১
মূলত আমি মৃত । কিন্তু
লাশটাকে কোন পরিণতি
দিতে পারিনি এখনও।
সুতরাং মৃতের উপর ভনভনে
মাছিগুলোর মতো একটার পর
একটা দিন আমার লাশকে
ছুঁয়ে উড়ে যাচ্ছে।
লাশের মুখ থেকে
গ্যাঁজলা হয়ে বেরিয়ে
ঠোঁট চলকে গলা উপচে বুক
অবধি শুকিয়ে
দুর্গন্ধময় দ্বিতীয়
চামড়া হয়ে গেছে- আমার
কথারা। তাই আলাদা করে
কিছু বলার দরকার হয় না।
না বলারও। তবে সুইচ অন
করলে ঘরে কেউ থাকুক বা
না থাকুক, পাখা যেমন
ঘুরতেই থাকে, মূলত মৃত
হওয়ার দরুণ সুখ- দুঃখের
ওপারে চলে যাবার পরেও
আমার চোখে জল আসে। এই
ঘটনাই প্রমাণ করে, আমার
জীবন না থাকুক, বিদ্যুৎ
প্রবাহ আছে।
দোতলা থেকে ঝাঁপ দেবার
ব্যাপারটা আজ দেব কাল
দেব করে দেওয়া হয়ে উঠছে
না। রান্নাঘরের পাঁচটা
ছুরিই ভোঁতা। আজ কিনব
কাল কিনব করে কেনা
হচ্ছে না। তাই শিরাগুলো
ঈগলের নিষ্ঠুর নখের মতো
এখনও বহাল তবিয়তে গেঁড়ে
বসে আছে। কাল রাতে ছাদে
উঠে পাঁচিল থেকে ঝুঁকে
পড়ে দেখলাম,পৃথিবী
কতখানি পাতাল
তমিস্রাময়!! একগ্লাস
জলে ঘুমের ওষুধ গুলে
সত্ত্বায় মিশিয়ে
নেওয়াটাই বেদনাহীন বা
নির্বেদ। কিন্তু,
এক্ষেত্রেও ডোসেজ
সম্পর্কে পর্যাপ্ত
জ্ঞান থাকা চাই। ডোস কম
হয়ে গেলে লাশ হয়তো
সম্পূর্ণ
পরিণতিপ্রাপ্ত হবে না।
আধমরা হয়ে বেঁচে থাকা
যায়। কিন্তু আধালাশ
ব্যাকরণসম্মত নয়। আসলে
কাঙ্খিত পরিণতির দিকে
এগোতে গেলে চাই
অধ্যবসায়,উদ্যম এবং
সাহসিকতা। আসলে মৃত্যু
বা অমোঘযাত্রাও একটা
অ্যামবিশন,কিন্তু আমি
এতটাই মৃত যে সে
সম্পর্কেও বর্তমানে
কোনরকম শক্তিক্ষয় করতে
অপারগ।
আসলে আমার দ্বারা কিছু
হবে না। আমি জীবনে যখন
যা চেয়েছি, তাতেই বাধা
পেয়েছি। আর চাওয়াগুলোর
মধ্যে যে দু একটা
কষ্টেসৃষ্টে কপালে
জুটেছে, পেতে পেতে
সেগুলো চাইবার আকাঙ্খা
আর পাবার মোহ ততদিনে
ফুস। আমি বহুদিন হাসি
না। যেখানে হাসা উচিৎ,
সেখানে দাঁতের পাশে
দাঁতের সুষম বিন্ন্যাস
চোয়াল রেখায়
সম্প্রসারিত করে আমি
হাসি নির্মাণ করি। এই
যে পরিস্থিতির চাপে
হাসি নির্মাণ করি, বা
বিদ্যুৎ প্রবাহের মতো
চোখে জল আসে, এই যে এই
মুহুর্তে মূত্রনালীতে
সুড়সুড়িপূর্ণ
প্লাবনের ইঙ্গিত আসন্ন
প্রস্রাবের বার্তা বহন
করছে, বা সহজ করে বললে,
এই যে আমার মলমূত্র বা
যৌনতার বেগ আসে, এইসব
প্রতীয়মানতায় লাশটার
বিদ্যমানতা প্রমাণিত
হয়, এতে অবোধ আর
নির্বোধদের কাছে
নিজেকে জীবিত বলে
ধাপ্পা দেওয়া যায়। এহেন
সুচারু কসমেটিক
সার্জারির উন্নীত
লাবণ্যে সেট ইন করা
রিগর মর্টিসকে কোনমতে
চাপা দেওয়া চলছে। তাতে
কোন হীনম্মন্যতা নেই
আমার। আলেকজান্ডার
রুডোস্কি’র সিনেমায়
‘এল টোপো’ র যীশু আমারই
মতো মৃত ছিল, গ্যাঁজলা
মুখে মাছি ভনভন করছিল
তাঁর; অতঃপর এক মুতে তার
জাগরণ সুচিত হল। আমিও
যখন নির্দিষ্ট সময়
অন্তর মুতে থাকি,তখন
একথা স্পষ্ট, আমার
মধ্যে জীবন না থাক;
বিদ্যুৎ প্রবাহ আছে।
২
সেজ মানে আমার সেজজেঠু
জন্মেছিলেন পঁচিশে
ডিসেম্বর। বড়দিনে
জন্মানো বড় পাগল।
চেহারাও মানানসই ছ’ফুট,
দোহারা। শ্রী সম্পর্কে
বিশেষ কিছু বলার নেই।
কষ্টিপাথরে গড়া
বিবেকানন্দ। আর কোন
বিশেষত্ব নেই। অভাবী
সংসারে নিজের চেষ্টায়
পড়াশোনা করেছিলেন।
ব্যাংকে চাকরি
জুটিয়েছিলেন।
আলমারিতে নব্বই শতাংশ
দুষ্প্রাপ্য বইয়ের
সংগ্রহ তাঁর। তারপর
রেডিও পিকিং এ একদিন
শোনা গেল বসন্তের
বজ্রনির্ঘোষ। শুনেছি
নিজের হাতে বোমা বানাতে
জানতেন। রেডবুক গীতার
মতো পাঠ করতেন। তারপর
একদিন আমলকী বনে শোনা
গেল, বসন্ত চলে গেছে।
বন্ধুরা সবাই যে যার
মতো মানিয়ে গুছিয়ে নিল।
একমাত্র তিনিই নির্ঘোষ
দ্বারা বজ্রাহত তালগাছ
হয়ে গেলেন। তাঁর মাথার
ভেতরে কারা যেন সব
চুপিচুপি কথা বলাবলি
করতে লাগল। কাদের ঘাস
মাড়ানো খসখস, ছায়া
মাড়ানো তিরতির, হঠাৎ
হঠাৎ চমকে উঠতেন। তার
আফ্রিকার মতো দরাজ বুকে
অজানা প্রাণীকুলের
নিঃশঙ্ক গমনাগমন- রাতে
ঘুমোতেন না। বাড়ির ছাদ
থেকে পাঁচিল টপকে
লাফিয়ে যেতেন আরেক
বাড়ির ছাদে। চেঁচিয়ে
চেঁচিয়ে বলতেন অসংলগ্ন
কথা। শেষপর্যন্ত পাড়া
প্রতিবেশিদেরও এক এক
রাতে ঘুম ভাঙ্গতে শুরু
করল । বিরক্তি, ক্ষোভ,
উন্মাদনা চরমে উঠতেই
উদ্দাম বন্য ঘোড়াকে
লাগাম পরানোর ব্যবস্থা
হল। তিনি ঘুরে এলেন
পুনর্বাসন কেন্দ্র
থেকে। শান্ত সমাহিত
মননশীল পাগল। পুতান
জেঠু ছিলেন অফিসের
বন্ধু। মাঝে মাঝে দেখতে
আসতেন।
প্রতিমাসে
সাইকিয়াট্রিস্ট ডক্টর
মজুমদারের কাছে যেতে
হোত আর প্রতিবার ডক্টর
প্রেস্ক্রিপশনে লিখে
দিতেন ‘রিপিট অল’ ।
এভাবেই মাস ফুরোল, বছর …
রিপিটল বাবুর চুলে পাক
ধরল। অফিসের জুনিয়রদের
টিটকিরি আর
হাসিঠাট্টার ফাঁকেই
তিনি ভলান্টারি
রিটায়ারমেন্ট নিলেন।
মেজ মানে মেজজেঠু একই
জমিতে তাঁর আর সেজ’র
বাড়ি খাড়া করলেন।
রিটায়ারমেন্টের পর সেজ
উঠে গেলেন সেখানে।
একদিন মেজ ভোরবেলা উঠে
কাশলেন না। তাঁর
হাপানির গরগর শোনা গেল
না। সূয্যিঠাকুর যখন
মাথার উপর উঠল, তখন তার
ঠান্ডা বুকে
স্টেথোস্কোপ বসিয়ে
ডাক্তার ডেথ
সার্টিফিকেট লিখে
দিলেন।
তারপরও অনেকবছর ছিলেন
সেজ। একটা দীর্ঘায়িত
খড়ের কাঠামো হয়ে।
খাবারের ঘন্টা পড়লে
খেতে আসতেন। শেষকালে
নিজের ঘরেই খাবার
খেতেন। যতই দুর্বল হোক,
গোগ্রাসে গেলার
অভ্যেসটা ছাড়তে
পারেননি। ঝলসানো রুটিও
বিপ্লব জানে। সে খোচর
মৃত্যুকে একহাত নেওয়ার
জন্য খাদ্যনালীর বদলে
শ্বাসনালীতে ঢুকে পড়ল।
হাপরের মতো নিঃশাসে
ছিটকে এল রুটি আর শেলের
টুকরো। ফুসফুস কখন
এনকাউন্টারকালীন নিথর
দৃঢ়তায় দুহাত মাথার উপর
তুলে দিয়েছে, রুটি জানে
না। মধ্যরাতে আবার তার
চাঁদ হওয়ার শখ হল। সে
আকাশ থেকে দেখল একটা
হিমেল গাড়ি চলেছে
হাসপাতালের দিকে। হাত
পা এখনও গরম আছে। মুর্গ
মসল্লম পনেরো
সেকেন্ডের জন্য
মাইক্রোওয়েভে দিলে
যেমন হয়। সার্টিফিকেট
পাবার পর সারারাত তিনি
মশারির ভেতর একলা শুয়ে
ছিলেন, যেমন থাকতেন।
একলা পুড়ে গেলেন, যেমন
পোড়ার কথা ছিল। শেষবার
যখন দেখা হয়েছিল, তাঁর
বইয়ের তাকে অরবিন্দের
‘সাবিত্রী’,
মানবেন্দ্রনাথ রায়ের
র্যডিকাল
হিউম্যানিস্টঃ
সিলেক্টেড রাইটিং’, আরও
কী কী সব বই ছিল, নাম মনে
পড়ছেনা- তিনি চলে যাবার
পর তাঁর বইয়ের তাকে
চোখে পড়েছিল
মাধ্যমিকের ইতিহাস,
ভূগোল, গণিতের রূপরেখা।
একটা ছোট্ট খাতায় তিনি
‘সুররঞ্জনী’ বলে একটি
নতুন রাগের রূপরেখা
লেখবার চেষ্টা
করছিলেন।
শ্রাদ্ধবাসরে তাঁর ঘরে
গিয়ে অনেকবার খুঁজে
ছিলাম খাতাটা, পাইনি।
হয়তো সুররঞ্জনী রাগটা
ওই ঘরের মধ্যেই এখনও
আটকে আছে।
৩
মূলত আমি এবং সেজ মৃত।
তাই বার্গম্যানের
ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ’
এর কাঁটাহীন ঘড়ির দিকে
একবার তাকিয়ে সেজকে
নিয়ে উঠে পড়লাম
পয়তাল্লিশ হাজার বছর
আগের এক নৌকোয়।
সেইসময়েই এশিয়া থেকে
বিচ্ছিন্ন এক ঝাঁক
দ্বীপপুঞ্জ, যারা
নিজেরাও ছোট ছোট
প্রণালীর শিরা দ্বারা
পরস্পর থেকে আলাদা- সেই
ইন্দোনেশিয়ান
আরকিপেলেগো’র
মৎস্যজীবী অধিবাসীরা
সমুদ্রে পাড়ি দেওয়ার
উপযুক্ত জলযান তৈরি করে
ফেলল। হোমো
স্যাপিয়েন্সদের আর পায়
কে? তারা অমনি
আফ্রো-এশিয়ান এলাকা
থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে
পড়ল রহস্যেমোড়া
সুদূরকে খুঁড়তে।
মহাকালের এমনিওটিক
ফ্লুইডে ভাসতে ভাসতেই
তারা শিখে ফেলল ধর্ষণের
প্রক্রিয়া। জাহাজী
ব্লেড দিয়ে চিরে চিরে
ক্রমাগত নিজের
অনুপ্রবেশের পথটাকে
আবিষ্কার ও দীর্ঘায়িত
করতে করতে একদিন তারা
অনাঘ্রাত
অস্ট্রেলিয়ার নথ
ভাঙ্গল।
হোমো সেপিয়েন্সেদের
অস্টেলিয়ার বেলাভূমির
নুনমিশেলে পা রাখার ঠিক
আগের দিনই আমি আর সেজ
পৌঁছে গেলাম সেখানে-
সেই জেলেদের একটা নৌকো
চুরি করে…
সেজকে নামিয়ে দিয়ে
বললাম, ‘টাটা’…
সেজ তাঁর দীর্ঘ
তালপাতার মতো হাত নেড়ে
বাতাস পাঠালেন। সে
বাতাস মুখে মেখে আমি
নৌকোর অভিমুখ ঘুরিয়ে
দিলাম। যেহেতু আমি মৃত,
তাই আমার থাকা বা না
থাকা গীতার নিষ্কাম
কর্মের মতো- ফলতঃ
শূন্য। তাছাড়া গল্পটা
আমার নয় সেজ এবং মৃণাল
সেনের…
সেজ’র দীর্ঘ পায়ের ছাপ
শুষে নিল সমুদ্রের ঢেউ
। নীলাভ ভাঙতে ভাঙতে
সভ্যতার হলুদ
প্যাপিরাস কুড়োতে
কুড়োতে তিনি পৌঁছে
গেলেন সবুজ গভীরে। ঘন
গাছেরা যেন সেজ’রও সেজ
জ্যাঠামশায়, কী তাদের
মহামহিম কোল, সেজ
জোনাকপোকার মতো সেই
অন্ধকার অথচ আপন সবুজে
ঝিঁ ঝিঁ রহস্যে ঘুরতে
লাগলেন এবং প্রতি
মুহুর্তে নিজেকে পুরো
ফ্রেমটায় মিশিয়ে এবং
পুরো ফ্রেমটা থেকে পৃথক
করে আবিষ্কার করতে করতে
আলোয় আলো হতে
লাগলেন…তার পায়ের
আওয়াজে সরসর করে ঝোপঝাড়
নড়ে উঠল। ড্রাগনপ্রায়
টিকটিকি আর অতিকায়
সাপেরা কিলবিল করতে
করতে বুঝল, সেজ মূলত মৃত
ও শীতল রক্তের… তাই
তাদের আত্মপরিজন…
ঘুরতে ঘুরতে একটা গাছ ,
যার মাথা আকাশে গিয়ে
ঠেকেছে আর আকাশ ঢেকেছে,
তার তলায় এক বিরাট বড়
ছায়াশিবির তৈরি হয়েছে।
সেজ দেখলেন, সেই
ছায়াশিবির থেকে ধীর
পায়ে পায়ে রোদমধুরে
বেরিয়ে এল এক ক্লান্ত
স্ত্রী মার্সুপিয়াল
লায়ন , আধুনিক বাঘের মতো
তার আকার অনেকটা।
ক্যাঙ্গারুর মতো তার
পাউচ-গর্ভ থেকে উঁকি
দিচ্ছে সদ্যজাত ভীত
সন্ত্রস্ত তুলো তুলো
সন্তান। সেজ
বিবেকানন্দীয়
দৃষ্টিতে যত্ন করে মুড়ে
দিলেন তাদের, মুড়ে
রইলেন। বিভোর হয়ে কখন
যে বসে পড়েছেন, সে খেয়াল
নেই। চোখে জল এসে
যাচ্ছে তাঁর। আর মাত্র
একদিন । আগামী ভোর বা
সন্ধ্যেবেলাতেই হোমো
সেপিয়েন্সরা পা রাখবে
এই বিজন দেশে। তাদের
পেটে রাশি রাশি খিদে।
আর অস্টেলিয়ায় রাশি
রাশি মাংস … দুশো
কিলোগ্রামের ক্যাঙারু,
দৈত্যাকৃতি
ডিপ্রোডোটন, মাংসে মোড়া
ভার -ভর্তি কোয়ালা, রাশি
রাশি মাংস… যারা লক্ষ
লক্ষ বছর ধরে প্রকৃতির
যাবতীয় খেয়ালকে
অগ্রাহ্য করে টিকে ছিল,
তারা আগামী ভোর বা
সন্ধ্যের পর থেকে কয়েক
হাজার বছরের মধ্যেই
মানুষের পেটে বিলুপ্ত
হয়ে যাবে। ঐ যে মায়ের
পেটপকেটে নিশ্চিন্তে
ঝিমোন তুলো তুলো
মার্সুপিয়াল শিশু …
তুলোট হয়ে যাবে কিছুকাল
পরেই। সেজ’র চোখে জল।
পেটে খিদে। খুব। খু- উ-ব
খিদে… খিদে বড় বালাই।
ঠাকুমার হাতের আলুর
খোসা ভাজা, পটল খোসা
ভাজা, পোস্ত গুঁড়ো
ছড়িয়ে লাউয়ের খোসা
ভাজা…
এইসমস্ত গন্ধ কোথা থেকে
ভেসে আসছে
অস্ট্রেলিয়ার বাতাসে?
গন্ধের উৎস খুঁজতে উঠে
দাঁড়াবেন কিনা
ভাবছিলেন, এমন সময়ে এক
বিরাট বড় কাঁসার থালা
নিয়ে ছায়াশিবির থেকে
বের হয়ে এল এই এতখানি
পেট উঁচু করা অহল্যা।
গর্ভবতী অহল্যা, পরনে
তার লাল পেড়ে সাদা
সুতির শাড়ি।
শ্যামাঙ্গী রুক্ষ
অহল্যা একথালা ভাত নিয়ে
একমুখ হাসি নিয়ে
দাঁড়িয়ে আছে। পেটের
গর্তটা রক্তমাখা
ন্যাতাক্যাঁথা দিয়ে
বোজানো। কাকদ্বীপের
কৃষক রমণী অহল্যা খুন
হয়েছিল। সেই সঙ্গে তার
পেটের বাচ্চাটাও। কারণ,
তারা তাদের বারো হাজার
বছর ধরে চষা জমির ফসলের
দুই তৃতীয়াংশ দাবী
করেছিল। অভাগারা
তেভাগা করে বিলুপ্ত হয়ে
গেছিল কালের গর্ভে...
সেজ’র চোখের জল এবার
গাল গড়িয়ে নেমে গেল...
যেভাবে মানুষ নেমে যায়।
অহল্যা এসে দাঁড়াল
মার্সুপিয়াল সিংহীর
পাশে। চোখের সামনে এত
ভাত অথচ সেজ’র খিদে উবে
গেল।
একবার মার্সুপিয়াল
সিংহী - ফুল শট
একবার অহল্যা - ফুল শট
অনলি জাম্পকাট
নো ট্রান্সিশন।
এবার সিংহী এক্সট্রিম
ক্লোজ আপ – দুই গভীর
বাতায়নের মতো চোখ
অহল্যা এক্সট্রিম
ক্লোজ আপ- দুধেল ভাতের
মতো চোখ।
ক্যামেরা পেছোচ্ছে ...
এক্সট্রিম লং শট
ক্যামেরা পেছোচ্ছে...
সিংহী, অহল্যা আর সেজকে
নিয়ে একটা ত্রিভুজ তৈরি
হল।
‘কাট’।
সেজ পিছন ফিরে তাকালেন।
মৃণাল সেন পাইপ ধরালেন।
সাদা পাজামা সাদা
পাঞ্জাবী, চোখে কালো
ফ্রেমের চশমায় ধোঁয়া
তখন ঘামের ঘন দানা।
এতদিন এই শটটার জন্যই
বসেছিলেন যেন।
যাক, কাজটা পার্ফেক্টলি
উৎরে গেছে। অবশ্য
‘পারফেকশন’ শব্দটাই
আপেক্ষিক। পারফেকশন
বলে হয়কি কিছু? এই যে
‘ভুবন সোম’ , যা তাঁকে
আন্তর্জাতিক খ্যাতি
দিয়েছিল, সিনেমার
ইতিহাসে চিরকালের জন্য
তাঁর নামটা শ্বাশ্বত
হয়ে গিয়েছিল, সেটাও কি
পার্ফেক্ট ছিল? পরে কি
মনে হয়নি এতটা পাগলামি
না করলেও চলতো? আরেকটু
পরিমিতি, আরেকটু
সূক্ষ্মতা? আসলে মাথাটা
তখন নবতরঙ্গায়িত ছিল,
জটায় এত গঙ্গাভার
সামলাতে পারেননি, বইয়ে
দিয়েছেন ‘ভুবন সোম’এ।
যেমন এই মুহুর্তে দু
চোখের জটাভার সামলাতে
পারছেন না সেজ। মৃনাল
সেন নিজের ভাবনা থেকে
রিভার্স শট নিয়ে এগিয়ে
চললেন সেজ’র কাছে।
ধোঁয়াগন্ধী হাত আলতো
করে সেজ’র কাঁধে রেখে
বললেন, ‘আপনি মিথ্যেই
কষ্ট পাচ্ছেন,
মিহিরবাবু। ইতিহাস বা
প্রাগৈতিহাসিক জীবন -
ধারা কিন্তু মূলত:
সবলের হাতিয়ারে
দুর্বলের রক্তধারা। এই
তো দেখুন না, আমাদের
একটা মিসকনসেপশন আছে,
প্রাক ঐতিহাসিক
পর্যায়ে পৃথিবীতে একই
সময়ে কেবল একটিমাত্র
মানব প্রজাতিই বাস করত।
কালক্রমে তারা বিলুপ্ত
হয়ে গেছে উন্নততর
বংশধারার বীজ বপন করে ।
তারপর সেই উন্নততর
প্রজাতি আবার সভ্যতা বা
অসভ্যতার মশাল নিয়ে
এগিয়ে চলেছে। একদম
বোগাস ধারনা এটা। আজকের
যুগে যেমন ইংরেজ, ফরাসী,
তুর্কী , ভারতীয় একই
সময়ে একই পৃথিবীতে
বসবাস করছে
বিভিন্নপ্রান্তে
ছড়িয়ে ছিটিয়ে, ঠিক
তেমনই অনেকগুলো মানব
প্রজাতি একই সময়ে বাস
করত একই পৃথিবীতে।
ইয়োরোপ ও পশ্চিম
এশিয়ায় থাকত
নিয়ান্ডারথালরা।
ইন্দোনেশিয়ার ফ্লোরেস
নামক একটি দ্বীপে বসবাস
করত বামন মানুষ ‘হোমো
ফ্লোরেসিয়েনসিস’।
আবার ইন্দোনেশিয়ার
জাভায় বাস করত ‘হোমো
সলোয়েনসিস’। পূর্ব
এশিয়ায় ছিল ‘হোমো
ইরেক্টাস’।
সাইবেরিয়ার ডেনিসোভায়
ছিল ‘হোমো ডেনিসোভা’।
শুধু পূর্ব আফ্রিকার
কথাই যদি ধরেন -সেখানে
শুধু আমরা অর্থাৎ ‘হোমো
সেপিয়েন্স’রাই ছিলাম
না; ‘হোমো রুডলফেনসিস’,
‘হোমো ইরেগেস্টার’
এরাও ছিল। কিন্তু
‘আমরা’, আস্তে আস্তে
অন্যান্য কমজোরি
মানব-জাতিগুলোকে
পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত
করে দিলাম। আজ থেকে
তিরিশ হাজার বছর আগে
শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিল
নিয়ান্ডারথাল।
সেপিয়েন্সদের
কমিউনিকেশন স্কিলের
ধারেকাছে তারা ভীড়তে
পারল না। শেষমেষ
সেপিয়েন্সরাই জয় করল
বিশ্ব। এবার ইতিহাসে পা
রাখুন- গ্রীক, রোমান,
ব্রিটিশ, এখন আমেরিকা
–সমস্ত ক্ষমতাধররা
তাদের কমজোরি
কাউন্টারপার্টদের দাস
করে ফেলল । পৃথিবীটা
এরকমই।
-আপনি একথা বলছেন? আপনার
সিনেমায় আমরা শুনেছি
মাথার উপরে দৈত্যাকৃতি
মাছির মতো
যুদ্ধবিমানের ভনভন।
মিছিল। চেয়ার ভাঙ্গা,
উদ্ধত মাইক, ইনকিলাব
জিন্দাবাদ, চলছে চলবে।
গুলি খেয়ে মাটিতে
লুটিয়ে পড়া যুবকও আপনার
শেষ সিনে উঠে দাঁড়ায়।
সেই আপনার মুখ থেকে
ক্ষমতার ইতিহাস -
বন্দনা ... বড় বেশি অসংগত
ঠেকছে।
- এইটাই তো সমস্যা
মিহিরবাবু, আমরা সবাই
সবাইকে লেবেল করতে বা
টাইপকাস্ট করতে
ভালোবাসি। কারণ আমাদের
মস্তিষ্কের সীমিত ধারণ
ক্ষমতায় নির্দিষ্ট
কতগুলো প্যারামিটারে
একজন মানুষকে বিচার করে
তার সম্বন্ধে একটা
বিধান দিয়ে দেওয়ায় খুব
সুবিধা। কিন্তু এই
স্বভাবটা কিরকম জানেন,
একটা গ্লোব বা এটলাস
কিনে গোটা পৃথিবীটা
আমার হাতের মুঠোয় বলে
আহ্লাদিত হওয়া। দয়া করে
আমাকে টাইপকাস্ট করবেন
না। আমি কিন্তু কোন
পার্টির কার্ড হোল্ডার
ছিলাম না। আমি নিরন্তর
আত্মসমীক্ষা চালিয়ে
গেছি আমার কাজের মধ্যে
দিয়ে। একটা সিনেমায়
দেখিয়েছিলাম, একটি
বিশেষ মতাদর্শ ও
রাজনৈতিক দলে বিশ্বাসী
যুবক শেষকালে নিজের
পার্টিরই হিটলিস্টে
উঠে গেছে। একদিকে পুলিশ
, অন্যদিকে নিজের দলের
লোকেরা তাকে হন্যে হয়ে
খুঁজছে। এই যে পার্টির
অন্তর্ঘাত, পারস্পরিক
অবিশ্বাস, হাইকমান্ডের
একনায়কোচিত নির্দেশের
ঔদ্ধত্য- এগুলো যখন
সিনেমায় দেখাতে শুরু
করলাম, লোকে আমার উপর
ক্ষেপে গেল, আপনারই মতো
অসঙ্গত বলে মাথা
নেড়েছিল। অথচ নতুন কিছু
কি এমন দেখিয়েছিলাম
আমি? রবীন্দ্রনাথ চার
অধ্যায়ে দেখাননি, যে
দলের জন্য এলা অতীন
নিজেদের সর্বস্ব উজাড়
করে দিল, সেই দলের
আদেশেই অতীনকে এলার
কাছে আসতে হল বিষের
পাত্র নিয়ে।
- তা ঠিক। তবু আমার কেবল
সেই শিকাগো বা
মিনেসোটার বাছুরের চোখ
দুটির কথা মনে পড়ে।
বাছুরগুলো একটু বড় হতে
না হতেই তাদের মায়ের
থেকে আলাদা করা হয়, যাতে
তার মায়ের দুধের
ভান্ডার আমাদের ভোগে
লাগে। সেই বাছুরটাকে
এক্কেবারে নিজের মাপের
একটা আঁটোসাঁটো খোপে
বন্দী করে রাখা হয়, মাঠে
চড়তে দেওয়া হয় না যাতে
তারা বেশি চলাফেরা
নড়াচড়া করতে না পারে,
তাদের পেশীগুলো নরম
থাকে, মাংস নরম আর
সুস্বাদু হয়। তারপর যখন
তারা ওরই মধ্যে একটু
শাসালো আর পেশীবহুল হয়,
তখন ওদের ছেড়ে দেওয়া হয়
উন্মুক্ত মাঠে; দুচারটে
ঘাস আর মল্লিকার মাংস
খেতে দেওয়া হয়, তার দু
চারদিন বাদেই তারা
কসাইখানায় মাংস হয়ে
যায়। কোন একটা বইয়ে এই
খোপে বন্দী থাকা সারি
সারি বাছুরদের
দেখেছিলাম। তার মধ্যে
একজন তাকিয়েছিল আমার
দিকে , আপনার দিকে, তার
অনাগত ভবিষ্যতের দিকে।
কি জানি, ওই কাজলদীঘি
চোখ আজও কেন ভুলতে
পারিনা। যেমন ভুলতে
পারিনা ‘কলকাতা
একাত্তর’ এ মহানগরের
ফুটপাতে এক সদ্যজাত
শিশুর কান্না।
- আবারও ভুল করছেন।
সবকিছুকে সংখ্যা সন
তারিখ দিয়ে ভাববেন না।
ভাবতে হলে তাকে
যথাসম্ভব আবহমানতার
নিরিখে মাপুন। আজ থেকে
বারো হাজার বছর আগে
মানুষ শিকারী
সংগ্রাহকের জীবন ছেড়ে
কৃষক জীবন বেছে নিল কেন?
অতিরিক্ত খাদ্য হাতের
মুঠোয় পাবার আশায়, যাতে
আগামী দিনের জন্য
খাবারের আশঙ্কা না
থাকে। কিন্তু সেই
নিশ্চয়তা কতখানি বাড়ল?
কিছুমাত্র না। বরং
খাদ্যের সরবরাহ বাড়ায়
মেয়েরা দ্রুত
প্রাপ্তবয়স্কা হল ও
সন্তানবতী হওয়ার
ক্ষমতালাভ করল। শিশুর
জন্মহার দ্রুতহারে
বাড়তে লাগল। কিন্তু
আগেকার মতো পুষ্টিকর
বৈচিত্র্যপূর্ণ
ডায়েটের বদলে গম,জাউ
ইত্যাদি শস্য দিয়ে
তাদের পেট ভরবার ফলে
তাদের রোগ প্রতিরোধ
ক্ষমতা কমে গেল।
শিশুমৃত্যুর হার
ভয়ংকরভাবে বেড়ে গেল।
আপনারা কলকাতা
একাত্তরের ফুটপাতে যে
শিশুটিকে কাঁদতে
দেখেছেন, সেই শিশু
উণসত্তর, সত্তর সালের
বা একাত্তরের নয়, সে
বারো হাজার বছর আগেকার
মুমুর্ষু শিশু যার
কৃষকপিতার উদ্বৃত্ত
ফসল কোন ক্ষমতাবানের
দ্বারা আত্মসাৎ
হয়েছিল।
- তাহলে আপনি বলছেন,
মানুষের শিকারি জীবনই
ভাল ছিল।
-আমি কিছুই বলি না। আমি
দেখি আর
ইন্ট্রোস্পেক্ট করি।
তাছাড়া ভাল হোক , মন্দ
হোক, তাদের শিকারী
জীবনে ফেরা আর সম্ভব
ছিল না। কারণ শিশু
মৃত্যুর হার লক্ষ্যণীয়
ভাবে বেড়ে গেলেও
জন্মহার তুলনায় বেশিই
ছিল। অত বেশিসংখ্যক
মানুষের মুখে খাবার
তুলে দেওয়ার জন্য
শুধুমাত্র শিকারের
মাংস আর সংগৃহীত
লতাপাতা ফলমূল শেকড়
বাকড় যথেষ্ট ছিল না।
ছমছম শব্দে ঘাসের মন
নড়ে উঠল। তাদের
কথোপকথনের ফাঁকে
অহল্যা একটা থালায়
দুকাপ চা আর এক কাঁসি
মুড়ি কাঁচালঙ্কা নিয়ে
হাজির। তার কপালে ভাত
ফোটানো গন্ধের ঘাম।
সোঁদা মাটির গন্ধ। তার
কনুইয়ে লেগে থাকা পোস্ত
গুঁড়ো বলে দিচ্ছে, আজ
তাদের ভাত না খাইয়ে
ছাড়বেই না সে। অহল্যা,
অর্থাৎ যার মধ্যে কোন
‘হল’ বা মালিন্য নেই,
সেই আদি প্রকৃত মানবী
তাদের খাবার দিয়ে ছমছম
করে মিলিয়ে গেল সেই
ছায়াশিবিরের অন্ধতায়।
মার্সুপিয়াল সিংহীর
বুক থেকে তখন দুধ শুষে
নিচ্ছে সদ্যজাত
টলটলেটা…
মৃণালবাবুর সঙ্গে
কথাবার্তায় সেজ’র
বেদনার্ত মনটা আগের
থেকে অনেকটা শান্ত।
তিনি চায়ের কাপটা তুলে
নিলেন।
মৃণাল ততক্ষণে দু ঢোকে
গলা ভিজিয়ে ফেলেছেন।
তাঁর সেই চা এবং দরদ
ভেজা বজ্রময় অথচ করুণ
গলা কানে এল সেজ’র
-আপনি বলছিলেন না
বাছুরের চোখের কথা?
বাছুর তো তবু বাছুর।
কিন্তু নারী তো মানুষ ।
তাকে কিভাবে ট্রিট
করেছে সভ্যতা? জীবন
সঙ্গিনীকে
শয্যাসঙ্গিনীতে
রুপান্তরিত করে ফেলার
কাঁচা কাজটাকে আপনি কি
বলবেন? আগে তো বিবাহ ছিল
না, নারী তার সন্তানের
সংখ্যার অনুপাতে
গোষ্ঠী থেকে খাবার পেত।
তারা সন্তানের লালন
করত, শিকার যে করত না , তা
নয়, কিন্তু বসতির
চারপাশ থেকে লতাপাতা
ফলমূল সংগ্রহ করত মূলত
তারাই। এভাবেই
লতাপাতার উদ্ভিদের মন
বুঝে ফেলল তারা,কয়েকটা
বীজ কুড়িয়ে এনে মাটিতে
রোপন করল। এভাবে
মেয়েরাই ঘর হতে দুই পা
ফেলিয়া কৃষির প্রচলন
করেছিল। কিন্তু এর সুফল
যখন সকলের চোখে পড়ল, তখন
তা আর কিচেন গার্ডেনিং
রইল না, রীতিমতো বড়
আকারে কৃষিকাজের
প্রচলন শুরু হল এবং তখন
তা পুরুষের এক্তিয়ারে
চলে এল। গোষ্ঠীপতি তখন
কৃষিজমিগুলো পুরুষদের
মধ্যে বন্টন করে দিলেন।
এদিকে মেয়েদের উপর
সন্তানের
রক্ষণাবেক্ষণের ভার।
অতএব তাদের পুরুষদের
দ্বারস্থ হতেই হল।
পিতৃতান্ত্রিক
পুরুষরা তাদের ‘বিশেষ
ভাবে বহন’ করতে রাজি
হল।সৃষ্টি হল
বিবাহপ্রথা। কিন্তু
বিশেষভাবে বহন করার
ক্ষেত্রে তারা শর্ত
রেখে দিল যে, যে নারীকে
সে বহন করছে, সেই নারীর
গর্ভে যেন তারই সন্তান
জন্ম নেয়- যাকে সে তার
ব্যক্তিগত সম্পত্তি
দিয়ে যেতে পারবে।
এইভাবে মেয়েরা
সেপিয়েন্স থেকে বংশধর
উৎপাদক ‘সতী’ হয়ে গেল।
পুরুষেরা বহুপত্নীক
হয়ে উঠেছে আবার আমবাগান
, রামবাগানে ঢুঁ মারার
দরজাও খোলা রেখেছে। অথচ
মেয়েদের মাতাল পঙ্গু
স্বামীকে বেশ্যাগৃহের
দ্বারে পৌঁছে দিয়ে তবে
নিজেকে ‘মহীয়সী’
প্রমাণ করতে হয়েছে।
তাদের কামনার
বহুমাত্রিকতাকে
স্বামীর পাদোদকের সাথে
মিশিয়ে তাদের গিলিয়ে
দেওয়া হয়েছে। বুঝলেন
মিহিরবাবু?’
- একমাত্র ব্যাসদেবকেই
দেখি, দ্রৌপদীর মধ্য
দিয়ে নারীর কামনার
বহুমাত্রিকতাকে
ছোঁয়ার চেষ্টা করেছেন।
- তা করেছেন। কিন্তু তার
মধ্যে দ্রৌপদীর
স্বেচ্ছাবিহারের কথা
নেই। বাধ্যবাধকতার
বেড়াজাল আছে। মায়ের
আদেশ, দৈব প্ররোচনা
কতরকম কস্মেটিক
সার্জারিতে অর্জুনকে
একলা না পাওয়ার ক্ষতটা
লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা
করা হয়েছে। হ্যাঁ, এটা
হয়তো ঠিক, রূপসী
শিক্ষিতা প্রবল
ব্যক্তিত্বসম্পন্না
নারীকে এক পুরুষের
পক্ষে সন্তুষ্ট করা
সম্ভব নয়, তা তিনি যত বড়
অর্জুনই হোন না কেন।
তবু, এই যে একেকজনের
সঙ্গে ঘড়ির কাঁটা
মিলিয়ে একবছর সহবাসে
বাধ্য করা। এ যে নারীর
পক্ষে কত বড় অমর্যাদা!
- আপনার ‘জেনেসিস’
দেখেছিলাম, মৃণালবাবু।
মুগ্ধ হয়েছিলাম।
কীভাবে এক সম্পূর্ণ
নারীকে আপনি তুলে
ধরেছিলেন! নারী দুজন
নিরাশ্রয়, নিষ্ঠুর
পুরুষকে দিল বটের ছায়া,
রাতের ওম, সংসারের
স্থিতি। আর তার বদলে
সেই নারী পেল ঘৃণা,
অবিশ্বাস আর
ব্যভিচারিণীর তকমা…
- আশ্চর্য! আপনি
দেখেছিলেন! ভালো! আসলে
ওই যে বলছিলাম না, মানুষ
সকলের গায়ে একটা লেবেল
সেঁটে দিতে ভালবাসে।
মৃণাল সেন মানেই
‘পদাতিক’, ‘কলকাতা
একাত্তর’, ‘ইন্টারভিউ’,
মৃনাল সেন মানেই
রাজনৈতিক ছবি করিয়ে,
আরেবাবা, সংসারে কোন
বিষয়টা রাজনৈতিক নয়
বলুন তো? এই ‘জেনেসিস’
সিনেমাটা কি রাজনৈতিক
নয়? এর মধ্যে
থিসিস,অ্যান্টিথিসিস,
সিন্থেসিস নেই? কিন্তু
আপনি যদি ক্রিটিকদের
জিজ্ঞেস করেন,
‘জেনেসিস’ কেমন ছবি?
উত্তর পাবেন, আমার এই
সিনেমাটা নেহাতই
রূপকাত্মক,
ব্যক্তিকেন্দ্রিক।
ক্যালকাটা ট্রিলজি’র
মতো জোরালো বা
‘রাজনৈতিক’ নয়।
আরেবাবা, সৃজনের রূপটা
কি সবসময়ে একইধারায়
বইবে? এখানে শবানা’র
চলে যাবার পর যে
বুলডোজার দিয়ে ঘর ভেঙে
দেওয়া হল, সেখানে নারীই
বলুন আর রাজনীতিই বলুন,
উভয় পরিপ্রেক্ষিতেই কী
নিরুচ্চার বিদ্রোহ নেই?
কিন্তু সেসব কথা বলা
যাবে না। হাতে গোণা
ক’জন লোক ‘জেনেসিস’
দেখেছেন, বলতে পারেন?
আপনি দেখেছেন, তা-ও ভাল
লাগল শুনে।
- হ্যাঁ, দেখেছি তো
অবশ্যই। ভেবেছি এই নিয়ে
অনেক। নারীর চিন্ময়
রূপটাকে খুঁজতে চেয়েছি
বলেই হয়তো মৃন্ময়ী
রূপটা অধরা থেকে গেল।
অবশ্য বিয়ে থা করিনি
ভাগ্যিস, নইলে এই
পাগলের সঙ্গে সঙ্গে তার
জীবনটাও জ্বলে পুড়ে
ছারখার হয়ে যেতো না!
মুড়ি চিবোতে চিবোতে
কাঁচালঙ্কার করুণ
জ্বালা অনুভব করলেন
সেজ।
কিন্তু মৃণাল ততক্ষণে
হাত ঝেড়ে উঠে পড়েছেন,
ভয়ানক ব্যস্ততার ভাব
তাঁর চোখেমুখে,
দীর্ঘায়িত শরীরে।
ক্যামেরার
কলকব্জাগুলো আবার
নাড়াচাড়া করতে
লেগেছেন। পাইপের
ধোঁয়ায় তাঁর মুখ আরও
ধূসর।
সেজও তড়িঘড়ি উঠে
পড়লেন,
-আপনি তবে চললেন?
-হ্যাঁ, মিহিরবাবু , আমার
তো দাঁড়াবার সময় নেই।
মহাকালকে
ক্যামেরাবন্দী করার
দায় পড়েছে যার, তার তো
থামার উপায় নেই।
জানেনতো, শুধু সিনেমার
সময়েই নয়, আমি এমনি
এমনিই অনেক দৃশ্য
ক্যামেরায় ধরে রাখতাম।
মিছিল, জমায়েত,
শ্লোগান। অনেক সময়
সেগুলো ব্যবহার করেছি
সিনেমায়। তারপর কি
আশ্চর্য ব্যাপার !, হল
থেকে বেরিয়ে ছলছলে চোখ
নিয়ে কত দর্শক, কত বাবা,
ভাই আমার হাত ধরে
বলেছেন, সিনেমায় দেখানো
মিছিলে তাঁরা দেখতে
পেয়েছেন এনকাউন্টারে
স্তব্দ হয়ে যাওয়া
তাঁদের ছেলে কিংবা
দাদাকে... শুধু তাদের এক
ঝলক দেখতে পাবেন বলে
তারা বারবার ছুটে গেছেন
একই সিনেমা দেখতে। আমার
তো এটাই কাজ, সময়ের মুখ
ধরে রাখা... যাবেন
মিহিরবাবু, আমার সঙ্গে?
এক্ষুনি আরেকটা শুটিং
শুরু হবে।
- যাব।
-যাবেন? বাহ!চলুন তবে। এই
শুটিঙটা শেষ হলেই
অহল্যার বাড়া ভাত পাত
পেড়ে খাব দুজনে... কী
বলেন...
হনহনিয়ে মৃণাল সেন
এগিয়ে গেলেন
ছায়াশিবিরের
উল্টোদিকে।
ব্যস্তসমস্ত হয়ে পিছু
নিলেন সেজ। একটা লেস
দেওয়া ধূলিমলিন
শতচ্ছিন্ন পর্দা
সরাতেই তাঁরা দেখলেন ,
সবুজ ধাঁধাঁনো বিরাট
ব্যাপক চৌকো একটা
দৃশ্য। তাতে ডাইনোসররা
নিশিন্তে ছিঁড়ে খাচ্ছে
গাছের সবুজ মাংস, তাদের
বিপুল গ্রীবা সাপের
ললিত ছন্দে দুলছে।
দুলছে গাছের মাথা।
মিঠেল মধুর হাওয়ায়।
হঠাৎ এই শান্ত দৃশ্যে
ঢুকে পড়ল দুটো
টিরেনোসরাস। এইমাত্র
শিকার করা একটা
দৈত্যাকৃতি টিকিটিকির
দখল নিয়ে ঘাড় আর ঠোঁট
বেঁকিয়ে ঝগড়া করতে করতে
লাশের দুইপ্রান্ত
দুজনে মুখে করে দৃশ্য
থেকে বেরিয়ে গেল। মৃণাল
ক্যামেরা থেকে চোখ না
সরিয়েই বললেন,
‘মিহিরবাবু, আমরা এখন
পয়ষট্টি মিলিয়ন বছর
আগের সেন্ট্রাল
আমেরিকার ইউকাটানে।
এক্ষুনি একটা উল্কা
তীব্র বেগে পৃথিবীর
হৃদয় ভেদ করে আছড়ে পড়বে
এইখানে। সঙ্গে সঙ্গে
পৃথিবীর ৭৫ শতাংশ
প্রাণী চিরতরে ধ্বংস
হয়ে যাবে। চিরকালের মতো
পৃথিবীর আবহাওয়া বদলে
যাবে। এই ডাইনোসরেরা
নিজেরা মাংসের
ভাস্কর্য হয়ে যাওয়ার
আগে শেষ মাংস চেটেপুটে
খেয়ে নিক।
মৃণালের কথা শেষ হতে না
হতেই এক প্রচন্ড
অপার্থিব অবর্ণণীয়
শব্দে প্রায় বধির হয়ে
গেলেন সেজ, আগুনের
উত্তাল ঢেউ গর্জন করতে
করতে ছুটতে লাগল গাছ
থেকে গাছে, অরণ্য থেকে
অরণ্যে , পৃথিবীর
এপ্রান্ত থেকে
ওপ্রান্তে। দশ লক্ষ
সুনামি ফুঁসে উঠল।
ডাইনোসরদের গা থেকে
কাবাবগন্ধী হাহাকার
উঠে আসছে। তাদের দীর্ঘ
গ্রীবাগুলো সর্পিল হয়ে
ঘনিয়ে ফেনিয়ে কিলবিল
করে মরছে, তাদের
অনৈসর্গিক আর্ত
চীৎকারের লয়কারীতে
কুন্ডলীকৃত কৃষ্ণ
ধোঁয়া তাদের মাথায় পা
ফেলে ফেলে কালীয় নৃত্যে
উন্মাদ...
ভূগোল বলছে, এক্সট্রিম
ওয়াইড শটে ক্রিটেশিয়াস
যুগ মুছে যাচ্ছে,
প্রবেশ করছে
টার্শিয়ারী...
মৃণাল মূলতঃ মৃত সেজ’র
কাঁধে হাত রেখে বেশ
খানিকক্ষণ কেশে কোনমতে
দমক সামলে বললেন,
‘কাট’ ।
ঋণস্বীকারঃ
সেপিয়েন্সঃ আ ব্রিফ
হিস্ট্রি অফ
হিউম্যানকাইন্ড- ইউভাল
নোয়া হারারি
দ্য ম্যাজিক অফ
রিয়ালিটি- রিচার্ড
ডকিন্স
মন্টাজঃ লাইফ,
পলিটিক্স,সিনেমা- মৃণাল
সেন