আচম্বিতে রাজ্যে বড় গোল
বেঁধেছে। ক্ষমতার
খেলায় কে কটা গোল দিতে
পারে সেই কোন্দল থেকেই
দলে দলে গোলেমালে
ভাষাকে ফুটবল ভেবে
বসেছে।সবলের ভাষায়
ভাষার বল এক্কেবারে
ছেৎরে যেতে যেতে ইদানিং
দমবন্ধ অবস্থায়
ইষ্টনাম জপ করতে বাধ্য।
বেচারা ভাষা তো আবার
এখন 'দমবন্ধ হয়ে
যাচ্ছিল ' বলে দলবদল
করতেও পারে না।তার তাই
এখন টিকিট না পেয়ে
রাজনীতি ছেড়ে দেবার
পরিস্থিতি। হ্যাঁ,
রাজনীতি ; এবং ভাষার
রাজনীতি।
রাজনীতি শব্দটা
বাংলাভাষায় যেভাবে
ব্যবহৃত হয় ইংরেজিতে
কিন্তু সেই একই চিহ্নক
হিসাবে কাজ করে না।
ইংরাজির পলিটিক্স আর
বাংলার রাজনীতি এক
ভাবলে গুলিয়ে যাওয়ার
খুব সম্ভাবনা।
সেক্ষেত্রে ইংরাজি
পলিটিক্সের বাংলা
সিগনিফায়ার যদি
লোকনীতি হত তাও কিছুটা
বোঝা যেত। অর্থাৎ
বাংলার পলিটিক্সে এখন
রাজনীতি এসে গেছে বললে
পাগলের প্রলাপ অথবা
অশিক্ষিতের মন্তব্য
বলে উড়িয়ে না দিয়ে আমি
নিজে অন্তত তৃতীয় কোনো
সম্ভাবনার উঁকিঝুঁকি
দেখতে পাই। পলিটিক্স
আসলে ব্যক্তির সঙ্গে
ব্যক্তির এবং ব্যক্তির
সঙ্গে সমাজের
আন্তর্সম্পর্কের
পাটিগণিত।
পার্টিগণিতের থেকে
ব্যাপারটা অনেক বড়। তাই
বাংলার কোনও
কবিতাকারিগর যদি বলে
বসেন যে তিনি রাজনীতি
বোঝেন না তাহলে আমি
বুঝে নিই যে তিনি যত
ভালো কারিগরই হয়ে উঠুন
না কেন, তাঁর এই বোধ
বজায় রেখে কবি হয়ে ওঠা
তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।সে
যাই হোক, এমন
অপ্রাসঙ্গিক কথা দিয়েই
প্রসঙ্গে ঢুকতে চাইছি
কারণ ভাষার সঙ্গে
ক্ষমতার এক সহাবস্থান
আর সহবাসের ফলেই
বিকর্ষণ এখন আমার এই
খোঁজাখুঁজির রাস্তা
তৈরি করতে চলেছে। এই
খোঁজই প্রতিটি মানুষের
নিরন্তর চর্চার বিষয়
হয়ে ওঠাই উচিৎ বলে আমার
দৃঢ় বিশ্বাস।মূলত
মানুষের পলিটিক্স বা
আন্তর্সম্পর্কের
শুরুতেই ভাষা সবচেয়ে বড়
ভূমিকাটি পালন
করে।ভাষা বলতে আমরা
যাকে চিহ্নিত করতে চাই,
সে হল ' means of communication ', অর্থাৎ
মানুষের পারষ্পরিক
আন্তর্সম্পর্কের
ক্ষেত্রে ভাষা একটি
যন্ত্র বা tool হিসাবে
ক্রিয়া করে।আপনি হয়তো
আরও কিছুটা এগিয়ে বলবেন
মানুষ শুধু
নয়,ব্রহ্মাণ্ডের
যেকোনো বিন্দুর সঙ্গে
অপর বিন্দুর যোগাযোগ
সাধনের মাধ্যমটাই
ভাষা। আমিও তেমনটাই মনে
করি।কারণ, আমি যদি বলি
বিন্দুর সঙ্গে বিন্দুর
আন্তঃক্রিয়া গাণিতিক
পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়
তাহলে এটাও বলা উচিৎ যে
সেই গানিতিক পদ্ধতিও
ভাষারই এক প্রকার। ঠিক
যেমন উল্টোক্রমে ভাষা
একধরনের গাণিতিক নিয়ম
ছাড়া অন্য কোনওভাবেই
স্ফীতোদর হয়ে ওঠে না।
অর্থাৎ
ব্রহ্মাণ্ডবিজ্ঞান
ভাষার সন্তান বললে
অত্যুক্তি হয় না। এই
ভাষা অর্থাৎ যাকে
মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার
করে আমরা পারস্পরিক
ভাবের দেওয়ানেওয়া
চালিয়ে যাচ্ছি সেই
ভাষার একেবারে মূলে
রয়েছে আমাদের মায়ের
ভাষা। মায়ের ভাষাকে
রবিঠাকুর তাই মায়ের
দুধের সঙ্গে তুলনা করে
বড় একটা ভুল করেছেন বলে
মনে হয় না। তবে ভাষাকে
কেবল মায়ের দুধ হিসাবে
বললে ছোট একটু
অসম্পূর্ণতা থেকে যায়।
কারণ, মায়ের দুধ হল সেই
খাদ্য যা সর্বপ্রথম
আমাদের পুষ্টিসাধন
করে। ভাষার কাজ
এইটুকুমাত্র নয়। বরং
জন্মমুহূর্ত থেকে ভাষা
আমাদের মনোভূমিকে গড়ে
তোলে। এই যে ভাবনা এ
কেবল আমার
স্বকলমকল্পিত মনে করলে
ভুল করা হবে। তাই এই
ধারণাটার স্বপক্ষে কোন
কোন তাত্ত্বিক কী বলতে
চেয়েছেন তার একটা
হাল্কা ছানবিন করে
নেওয়া ভালো।
আমি বলতে চাইছি যে
ভাষা মানুষকে সৃষ্টি ও
নির্মাণ করে, মানুষ
ভাষাকে সৃষ্টি বা
নির্মাণ করার কাজে
মুখ্যভূমিকা নেয় না এবং
নিতে পারে না। মানুষ
বড়জোর ভাষার কোনও নতুন
প্রকার নির্মাণ করে
অথবা স্বেচ্ছায় বা
পরেচ্ছায় ভাষার একটি
ধরন বা প্রকারকে ধ্বংস
করেই নিজেকে ভাষার
দণ্ডমুণ্ডের কর্তা মনে
করে বসে। পৃথিবীর আলো
দেখার অনেককাল আগে
থেকেই একটি জীবের জন্ম
হয়। সেই নিষিক্ত হওয়ার
তুঙ্গ মুহূর্ত থেকেই
মরপৃথিবীর সঙ্গে তার
দেওয়ানেওয়ার খেলা
শুরু। মনস্তত্ত্ববিদ
কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং - এর
তত্ত্বকে বুঝলে দেখা
যাবে যে ইয়ুং কালেক্টিভ
আনকসশাস বা সামূহিক
নির্জ্ঞানের তত্ত্বে
এই বিষয়টি ইঙ্গিত করতে
চেয়েছেন। কালেক্টিভ
আনকনশাস আসলে ব্যক্তির
মস্তিষ্কে বয়ে আসা সেই
স্রোত যা তাকে জন্মের
স্থান আর সময়ের সঙ্গে
সম্পর্কিত করে। অর্থাৎ
ব্যক্তির মনোরাজ্যে
প্রথম নেমে আসা ভাবের
সংস্থাপনার মুহূর্তেই
পূর্ববাহিত সংস্কৃতির
রূপকে চেনায় সেই ভাষা,
যা তার পূর্বপুরুষের
মুখে মনে ব্যবহৃত হতো
এবং সেই মনকেও বাণী দেয়
ভাষার অনুক্রম। এবারে
আসি সেই পর্বে যে পর্ব
থেকে বিশ্বমানবের ভাষা
ব্যবহারের পদ্ধতিকে
ধরতে চেয়েছেন নোয়াম
চমস্কি। বিশ্বমানবের
মৌলিক একক যে ব্যক্তি
তার মা - ছাড়া অন্য
ব্যক্তিদের সঙ্গে
আন্তঃসম্পর্কের
শুরুয়াৎ কীভাবে ঘটে?
শিশু যখন তিনমাস বয়সে
মোটামুটি পৌঁছায় তখনই
তার শ্রবণশক্তি কাজ
করতে শুরু করে। অর্থাৎ
পৃথিবীর আলো দেখার আগেই
সে মা এবং মায়ের পরিচিত
ব্যক্তিদের ভাষা শুনতে
শুরু করে। তার
মস্তিষ্কের
রেজিস্টারে শব্দগুলো
তখনই সঞ্চিত হয় তবে
মস্তিষ্ক তখন এতটা
পুষ্ট নয় যে সেই শব্দ বা
ধ্বনিগুলোকে বিশেষ
অর্থে ব্যবহার করে
সুসজ্জিত এক একটি
অর্থপূর্ণ শব্দ
উচ্চারণ করবে। এই যে
আমি যেই অর্থপূর্ণ
অমনি আমি বলতে চাইলাম
যে ভাষা আসলে কোনও জাতি
বা বর্গের সর্বজনমান্য
চিহ্নকমালা। এই চিহ্নক
বা সিগনিফায়ার এবং
সিগনিফায়েডের মধ্যে
যোগাযোগটিকে
সার্বজনীন স্বীকৃতি
দেওয়ার ক্ষেত্রেই
ক্ষমতার গুরুত্ব
সবচেয়ে ব্যাপক এবং
স্থূলভাবে লক্ষিত হয়।
এই বিশেষ আলোচনাটুকু
হিটগেনস্টাইন, জাঁক
লাঁকা আর স্যসুরের
চিন্তাক্রম ছেনেছুনে
আমরা পরের দিকে আলোচনা
করে দেখব। এখন সেই
মানুষটির কাছে ফিরে যাই
যে এখনও মায়ের পেটে।
তার বয়স তিনমাস
পেরিয়েছে। সে শুনতে
পাচ্ছে শুধু নয় অতীত
থেকে মায়ের ধারাক্রমে
প্রাপ্ত জ্ঞানের সঙ্গে
সে বাইরে থেকে আসা
শব্দগুলোকে মিলিয়ে
সাজিয়ে জীবনসংগ্রামের
জন্য অস্ত্রসজ্জিত হয়ে
উঠছে। এইভাবে ছয়মাস
কাটে। তারপর একদিন সে
যখন পেট কিংবা
জন্মোদ্বার ভেদ করে
বাইরে বেরোয় তখন তার
ভাষাকে আমরা
সার্বিকভাবে নাম
দিয়েছি কান্না। কিন্তু
যদি একক হিসাবে শুনে
দেখতাম তাহলে হয়তো
বুঝতাম কোনও শিশুই
কাঁদে না। আসলে সে তার
অনুভূতি প্রকাশ করে। সে
শ্বাস নেয়। শ্বাস চাই
বোঝানোর ভাষা শুনে
নিওনেটাল স্পেশালিষ্ট
ডাক্তাররা বুঝে নেন
শিশুটির কতটা অক্সিজেন
প্রয়োজন। এরপর থেকে বেশ
কিছুদিন শিশু তার ভাষা
বলে আর কিছু না কিছু
বোঝাতে চায়। যেহেতু তার
বাবা - মা অথবা
নিকটাত্মীয় তাদের
স্মৃতিতে কতকটা
শিশুটির উচ্চারিত
ধ্বনিরাজিই ধারণ করে
আছেন তাই তাঁরা অনুমানে
অন্যের থেকে আগে শিশুর
চাহিদা বুঝতে পারেন।
অর্থাৎ শিশুর ভাষা তখন
আছে কিন্তু সেই ভাষা
সর্বজনগ্রাহ্য নয়।
কিন্তু এভাবে তো শিশু
জগৎসংসারকে তার
প্রয়োজন বোঝাতে পারছে
না ফলে ভাষার ব্যবহার
শেখা ছাড়া তার আর কিছু
করার নেই।
এখানেই বড় একট প্রশ্ন
মনে আসতে পারে যে, মানুষ
আসলে অন্যের সঙ্গে
যোগাযোগ করতে চায় কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে
হলে রোঁলা বার্ত উদ্ধৃত
করে নিজেকে পণ্ডিত
প্রমাণ করার দরকার হয়
না। নিজেই একটু ভেবে
দেখলে বোঝা যায় যে
চাহিদা বা need থেকেই
আমাদের যাবতীয়
যোগাযোগ। চাহিদা তো
আবার অনেক তাই বিচিত্র
সব শব্দের প্রয়োগ।
এবারে এল শব্দ এবং
শব্দের মাধ্যমে
যোগাযোগ করার
চেষ্টা।কিন্তু কেউ যদি
বোবা হয়? অথবা আরও
সমস্যা বাড়িয়ে শিশুটির
শ্রবণশক্তি যদি না
থাকে? তাহলেই তার ভাষা
অন্যদের থেকে আলাদা
হবে। তাকে এবার অন্যের
সঙ্গে যুক্ত হবার জন্য
'স্পেশাল এডুকেশন ' নিতে
হবে। এই ঘটনাটা একটু
ভালো করে অনুধাবন করতে
পারলেই বোঝা যাবে যে
ভাষা ব্যবহারের
ক্ষেত্রে মানুষের কিছু
সর্বজনগ্রাহ্য চিহ্নক
আছে। এই চিহ্নক বা
সিগনিফায়ারগুলিকে এক
একটি জাতিগোষ্ঠী
মান্যতা দিয়েছে। তাই
একটি ভাষাকাঠামোর
অন্তর্গত ব্যক্তি অপর
কাঠামোয় মানিয়ে নিতে
অসুবিধা বোধ করে। ঠিক
এই বিন্দু থেকেই
ক্ষমতার ভাষা কাজ করতে
শুরু করে। এই ক্ষমতা
অবশ্যই রাজনৈতিক
ক্ষমতা। এই যে রাজনীতির
কথা বললাম সে আবার
একাধারে যেমন পলিটিক্স
অর্থাৎ জননীতি তেমনই সে
রাজনীতি অর্থাৎ রাজা বা
শাসকের নীতি। ভাষা যখনই
গোষ্ঠীর অনুমোদন চাইল
তখনই তার মান্য কাঠামোর
প্রয়োজন এল আর এই
ফাঁকেই প্রশ্ন উঠল যে
গোষ্ঠীর কোন পরিবারের
ব্যবহার্য ভাষাকে সকলে
মান্যতা দেবে। অবশ্যই
এই বিশেষ অধিকার বা
সম্মান পাওয়ার জন্য
পরিবারগুলি রেষারেষি
শুরু করবে, আর সেই
টানাটানির থাকে
কামড়াকামড়ি লেগে যাবে।
তখন এ বলবে আমায় দেক তো ও
বলবে আমায়। এ যাকে বলবে
'মা' ডাকতে ও তাকে মানে
না নিয়ে 'আম্মা' ডাকা
শুরু করে দেবে। এই
ক্ষেত্রে স্বাধিকার
থেকে কাকে বঞ্চিত করে
কাকে নির্বাচিত করা হবে
সেটাই ঠিক করবে
ক্ষমতা।
একটা মানুষ এই
ক্ষমতানির্দিষ্ট
ভাষাকাঠামোর অন্তর্গত
হলে তার দূর
ভবিষ্যৎপ্রজন্মও
জন্মইস্তক সেই সেই
ভাষাকেই মস্তিষ্ক ধারণ
করে। তার যে চিহ্নকগুলো
সে ব্যবহার করে সেগুলো
সবই সে বলতে শেখে
মেধাকে ব্যবহার করে।
শরীর এক্ষেত্রে তার
সাধারণ অবলম্বনমাত্র।
স্বরতন্ত্রের যে
যন্ত্রগুলো তাকে শব্দ
উচ্চারণ করতে সাহায্য
করে সেগুলি
ভাষাব্যবহারের
ক্ষেত্রে অবলম্বন
কিন্তু নির্দেশক হতে
পারে না। কোন শব্দকে
ব্যবহার করলে কোন
জনমান্য ভাব প্রকাশিত
হবে তা বুঝতে পারে
মস্তিষ্ক। সেই
মস্তিষ্ক মায়ের মুখে যে
ভাষা শুনেছে প্রথমে তার
থেকে আর তারপরে
পরিচিতদের ভাষা শুনে
বুঝে নেয়, বিবেচনা করে
যে কোন ভাষায় কীভাবে
কথা বললে সে নিজেকে
মানুষের সঙ্গে সংযুক্ত
করতে পারবে। একসময় মনে
করা হত যে শিশুর
মস্তিষ্ক ফাঁকা
স্লেটের মতো তার সেই
ফাঁকা ট্যাবুলা রাসায়
ভাষা নতুন অ আ ক খ লেখে।
কিন্ত আজ সেই তত্ত্বকে
পেরিয়ে এসে আমরা জেনেছি
কালেকটিভ আনকনশাসের
কথা। অর্থাৎ শিশু তার
গোষ্ঠীর ভাষাকাঠামোর
একটা প্রতিচ্ছবি নিয়েই
জন্মায়। তার মন তৈরি হয়
সেই ভাষাকাঠামোকে ভর
করে। মন ছাড়া মানুষের
অর্থ জড়ের সমতুল্য,
অর্থাৎ মানুষ তার
ভাষাকে তৈরি করার আগেই
প্রকৃতির ভাষা আর
গোষ্ঠীর ঐতিহ্যগত ভাষা
তার মনোভূমি নির্মাণ
করে দেয়। তাহলে সে
ভাষাশিক্ষা করে কেন?
ভাষা যদি তাকে নির্মাণ
করে তবে নতুন করে আর
ভাষাশিক্ষার দরকার কী?
এই প্রশ্ন হে পাঠক
আপনার মনে আসতেই পারে।
সেইজন্যেই সস্যুরের
ভাষাতত্ত্ব থেকে
কয়েকটা কথা একটু সহজ
করে বুঝে নেওয়া ভালো।
আসলে ভাষা সে নতুন করে
সম্পূর্ণ শেখে না। সে
তার শোনা কথা বা জানা
কথাকে ঠিকঠাক করে
ব্যবহার করতে শেখে।
বাস্তবে সে তার শোনা
শব্দগুলিকে
সিনট্যাগম্যাটিক এবং
প্যারাডিগমাটিক
সম্পর্কে প্রয়োগ করে
নিজের প্রয়োজন বা
অনুভূতিকে ব্যবহার
করে। এই যেমন ধরুন সে
বলতে চাইছে যে তার খিদে
পেয়েছে। তখন সে এই
চাহিদাকে অনেকভাবেই
প্রকাশ করতে পারে। যেমন
ধরুন সে বলতে পারে, '
আমার খিদে পেয়েছে ' আবার
এভাবেও বলতে পারে যে, '
আমাকে খেতে দাও '। এই
বাক্যটি গঠন করতে গিয়ে
সে প্রথমে তার
শব্দভাণ্ডার থেকে 'আমার
' বা 'আমাকে ' এই দুই
শব্দের মধ্যে থেকে
যেকোনো একটাকে বেছে
নেবা। এই যে শব্দকে
বেছে নিয়ে প্রয়োগ করা
একেই বলে ভাষার
সিনট্যাগম্যাটিক
সম্পর্ক। এবার ভাবুন,
সে কিন্তু ' 'আমাকে খেতে
দাও ' না বলে ' আমাকে দাও
খেতে ' এইভাবেও বাক্যে
শব্দবিন্যাস করতে
পারে। এই শব্দবিন্যসের
পদ্ধতিকেই
প্যারাডিগম্যাটিক
সম্পর্ক বলে মনে করা
হয়। তাহলে ভাষাশিক্ষার
মূলে রয়েছে কোন শব্দ
কোথায়, কীভাবে প্রয়োগ
করব তা জানা। আর এই
বাক্যব্যবহার বা
প্রকাশের ধরন থেকেই
একটা গোষ্ঠীর
সাংস্কৃতিক চলনের
অভিমুখ নির্দিষ্ট হয়।
এই ব্যাপারটা আমাদের এই
সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ের
সময়ে ভালো করে বুঝে
নেওয়া খুব জরুরি বলেই
মনে হচ্ছে।
বাংলা আর ইংরাজি
ভাষার একটু সাংস্কৃতিক
চলন দেখে নিই আসুন।
আমার বাড়িতে প্রথমবার
যখন আমার জামাইবাবু এল
তখন মা একেবারে জামাই
আদরে আমার ফেব্রিসদাকে
২১ রকমের পদ সাজিয়ে ভাত
খেতে দিল। ফেব্রিসদা
মানে আমার জামাইবাবুর
পুরোনাম ফেব্রিস পিউ।
তার বাবা ফরাসি, মা
ইতালীয় আর সে
ম্যারিকান। অর্থাৎ সে
পরিপূর্ণ পাশ্চাত্য
সংস্কৃতির মানুষ।
খাবারের ঢল এবং সুসজ্জা
দেখে সে আপ্লুত।
কিন্তু অল্প খাওয়ার
পরেই যখন সে হাল ছাড়ল, মা
আরেকটু খাবার জন্য
পীড়াপীড়ি শুরু করে দিল।
এবার ব্যচারি ফ্যাকাসে
মুখে বলে ' I am full'। মা
বুঝতে পারছে না। বলছে
এতে বোকা বনার কী আছে।
তখন মাকে বোঝাতে হল যে, ও
বলছে, ' আমার পেট ভরে
গেছে '। এই যে অনুভূতি
প্রকাশের ভাষার ফারাক
তার দিকে একটু মন দিয়ে
তাকালেই বোঝা যাবে যে,
কীভাবে বাক্যব্যবহার
দেখে সনাক্ত করা যায়
সাংস্কৃতিক অভিমুখ।
'আমার পেট ভরে গেছে' বলতে
বাঙালি বোঝায় যে তার
ক্ষুন্নিবৃত্তি
হয়েছে। এর মানে
একইসঙ্গে এটাও বোঝায় যে
তার সার্বিক দেহমন
তৃপ্ত হয়নি বরং কেবল
পেটের খিদে মরেছে।
অন্যদিকে 'I am full' - এর
গোদাবাংলা করলে দাঁড়ায়
'আমি পরিপূর্ণ'। খেয়ে
সম্পূর্ণ তৃপ্ত হওয়াকে
যে জাতি উদযাপন করে
তারা মুখ্যত ভোগবাদী
সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক।
প্রাচ্যের সংস্কৃতি
ভোগবাদী ছিল না বলেই
ভাষাব্যবহারে সে পেটের
ক্ষুন্নিবৃত্তিতে
সার্বিক সুখ পেত না। এই
একই প্রবণতা ভারতীয়
অন্যন্য ভাষায় লক্ষিত
হবে। এখানেই ভারতবর্ষ
অন্তর্লীন সাংস্কৃতিক
যোগাযোগ প্রত্যক্ষ
করে। বাহ্যিক ভাবনার
ক্ষেত্রে অবশ্য
হিন্দিভাষাসংস্কৃতির
সঙ্গে বাংলাসহ
অন্যান্য ভাষার
পার্থক্য থাকবেই। এই
যেমন ধরুন একটা
অতিপরিচিত হয়ে ওঠা
স্লোগান
কানহাইয়াকুমারের
কণ্ঠে ধ্বনিত হবার পরে
ইদানিং বাংলার
বিপ্লবীরা খুবই
ব্যবহার করছে।
স্লোগানটি হল, ' হাম লড়কে
লেঙ্গে আজাদি '। এই
স্লোগান বাংলার
সংস্কৃতি থেকে বেশ
কিছুটা সরে অবস্থান
করে। কারণ, বাংলার
স্লোগান হল ' লড়াই, লড়াই,
লড়াই চাই / লড়াই করে
বাঁচতে চাই '। একটু
ভাবলেই বোঝা যাবে যে
'লড়কে লেঙ্গে আজাদি'
বললে মনে প্রশ্ন জাগে
যে কার কাছ থেকে আমরা
আজাদি বা স্বাধীনতা লড়ে
ছিনিয়ে নিতে চাইছি?
তাহলে কি স্বাধীনতা
শাসকের হাতে আছে? তাহলে
কি শাসকপক্ষকে
স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত
করে আমরা আমাদেরটুকু
ছিনিয়ে নেব? এর মধ্যে
'ওরা- আমরা'র ব্যবধান
লক্ষ করা অস্বাভাবিক
নয়। কিন্তু বাংলার
লড়াই করে বাঁচতে চাওয়ার
ডাকে সামগ্রিক
শ্রীবৃদ্ধির আবেদন
রয়েছে। ভাষা ব্যবহার
থেকে জেনে নেওয়া যায়
একটি জাতি বা গোষ্ঠীর
সাংস্কৃতিক ধারা। কারণ,
ওই যে বললাম মানুষের
মনোভূমি গঠন করে ভাষা
আর মানুষ তৈরি করে
গোষ্ঠী। তাই গোষ্ঠীর
সংস্কৃতি ভাষার উপরে ভর
করেই নির্মিত হয়। আমি
স্বীকার করলেও এটা
বাস্তব আর জোর করে
অস্বীকার করলেও।
তাহলে এখন প্রশ্ন হল
একটা ভাষা কীভাবে
সর্বজগ্রাহ্য হয়ে ওঠে?
এখানে অবশ্যই ক্ষমতার
ভাষা কথা বলে। এই
ক্ষমতাকে রাজনৈতিক
ক্ষমতা বললে পূড়োটা ঠিক
বলা হবে না। রাজনৈতিক
ক্ষমতার উপর সামাজিক,
অর্থনৈতিক এবং
সর্বোপরি সাংস্কৃতিক
ঐতিহ্যের অনুক্রমও
লক্ষ করতে হবে।
মান্যবাংলা যে
কৃষ্ণনগরের ভাষার
দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হল
তার পিছনে রয়েছে দীর্ঘ
সাংস্কৃতিক ধারাক্রম।
সেখানে নদীয়ার
চৈতন্যদেব বা নদের
চাঁদের ভাষার প্রভাব
স্পষ্ট। গোস্বামীদের
সাংস্কৃতিক রাজা
কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকে
রত্নখচিত করে তোলে আর
বাংলায় ধর্মীয়
সংখ্যাগুরুর ভাষ্য
হিসাবে এই ভাষাকে
মান্যতা দেওয়া হয়।
তাহলে বোঝাই যাচ্ছে
ক্ষমতাকাঠামো ভাষাকে
গড়ে তোলে না, বরং সে আসলে
ভাষাকে
সর্বজনব্যবহার্য করে
তোলে। সুতরাং খিস্তি
দেওয়াকে কেউ বাংলার
ভাষা বলতেই পারে কিন্তু
খিস্তি বা খেউড়ের সঙ্গে
বাংলার সাংস্কৃতিক যোগ
বিচ্ছিন্ন। কারণ এই
খিস্তির ভাষায় যে
ক্রোধের উৎক্রমণ,
পুরুষতান্ত্রিকতা এবং
যৌন উস্কানি আছে তাকে
গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের
ঐতিহ্য অনুমোদন করে না।
কেউ এখন ক্ষমতাপ্রয়োগ
করে এই খেউড়ের
সংস্কৃতিকে
সাবঅল্টার্ন সংস্কৃতি
বলে ভুলভাবে ব্যাখ্যা
করে জোর করে চাপিয়ে
দেওয়ার চেষ্টা করলে
সেটা হিন্দিকে বাংলার
সংস্কৃতির উপর চাপিয়ে
দেওয়ার মতোই ব্যথিত
করবে, কারণ যেকোনো মেনে
নেওয়া বা আপোষ করার
মধ্যেই কিছু মানসিক
কষ্ট থাকবেই। তবে
ভাষাব্যবহারের
ক্ষেত্রে শেষপর্যন্ত
ক্ষমতাই সিদ্ধান্ত
নেয়। সেখানে ইসলামি
সংস্কৃতির ভাষা যেমন
বাংলার উপর একসময়ে চেপে
বসেছিল ঠিক তেমনই এখন '
what the fuck ' কিংবা ' oh shit! ' -
সংস্কৃতি ঢুকে পড়লে
বেদনার্ত হওয়া ছাড়া
বোধহয় আর কোনও উপায়
থাকবে না। কালক্রমে
হয়তো খোলা বাজারের
ধাক্কায় ধনতন্ত্র আর
বামচৈতন্য মিলেমিশে
একাকার হয়ে যাবে আর তা-ই
যদি হয় তবে ধনতান্ত্রিক
সভ্যতারই কৌশলগত জয়
দেখা যাবে। এই
অর্থনৈতিক ক্ষমতার
খেলায় 'জনমদুখিনীর ঘর '
পুড়ে যেতে দেখা ছাড়া
হয়তো আমাদের সেদিন
কিছুই করার থাকবে না।