়েছি। যেমন মেনু স্টল
কমনসেন্স মর্নিংওয়াক
আপডেট – এসব আমরা মেনেই
নিয়েছি। কিন্তু কথায়
কথায় লাঞ্চ ব্রেকফাস্ট
টাইম সাইড এসব বলার
মধ্যে কোথাও যেন একটা
বাংলাভাষাকে অবহেলা
করার সংকেত থেকে যায়।
গন্তব্যে পৌঁছে গিয়ে
কোনো শিক্ষিত বাঙালি
বাবা মাকে এসএমএস করে
জানাচ্ছেন reached in time বা reached
safely। খুশি হচ্ছেন বাবা
মা। অনেক অভিভাবক এখনো
মনে করেন তার ছেলে
মেয়েরা বাংলা ভালো বলতে
পারে না, এটা বেশ
আনন্দের। আর ইংরেজি
বলতে পারার জন্য তাদের
গর্বের আর সীমা নেই।
‘আমার ছেলে ইংলিশ
মিডিয়ামে পড়ে’-বলার
মধ্যে কী আত্মশ্লাঘা !
আর একটা ব্যক্তিগত
বেদনা ও আনন্দের কথা
বলে শেষ করি।
আমার মেয়ের জন্মদিন বা
আমার বাড়ির বা বন্ধুদের
কারো জন্মদিন পালনের
অনুষ্ঠানে গিয়ে দিনের
পর দিন দেখতাম মোমবাতি
জ্বালিয়ে Happy Birthday to you
পংক্তিটা সুর করে গেয়ে
মোমবাতি ফুঁ দিয়ে
নিভিয়ে দেওয়া হত। এই
লাইনটা কেন গাওয়া হবে
আর জন্মদিনের মঙ্গল
কামনায় কেনই বা বাতি
নেভানো হবে বুঝে উঠতাম
না। সম্প্রতি জন্মদিন
উপলক্ষে একটা গান
লিখলাম। বিধাতা আমার
গলায় ছিটেফোঁটা সুর
দেননি। তো অনেক কষ্ট
করে আমার মেয়েকে বললাম
কথাটা সুরে বেঁধে দিতে।
সুরে বাঁধা হল সেই কথা ।
ভয়ে ভয়ে বাড়ির দুটো
জন্মদিনে গাওয়া হল সেই
গান। মোমবাতি জ্বালা
হল, নেভানো হল না।
জন্মদিনের পায়েস খাওয়া
হল সকলকে। আমাদের ছোট
আনন্দ ছড়িয়ে পড়ল ঘরের
চারদিকে। ভালোবাসা নিও
–
দীপকদা
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১